অর্ঘ্য দত্ত - মায়াজম

Breaking

৩০ সেপ, ২০১৬

অর্ঘ্য দত্ত


ঝাঁকের কবি ও ফেসবুকঃসত্যিই কি এক সমস্যা?







পাড়ার সুশীল জেঠুর বাড়ির সদর দরজায় কাঠের ফলকে লেখা ছিল, শ্রী সুশীল কুমার সরকার- বি.কম। আর রায় কাকুর রাশভারী বাড়ির গেটে শ্বেতপাথরের নেমপ্লেটে খোদাই করা ছিল, মিস্টার ডি পি রয়- এম এ ( ডবল)। কাকুর নামের নিচেই এসএমটি মিতা রয়-এম এ। সুশীল জেঠু ছিলেন একটি ট্রান্সপোর্ট কোম্পানীর কেরানি এবং রায় কাকু রেলের টিটি। পরে চাকরি করতে করতেই প্রাইভেটে দু-দুটি এম এ ডিগ্রি সংগ্রহ করাতে তাঁর চাকরিতে পদোন্নতি হয়েছিল কিনা বলতে পারবো না। মিতা কাকিমা কিছুদিন ডেপুটেশন ভ্যাকেন্সিতে পাড়ার শারদা বিদ্যাপীঠে বাংলার শিক্ষিকা হয়েছিলেন। নিঃসন্তান মিতা কাকিমার বেশ সাহিত্য প্রেম ছিল। বই হাতে ছাড়া তাঁকে বিশেষ দেখিনি। তার ঘর ভরে থাকতো নবকল্লোল, প্রসাদ, উল্টোরথে। ছেলেবেলায় রায় কাকুর বাড়িতে আমার লোভের সামগ্রী ছিল ঐ সব পত্রিকার ফটোগুলো আর ঐ শ্বেতপাথরের নেমপ্লেটটা। অবাক বিস্ময়ে থ্রি-ফোরে পড়া এক বালক কর গুনে হিসাব করতো কত বছর পড়াশুনা করলে তবে ডবল এমএ হওয়া যায়! মধ্যবিত্ত এক পেটুক বালকের কাছে তখন এমনকী ডবল ডিমের মামলেটের চেয়েও ডবল এমএ ব্যাপারটা ছিল অনেক বেশি আকর্ষণীয় । আমার সেই ছেলেবেলায়, প্রায় সব বাড়িরই বসার ঘরের দেওয়ালে একটি-দুটি কালো বিশেষ কোট-টুপি পরা, হাতে পাকানো সার্টিফিকেট ধরা কনভোকেসানের বাঁধানো ফটো দেখতে পেতাম। তারপর আমরা একটু বড় হতে হতেই এই চিত্রটা পাল্টে গেল। স্টুডিওতে গিয়ে কনভোকেসনের ধড়াচুড়ো শোভিত ফটো তোলার হিড়িক গেল কমে, লোপাট হলো নেমপ্লেটে নামের পাশে অপেশাদার ডিগ্রি লেখার দেখনদারি অভ্যাস। তার বদলে একটা নতুন অভ্যাস তৈরি হচ্ছিল, কথায় কথায় ঠোঁট উল্টে বলা-- আজকাল তো ঘরে ঘরেই গ্রাজুয়েট, ঘরে ঘরে এমএ পাস! কথাটা এমন সুরে বলা হত যেন এটা খুবই একটা হতাশাজনক পরিস্থিতি। তবে চেনাশোনা কোনো কৃতী মানুষকে কিন্তু এসব কখনো বলতে শুনিনি। সাধারণত ঐ সুশীল জেঠু বা মিতা কাকিমার মতো মানুষদের মুখেই এমন কথা শুনতাম। সেটা তাদের ডিগ্রির আশানুরূপ স্বীকৃতি না পাওয়ার বেদনাজাত নাকি বাঁধানো নেমপ্লেট দেখে পাড়ায় হাঁ হয়ে যাওয়ার মতো যথেষ্ট নন-ম্যাট্রিক মানুষ কমে যাচ্ছিল বলে, না সমাজে উচ্চশিক্ষিতের প্রতি সাধারণ মানুষদের সম্ভ্রমে ওরা একটা ক্রমবর্ধমান ভাটার টান লক্ষ করছিলেন বলে তা অবশ্য আমার জানা নেই। তবে আর যাই হোক, বিএ-এমএর সংখ্যাধিক্যে তাদের গাত্রদাহের পেছনে যে কোনো মহান কারণ থাকতো না এটা নিশ্চিত।
অনেকটা ঠিক এই রকম গাত্রদাহই যেন আজকাল ফেসবুকের কবিদের নিয়েও দেখতে পাই। জনপ্রিয় বাজারি কাগজ থেকে বাজারবিরোধী কবির ফেসবুক স্টেটাস, সর্বত্রই অহরহ পড়ছি- 'আজকাল তো ফেসবুকে সবাই কবিতা লিখছে! সবাই কবি!' যদিও জানি এই দুইয়ের মধ্যে তুলনা টানা অতিসরলীকরণ হয়ে যাবে, তবু মনে হয় ফেসবুকে এত মানুষকে কবিতা লিখতে দেখে, কবিতা লেখার চেষ্টা করতে দেখে যারা আজ এত বিরক্ত তাদের মধ্যেও কি কোথাও ঐ একই মানসিকতা কাজ করছে? তবে সবার নয় নিশ্চিত। কেউ কেউ নিশ্চয়ই ফেসবুকে 'কবিতা'-র নামে যথেচ্ছাচারে বা কবিতার মান-এর অধোগমনে যথার্থ ব্যথিত হয়েও বিরক্তি প্রকাশ করে থাকেন। কবিতা যেন সেই সেলিব্রিটি, সেই সুপার স্টার 'কলা', যাকে স্পর্শ করার জন্য সাধারণ মানুষ ছন্দ-টন্দ মিলিয়ে, ভাব-ভাষা জুটিয়ে ফেসবুকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে আর কিছু মানুষ, বিপাসা বাসুর ব্যক্তিগত বাউন্সারেরব মতো, 'কবিতা'-র বাউন্সার হয়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছে- দূর হটো! ডোন্ট টাচ্ কবিতা।
কমাস আগেই আনন্দবাজারে এই ফেসবুক কবিদের বিষয়ে কোনো এক ঋষি না কার একটা লেখা নিয়ে খুব হইচই হয়েছিল। কোনো জনপ্রিয় কবি বুঝি ফেবুর কবিদের গেঁড়ি-গুগলির সাথে তুলনা করাতেও নানান প্রতিবাদ চোখে পড়েছিল। এত লোক কেন কবিতা লেখার চেষ্টা করছে তাই নিয়ে ক্ষোভে কোনো কোনো কবি তো নিয়ম করে নানান স্টেটাস লিখে যান, তাদের 'কোবি' বলে ব্যঙ্গ করতে থাকেন। কেউ আবার মজা করেও লেখেন,
"ঝাঁকের কৈ, বাজারে আর তেমন পাওয়া যায় কই?
ঝাঁকের কবি, ফেসবুকে অজস্র হাজার থই থই।" ( সৌমেন বোস)
একথাটা সত্যিই যে ফেসবুকে অজস্র হাজার এমন মানুষ থই থই করছে যারা কবিতা লিখছে, তাদের ওয়ালে নিয়মিত কবিতা পোস্ট করছে, তা সে যেমনই হোক। একথাও সত্য কবিতা বলে এমন অনেক লেখা প্রতিনিয়ত এখানে চোখে পড়ছে যা পাঠযোগ্যই নয়, কিন্তু সে তো পড়া না পড়া আমাদেরই হাতে। টাকা দিয়ে কেনা ছাপা পত্রিকাতেও তো কি আমরা গুচ্ছের অপাঠ্য লেখা পাই না? এত মানুষ যে হঠাৎ সোপ অপেরা না দেখে, তাস-পাশা না খেলে, ভিডিও গেমের নেশায় না পড়ে অবসরে কবিতা লেখার চেষ্টা করছে, অন্যের লেখা ঘাড় গোঁজ করে পড়ছে (সবাই না পড়ে লাইক দেয় এটা বিশ্বাস যোগ্য নয়) তা কি সত্যিই খুব খারাপ কিছু হচ্ছে? কবিতার, সমাজের, যারা লিখছে বা যারা স্বেচ্ছায় পড়ছে তাদের কারো? না। হচ্ছে না বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

কবিতা নিয়ে যে সব কথা বলা হয়, মানে, এ হল এক স্বর্গীয় ও অলৌকিক ব্যাপার বা কবিতা আসলে সূক্ষ্মতম শিল্প, সমস্ত শিল্পের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হল কবিতা কিংবা কবিতা হল নীরবে নির্জনে সাধনার বিষয়, তা মেনে নিয়েও মনে হয় যে কোনো শিল্পের মতোই অল্প কিছু মানুষের দ্বারা কবিতার বিশুদ্ধ চর্চা ও সাধনার পাশাপাশিই বহু মানুষের প্রতিদিনকার জীবনে ও যাপনেও এর এক লৌকিক প্রভাব থাকে। সাধারণ মানুষ যা কিছুতে মুগ্ধ হয় তা সৃষ্টির ক্ষমতা সে নিজেই অর্জন করার চেষ্টা করে। এ মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা। মানুষ সৃজনের আনন্দ উপভোগ করতে চায়, নিজের গভীর অনুভবকে অন্যের সামনে কাব্যভাষায় প্রকাশ করতে চায় এবং তার সঙ্গে মিশে থাকে নিজেকে অন্যের চোখে বিশিষ্ট করে তোলার ইচ্ছাও। তাই অনেক মানুষই, যারা কবিতা লেখেন না তারাও বিশেষ আলাপচারিতাতে নিজের অনুভব ব্যক্ত করতে গিয়ে নিজের অজান্তেই বেছে নেন এক অন্যরকম ভাষা, ললিত ভাষা। তাই প্রকাশ করার সামান্যতম সুযোগেই মানুষের ভেতরের সেই সৃজনপ্রিয় সত্তাটি জাগরুক হয়ে ওঠে, নিজের সৃজনীশক্তির সীমাবদ্ধতার তোয়াক্কা না করেই সৃষ্টিতে মেতে ওঠে মনের আনন্দে। আমরা ছোটোবেলায় দেখতাম কারো বিবাহ উপলক্ষ্যে পরিবারের অনেকেই পদ্য লিখে ছাপাচ্ছেন এবং অতিথিদের মধ্যে তা বিলি করছেন, ক্লাবের পুজোর স্যুভেনির বা স্কুল কলেজের বার্ষিক পত্রিকায় ছাপার সুযোগ পেয়েই অনেকে লিখে ফেলতেন ছড়া বা পদ্য, তাদের কাছে সেও ছিল কবিতা। যিনি বা যারা সেখানে লিখতেন এবং যারা পড়তেন তারা কেউই এ সব লেখা কালজয়ী হবে কিনা তা নিয়ে মাথা ঘামাতেন না, দু পক্ষের কাছেই এ ছিল উপভোগের বিষয়। তবে এ সব জায়গায় কোনো কবি, যার লেখা নামী ও জনপ্রিয় বা অন্য সাহিত্য পত্রিকায় নিয়মিত ছাপা হতো তারা স্বাভাবিক ভাবেই লিখতেন না এবং এই সব সখের কবিদের প্রতি তাদের এক স্নেহ মিশ্রিত প্রশ্রয়ই থাকতো। 'বা:, খাসা পদ্য লিখেছ, আরো লেখ' গোছের প্রচ্ছন্ন পিঠ চাপড়ানি থাকতো। সেটা কি এই কারণেই যে তাদের কবিতা প্রকাশের পরিসরটি ছিল সম্পূর্ণ পৃথক, একের এলাকায় অন্যের প্রবেশের সম্ভাবনা আদৌ ছিল না। আজকে যে এই সদ্য লিখতে আসা বা সখের কবিদের প্রতি তথাকথিত প্রতিষ্ঠিত বা প্রতিষ্ঠিত হতে মরিয়া কবিদের এত উষ্মা, এত ব্যঙ্গোক্তি তা কি ফেসবুক ঐ পৃথক পরিসরটুকু ঘেঁটে দিয়েছে বলেই? ফেসবুকে যে একজন পাঠকের সামনে নামী ও দক্ষ কবির কবিতার পাশেই ভেসে উঠছে একজন অনামী বা অদক্ষ কবির কবিতা, এই গা ঘেঁষাঘেঁষিটাই কি গাত্রদাহের কারণ ঘটাচ্ছে?
ফেসবুক যে কত মানুষকে সাধারণভাবে কবিতার প্রতি আগ্রহী করে তুলেছে! আমি ব্যক্তিগত ভাবে কতজনকে জানি যারা ফেসবুকের মাধ্যমেই কবিতার পাঠক হয়ে উঠেছেন। কতজন লেখা শুরু করেছেন! হতে পারে আজ তাদের লেখার ধরণ বা কী পড়বেন তা বাছাইয়ের রুচি যথেষ্ট পরিশীলিত হয়ে ওঠে নি। কিন্তু যারা এতদিন টাকা দিয়ে কিনতে হয় এমন বিভিন্ন ছোট-বড় সাহিত্য পত্রিকা তাদের বাড়িতে না আসার জন্য নিয়মিত কবিতা পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন নি, আজ ফেসবুক তাদের সে সুযোগ করে দেওয়াতে তাদেরও এখন অভ্যাস তৈরি হচ্ছে। এতদিন যেসব লেখা তারা পড়ার সুযোগ পাননি, যে সব কবিতা-আলোচনায় যোগ দিতে পারেননি, এখন সে সব পড়ে, আলোচনা শুনে দ্রুত নিজেদের পরিণত করে তুলছেন। নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত যারা তারা হয়তো এসব খেয়াল করার সুযোগ পাননি, কিন্তু আমি দেখেছি কীভাবে বছর খানেকের মধ্যেই কত বন্ধুর শুধু লেখাই নয়, কবিতা সম্বন্ধে তাদের ধারণাকেও পাল্টে দিয়েছে এই ফেসবুকই।
আসলে কিছু মানুষ অস্বীকার করতে চান যে তাদের মতোই সমস্ত বাঙালির অধিকার আছে বাঙলা কবিতা লেখার। যেমন তাদের আছে সে সব অপছন্দের কবিতা না পড়ার অধিকার। তারা তাদের নিজেদের লেখালেখি ও স্টেটাসে যতই সাম্যবাদের কথা বলুন, প্রকৃতপক্ষে তারা লেখার সাম্যবাদে বিশ্বাসই করেন না। অনেক অনামী, নতুন লিখতে আসা নবিশদের ভালো কবিতার ভিড়ে তাদের লেখাগুলো যে মাঝারি হয়ে পড়ছে, এই ফেসবুকে পাশাপাশি থাকা দুপক্ষের কবিতার মধ্যে প্রচুর পাঠকের প্রকাশ্য পক্ষপাতিত্ব যে প্রায়শই ওই ফেসবুক কবিদের দিকে ঝুঁকে পড়ছে এটা তাদের পক্ষে সহ্য করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অথচ তারা ফেসবুককে এড়াতেও পারছেন না। তাই তারা নিজেদের লেখা, তথাকথিত ভালো পত্রিকায় প্রকাশিত তাদের কবিতাও আবার ফেসবুকে পোস্ট করেন। যে ফেসবুকের শুধু কবিই নয় পাঠকদেরও তারা নস্যাৎ করেন কথায় কথায়, তাদের লাইক-মন্তব্যের প্রত্যাশাও কিন্তু ত্যাগ করতে পারেন না মোটেই। কেন? এর পেছনে কি ঐ গাছেরও খাব তলারও কুড়াবো মানসিকতাই কাজ করে না? তাদের একটি দুটি প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের ছবি ঐ বাড়ির দরজায় ঝোলানো ডিগ্রি লেখা নেমপ্লেটের মতো অথবা কনভোকসনের বাঁধানো ফটোর মতো বাজারি পত্রিকায় ছাপা হওয়া সবেধন নীলমণি কবিতাটির ছবি পোস্ট করে করে তারা ফেসবুকের কবিকুলের মধ্যে নিজেদের পেডিগ্রি জাহির করতে থাকেন এবং 'আজকাল তো ঘরে ঘরে এমএ" -র সুরে নাচ কুঁচকে স্টেটাস লেখেন, 'আজকাল তো ফেসবুকে সবাই কবিতা লিখছে!' ঘরে ঘরে ধর্ষক জন্মালে, চোর জন্মালে, খুনি জন্মালেও বোধহয় এরা এত বিচলিত হতেন না।
অথচ বুঝতে চান না যে, যে সব কবিরা দশটি পত্রিকাতে একই সাথে লেখেন, কবিতার আসরে-বাসরে কবিতা পাঠ করে বেড়ান, পত্রিকা সম্পাদনা করেন তাদের থেকে হয়তো নতুন লেখা পড়ার খিদে ও সময় দুইই এই ফেসবুকের কবিতা পাগলদের অনেক বেশি। তবে হ্যাঁ, কী পড়বেন তা নির্বাচনের রুচি ও ক্ষমতা হয়তো শুরুতে তেমন পরিপক্ক থাকে না। কিন্তু সে তো শুধুই সময়ের ব্যাপার। ফেসবুকই প্রকৃত আগ্রহীদের সঠিক বন্ধুবৃত্ত ও পাঠযোগ্য লেখা জুগিয়ে একদিন তাদের করে তোলে সংবেদী ও রসিক পাঠক। তারা লেখেনও, পড়েনও। এবং পড়ছেন বলেই তাদের অনেকের লিখতেও ইচ্ছে করে। আগে হয়তো শ্রোতা বা পাঠকের অভাবে তাদের নিভৃত অনুভবকে ভাষায় অনুবাদ করার একটা আলস্য ছিল, এখন ফেসবুক সে অভাব পূরণ করাতে অনেক বেশি মানুষ লিখতে শুরু করেছে। তাই অমিতাভ প্রহরাজ যখন বলেন ' লেখামো, পাগলামোর মতো এক হ্যাবিট যা এখন মাস স্কেলে', তখন মন তাতে অনায়াসে সায় দেয়।
আমার মনে হয় যত বেশি মানুষের ফেসবুকে নিয়মিত কবিতা পড়ার অভ্যাস তৈরি হবে, তত বেশি মানুষ লিখতেও শুরু করবেন। প্রিন্ট মিডিয়াতেও এটাই সত্য ছিল। গান, নাচ, ক্রিকেট সবের ক্ষেত্রেই একথা সত্যি। জানি কবিতার প্রসঙ্গে নাচ-গান-ক্রিকেটের তুলনা টানাতে অনেক ভ্রুই কুঞ্চিত হবে। কিন্তু এই ফেসবুকেই বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত প্রণিধানযোগ্য স্টেটাস দেন এমন একজন ব্যতিক্রমী কবিই বেশ কিছুদিন আগে লিখেছিলেন-- 'ভাবুন তো সংগীত শুধু সংগীত শিল্পীরা, নৃত্য শুধু নৃত্যশিল্পীরা, ক্রিকেট ম্যাচ শুধুই ক্রিকেট প্লেয়াররা দেখতে যাচ্ছেন! কিন্তু কবিতা এখন শুধু কবিরাই পড়ছেন।' যেহেতু পোস্টটা আর ওঁর ওয়ালে দেখা যাচ্ছে না তাই বিষয়টা স্মৃতি থেকে লিখলাম, সঠিক উদ্ধৃতি দিতে পারলাম না। আমিও সেদিন বিস্মিত হয়েছিলাম, ভ্রু কুঁচকিয়ে ছিলাম। কারণ কথাগুলোর ভেতরে মস্ত ফাঁকি আছে বলে মনে হয়েছিল। প্রথমত একজন সংগীত শিল্পী, নৃত্য শিল্পী, বা ক্রিকেটার তাদের দর্শকাসনে যারা থাকেন তারা নিজেরাও গান নাচ করেন কিনা বা ক্রিকেট খেলেন কিনা তা নিয়ে আদৌ ভাবেন বলে মনে হয় না। অনেক বিখ্যাত সংগীত ও নৃত্যশিল্পীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কথা বলার সুযোগ হয়েছে কিন্তু তাদের কখনো এত ছেলে মেয়ে কেন আজকাল নাচ-গান শিখছে, বা এত ছেলে কেন ক্রিকেট খেলছে বলে বিরক্তি বা ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখি নি। বরং তাঁরা নবীনদের চর্চাতে উৎসাহই জোগান এবং বোঝেন যে ঐ চর্চাটুকু বজায় না থাকলে তার প্রভাব একদিন তাঁদের দর্শক সংখ্যাতেও পড়বে। ঐ শিক্ষা বা চর্চা প্রত্যেককে প্রকৃত শিল্পী করে না তুললেও ভবিষ্যতের রসিক দর্শক-শ্রোতা হয়ে উঠতে সাহায্য করবে। তাছাড়া সবথেকে যেটা বড় কথা , তারাও তাদের শিল্পে নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন কিন্তু তা দর্শক-শ্রোতার এতদিনকার গড়ে ওঠা ধারনাকে ধুলিসাৎ করে দিয়ে নয়। বছরের পর বছর ধরে একই রাগ বা একই রবীন্দ্রসংগীত শ্রোতারা বিভিন্ন শিল্পীর কন্ঠে শোনেন টিকিট কেটে, হল ভরিয়েও। সেসব শ্রোতারা এমনই রসিক, এতই সংবেদী তাদের কান ও মন যে একই রাগ বা একই গানে শিল্পী থেকে শিল্পীতে গায়কী বা উপস্থাপনাতে যে সামান্য পরিবর্তন ঘটে, শিল্পীর যে নিজস্বতা থাকে তারা তারই কদর করেন। ক্রিকেট প্রেমিক দর্শক কখনো বলেন না, ধুর সেই একই তো ক্রিকেট, কত বছর ধরে একই রকম ভাবে খেলা হয়ে চলেছে। সেই তিনটেই উইকেট ঐ একই জায়গায় পোঁতা হয়, সেই ছয় বলে এক ওভার গোনার নিয়ম কত বছর ধরে চলছে! ব্রাডম্যান থেকে শচিন হয়ে বিরাট কোহলি, সবার সেই একই রকম ভাবে ব্যাট করা। অথচ কবিতায়ই নাকি শুধু চরম ব্যতিক্রমী কিছু একটা না ঘটালে সব লেখাই পুরানো লেখার চর্বিতচর্বন! তাকে একদম খোল নলচে পাল্টে নতুন হয়ে উঠতেই হবে। আচ্ছা, গানকে নতুন করতে গিয়ে যদি দর্শকদের তা গান না মনে হয়ে চিৎকার বা প্রলাপ মনে হয় বা নাচকে মনে হয় সার্কাস তাহলে কি সাধারণ শ্রোতা-দর্শক সেই অনুষ্ঠানে আসবেন ? সেক্ষেত্রে দর্শকদের ওপর ক্ষোভ দেখিয়ে বা অন্য যারা গতানুগতিক নাচ-গানের কাঠামোর মধ্যে থেকেই নিজস্ব ভঙ্গি খুঁজে নিয়ে নাচ-গান করছেন তাদের ওপর রাগ দেখিয়ে যেমন লাভ নেই, তেমনি কবিতার সঙ্গে নাচ-গান- ক্রিকেটের তুলনা টানলে মনে রাখা উচিত যে প্রথাভাঙা কবিতার ক্ষেত্রেও ঐ একই নিয়্ম প্রযোজ্য হবে। হতেই হবে। পাঠক তাদের নিজস্ব রুচি অনুসারে সেই কবিতাই খুঁজে নিয়ে পড়বেন যা তারা পড়তে চান। যে কবিতা তারা উপভোগ করতে পারবেন। ব্যতিক্রমী লিখলেই যে সব শিক্ষিত পাঠককে তা পছন্দ করতেই হবে এমন কোনো কথা নেই বা কারো পছন্দ না হলেই যে তিনি কবিতার পাঠক হিসাবে অপ্রস্তুত বা অশিক্ষিত এমন ধরে নেওয়ারও কোনো যুক্তি নেই ।
বেঁচে থাক ফেসবুকে থইথই করা ঝাঁকের কবির দল, ফেসবুকের কবিতার সুনামিতে ভেসে যাক প্রতিষ্ঠানের মৌরসি পাট্টা, দাম্ভিক কবির উন্নাসিকতা। ফেসবুকেই কবির সঙ্গে পাঠকের হোক শুভদৃষ্টি, হোক সরাসরি যোগাযোগ। এতবছর ধরে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা যে চাতক-পাঠকদের হাতে পৌঁছনোর সুযোগ পায়নি ছোটো পত্রিকায় নীরবে লিখে যাওয়া কবির অসামান্য কোনো লেখা, পাঠক তা খুঁজে পাক এই ফেসবুকে। পাঠক আবিষ্কার করুক প্রচারের আড়ালে থাকা যত সাধক কবিদের। সেই কবিতাপাগল পাঠকরা নিজেরাও লিখতে চাইলে লিখুক এখানে। হোক নানান রকমের কবি ও পাঠকের সহাবস্থান । এই ফেসবুকই তো আমার মতো অনেককে চেনালো একজন বারীন ঘোষাল বা মলয় রায়চৌধুরীকে, জনপ্রিয় বাংলা পত্রিকা এতদিনেও যাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় নি। এই ফেসবুকেই তো আমি খুঁজে পেয়েছি "এক না জ্বলা উনুন সারাদিন ধ্যানস্থ বুদ্ধের মতো কোন বোধ সঞ্চারিত করে" ( স্বপন বিশ্বাস), "তোমার সঙ্গত চেয়ে ভুল স্বরগ্রামে / প্রতি রোম-ছিদ্রে ছিদ্রে প্রাণবায়ু ডেকে ওঠে নামে" (কমলেশ পাল) বা " জন্মান্ধ কিশোরীর হাত ধরে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছে ঘাতক-ধর্ষক / পৃথিবী শাসন করছে অনসূয়া চন্দ্রমার আলো... (উত্তম দত্ত) -র মতো সব পংক্তি। এখানেই আবিষ্কার করেছি এমন আরো অনেক প্রিয় কবিকে।
ফেসবুক দীর্ঘজীবি হোক। এখানকার একজন কবির একটি কবিতাও যদি দীর্ঘজীবি না হয় তবুও। আজকের জীবনে এই যে কবিতার সজীব উপস্থিতি, ফল্গুর মতো এই যে ফেসবুকের কবিতা রস সিক্ত করে রাখছে আমাদের নিত্যদিনের যাপনকে তারই বা মূল্য কম কিসের! তাই সবাই লিখুক, পাগলের মতোই লিখুক, যার যেমন ইচ্ছে লিখুক। আমাদের যার যেমন ইচ্ছে তেমনটিই খুঁজে পড়বো। কারো কোনো উপহাস, ব্যঙ্গ, বক্রোক্তি যেন একজন নবীনেরও কবিতা লেখার সরল, অনাবিল ইচ্ছাকে না হত্যা করতে পারে। একশো বছরের বেশি সময় আগে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, "সংশয় করিয়া, বিদ্রুপ করিয়া, অসৎ অভিসন্ধি আবিষ্কার করিয়া অনেক বিজ্ঞ অনেক সৎকার্যকে অঙ্কুরে দলিত করিয়া দিয়াছেন, অনেক তরুণ হৃদয়ের নবীন আশাকে তাঁহাদের হাস্যের বিদ্যুতাঘাতে চিরকালের জন্য দগ্ধ করিয়াছেন, অনেক উন্মুখ প্রতিভাকে নিষ্ঠুর ভাবে পীড়ন করিয়া হয়তো..." , আমরা বুঝতে পারি, সেই ট্রাডিশন সমানে চলিতেছে।




৮টি মন্তব্য:

  1. অসাধারণ লেখা । অভিবাদন ও ভালবাসা অর্ঘ্যদা ।

    উত্তরমুছুন
  2. দেরী হল পড়তে। কিন্তু না পড়লে সত্যিই মিস করতাম। যদিও আমি অকবি, তবুও বলি অসামান্য একটি প্রবন্ধ। শুভেচ্ছা রইল।

    উত্তরমুছুন
  3. লেখককে শ্রদ্ধা ও সম্মান, খুব ভালো লাগল লেখাটি
    পড়ে

    উত্তরমুছুন
  4. খুব ভালো জায়গায় ধরেছেন অর্ঘ্য, খুব সুন্দর ভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। ফেসবুক আমাদের অনেক কবিকে চিনিয়েছে, অনেক কবির বিকাশ ঘটিয়েছে, অনেককে নতুন নতুন লেখার পথ খুলে দিয়েছে। একথা সত্যি যে কেন সবাই লিখছে বলে কেউ কেউ খিল্লি করেন, কিন্তু সেসব উপেক্ষা করেও লিখছেন তো অনেকেই। এ তো পরম প্রাপ্তি আমাদের। যাঁদের লিটল ম্যাগে মাত্র দু একটা লেখায় পেতাম, তাঁদের এখানে অনেক লেখায় পাই, আরও ভালো করে আত্মস্থ করতে পারি, এ তো কম কথা নয়।

    শুভেচ্ছা লেখক এমন একটা লেখা উপহার দেওয়ার জন্য।

    উত্তরমুছুন
  5. দুর্দান্ত লেখ্া৷একদম মনের কথা বলেছেন৷শুভেচ্ছা দাদা৷

    উত্তরমুছুন
  6. ভালো লাগলো খুব। মনের কথা গুলো খুঁজে পেলাম এই লেখায়।

    উত্তরমুছুন
  7. খুব ভালো লাগলো পরে। আপনার লেখায় নিজের কিছু না বলতে পারা কথার মিল, ভালো লাগাটাকে আরো বাড়িয়ে দিলো।।

    উত্তরমুছুন
  8. খুব ভালো লাগলো পরে। আপনার লেখায় নিজের কিছু না বলতে পারা কথার মিল, ভালো লাগাটাকে আরো বাড়িয়ে দিলো।।

    উত্তরমুছুন

Featured post

সোনালী মিত্র