আপত্য
পূজো এসে গেছে। কত আলো, কত খাবারের গন্ধ, কত গান। প্রতিদিনের চেনা কোলাহল ছাপিয়ে ফুচির কানে ঢোকে সেইসব। আধখালি পেটে নাক টেনে এক বড় নিঃশ্বাস নেয় জোরে; কিসের গন্ধ এটা? এগরোল? সেই দুপুরে পাশের পূজা মন্ডপে ঠায় দু ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে দেড় হাতা খিচুড়ি আর ঘ্যাঁট তরকারী খেয়েছিল। বেশ লেগেছিল। এখন আবার খালি খালি লাগছে পেটটা। কেন যে এত খিদে পায়!
রাস্তা জুড়ে বড় বড় আলো ঝলমলে ছবি। তাকিয়ে থাকতেই যেন ভাল লাগে। রেলিং ধরে দু চার পা হাঁটতেই বিরাট ছবিতে একটা মেয়েকে ফ্রকের কোণা ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে। তারই মত; শুধু একটু বেশি সুন্দর। নিজেও পিঠের বোতাম খোলা জামাটাকে দুটো কোণা দিয়ে অল্প একটু তুলে ধরে তিনবার আলতো দুলে নিল, তাকিয়ে দেখল এদিক ওদিক, তাকেও বুঝি এমন লাগছে এখন!
মঙ্গলা প্লাস্টিক মোড়া ঘরের একটু দূরে এক কোণে উনুন ধরিয়েছিল। সামনের ওষুধের দোকানের খিটখিটে বুড়ো মালিক উনুনটাকে ধোঁয়া ছাড়তে দেখলেই একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাকায়। তাকাক, গায়ে মাখে না মঙ্গলা- ফুটপাথ কি ওর বাপের নাকি? ডাল ভাত খাবে আজ। দুপুরের ঝড়তি পড়তির বাজার থেকে কম দামে কিনে এনেছে হলদে হলদে পটল। দোকান বন্ধ করবে দেখে অল্প দু দশখান ঢ্যাঁড়স বিলকুল বিনি পয়সায় দিয়ে দিয়েছে জলিল নামের লোকটা। ওই ডুমো ডুমো করে ভেজে দেবে পাতে। বঁটিটা টেনে কোটা শুরু করতেই পল্টু থপথপ করতে করতে এগিয়ে এল। একটা নোঙরা বড় গেঞ্জি আর কোমরে কালো ঘুনসি। ছোট থেকেই পেটটা একটু ফোলা পল্টুর, কেন কে জানে! মায়ের বগলের ফাঁক দিয়ে মুখ গলিয়ে প্রায় শুকনো বুকটা খুঁজে ছোট ছোট চার দাঁতে কামড় বসাল আলতো করে। রেগে গেল মঙ্গলা; হাতের ঝটকায় ফেলে দিল মাটিতে; বিড়বিড় করল, “ ছেলের জাত, শুধু শরীল চেনে।“ তারপর বঁটিটাকে পাশ করে শোওয়াল ঠক করে, উঠে পড়ল হঠাৎ । ছেলেটাকে এক হাত ধরে টানতে টানতে প্লাস্টিকের ঘেরাটোপের বাইরে রেখে চেঁচাল, “ফুচি... ভাইকে নিয়ে যা।“
ফুচি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুটো ছেলে মেয়ের হাসাহাসি দেখছিল, কি জন্য এত হাসে ওরা? সব আওয়াজ ছাপিয়ে মায়ের চেনা গলার টান কানে যেতেই তার ঘোর কেটে গেল। মুখ ঘুরিয়ে দেখতে পেল পল্টু হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে আসছে। পা এমনভাবে ফেলছে যেন যত রাগ তার রাস্তার উপর। নাক দিয়ে ভারি সবুজ সর্দি ঝুলছে, হাতের ধূলোয় মাখামাখি ভেজা গাল। ফুচি ছুটে গেল সেইদিকে। এই ভাইটা তার খুব আদরের, আগের ভাইটা তো মরেই গেল বড় হতে না হতে। পল্টু তার খেলার সঙ্গী; পল্টু কাঁদলে তার ভীষণ কষ্ট হয়।
ভাইকে কাঁখে করে তুলে নিল ফুচি। তার আগে নাক মুছিয়ে দিল, প্রায় ন্যাড়া মাথায় চুমো খেল এক। হাঁটতে লাগল সামনের দিকে। রাস্তার বাতিস্তম্ভের গায়ে গায়ে ঝিকমিকে আলোর ফুলঝুরি, পাখি, ফুল, রেলগাড়ি, আরো কত কি। আঙুল তুলে তুলে পল্টুকে দেখাতে লাগল সে। পায়ে পায়ে হেঁটে গেল বিরাট দোকানটার দিকে, যেখানে মস্ত পুতুল লোকটা কোমর দুলিয়ে হাত নাড়িয়ে ডাকছে পথ চলতি মানুষকে। ভাইয়ের হাতটা এগিয়ে দিল পুতুলের দিকে। পুতুল মানুষ যেন দেখল না মোটে; একটু ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে দিল এক ফরসা গোলগাল বাচ্চার বেলুন ধরা হাতের দিকে। ভাইটি তার বড্ড জেদি, ঠিক মায়ের মতন। কান্না যেন থামে না আর, হেঁচকি তুলে তুলে আঙুল তুলে কি যেন বলে যেতে থাকে, ফুচির চুল ধরে টানে, গালে চিমটি কেটে যেতে থাকে। আওয়াজ তার চাপা পড়ে যায় ঢাকের বাজনায়।
আরও দু পা এগিয়ে একটা বড় গলির মধ্যে ঢুকল ফুচি। পথের পাশে সারি সারি বাইক দাঁড় করানো। ছোট ভাইটাকে একটার উপর একটু বসাতেই রে রে করে তেড়ে এল মস্ত বাড়ির দারোয়ান। “ভাগ হিঁয়াসে.. কাঁহা কাঁহাসে আ যাতি হ্যায়...” পল্টুকে কোলে নিয়ে ফিরে যেতে যেতেই দেখল, উলটো দিকের বিরাট দোকান বাড়িটার সামনে কি সুন্দর একটা ছবি। একটা ফুটফুটে বাচ্চা; ঠিক তার ভাইয়ের মতন। আর একটা সুন্দর ফরসা মত লোক সাদা মেঝেতে শুয়ে আছে লাল জামা পরে। বাচ্চাটা তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে খিলখিল হাসিতে। ওর মা প্যান্ট জামা পরে বসে আছে আর ধরে আছে বাচ্চাটার কোমর। সব্বাই হাসছে; আওয়াজটা যেন ভেসে আসছে ফুচির কানে, ঠিক তোষকে শুয়ে পল্টু যেমন হাসে তার কাছে কাতুকুতু খেলে।
ফুচি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল সেইদিকে; পল্টুর কান্নার আওয়াজ খানিক স্থিমিত হয়েছে, হয়তো বাজনার সাথে পাল্লা দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে গেছে সে। কিন্তু বড় বড় হেঁচকি টানছে এখনও। বড় পেটটা টানে টানে ওঠানামা করছে যেন। ফুচি রাস্তার ওপারে গিয়ে দোকানটার সামনের বড় কালো মার্বেলের চওড়া সিঁড়ির এক পাশে শুয়ে পড়ল হঠাৎ। ঠিক অমনি করে ভাইকে বুকে টেনে নিল, আদর করল খুব। আজ পূজার দিনে ভাইটার মুখে এমন হাসি যে ফোটাতেই হবে তাকে।
সুচিন্তিত মতামত দিন