মাপ নিষ্প্রাণ নয়
মাপের প্রাথমিক ও সচেতন ধারণা শব্দের উৎপত্তির সাথে জড়িত। জীবিত, জড়, প্রাকৃতিক, অপ্রাকৃত, ঘটনা,ঘটনাহীনতা, ব্যবহার, প্রবণতা ইত্যাদিকে মানুষের কল্পনার মধ্যে, ধরাছোঁয়ার আনার জন্য উৎপত্তি বিভিন্ন শব্দের। শব্দ মানুষের সেরিব্রামে কিছু বিদ্যুৎতরঙ্গের সাথে সমার্থক হয়ে ওঠে। সেরিব্রামের চারটে লোব। ফ্রন্টাল লোব বাক, যুক্তিবিচার, পরিকল্পনা, চলাফেরা, আবেগ, সমস্যা সমাধান নিয়ন্ত্রণ করে। ওসিপিটাল লোব নিয়ন্ত্রকরে দৃষ্টিকে। পেরিইটাল লোব পারিপার্শ্বিকের সাথে পরিচিত করায়। টেম্পোরাল লোব স্মৃতি আর শ্রবণে সাহায্য করে মাপের সমস্ত ঘটনা ঘটে সেরিব্রামে।
আদিম মানুষ বা মনুষ্যেতর প্রাণীর কাছে মাপের জন্য দৃশ্য, শব্দ আর গন্ধ এই তিন ছিল প্রধান মাধ্যম। মাপের জন্য উপস্থিতি একান্ত দরকার। এই তিনের সীমার মধ্যে অনুপস্থিতের কাছে বার্তা দেওয়া অসম্ভব। যেখানে শব্দের ব্যবহার সম্ভব নয় সেখানে বার্তাপ্রেরণের জন্য এল চিহ্ন। চিহ্নের স্থায়িত্ব শব্দের চেয়ে বেশী। চিহ্ন থেকে বার্তা পেতে উপস্থিতির দরকার হয় না। কাজ, পর্যবেক্ষণ আর জীবনের গল্প বলার জন্য চিহ্ন ব্যবহার হতে লাগল। ব্যবহার করতে করতে মানুষের মস্তিষ্ক সেই চিহ্নগুলোর সাথে পরিচিত হয়ে উঠল। ঠিক ঠিক মাপে চিহ্নকে জৈব-রাসায়নিক আর বৈদ্যুতিক সঙ্কেতে রূপান্তর করতে শিখল। এক একটা চিহ্নের সাথে এক একরকম জটিল বৈদ্যুতিক বার্তা তৈরি হল। একাধিক দৃশ্য, গন্ধ, স্পর্শ, শব্দ ও আভাসে সম্পৃত্ত ও সংযোজিত হয়ে। মস্তিষ্ক চিহ্নগুলোকে এই নির্দিষ্ট মাপে পরিবর্তন করার ফলে এক জটিল দৃশ্যশ্রাব্য মাধ্যমের জন্ম। জন্ম পাঠচর্চার। মস্তিস্কের কাছে এই মাপ হয়ে উঠল এক নিরন্তর চর্চা। নিরন্তর বিদ্যুৎমোক্ষণ। এই চর্চা থেকে গড়ে উঠল রুচি, পছন্দ, পক্ষপাত, সংস্কার। বদলে যেতে থাকে ইতিহাস।
মাপ এক নিরন্তর চর্চা
এই নিরন্তর প্রক্রিয়াতে স্থানিকতা, প্রয়োজনীয়তা, গোষ্ঠীচর্চার জন্য বিদ্যুৎমোক্ষণের স্বরূপ বদলে যেতে থাকে। ফলে শব্দ সেরিব্রামে যে বিদ্যুৎ মাপিং (mapping) বানায় তা বদলে যায়। বদলে যায় শব্দের আবহ। বদলে যায় অর্থ। সেই ম্যাপিংএর প্রভাবে রাসায়নিক পরিবর্তন হয়। বিভাব, প্রবাহ ও রোধএর পরিবর্তনের জন্য অন্য এক অর্থের দিকে শব্দ চালিত করে মস্তিষ্ককে। ফলে কোনও একটা বিশেষ চিহ্ন কিছুদিন আগেও কোনও বিশেষ শব্দের যে অর্থ প্রকাশ করত সে সম্পর্কে ধারণা আবছা হয়ে যায়। তখন সে পরিবর্তিত রূপকে আঁকড়ে ধরে। এইভাবে চিহ্নের অর্থ বদলে যেতে থাকে, চিহ্ন আর নিষ্প্রাণ থাকে না। চিহ্নের মধ্যে মিশে যায় জীবন, আর ব্যবহারের পুনরাবৃত্তি। আর জীবনের স্বাভাবিক ধর্ম মাইটোসিস – নিজেকে বিচ্ছেদ করে নিজেকে নির্মাণ করা।
সেই নিরন্তর বিচ্ছেদ ও নির্মাণের ফলে শব্দের মূল আকৃতির বা বৈশিষ্টের পরিবর্তন না হলেও পরিবর্তন হয় অবয়বের, বোধের, প্রতীতির।
মাপ এক আদিম প্রবৃত্তি
জীবজগতে মাপ সম্বন্ধীয় ধারণা খুবই প্রয়োজনীয়। সঠিক ধারণা টিকে থাকা আর উদ্বর্তনের জন্য একান্ত দরকার।জীবের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলো সঠিক হরমোন আর খাদ্যরসের ওপর নির্ভরশীল। সেখানে শুধু স্থুল মাপ নয়, নির্দিষ্ট অনুপাত তার শারীরিক নৈপুণ্যের সমার্থক। জৈবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলো ছাড়া খাদ্যের সঠিক অবস্থান জানা, শিকারধরা, আর শত্রুমিত্র চিনতে পারা এক অত্যাবশ্যক পরিমেয় বিষয়। মৌমাছি তার বিশেষ নাচের সাহাজ্যে সঙ্গীদের চিনিয়ে দিতে পারে ফুলের অবস্থান – দিক ও দুরত্ব, মধুর পরিমাণ। ব্যাঙ হিসেবকষে তার জিভ ছুঁড়ে দিতে পারে শিকারের ওপর। ফস্কালে প্রাণ সংশয়। পাখি হাওয়ার গতি আর দিক নির্ণয় করে ভাসিয়ে দিতে পারে ডানা। পরিযায়ীরা মেপে চিনে নিতে পারে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র। তাই নির্ভুল যাত্রায় চিনে নিতে পারে নিরাপদ গ্রীষ্মকালীন আবাস আর শীতকালীন আবাস। তাই মাপ আর সংখ্যা দুই সমার্থক, এই ধারণা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। মাপ এক আদিম বোধ।
এইভাবে মাপ থেকে যা অর্জিত হয় তা জ্ঞান। জানা আর করা এক অবিচ্ছেদ্য প্রক্রিয়া। জ্ঞেও আর জ্ঞানের পার্থক্যকে সুসংহতভাবে জানার প্রচেষ্টা হল মাপ। পরবর্তী প্রজন্ম আগের জ্ঞানের সাথে যুক্ত করে নতুন অভিজ্ঞতা আর শিক্ষা। মানুষ যখন প্রাকৃতিক শক্তির মাপ সম্পর্কে অল্পবিস্তর ওয়াকিবহাল হল তখন সৃষ্টি হল অগ্নি, বরুণ ইত্যাদি দেবতার। মাপ না জানাটা অজ্ঞতা। আর অজ্ঞতার জন্য পদেপদে বাধা ও বিপদ। মানুষ প্রার্থনা দিয়ে পূরণ করতে চাইল সেই অজ্ঞতা।
ঈশ্বর = ১
আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে নিউটনই প্রথম শক্তিকে সুসংহত পরিমাপের এককে নিয়ে আসেন। সেই সুত্রবদ্ধ শক্তির জন্য সাবলীল হয় জীবন। তিনি বলেন,
বল = ভর X ত্বরণ
রেনেসাঁসের সময় থেকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিশিষ্টগুলোর এক একটা নামকরণ করে চিহ্নিত করা হল। সংখ্যা দিয়ে তার মান নির্ধারণ করা হল। মাপগুলোকে প্রামানিক করার চেষ্টা হয়েছে। অর্থাৎ যা সংখ্যা নয় এমন প্রাকৃতিক জিনিসকে বুঝতে গিয়ে আমরা সংখ্যার আশ্রয়ে চলে এলাম। যে সংখ্যা পদার্থের নানান চরিত্র বা গুণের মধ্যে নির্মাণ করল সম্পর্কের। আমরা জানলাম যে সম্পর্ক মানে অনুপাত। সম্পর্ক মানে একের সাপেক্ষে অন্যের তুলনা। কিন্তু প্রশ্ন হল সেই এক কি? কি সেই আদিম বা প্রথম যার সাথে তুলনা করা যায়?
ভারতীয় সভ্যতা কি এই তুলনা প্রতিতুলনার জেরে পৌঁছে গেছে একম অদ্বিতীয়মে? সমস্ত রাশির কর্ম, জ্ঞান, কর্মফল সেই অদ্বিতীয়ের সাথে তুলনা করে নির্ধারিত হয়। যা অদ্বিতীয় তা ঈশ্বর। হরিচরণ বন্দোপাধ্যায় বঙ্গীয় শব্দকোষে বলছেন ঈশ্বর হল সামর্থ, স্বকার্য্যকরণক্ষম। কার্য অর্থাৎ কৃতিসাধ্য, করণীয়। যিনি স্বকার্যকরণক্ষম, তাঁর সাপেক্ষে বাকিদের মাপ।
বিজ্ঞান বলে মাপ হল আপেক্ষিক মাত্রা ও এককের মধ্যে সংখ্যাবাচক মূল্যায়ন। মাপের প্রথমে ‘কি’ মাপা হবে তা গুরুত্বপূর্ণ। “মাপয়িত্বা কর্ম্ম সমারভে”। কাজের শুরুতে মেপে নেওয়াটা জরুরী। যা করতে চাই তা জানলে কতটা করলাম মাপা সম্ভব। সেখানে পদ্ধতিগত পার্থক্য থাকতে পারে। যদিও এই ‘কি’ এর মানে সেই পদার্থ বা পরিস্থিতি নয়, বরং তার আরোপিত সত্ত্বা। এই আরোপিত সত্ত্বাকে সংখ্যাবাচক চিহ্নে পরিণত করাই হল মাপ।
পদার্থ বা পরিস্থিতির অস্তিত্ত্ব মাপের ওপর নির্ভর করে না। বরং মাপ থেকে আমরা তাদের অস্তিত্ত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হই। একএকটা মাপ একএক রকম গুণবাচক। যেমন তাপমাত্রা আর আয়তন একই বস্তুর দুটো আলাদা গুণ বোঝায়।
অর্থাৎ একক হল ঈশ্বর। বাকি পৃথিবীর আপেক্ষিক মাত্রা সেই এককের সাথে তুলনা করে নির্ধারিত হবে। মাপের জন্য এককের গুরুত্ব অপরিসীম।
অর্থাৎ মাপ = আপেক্ষিক মাত্রা X একক
বা মাপ = আপেক্ষিক মাত্রা X ঈশ্বর
এখানে একক এমন এক ভেক্টর যা শুধু দিক নির্দেশ করে, যদিও তার অবস্থান অজানা ও অনির্দিষ্ট।
শূন্য দর্শন
যদি এমন হয় যে মাপ = 0,
তবে আমাদের হাতে দুটো বিকল্প।
বিকল্প১, আপেক্ষিক মাত্রা = 0
বিকল্প২, ঈশ্বর = 0
মাপ মানে দুটো ঘটনা, রাশি পরিস্থিতি বা পদার্থের মধ্যে তুলনা। আর যখন আমরা দুই পদার্থ বা রাশির মধ্যে তুলনা করছি তখন যতো ক্ষুদ্রই হোক দ্বিতীয় পদার্থ বা রাশি কখনই শূন্য হতে পারে না। তার কিছু না কিছু অস্ত্বিত্ব থাকবে। হতে পারে তা শূন্যের কাছাকাছি, প্রায় শূন্য। কিন্তু প্রায়শূন্য আর শূন্য এক নয়। যেমন হিমালয়ের সাথে ধূলিকণার উচ্চতার তুলনা করতে যাই তবে ধূলিকণার অস্ত্বিত্ব প্রায় শূন্যের সমান, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা শূন্য নয়।
অর্থাৎ মাপ=0 হলে আমাদের সামনে একটাই বিকল্প থাকে, ঈশ্বর = 0।
এইভাবে আমরা শূন্য থেকে ঈশ্বরকে সৃষ্টি করে ফেললাম। এই সৃষ্টি যুগান্তকারী।
হিব্রু ঐতিহ্য বলে ফাঁকা বা শূন্য বা void অবস্থা থেকে ভগবানের নড়াচড়া আর শব্দ করার জন্য ব্রম্ভাণ্ডের সৃষ্টি। অর্থাৎ শূন্য আর শূন্য থাকছে না। তা সৃষ্টিশীল হয়ে উঠছে।
প্রাচীন ভারত “0” এই চিহ্নকে নির্মাণ করেছে। ভারত “0” কে বলছে শূন্য, খ, আকাশ, গগন, ব্যোম, বিন্দু। বিন্দু অর্থাৎ ওম। প্রাচীন ভারত বিন্দুকে সাধনা স্তরে নিয়ে গেছে। যা মাপের পদ্ধতিকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। যেখানে বিন্দু হল সম্পূর্ণ। শূন্য শুধুমাত্র কিছু পরিমাণ ফাঁকা স্থান নয় বরং তা এক পরিপূর্ণ সম্ভাবনা।
বিন্দুরূপিণী জগত। বিন্দুকে টেনে নিয়ে গেলে রেখা। রেখাকে টেনে নিয়ে গেলে ক্ষেত্র। ক্ষেত্রকে টেনে নিয়ে গেলে ব্রম্ভাণ্ড। তাই বিন্দু হল সৃষ্টি। বিন্দু হল ঈশ্বর। অং রূপিণী। শূন্য বা বিন্দু আর অনস্ত্বিত্ব থাকে না, তা হয়ে ওঠে অস্ত্বিত্ব।
0 = ঈশ্বর
দুটো সম্পূর্ণ আলাদা মাপ পাওয়া গেল।
0=ঈশ্বর
১=ঈশ্বর
এটা সত্যি যে শূন্যের ক্ষমতা ঐশ্বরিক। কোনও সংখ্যার ডানদিকে বসলে সংখ্যার মান দশগুণ বেড়ে যায়। কিন্তু প্রশ্ন হল “0” কি?
আগামীকালের থেকে আজকের পৃথিবী অনেকবেশী শূন্যময়। আজ থেকে কয়েক দশক আগে শূন্য দশটা অঙ্কের একটা ছিল। 0,১,২,..., ৯। আজকের পৃথিবীতে মোটামুটি দুটো অঙ্ক – 0 আর ১। আজকের পৃথিবী অনেকবেশী ডিজিটাল। অর্থাৎ আজকের পৃথিবীতে শূন্যের সম্ভাবনা অর্ধেক, যা কয়েক দশক আগেও ছিল দশ শতাংশ।
শূন্য নিয়ে প্রধান সমস্যাটা ভাগের ক্ষেত্রে। কোনও সংখ্যাকে শূন্য দিয়ে ভাগ করলে হয় অসীম, আর শূন্যকে অসীম দিয়ে ভাগ করলে হয় শূন্য। অর্থাৎ শূন্য অবিভাজ্য। শূন্যকে ভেঙে টুকরো করা যায় না। অথচ যে কোনও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সংখ্যাকে শূন্য ভেঙে ফেলতে পারে অসীম সংখ্যক টুকরোতে। এইভাবে মাপের মধ্যে এক সংশয়ের জন্ম হয়। সত্যিই কি শূন্য অবিভাজ্য?
প্রশ্ন হল এই যে ব্রম্ভাণ্ডের অধিকাংশ স্থান শূন্য বা ফাঁকা। এই ফাঁকাটা কি ব্রম্ভাণ্ডের বাইরে না মধ্যে ? কারণ ফাঁকা মানে সেখানে কিছুই নেই। কোনও পাত্রের মধ্য থেকে যদি সব পদার্থ বের করে নেওয়া হয় তবে সেটাও শূন্যস্থান। সেই শূন্যস্থান কি ব্রম্ভাণ্ডের বাইরে ?
এখানে আসে হাইজেনবার্গের অনির্দিষ্টতার তত্ত্ব আর কোয়ান্টাম মেকানিক্স। এই তত্ত্ব বলে কোনকিছুর অবস্থান আর গতিকে নির্ভুলভাবে একই সময়ে মাপা সম্ভব নয়। তাই শূন্যস্থান মানে সেখানে কোনও বস্তু নেই, শক্তি নেই তা সম্পূর্ণ ফাঁকা একথা ভাবা মানে অনির্দিষ্টতার তত্ত্বকে অস্বীকার করা। কারণ তখন প্রত্যেক বিন্দুতে গতি আর শক্তির সঠিক পরিমাপ দরকার, যা অসম্ভব।
শূন্য আর শূন্য থাকল না। সেখানে থাকল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শক্তি, যেখান থেকে আর কোনও শক্তি সরানো সম্ভব নয়। পদার্থবিদ্যা একে বলছে শূন্যবিন্দু শক্তি (zero-point energy)।
সংখ্যার স্বৈরাচার
পদার্থের স্বাধীন ক্ষুদ্রতম একক পরমাণু। জড় আর জীবিতের শরীর বিভিন্ন পরমাণু দিয়ে তৈরি। তাই আপাতদৃষ্টে এটা সঠিক হবে যদি আমরা সবকিছুই পরমাণু স্তরে মাপতে পারি। রসায়নবিদ্যার মাপ কিছুসংখ্যক পরমাণু নিয়েই। তার একক মোল (mole)। কিন্তু একটা পরমাণু বা কিছু সংখ্যক পরমাণু কি বোধ বা চৈতন্যের পরিমাপ করতে পারে? প্রত্যেক পরমাণুর ব্যবহার কি এক এক অনুভূতির জন্য নির্দিষ্ট? বোধ বা চৈতন্যকে সংখ্যাতে পরিণত করা অসম্ভব, অন্তত এখনও পর্যন্ত মানুষের যা জ্ঞান। আবার মাপ হল বেঁচে থাকার ক্ষমতা। মাপ ভুল হলে ধ্বংস অনিবার্য। আর প্রকৃতিবিচ্ছিন্ন মানুষের মাপের রাজ্যে বোধ বা চৈতন্যের চেয়ে সংখ্যার জোর অনেক বেশী হয়ে উঠছে। সংখ্যা নিয়ে যাবতীয় বাগাড়ম্বর একটাই কারণে, তা আমাদের দৈনন্দিন বসবাসের জমিটুকু দেয়। যদিও সংখ্যা আমাদের অজ্ঞতার পরিচায়ক। সমস্ত প্রকৃতিকে আমরা এখনও সংখ্যা দিয়ে বুঝতে পারিনি।
সংখ্যা আমাদের অনুকরণ বা নকল করতে শেখায়। সেই অনুকৃতি পোশাকের সামঞ্জস্য, বাসস্থানের সামঞ্জস্য, চিন্তার সামঞ্জস্য নির্মাণে সহায়ক হয়ে ওঠে। আসে বিনিময়, আসে অর্থ। আর অর্থ ক্রমশ সব মাপের একক হয়ে উঠতে থাকে। সংখ্যার শক্তিতে আসে স্বৈরাচার। সংখ্যার মধ্যে আছে এক নিজস্ব ষড়যন্ত্র। নিজস্ব নিয়মতন্ত্রে তা আশপাশের সংখ্যাগুলোকে খুঁজে নেয়। সংখ্যার এক ইতিহাস নির্মিত হয়। নির্মিত হয় এক নীতির ক্ষেত্র। এই নীতির ক্ষেত্রে প্রত্যেকের মান সুনির্দিষ্ট এবং পূর্বনির্ধারিত। চাষি এবং বুদ্ধিজীবী কে কতটা প্রাধান্য পাবে তা এই নীতি দিয়েই নির্ধারিত হবে। সামাজিক ব্যবহারে সেরিব্রাম তা আগেই জেনে থাকবে, আলাদা কোনও নির্দেশ তাকে দেওয়ার প্রয়োজন হবে না। নির্দিষ্ট নিয়মে সংখ্যার পুনরাবৃত্তি হয়, নির্দিষ্ট নিয়মে তারা স্থানচ্যুত হয়। সংখ্যার এই নিয়ম নীতি থেকে বেরিয়ে আসা যায় না, যতক্ষণ না সংখ্যার অন্যকোনো নিয়মনীতি চালু না হয়। সংখ্যার অন্যকোনো নিয়মনীতি তখনই চালু হয় যখন কিছু আলাদা পর্যবেক্ষণ সামনে আসে।
0 ÷ ঈশ্বর = সৃষ্টি
সময় এক অদ্ভুত ক্ষেত্র। সময় সম্পর্কে আমাদের কোনও সঠিক ধারণা নেই। রিচার্ড ফাইনম্যানের মতে “Time is what happens when nothing else happens.” স্টিফেন হকিং বর্ণনা করেছেন ‘সময়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’। আরসব মাপের থেকে সময়ের মাপ সম্পূর্ণ আলাদা।
যে কোনও মাপের জন্য এক রেফারেন্সের দরকার। তাই দৈনন্দিন কাজের সুবিধার জন্য সময় মাপা হয় পর্যায়বৃত্ত ঘটনা থেকে। যেমন সূর্যদয় থেকে সূর্যদয় পর্যন্ত এক দিন। এক দিনকে কাল্পনিক কিছু সংখ্যা দিয়ে ভাগ করে ঘণ্টার কথা বলল মিশরিয়রা। গ্রীষ্মের রাতে ১২ টা দক্ষিণী তারা ওঠে, প্রত্যেকটা এক এক ঘণ্টার নির্দেশক। আর মিনিট, সেকেন্ড ব্যাবিলনিয় সভ্যতার অবদান। ৬০ কে নানান পূর্ণসংখ্যা দিয়ে ভাগ করা সুবিধা। ব্যাবিলনিয় সভ্যতা ঠিক করেছিল বৃত্তে ৩৬০০ থাকবে (৩৬৫০ র বদলে)। সমস্ত বছরকে ৩৬০ দিয়ে ভাগ করলে একদিন।
বিজ্ঞান সময়কে নানাভাবে দেখেছে। যেমন, থার্মোডায়নামিক্সের দ্বিতীয় সুত্র বলে সময়ের সাথে সাথে বিশৃঙ্খলা বাড়ে। এর মানে সময়েরও কোনও শুরু আছে। না হলে সমস্ত জগত এখন চূড়ান্ত বিশৃঙ্খল হয়ে যেত। যখন কোনও বিশৃঙ্খলা নেই সেই সময়ই শূন্য সময়। ঠিক সেই সময়ে ঘটে মহা বিস্ফোরণ। পরীক্ষাতে দেখা গেছে ব্রহ্মাণ্ডের সম্প্রসারণশীলতা। পেনরোজ-হকিং শুনিয়েছেন এক singularity –র কথা। যেখানে পদার্থ জড় হয় এক বিন্দুতে, এক প্রায় শূন্যতে। সেখানে কোনও পর্যায়বৃত্ত নেই। কারণ পর্যায়বৃত্ত থাকলে সময় কমেও যেতে পারত। সময় কমছে না, ক্রমশ বেড়েই চলেছে। সেই শূন্যের বিস্ফোরণ কেন হল জানা নেই। কিন্তু শূন্যের বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্টি জগতের - সমস্ত বস্তুর , সমস্ত শক্তির।
এ যেন 0 ÷ ঈশ্বর = সৃষ্টি।
মাপের অনির্ণেয়তা থেকে বাঁচার জন্য আমরা বারবার ঈশ্বরের সাহায্য নিয়েছি। এখন ঈশ্বরকে মাপাটা মাপের প্রধান কাজ।
সুচিন্তিত মতামত দিন