অভীক সরকার - মায়াজম

Breaking

৩০ সেপ, ২০১৬

অভীক সরকার



          ★★ গন্ধটা খুব সন্দেহজনক ★★








মাদের চেনাপরিচিতদের মধ্যে যখন কোন ক্যাবলার হাতে হঠাৎ করে কিছু কাঁচা টাকা আসে, সবার আগে বাড়ে তার শখশৌখিনতার মাত্রা, আমার স্বর্গীয় ঠাকুর্দা যাকে বলতেন 'ফুডানি'। দামি রঙচঙে জামাকাপড়, বিচিত্র সাইজ ও শেপের রোদচশমা, বাহারি জুতো, মেটাল ব্র্যাণ্ডের কবজি হড়কানো ভারী রিস্টওয়াচ, জেল দেওয়া চুলের জেল্লা, এসবই হচ্ছে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো বড়লোকির চিহ্ন। এবং এতেই শেষ নয়, তার সঙ্গে জোটে আরও একটি অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গ, সুগন্ধি বা পারফিউম।
সুগন্ধি আমরা সবাই ব্যবহার করি। হয় ডিও হিসেবে বা অ'ডি কোলন হিসেবে বা অ'ডি পারফিউম হিসেবে যাকে প্রচলিত ভাষায় আমরা বলি 'সেন্ট', এই সেন্টের সঙ্গে ক্রিশ্চিয়ান সাধুতার কোন নিবিড় সম্পর্ক নেই যদিও। এগুলো সবই বিভিন্ন ধরণের পারফিউম। আমরা বিভিন্ন ধরণের প্রয়োগ, মূল সুগন্ধির পরিমান, ইথানলের পার্সেণ্টেজ, গন্ধের নোট, এসবের ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন পারফিউমের বিভিন্ন নাম দিই।
ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের মতন সুগন্ধিরও শাস্ত্রটিও বড় বিশাল। তার বিস্তার, প্রকরণ, বিন্যাস, বিভব, গমক, মীড় সবই শেখার বিষয়। আমিও খুব শিখেছি তা নয়, তবে এর একটি খুবই ইন্টারেস্টিং দিক নিয়ে সম্প্রতি কিছু পড়েছি।ভাবলাম এই সুযোগে মালটা আপনাদের খেদমতে পেশ করে ফেলি।
পারফিউম শব্দটা এসেছে ল্যাটিন 'পারফ্যুমারে' থেকে, যার আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে টু স্মোক থ্রু। বিভিন্ন গাছগাছড়া বা ফুল থেকে ধোঁয়া দিয়ে উত্তপ্ত করে সুগন্ধি তেল বার করা হতো বলে এই নাম। অবশ্য শুধু উত্তপ্ত করে নয়, পিষে বা বেটেও বিভিন্ন বনজ বা উদ্ভিজ্জ উপকরণ থেকে সুগন্ধি তেল বার করার প্রচলন ছিল। আদিকাল থেকেই বিলাসের অন্যতম উপকরণ হিসেবে এর ব্যবহার। হরপ্পা মহেঞ্জোদারোতে এর খোঁজ পাওয়া গেছে ( ৩৩০০ থেকে ১৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ), উল্লেখ আছে চরক এবং সুশ্রুত সংহিতাতেও। শুধু পারফিউমের উল্লেখই নয়, দুজায়গাতেই আদি ডিস্টিলেশন পদ্ধতির বর্ণনাও পাওয়া গেছে। হরপ্পায় পাওয়া গেছে সুগন্ধি রাখার জার, বা বিভিন্ন সীল যাতে ডিস্টিলেশন বা পাতন প্রক্রিয়ার ছবি আছে।
আমরা যারা উচ্চমাধ্যমিকে ও' হেনরির লেখা "গিফট অফ দ্য ম্যাজাই" নামের একটি অবিস্মরণীয় ছোটগল্প পড়েছি ( এবং গিফট অফ দ্য মাগি বলে বিস্তর হাহাহিহি করেছি) তাদের মনে থাকতে পারে, সেখানে উল্লেখ ছিল যে যীশু জন্মাবার পর সুদূর পারস্য থেকে, এক তারার চিনিয়ে দেওয়া পথ ধরে, তিনজন জ্ঞানী পুরুষ যীশুকে দেখতে আসেন। তাঁরা কি এনেছিলেন মনে আছে? মানে ম্যাজাইদের আসলি গিফট কি ছিল? এক ছিলো সোনা, আর দুটি সুগন্ধদ্রব্য। যাদের ইংরেজি উচ্চারণ হচ্ছে মাঢ় ( myrrh) এবং ফ্র্যাঙ্কিনসেন্স (frankincense)। অভিধান বলছে এদের বাংলা হচ্ছে গন্ধরস আর লবান!! হবেও বা, বিপুলা এ পৃথিবীতে কটা বাংলা শব্দই বা শিখে উঠতে পেরেছি? আসলে দুটিই একধরনের রেসিন বা গন্ধক।
তবে পারফিউমারি, বা সুগন্ধিবিজ্ঞান শুরু হয় যেখানে তার নাম মেসোপটেমিয়া। এবং, চমকাবেন না প্লিজ, একজন মহিলার হাত ধরে, নাম তাপুতি, বা তাপ্পুতি। পুরো নাম তাপ্পুতি বেলাটেকালিম। ১২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে লিখিত এক কিউনিফর্ম লিপিতে এঁর খোঁজ পাওয়া যায়।
ঐতিহাসিকদের মতে, ইনিই পৃথিবীর প্রথম কেমিস্ট। 
ভদ্রমহোদয়া ব্যাবিলনের রাজপ্রাসাদের ওভারশিয়ার বা উপদর্শক ছিলেন। রাজপরিবারের সমস্ত সুগন্ধি জোগানর ভার ছিল এঁর ওপর। সে বিষয়ে ইনি একজনের সঙ্গে রিসার্চও করতেন, যাঁর নামের শেষ অংশ হলো নিনু। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, এই নিনুর নামের প্রথম অংশ অধরাই থেকে গেছে। আজকাল অবশ্য প্রচুর রিসার্চ পেপারে অনেকের পুরো নামই অধরা যায়, এ কথা বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির আনাচেকানাচে কান পাতলেই শোনা যায়, ফলে নিনুবাবুর যে খানিকটা নাম জানতে পারা গেছে তাই বা কম কি?
প্রাচীন মিশরীয়রা কিফি বা কাইফি (Kyphi) নামের একধরনের সুগন্ধিমিশ্রণ তৈরি করতো, পুজো এবং বিভিন্ন রোগাদি চিকিৎসার জন্যে। এতে থাকতো হেনা, সেই মাঢ় বা গন্ধক, দারচিনি আর জুনিপার গাছের অংশ।
ইনফ্যাক্ট, সুগন্ধি বোঝাবার জন্যে প্রাচীন মিশরে যে শব্দটি ব্যব্যহার হতো, তার অর্থই হচ্ছে " ঈশ্বরের গন্ধ"!
মিশরীয়দের হাত থেকে পারফিউম প্রস্তুতপ্রণালী গ্রীক ও রোমানদের হাতে যায়, এবং রোমান সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে সঙ্গে এই শাস্ত্রটিরও অবলুপ্তি ঘটে। তখন সুগন্ধিশাস্ত্র টিঁকে আছে কেবল প্রাচ্য দেশে, আল-কিন্দি বা ইবন সিনা ( আভিসেন্না) নামের রসায়নবিদ বা বিজ্ঞানীদের হাতে।
পারফিউমের সঙ্গে ইওরোপের ফের দেখাশোনা হয় ১৩ শতকে, ক্রুসেডের হাত ধরে। ক্রুসেডফেরত খ্রিষ্টান ধর্মযোদ্ধাদের দল আর দশটা প্রাচ্য জিনিসের মতন পারফিউমও নিয়ে আসে ইওরোপে। ধীরেধীরে সারা ইওরোপে পারফিউম বিলাসব্যসনের অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। ১৪০০ সাল নাগাদ হাঙ্গেরিতে সুগন্ধি তেল অ্যালকোহলে মিশিয়ে হাঙ্গারিয়ান ওয়াটার তৈরি হতো, প্রধান ভোক্তা ছিলেন হাঙ্গেরীর রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। এছাড়াও ইতালির ফ্লোরেন্সের সান্তা মারিয়ার যাজকরাও সুগন্ধি বানাবার নতুন পদ্ধতি আর রেসিপি আবিষ্কার করেন। ধীরেধীরে ইতালি হয়ে ওঠে পারফিউম চর্চার ভরকেন্দ্র। এবং রেনেসাঁর সময়, ইতালির সবচেয়ে প্রভাবশালী পরিবার মেদিচি পরিবারের ক্যাথেরিন ডি মেদিচির ব্যক্তিগত পারফিউমার রেনে দ্য ফ্লোরেন্টাইনের হাত ধরে এই শাস্ত্র জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ওঠে।
এই রেনে দ্য ফ্লোরেন্টাইন ( রেনাতো ইল ফ্লোরেন্তিনো) পরে চলে যান ফ্রান্সে। এবং তার পরের ইতিহাস আরেকদিন সময় পেলে বলবো'খন, মোটামুটি ওয়ান ফাইন মর্নিং দেখা গেলো ফ্রান্স হয়ে দাঁড়িয়েছে পারফিউম সাম্রাজ্যের একমাত্র রাজধানী।
আজকাল আমরা যেসব সুগন্ধি ব্যবহার করি, তার মূলমন্ত্রটি একই। পারফিউমের যে এসেন্স, বা ফ্র্যাগরান্স কম্পাউণ্ড, তার সঙ্গে ইথানল আর জল মিশিয়ে। এই ফ্র্যাগরান্স বা মূলগন্ধের পার্সেন্টেজ ওপর নির্ভর করে পারফিউম কতক্ষণ থাকবে, বা কতটা তীব্র ও তীক্ষ্ণ হবে। এই পার্সেন্টেজের ওপর নির্ভর করেই আমরা পারফিউম পরিবারের বিভিন্ন সদস্যকে বিভিন্ন নামে ডাকি, যেমন ১৫% থেকে ৩০% হলে বলি স্পিরিট অফ পারফিউম, ১০% থেকে ২০% হলে বলি অ' ডি পারফিউম বা পারফিউম ডি টয়লেট, ৫% থেকে ১৫% হলে বলি ইডিটি বা অ' ডি টয়লেট, ৩% থেকে ৮% হলে বলি ইডিসি বা অ'ডি কোলন।
এই পার্সেন্টেজ গুলো ওভারল্যাপিং বলে ঘাবড়াবার কিচ্ছু হয় নি। বিভিন্ন কোম্পানি তার বিভিন্ন পারফিউম রেঞ্জে বিভিন্ন পার্সেন্টেজ ব্যবহার করে, দামের ব্যপারটাই এখানে মূখ্য। মানে হাজার টাকার দামি অ'ডি টয়লেটে আপনি তিনশো টাকার অ'ডি পারফিউমের থেকে বেশি পরিমাণ মূলগন্ধ পেতেই পারেন। অনেকটা সাধারণ কলেজের ফার্স্ট বয় যেমন পড়াশোনাতে নামী কলেজের সাধারণ ছেলেদের থেকে অনেক বেশি ভালো হয়, তেমনই।
হ্যাঁ হ্যাঁ, জানি জানি, কি জানার জন্যে আপনার মনটা আকুলিবিকুলি করছে, ডিওডোরান্টের ফ্র্যাগরান্সের পার্সেন্টেজ জানার জন্যে তো? ওটাও ওই ৩% থেকে ১০% মতই। তবে প্রয়োগপদ্ধতি আলাদা। ডিওর উদ্দেশ্য দুর্গন্ধ ঢাকা দেওয়া, তাই আপনি সরাসরি চামড়ার ওপর শরীরের অস্থানেকুস্থানে স্প্রে করতে পারেন। ডিওতে খানিকটা জীবাণুনাশক ইয়েও থাকে। পারফিউমের উদ্দেশ্য সুগন্ধি আনা, তাই জামা কাপড় বা রুমালের ওপর প্রয়োগ করাটাই স্বাস্থ্যসম্মত। বুইলেন?
সুগন্ধির প্রকারভেদ অনুযায়ী ছয় প্রকারের, মানে আধুনিক গন্ধশাস্ত্র মতে সমস্ত পারফিউমকে এই ছয় ধরণের মধ্যে ভাগ করা যায়, যেমন, ব্রাইট ফ্লোরাল বা ফুলবাস, গ্রীন বা যৌবনতারুণ্য,অ্যাকোয়াটিক বা সমুদ্রশান্তি, সিট্রাস বা উগ্রলাবণ্য, ফ্রুটি বা ফলকামনা এবং গুরমণ্ড বা উদরঋদ্ধি।
বাংলা নাম গুলো কিন্তু প্রামাণ্য নয়, আমার দেওয়া। ফলে ভুলেও কোত্থাও রেফার করবেন না, ইংরেজিটাই ফলো করবেন, কেমন?
এতক্ষণে নানা প্যাচাল পেড়েছি, এইবার টুক করে কাজের কথায় ঢুকে পড়বো, তার আগে আরেকটা জিনিস না বলে রাখলেই নয়। 
গানে যেমন সাতটি নোট থাকে ( সারেগামাপাধানি বা ডোরেমিফাসোলাটি) , সুগন্ধেরও তেমন তিনটি নোট থাকে। এদের বলে টপ নোট, মিডল নোট আর বেস নোট। তিনটি আলাদা রেঞ্জের গন্ধ হয়, প্রকাশিত হবার সময় আর স্থায়িত্ব আলাদা আলাদা। কোন নোটে কোন সুগন্ধি থাকবে সেটা ঠিক করাই পারফিউম প্রস্তুতকর্তার মুন্সিয়ানার পরিচয়, অনেকটা স্কচে কোন সিঙ্গল মল্ট কতটা থাকবে সেটা ঠিক করার মতন।
যে কোন পারফিউম ব্যবহার করার সঙ্গে সঙ্গে যে গন্ধটা পান, সেটাই হচ্ছে টপ নোট। মানে আপনি সেন্ট বা ডিও কিনতে গিয়ে যেটি শুঁকে ভারি মোহিত হয়ে পারফিউমটি কিনে ফেলেন, সেটি হচ্ছে টপ নোট।

টপ নোট উড়ে গেলে যে গন্ধটি ভেসে আসে, সেটি মিডল নোট। এর স্থায়িত্ব মোটামুটি দু মিনিট থেকে এক ঘন্টা। এটির বহুতর কাজের একটি হচ্ছে, বেস নোটের প্রাথমিক ততটা-সুখের-নয় গন্ধটাকে একটু সহনীয় করে তোলা। 
এর পরে আসে বেস নোট, ইনিই আসল মানুষটি। এই ভদ্রলোকটিই পারফিউমের প্রধান চরিত্র। সুগন্ধির গভীরতা ও ব্যাপ্তি এই ভদ্রলোকটির বদৌলতে আসে। ইনি থাকেন অনেক্ষণ, এবং যাতে থাকেন সেজন্যে এনার সঙ্গে ফিক্সেটিভ ব্যবহার করা হয়, অর্থাৎ ভারী অনুবিশিষ্ট কেমিক্যাল, যা ধীরে ধীরে বায়ুতে মুক্ত হয়। 
মানে গুছিয়ে বললে, যখন আপনি টাই পরে, দামী ফর্ম্যাল পোশাকে ইন্টারভিউ দিতে গেলেন, তখন আপনি টপ নোটে খেলছেন। তারপর বাড়ি ফিরে যখন হাঁটুর ওপর লুঙ্গি তুলে কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মুড়িমাখা খেতে খেতে গিন্নির সঙ্গে সোহাগ কচ্চেন, তখন আপনি মিডল নোটে। আর বাত্তুমে মুক্তকচ্ছ হয়ে আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই যখন মোহিত, তখন আপনি বেস নোটে বেশ আছেন।
এইবার আসল কথা। বিভিন্ন পারফিউম বা সুগন্ধি, যে বিভিন্ন মুলগন্ধের সংমিশ্রনে তৈরি সে তো বোঝা গেলো, তা এই মূলগন্ধ বা ফ্র্যাগরান্স বেস আসে কোথা থেকে?
সমস্ত ফ্র্যাগরান্স বেস বা মূলগন্ধকে দু ভাগে ভাগ করা যায়, উদ্দিজ্জ এবং প্রাণীজ। উদ্ভিজ্জ মুলগন্ধ খুঁজে পাওয়ার সোর্স হাজার খানেক আছে, আরো আবিষ্কার হয়েই চলেছে। কিন্তু, হে পাঠক, পারফিউমের কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসে প্রাণীজ ফ্র্যাগরান্স খুঁজে পাওয়া গেছে কয়টি জানেন?
পাঁচটি। আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন, পাঁচটি। তন্নতন্ন করে খুঁজেও এর বাইরে আর কোন প্রাণীজ ফ্র্যাগরান্সের খোঁজ পাওয়া যায় নি। হারাধনের সেই পাঁচটি ছেলেকে নিয়েই এই লেখা।


যাবতীয় উদ্ভিজ্জ মূলগন্ধকে উৎসে আটভাগে ভাগ করা যায়, চট করে তাদের পরিচয়টা দিয়ে ফেলে মূল বিষয়ে ঢুকে পড়বো। সেই আটটি প্রকারভেদ হচ্ছে,
১. ফুলঃ যেমন গোলাপ, জুঁই, রজনীগন্ধা, জেরেনিয়াম, নার্গিস, চাঁপা, বিভিন্ন লেবুর ফুল থেকে শুরু করে মায় ল্যাং ল্যাং পর্যন্ত। হাজারগণ্ডা সুগন্ধি ফুলের প্রজাতি, গুচ্ছখানেক ফুলের ফ্র্যাগরান্সের সোর্স।
২. ফলঃ আপেল,স্ট্রবেরি, চেরি এগুলো তো আছেই, আর আছে সিট্রাস, মানে লেবুজাতীয় সব ফল, কমলা, পাতিলেবু, কাগজি লেবু ইত্যাদি ইত্যাদি।
৩. পাতা ও শাখাঃ ল্যাভেন্ডার, রোজমেরি ইত্যাদি।
৪. শিকড় বা গেঁড় (রাইজোম)ঃ আদা, আইরিস রাইজোম, খসগাছের মূল। 
৫. বীজঃ গাজরের বীজ, ধনেগাছের বীজ, কোকা, এলাচ, জায়ফল, জয়িত্রি ইত্যাদি। 
৬. কাঠঃ চন্দনকাঠ, রোজউড, বার্চ, সেডার পাইন।
৭. রেসিনঃ লডানম, ধুনো, সেই 'গন্ধরস ' এবং 'লবান', বালসাম অফ পেরু,পাইন আর ফার গাছের রেসিন,গাম বেঞ্জিন ইত্যাদি।
৮. গাছের ছাল বাকলঃ দারচিনি, কেসকারিল্লা ইত্যাদি।
উদ্ভিজ্জ মূলগন্ধগুলিকে পারফিউমের তিনটি নোটের যে কোন জায়গাতেই ব্যবহার করা হয়। কিন্তু প্রাণীজ যে পাঁচটি মূলগন্ধ আছে, সেগুলো সবই ব্যবহার করা হয় বেস নোট হিসেবে। এই ফ্র্যাগরান্সগুলি পারফিউমে খুব আলাদা বা বিশিষ্ট কিছু টোন আনে এবং এগুলো সবই ফিক্সেটিভ, অর্থাৎ অনেক্ষণ থাকে। জান্তব হবার কারণে এই গন্ধগুলো মানুষের মনে প্রায় আদিম একটা টান বা আবেদন তৈরি করে, যেটা কোন বনজ বা উদ্ভিজ্জ সোর্স থেকে পাওয়া ফ্র্যাগরান্সে সম্ভব না।
সেই পঞ্চপাণ্ডব হলো, অ্যাম্বারগ্রিস, মাস্ক বা কস্তুরি, সিভেট অয়েল, ক্যাস্টোরিয়াম আর হায়রাসিয়াম।
অ্যাম্বারগ্রিসের সঙ্গে বেশ একটা প্রাচীন রোম্যান্টিক মিথ মিশে আছে। সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পেরিয়ে হঠাৎ একদিন সমুদ্রের তীরে এসে পৌঁছল না জানি কার ভালোবাসা, এক সুগন্ধিস্তুপ। আদিম সমুদ্রের গভীর সুগন্ধ বুকে নিয়ে, কোন এক দারুচিনি দ্বীপের রাজকন্যের জন্যে সেই মন উথালপাতাল করা....
ইয়ে, কত্তা, চোখ খুলুন, অত ঢুলুঢুলু চোখে আবেশে ভেসে যাওয়ার মতন কিছু হয়নি, মালটা আসলে বমি!!
হ্যাঁ, চমকাবার কিছু হয়নি। অ্যাম্বারগ্রিস হচ্ছে স্পার্ম হোয়েল নামের একপ্রকার তিমিমাছের বমি। তাও সব স্পার্ম হোয়েলের সব ধরণের বমি নয়। স্পার্ম হোয়েল যখন এমন শক্ত কিছু খেয়ে ফেলে, যা হজম করতে পারে না ( যেমন কাটলফিশের চঞ্চু) , সেগুলো বাই চান্স যদি অন্ত্রের এত ভেতরে চলে যায় যে উগরে দেওয়া যায় না, তবে সেই তিমিবাবুর পেটে বেজায় বেগড়বাঁই সৃষ্টি হয়। মনে রাখবেন, এসব একশো স্পার্ম হোয়েলের মধ্যে একজনের ভাগ্যেই ঘটে। তা সেই বেগড়বাঁই কমাতে পিত্তথলি থেকে রস বেরিয়ে ক্রমশ সেই ইরিটেশন বা উৎপাতের উৎসে চাপা দিতে থাকে। তা অনেকদিন যখন পুরো স্তূপটি এত বড় হয়ে যায়, যে তাকে ইউজুয়াল পথে বার করতে গেলে আক্ষরিক অর্থেই সেসব পথ ফেটে হাতে চলে আসার কথা। আর কথা নেই বার্তা নেই খামোখা ন'মাসি পেট নিয়ে ঘুরতে কারই বা ভালো লাগে? ফলে বহু কষ্টে বাবাজীবন সেটি উদগার করে সমুদ্রে ফেলে নিষ্কণ্টক হয়ে কেটে পড়েন।
তা সেই তীব্র কটু মলগন্ধযুক্ত বর্জ্য বস্তুটি, প্যারাফিন বা মোমজাতীয় জমানো পিত্তরসপিণ্ডটি সমুদ্রে ভাসতে থাকে। তখন তার রঙ ফ্যাকাশে সাদা, কালো কালো দাগযুক্ত। তারপর সে জিনিস ভাসতে ভাসতে, রোদেজলেহাওয়ার পুড়ে আস্তে আস্তে শক্ত হয়ে আসে, রঙ হয় কালো বা ডার্ক গ্রে। 
তারপর সে যখন তীরে এসে পৌঁছয়, তখন তার গন্ধ অনেক মোলায়েম হয়ে এসেছে। তাতে কাঠ, মস, অ্যাম্বার ইত্যাদির মিষ্টি গন্ধ। লোকে বলে এতে নাকি সমুদ্রের প্রাণীজ, আদিম বারুণিক গন্ধও মিশে থাকে।
এক একটা অ্যাম্বারগ্রিসের সাইজ পঞ্চাশ গ্রাম থেকে পঞ্চাশ কিলো অবধি হতে দেখা গেছে। পারফিউমে এর বহুল ব্যবহার। অত্যন্ত অল্প পরিমাণ অ্যাম্বারগ্রিস পুরো পারফিমের বেস নোট নিয়ন্ত্রণ করে, যার সৌন্দর্যের মধ্যে মিশে থাকে একটা দুর্মূল্য, জটিল এবং প্যাশনের ভাব। বস্তুটি ৬২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে গলে জল, আর ১০০ ডিগ্রিতে পুরো হাওয়া, ভ্যানিশ।
অ্যাম্বারগ্রিসের দাম এখন প্রায় দুহাজার টাকা প্রতি গ্রাম। এই উঁচু দামের কারনও সহজবোধ্য। কবে কোন স্পার্ম হোয়েল এসব গড়বড় বাধাবে, তারপর সে জিনিস উগরোবে, তারপর বস্তুটি ঢেউতে টুকরো টুকরো না হয়ে সহি সালামত তীরে এসে আশ্রয় নেবেন, এসবই ভাগ্যের ব্যাপার। ফলে এর দাম হবে না তো কার হবে?
এসব ঝামেলার কারণে অনেক দেশেই অ্যাম্বারগ্রিস কেনাবেচা নিষিদ্ধ, কোন তিমি কার জলসীমান্তের মধ্যে কি খেয়ে পেটে কাণ্ড বাঁধিয়েছে, আর কোথায় গিয়ে সেই পাপ উগরেছে, আর সেই জিনিস কোন দেশের তীরে গিয়ে ঠেকেছে, এতসবের হিসেব কে নেবে ভাই? তাও শুনতে চান মোটামুটিভাবে কোথায় কোথায় পাওয়া যায়? তবে শুনুন, আটলান্টিক মহাসাগর, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল, মাদাগাস্কার, মালদ্বীপ, দক্ষিণ চীনসাগর, জাপান,অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড আর মলক্কা দ্বীপে। তবে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় বাহামা আর ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে। 
তাহলে আর কি, দাম তো শুনেই নিলেন, পরের বার ওদিকে গেলে সমুদ্রের ধারে হাওয়া খেতে খেতে যদি দেখেন কালচে টাইপের পটিগন্ধযুক্ত কিছু একটা ভাসতে ভাসতে আপনার কাছেই তীরে এসে ঠেকেছে, তাহলে আর কোন বিকিনি সুন্দরী নয়, ওই গন্ধেশ্বরী দেবীকেই জাপ্টে ধরে ঘরে নিয়ে আসবেন। এক গ্রাম দুহাজার টাকা, খেয়াল আছে তো? আর যদি কিলো পাঁচেক পেয়েই যান....শুনছেন, ও দাদা, শুনছেন? 
যাত্তারা, লোকটা অজ্ঞান হয়ে গেলো নাকি, অ্যাঁ?
পরের আইটেম হচ্ছে কস্তুরি। 
রবীন্দ্রনাথ প্রচুর কিছু লিখে অনেক লোকের খুবই অসুবিধা, এবং গোনাগুনতি লোকের কিছু সুবিধা করে গেছেন। সুবিধা এই যে চট করে লাগসই কোটেশন লাগলে, সে যে কোন বিষয়েই হোক, একবার রবীন্দ্রনাথ প্লাস ওমুক বলে গুগলে সার্চ মারলেই কিছু না কিছু ভেসে আসে। যেমন আমি পেলুম, 
"পাগল হইয়া বনে বনে ফিরি/আপনগন্ধে মম, কস্তুরিমৃগ সম। দক্ষিণবায়ে ফাল্গুন রাতে কোথা খুঁজে পাইনা / যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না"।
যে কোন ভদ্রলোকের মতন আমার এখানেই থেমে যাওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু কস্তুরি ব্যাপারটা ভারতীয় সাইকি বা মননের সঙ্গে এমন ভাবে জড়িয়ে গেছে যে একটা উদ্ধৃতিতে থামা মুশকিল। সমস্ত আধ্যাত্মিক, মিস্টিক, দার্শনিক কাব্যানুষঙ্গে কোথাও না কোথাও কস্তুরি, কস্তুরিমৃগ, নিজের অন্তরের সৌন্দর্য ক্ষ্যাপার পরশপাথরের মতই খুঁজে খুঁজে ফেরা এসব দৃশ্যকল্প ফিরে আসে বারেবারে, যেমন কবীরের এই দোঁহাটি, "কস্তুরি কুণ্ডল বসে, মৃগ ঢুণ্ডত বন মাহি/ জ্যায়সে ঘট ঘট রাম হ্যায়, দুনিয়া দেখে নাহি"। 
আহা!
কস্তুরিমৃগ আসলে বিবর্তনের লাইনে বর্তমান হরিণের একটু আগের জীব। এ জিনিস পাওয়া যায় / যেত হিমালয়ান রেঞ্জে, অর্থাৎ নেপাল,তিব্বত, দক্ষিণ চীন, উত্তর পাকিস্তান, মঙ্গোলিয়া ইত্যাদি জায়গায়, এমন কি সুদূর সাইবেরিয়াতেও! 
এই কস্তুরিমৃগের পুরুষপ্রজাতির যৌনযন্ত্রটির কাছাকাছি যে লোমশ, টেনিসবল সাইজের গ্রন্থিটি জন্মায় তারই নাম কস্তুরি। লোকে ভাবতো এটি কস্তুরিমৃগের অণ্ডকোষ, তাই তাকে বলতো মুষ্ক, সংস্কৃতে অণ্ডকোষকে তাই বলা হয় বটে, সে অ্যানকোণ্ডারই হোক বা ইঁদুরের। 
সেই মুষ্ক থেকে মাস্ক। সুগন্ধি দুনিয়ার তোলপাড় করা দ্রব্য মাস্ক।
বেশি আবেগে ভেসে যাবার আগে,হে পাঠক আপনাকে জানিয়ে রাখি, পুরুষ মাস্ক ডিয়ারকে খুন না করে, তার রক্তে আপনার হাত রঞ্জিত না করে এ জিনিস আগে আপনার হাতে পৌঁছত না। এখন যে পৌঁছয় না তার কারণ অবশ্য অন্য, মাস্কডিয়ার ১৯৭৯ থেকে প্রোটেক্টেড ওয়াইল্ড লাইফ অ্যানিমাল বলে। 
তা এই কস্তুরিমৃগটিকে বধ করে আপনি যে মাস্কপডটি পান, সেটিকে বিদীর্ণ করলে একধরনের লালচে বাদামি পেস্ট পাবেন। কয়েকদিনবাদে সেই পেস্টটি কালচে দানাদার পদার্থে পরিণত হয়। এই কস্তুরিদানাটাই হচ্ছে সুগন্ধির মূল উৎস। এর গন্ধ এত তীব্র যে, নাকে কাপড় বেঁধে নাকি একে সংগ্রহ করতে হয়। এই দানা অল্প, বিশুদ্ধ ইথানলের সঙ্গে মিশিয়ে কস্তুরির মাদার টিঙ্কচার তৈরি হয়। এই মাদার টিঙ্কচারই সুগন্ধি প্রস্তুত করতে কাজে লাগে। 
সুগন্ধিবিশেষজ্ঞরা বলেন যে কস্তুরিঘ্রাণের মতন জটিলতম গন্ধ আর কোন উৎসে পাওয়া যায় না। বিভিন্ন লোক বিভিন্নভাবে এই গন্ধ বর্ণনা করে, কেউ বলে তীব্র জান্তব, কেউ বলে আরণ্যক, কেউ বলে মিষ্ট পাশবিক, কেউ বলে আদিম রিপুর একমাত্র অভিজ্ঞান। তবে এক বিষয়ে সবাই একমত, এই গন্ধ অনির্বচনীয়, অলৌকিক !! 
এখানে বলে রাখা ভালো যে কস্তুরির একটি দানা সত্যিই লক্ষ কিউবিক ফুট বাতাস পরিশুদ্ধ করতে পারে। জানাশোনা সমস্ত গন্ধের মধ্যে কস্তুরির গন্ধই সবচেয়ে পেনিট্রেটিং বা দূরগামী আর সবচেয়ে পারসিসটেন্ট বা নিবিষ্ট।
পুরীতে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার সময় তিন বিগ্রহের "মুখশৃঙ্গার" বা সাজুগুজু করার জন্যে ( নেত্র উৎসব বা নবযৌবন দর্শন) কস্তুরি আবশ্যক। ওই সামান্য কস্তুরি সমগ্র মন্দির চত্বরের বাতাস তীব্র মিষ্টি গন্ধে পরিপূর্ন করে। শুধু রথযাত্রার দিন নয়, পরের কয়েকদিনও। কতটা কস্তুরি লাগে জানেন? পাঁচ গ্রাম!! হ্যাঁ, পাঁচগ্রাম কস্তুরি, হিং আর কর্পূর মিশিয়ে সেই মুখশৃঙ্গারের উপকরণটি তৈরি হয়। তাতেই ওই বিশাল চত্বর তিনদিন থেকে চারদিন আমোদিত থাকে। কস্তুরির মহিমাটা বুঝতে পারছেন স্যার?
এইজন্যই কস্তুরি এই দুনিয়ার সবচেয়ে দামী প্রাণীজ বস্তু। একগ্রাম কস্তুরিদানার দাম কত জানেন? সাড়ে সাত হাজার থেকে আট হাজার টাকা, মানে সোনার দামের প্রায় আড়াইগুণ বেশি!
দামের কথাই যখন উঠলো তখন জীবনের দামটাও শুনুন। এককিলো কস্তুরিদানার জন্যে কম করে পঞ্চাশ থেকে ষাটজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষ মাস্কডিয়ারকে খুন করতে হয়!!! 
সুখের বিষয় এই যে, এখন কৃত্রিম উপায়ে কস্তুরিগন্ধ প্রস্তুত করা হচ্ছে। আপনার বগলের দুর্গন্ধ চাপা দেবার জন্যে আর ক'টি নিরীহ প্রাণীকে আত্মোৎসর্গ করতে হচ্ছে না।
যেসব মহাত্মারা মহর্ষি তপন রায়চৌধুরীপ্রণীত "রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তর পরচরিতচর্চা" নামক অসামান্য রম্যগ্রন্থটি পড়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই হঠাৎ বড়লোকির লক্ষণ হিসেবে 'খাডাশের গায়ে ত্যাল ম্যাক ম্যাক করে' বাক্যবন্ধটির সঙ্গে সবিশেষরূপে পরিচিত। এই খাডাশ বা গন্ধগোকুল গোত্রের প্রাণীর আত্মরক্ষার প্রধান অস্ত্রই হলো তীব্র দুর্গন্ধ ছড়িয়ে শত্রুকে দূরে রাখা। 
এহেন খাডাশের 'ত্যাল' দিয়াই তৃতীয় প্রাণীজ সুগন্ধিটি প্রস্তুত হয়। বিশ্বাস হচ্ছে না, না? 
গন্ধগোকুলের ইংরেজি নাম হলো সিভেট। বিড়ালের আকার এবং লম্বা লেজ। সরু সূঁচলো মুখ হচ্ছে এদের চেনার উপায়। এদের যে প্রজাতিটি তপনবাবুর শৈশবে বরিশালের নাইটলাইফের হদ্দমুদ্দ করে থাকতো, তার নাম এশিয়ান পাম সিভেট।



এদেরই যে জাতভাই আফ্রিকাতে থাকে ( সিভেটিক্টিস সিভেটা), তাদের থেকে পাওয়া যায় সিভেট সুগন্ধিটি। এদের বাসস্থান হচ্ছে সাবসাহারান আফ্রিকা, আটলান্টিক থেকে আরব সাগর অবধি। 

পুরুষ এবং মহিলা সিভেটের পায়ুগ্রন্থি থেকে যে পিচ্ছিল হলদেটে গ্রন্থিরস বের হয়, তাই হচ্ছে সিভেট সুগন্ধির মূল উপকরণ। বুঝতেই পারছেন, এ জিনিসের প্রাথমিক গন্ধে আমোদিত হওয়ার বদলে দাঁত ছরকুটে দুম করে অজ্ঞান হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে অ্যালকোহলে সঙ্গে মিশিয়ে মালটাকে তরল আর মৃদু করে আনলে একটা বেশ জান্তব অথচ মসৃণ ফুলেল গন্ধ পাওয়া যায়, যার জুড়ি মেলা ভার। মসৃণ কথাটা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, কারণ এর অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে পারফিউমের সরগমের যে উচ্চাবচ বা রাফ প্যাচ আছে তাকে ভরাট করা, পুরো সুগন্ধির তানটিকে আরও নিভাঁজ, স্নিগ্ধ আর স্বচ্ছন্দ করে তোলা।
এখন কথা হচ্ছে, লাও তো বটে, কিন্তু আনে কে? মানে অমন জিনিসটি সংগ্রহ করে কি করে? একটা করে সিভেট ধরে পায়ুদেশ টিপে রস বার করে নিলাম, এটা তো ঠিক সংগ্রহ করার উপায় হতে পারে না!! আর সিভেটের পায়ুদেশের কাছে যে পেরিনিয়াল গ্ল্যাণ্ড ( যৌনস্থান থেকে পায়ুদেশ অবধি অঞ্চলকে পেরিনিয়াল বলা হয়) থেকে রসটি ক্ষরণ হয়ে, সিভেট মেরে ফেললে সেখান থেকে আর গ্রন্থিরস বার করা সম্ভবও না।
ফলে যেটা করা হয়, সেটা হচ্ছে যে সিভেট চাষ করা হয়!! আর এর প্রায় পুরোটাই হয় ইথিওপিয়ায়।
সিভেট এমনিতে খাঁচায় বাঁচা প্রাণী নয়। তাই এদের ব্রিডিংও স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশেই করতে হয়, বিশাল জায়গা জুড়ে। সেখানে জায়গায় জায়গায় লম্বা লাঠি পুঁতে রাখা হয়। সিভেটদের জৈব প্রবৃত্তি হচ্ছে লাঠিতে পায়ুদেশ ঘষা ( ঘষে কি আনন্দ পায় আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না, কারণ উত্তর দিতে পারবো না, এদের সঙ্গে আমার বিশেষ বার্তালাপ নেই)। এই প্রক্রিয়ায় লাঠির গায়ে সিভেটরস লেগে যায়, এবং দিনের শেষে সেই লাঠি সংগ্রহ করে নতুন লাঠি রাখা হয়। এই হচ্ছে সিভেটগন্ধরস সংগ্রহ করার প্রক্রিয়া। 
তবে এত করেও কিন্তু সিভেটগন্ধের দাম আগের দুটি গন্ধদ্রব্যের ধারকাছ দিয়ে যায় না, এই কিলোপ্রতি হাজার তিরিশেক হবে!
এবার চতুর্থ উৎস।
আমরা যারা ছোটবেলায় সুকুমার সমগ্রে মজে থাকতাম, তারা নিশ্চয়ই বীভারের কথা পড়েছি, আরে সেই যে 'জানোয়ার ইঞ্জিনিয়ার' বলে অসামান্য লেখাটি? উত্তর আমেরিকার এই ছোট জন্তুটির ব্যাপারে অমন চমৎকার লেখা আজ অবধি আর কেউ লিখতে পারের নি।।
এই বীভারের শরীরের ক্যাস্টরথলি থেকে আসে ক্যাস্টরিয়াম নামের মূলগন্ধউৎসটি।
পুরুষ এবং মহিলা, দুইধরণের বীভারেরই লেজের কাছাকাছি, সেই পেরিনিয়াল অঞ্চলে দুটি করে ক্যাস্টরথলি থাকে থাকে। এই থলি বা গ্রন্থি থেকে যে রস বার হয়, বীভার তার প্রস্রাবের সঙ্গে মিশিয়ে নিজের এলাকা নির্দিষ্ট করে রাখে, যাতে আর কেউ এসে দখলদারি না দেখাতে পারে। 
এইবারে সেই দুঃখের খবর, কস্তুরিমৃগের মতই বীভারের রক্তে হাত না রাঙিয়ে আপনি ক্যাস্টরথলি সংগ্রহ করতে পারবেন না। এবং বীভারের উজ্জ্বল চামড়া আর এই ক্যাস্টরিয়ামের জন্যে আজ অবধি যে কত লক্ষ বীভার মারা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই!
এই ক্যাস্টরথলি সংগ্রহ করলে দেখা যায় এর মধ্যে থলথলে কিছু একটা আছে। পুরো জিনিসটাই তখন রোদে শুকোতে দিতে হয়। যত দিন যায়, তত একে ছোট্ট শুকনো গাছের ডালের মতন দেখতে হয়। এই বস্তুটিই বাজারে বিকোয়, নাম ক্যাস্টরপড। ৭০% অ্যালকোহলে মেশালে এটির নামই আবার ক্যাস্টরিয়াম, চতুর্থ মূলগন্ধউৎস। এক একটি ক্যাস্টরপডের দাম প্রায় তিন থেকে চার হাজার টাকার কাছাকাছি।
ক্যাস্টরিয়ামের গন্ধটি অন্য গন্ধগুলির মতন বহুতর নয়, এর একটিই অনন্য সুগন্ধ, তা হলো দামী লেদারের গন্ধ। লেদার শব্দটা ব্যবহার করলাম কারণ ইংরেজিতে স্কিন এবং লেদারের পার্থক্য স্পষ্ট, বাংলায় দুটোই হচ্ছে চামড়া। ক্যাস্টরিয়ামের গন্ধটির মধ্যে পয়সাওয়ালা বাড়ির দামি লেদার আপহোলস্ট্রির আভিজাত্য আছে। সুগন্ধিতে এই আভিজাত্যটুকু আনাই ক্যাস্টরিয়ামের কাজ।
এছাড়াও ক্যাস্টরিয়ামের কিছু ঔষধিমূল্যও আছে। আমেরিকার প্রাচীন আদিবাসিন্দারা এই ক্যাস্টরপড পুড়িয়ে তার ধোঁয়া মাথাধরা থেকে শুরু করে হিস্টিরিয়া অবধি সবেতেই ব্যবহার করতো। তার অবশ্য কারণ হ্যায়। বীভারের প্রিয়তম খাদ্য হলো উইলো গাছের ডাল, যার অন্যতম রাসায়নিক উপাদান হলো স্যালিসাইলিক অ্যাসিড। ফলে ক্যাস্টরপড ধোঁয়া অনেকটা অ্যাসপিরিনের কাজই করে।এখন স্যালিসাইলিক অ্যাসিডের সঙ্গে অ্যাসপিরিনের সম্পর্ক যদি না জানেন, তাহলে কিন্তু খেলবো না মাইরি!!
আর এই ক্যাস্টরিয়ামের আরো একটি ব্যবহার আছে, আইসক্রিমের ফ্লেভারের উপাদান হিসেবে!!
পরের বার যখন প্রিন্সেপ ঘাটের স্কুপে বসে, কাঁধে বান্ধবীর মাথা নিয়ে পড়ন্ত সূর্যাস্তের আলোতে গঙ্গার ঢেউ গুনতে গুনতে সাধের আইস্ক্রিমটির মুখের মধ্যে গলে যাওয়া অনুভব করবেন, হে পাঠক, সেই রম্যমুহূর্তে যদি বীভারের পশ্চাদ্দেশের ছবি আপনার মানসচক্ষে ভেসে ওঠে, জেনে রাখুন তার জন্যে কর্তৃপক্ষ দায়ী নহে!!
এইবার হারাধনের শেষ ছেলেটি, হায়ারাসিয়াম। 
হায়ারাসিয়াম কি, তা বলার আগে বলে নিই এই মূলগন্ধটির কাজ আগের গুলোর থেকে একটু আলাদা। এর কাজ হচ্ছে পারফিউমে 'মালিন্য' আনা। মানে তীব্র মিষ্টি, বা তীব্র লেবুগন্ধের মধ্যে একটু কড়া, বলতে গেলে সামান্য 'দুর্গন্ধ' এনে তাকে বাজারের উপযোগী করা। অনেকটা সহজ সরল সৎ গ্রাম্য ভালো ছেলেটি শহরে পড়তে এলে তাকে একটু বিয়ার, সামান্য গাঁজা, মালঞ্চতে দুপুরের শো ইত্যাদি দেখিয়ে অতিভালোমানুষিটা কাটিয়ে দেওয়া, এই টাইপের আর কি। 
এ ছাড়াও এর সবচেয়ে বড় গুনদুটির একটি হলো, বিভিন্ন পার্সেন্টেজে বিভিন্ন উপাদানের সঙ্গে মিশিয়ে হায়ারাসিয়াম অন্যান্য প্রানীজ গন্ধগুলি সৃষ্টি করতে পারে, সে সিভেটই হোক, বা মাস্ক, বা ক্যাস্টরিয়াম। এছাড়াও তামাকের মিষ্টি নেশাতুর গন্ধ বা আমাদের আগরগাছের গন্ধ তৈরি করতেও এর জুড়ি নেই। আর দ্বিতীয়টি হলো, এটি সংগ্রহ করার সময় কাউকে মারতেও হয়না, কাটতেও হয়, উৎপাদক প্রানীটি বরং এটি দিয়ে ভারি খুশিই হয়। আস্তে আস্তে ব্যাপারটা বলি দাঁড়ান। 
আফ্রিকাতে হায়রাক্স বলে একধরণের বীভারের সাইজেরই প্রাণী পাওয়া যায়, সাবসাহারান পার্বত্য অঞ্চলে থাকে বলে এর নাম রক হায়রাক্স। লোমওয়ালা প্রাণী, গোলগাল শেপের। এরা একধরণের প্রাইমাল ম্যামাল। মানে স্তন্যপায়ী প্রাণের উদ্ভবের সময়কার জিনিস। জীবজগতে এর সবচেয়ে কাছাকাছি আত্মীয় কে জানেন? বললে পেত্যয় হবে না দাদা, হাতি!! অনেকটা লেডি ডায়ানার ভাই উদয় চোপড়া কেস না? 
যাগগে, তা এদের শরীরে কোন গতিকে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মতন নিজের শরীরের তাপমাত্রা বাইরের তাপমাত্রার সঙ্গে ওঠানামা করানোর ব্যবস্থাটা মিস হয়ে গেছিলো। ফলে এদের স্বভাব হচ্ছে "আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি", মানে গায়ে গা ঘেঁষে উত্তাপ সঞ্চয় করে রাখা। ফলে এরা আরো একটা কাজও এক জায়গাতেই করে, প্রায়শই একসঙ্গেই, প্রাতঃকৃত্যাদি!! 
কি করে অমন একটি একান্ত ব্যক্তিগত নিভৃত কাজ পুরো যৌথখামার হয়ে উঠলো সে খবর নিই নি। একজনের 'পেলে' কি করে বাকি সক্কলের বা অনেকেরও 'পায়', সে খবরও আমার কাছে নেই। তবে ঘটনা এই যে এক একটি দলের ধাপা এক জায়গাতেই হয়। আর এইসব হিসিপটি কয়েকশো বা কয়েক হাজার বছর বাদে রোদে জমে কালো রঙের পাথুরে হয়ে ওঠে। তাকে চলতি ইংরেজিতে বলে 'আফ্রিকান রক'।
ওই জন্যেই বলেছিলাম, উৎপাদক প্রানীটি বরং এটি দিয়ে ভারি খুশিই হয়!!! দামেও শস্তা, কিলোপ্রতি চোদ্দোশো থেকে পনেরোশো টাকা।
তা এই আফ্রিকান রক হলো ভঙ্গুর রেসিন টাইপের বস্তু। ভাঙলে এর ভেতর থেকে ঘন কালচে বাদামি রঙের থকথকে লিকুইড বেরিয়ে আসে। তারপর তার সঙ্গে ৭০% অ্যালকোহল মিশিয়ে টিঙ্কচার তৈরি করে....বাকিটা তো এতক্ষণে জেনেই গেছেন।
বহুকাল থেকে এই আফ্রিকান রক সংগ্রহ করে পারফিউমের কাজে লাগানো হয়। এখন এর ব্যব্যহারের ওপর আরো জোর দেওয়া হচ্ছে, ক্যাস্টরিয়াম বা মাস্ক বা সিভেটের বদলে নৈতিক বিকল্প বলে।
তা আমার নটে গাছটি মুড়লো। পারফিউম কেনার আগে একটু দেখে নেবেন, কি জিনিস কিনছেন। আর যদি অ্যাডভেঞ্চারে মতি থাকে, তাহলে বাঁধাছাঁদা করে বেরিয়ে পড়ুন, কোথাও যদি ষষ্ঠ কোন প্রাণীজ পারফিউমের খোঁজ পান, তাহলে তো কেল্লা ফতে। কয়েকশো কোটি টাকা হাতের ময়লা দাদা, এই লিখে দিলাম। 
তা বেরোচ্ছেন নাকি? পেলে এই ছোট ভাইটিকে কিন্তু ভুলবেন না, কেমন?
আসুন, দুগগা দুগগা....


৪টি মন্তব্য:

  1. ষষ্ঠ তথা জ্যেষ্ঠ পান্ডব কর্ণের মত গন্ধের বাজারে প্রাণীজ উৎসের ছ'নম্বরে আছে মৌচাক, যেখান থেকে মধুর গন্ধ বের করে নেওয়া হয়।

    "মধুগন্ধে ভরা মৃদুস্নিগ্ধছায়া নীপকুঞ্জতলে শ্যামকান্তিময়ী কোন্‌ স্বপ্নমায়া ফিরে বৃষ্টিজলে ..."

    উত্তরমুছুন
  2. ওরে ব্যস দাদা ।যা দিলেন রসেবসে এ জনমে ভুলিবো না ।তথ্য সমৃদ্ধ লেখাটির জন্য ধন্যবাদ দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না ॥

    উত্তরমুছুন

Featured post

সোনালী মিত্র