ফুল পরী
কারই বা ডাক্তারখানা যেতে ভালো লাগে? তাও যদি বা শরীরখারাপ হতো তো তাকে সুস্থ করার তাগিদ থাকলেও বা না হয় কথা ছিল। কিন্তু কাজে ফেরত যেতে হলে তোমার ছোটবেলায় ক্লাস ওয়ানে (যখন “পাখীসব করে রব, ছোট খোকা বলে অ আ” পড়ছি ) সেই টীকা নিয়েছিলে কিনা, বড়বেলায় কোন দেশে গিয়েছিলে কিনা যেখানে গেলে ফিরে এসে ইনজেকশন নিতে হয়। বাপ-মায়ের একান্ন পুরুষের কি কি নাম জানা, বা না জানা রোগ ছিল জানলে তার ফিরিস্তি দাও। তারপরে ডাক্তারখানায় চেক করার নামে কি কাণ্ড যে চলে। নার্স তোমার ওজন দেখবে, কতো লম্বা হলে, নাকি বয়স হচ্ছে বলে আবার গুটিয়ে ভেতর দিকে সেঁধিয়ে যাচ্ছ তা দেখবে, সামনের সাদা দেওয়ালের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসবে, আর তুমি? ভেতরে ভেতরে ভাববে, “কিছু সন্দেহজনক ব্যাপার না কিরে বাবা”। ভয়ে ভেতরটা যত শুকিয়ে আসবে মনে পড়বে, আদা দিয়ে বানানো স্পেশ্যাল চা টা টেবিলে রেখে চলে এলাম আর উপবাসী পেটটা ভয়ে কেমন যেন মুচড়ে উঠবে ।
তারপরে লালাভ নাকেরএক মহিলা তার ঝকঝকে রুমে নিয়ে গিয়ে খরখরে এক কাগজের ড্রেস পরতে বলবে । যে ড্রেসের বোতামের বালাই নেই, যে চারটে শরকা-দড়ি ছাড়া আর কিছু চেনেনা। নড়তে গেলেই নতুন অরগ্যাণ্ডী শাড়ীর মত খসখসিয়ে কথা কয়ে ওঠে । সেখানে থান-ইটের সাইজের ছোট্ট লকার আছে, নিজের জামা কাপড়, চাবি, ব্যাগ রেখে লক করে তবে যাবার অনুমতি হবে পরের রুমে। ওই ছোট্ট লকারের সঙ্গে যুদ্ধ করে সব ভরতে ভরতে মনে হলকাগজের গাউন কাঁদতে কাঁদতে বলছে, “ছেড়ে দে মা আজকের মত, রিসাইকল বিনে যাই।“ আমার পরে আরও তিনজন এল, তাদের আমার চেয়েও করুণ অবস্থা দেখে দুঃখ না পেয়ে বরং মনটা একটু ভালো হয়ে গেল।
পরের ঘরে যখন গেলাম দেখি সে ঘর প্রায় অন্ধকার, ঢুকতেই সেই মহিলা বলল, “ এইখানে এসো, এমনি করে দাঁড়াও, কোমরটা বাঁকাও, ওইদিকে তাকাও...হ্যান করো, ত্যান করো”, যেন ফিল্মের জন্য পোজ দিচ্ছি। কথা না শুনলে যেন আমি বাচ্চা তেমন করে হাত, পা, কোমর বেঁকিয়ে, ঘুরিয়ে, দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। তারপরে মেশিন দিয়ে চেপে, ছবি তুলে তুলে, প্রায় আধমরা করে ছেড়ে দিল। ডাক্তারের কাছে যাবোনা বললেও শোনে কে। বাড়িতে, পাড়াতে ফুঁই কাটার লোকের অভাব নেই; তাদেরকে তো আর চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে যেতে হয়না, কিম্বা ইনজেকশনের সিরিঞ্জে ফুটো হয়ে যেতে হয়না । সব শেষে ওই কাগুজে রানীর ড্রেস ছেড়ে পরলাম নিজের নরম টি-শার্ট আর ক্যাপ্রি । জীবনে গালাগাল দিইনি কারোকে, বাড়ীর কড়া নজরে থাকতে থাকতে শেখার সুযোগ পর্যন্ত তেমন পাইনি, কিন্তু আজ সেই গন্ধমাখা গালাগাল জানিনা বলে খুব আপসোস হচ্ছিল । মনে হচ্ছিল, জম্পেশ করে গালাগাল দিতে পারলেও বেশ একটা অন্ধকার মত সুখ হত। কাকে? তা জানিনা। ভাগ্যকে নাকি নিজেকে।
“অন্য টেস্টগুলো পরে করবো” বলে ডাক্তারখানায় আমাকে সতর্ক না করে, কি একটা তেলতেলেমতো এক চামচ ওষুধটুক করে খাইয়ে দিয়েছিল আর ভেতর জুড়ে সব অন্ত্রগুলো বেরিয়ে আসার জন্য হাঁকুপাঁকু করছিল, একটা বিশাল হোয়াক শব্দ করে বমি করে সেটা তুলে দেবার কথা ভাবছিলাম । কিন্তু কিছু বেরোল না। কিসের টেস্ট করবে তাই জানিনা, কেন করবে, কি দরকার, কেউ আমাকে বলছে না । সবাই কি যেন বড় কিছু লুকোচ্ছে আমার কাছ থেকে। রাগ করে তাই ঠিক করলাম আজ আর সময় মতো বাড়ি যাবনা । অত লক্ষ্মীমন্ত সোনা পুচু হয়ে কাজ নেই। আজ আর বাড়িই ফিরবো না। যা পারিস করগে যা । যার যা খুশী করুক, ভেবে মরুক।
বাড়ি নইলে না গেলাম তবে যাবোটা কোথায় ?মা বাবা তো পৃথিবীতে আর নেই, ভাইয়েরা তো পাত্তাও দেয়না, দোকান যেতে আজকাল ভাল্লাগে না, বন্ধুরাও কাজে কাজে। অলরবলর করে খানিকক্ষণ হেথা হোথা ঘুরতে ঘুরতে এলাম লাইব্রেরীতে। সেখানে একটা নতুন দরজা দেখলাম। মনে হল ওই দরজা দিয়ে বেরোতে পারলেই আমার সব সমস্যার সমাধান হবে । যে দরজার অন্যদিকে আছে সেই ম্যাজিকাল পৃথিবী । যেখানে পৌঁছতে পারলে আর দুঃখ নেই, যন্ত্রণা নেই, রোগ-শোক-গ্রহদোষ-বুদ্ধি-বিপর্যয়-দারিদ্র্য বলে কিচ্ছু নেই, যেখানে গেলে পাওয়া যাবে গভীর শান্তি । এমনিতে এত বই পড়তে ভালোবাসি, আজ আর কিচ্ছু পড়তে মন যাচ্ছেনা । শুধু মনে হচ্ছে সব তাকভর্তি বই, ছবি, সিডি, কম্পিউটার, চেয়ার, টেবিল সব ফেলে হেলে ভেঙে ভুঙ্গে একাকার করে বেরিয়ে যাই । ভেতর জুড়ে সেই কষ্টটা আমাকে শুধু কুরে কুরে খাচ্ছে। যখন থেকে শুনেছি আমার একমাত্র বন্ধু, আমার প্রিয় বন্ধুর ব্রেনে টিউমার হয়ে তাতে ক্যান্সার হয়ে গেছে, সে আর মাত্র একমাস বেঁচে থাকবে তখন থেকে আমার ভেতরের নিবিড় শান্তি ভাবটা চলে গিয়ে এসেছে এই চরম অস্থিরতা, কেউ চেক করবো বললে খ্যাঁক করে উঠছি, মনে হচ্ছে, দ্যাখো আবার, কি কি গোলমাল আছে শরীরে সব বলবে এবার। লিস্ট বার করল বলে। এই রকম কষ্ট পাওয়া মনে কোন কাজ হয়? যাই করি, মন লাগেনা। মৃত্যুভয়ের চেয়ে একাকীত্বের ভয়, ভেজি হয়ে বেঁচে থাকার অভিশাপ.. ভেজিটেবল হয়েও কি আর শান্তি আছে, কিছু নরকের লোক তাদের ওই কোমায় মরে থাকা শরীরটাকেও রেপ করে...মেয়ে হয়ে জন্মানো যে কি অভিশাপ...বালবিধবা পিসীমার কথা যে কি সত্যি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
এলেবেলে ঘুরতে ঘুরতে এলাম সিটি অফিসের কাছে । তার পিছনেই জানি একটা পুটকি পারা বাগান আছে। অনেক ক্ষুদিপারা পোকা আর মশাও আছে, গেলেই যেন তাদের বাফের প্রিয় মেনু হয়ে দাঁড়াই । তবু যাই । গায়ে লাগানোর জন্য স্প্রে গাড়িতেই আছে, সব ভুলে মেরে দিয়ে গেলাম।
আগস্টের এই ধকধকে গরমে আর ফুল তেমন নেই, সব্জীও যা ফলেছিল, কারা নিয়ে চলে গেছে, দু একটা মাত্র হেলে পড়া গাছ আছে বেঁচে । মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছি শুকনো, শূন্য বাগানে। একজন হোঁৎকা পারা লোক কোত্থেকে উড়ে এসে বলল, “আমার বাড়িতে অনেক ফুলের আর সব্জীর গাছ আছে, যাবে? চলো, আজ একসঙ্গে লাঞ্চ করা যাবে। ”
আমি “কালা” এমন ভান করে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটা পুলিশের গাড়ী পাশ দিয়ে পেরিয়ে যেতে দেখে সে দুএকবার বিড়বিড় করে শুধিয়েই আর না জ্বালিয়ে কেটে পড়ল । ভাবলাম, এখানেও বদমাইশি? মানুষের, প্রকৃতির । দুমাস নইলে আসিনি, সব ফুল খেয়ে বসে আছে? প্রজাপতি নইলে নেই, কেন মৌমাছি, মথ, ফড়িং তাদেরও থাকতে নেই? এই তো তিনটে ফুল মাথা দোলাচ্ছে এই অরুচি-মার্কা গরমে? লক্ষ্য করিনি কখন মনের যন্ত্রণা চোখের জল হয়ে গড়িয়ে পড়ছে । আমি এমনিতে কাঁদিনা, একদম না। অন্ধকারের নির্জনতা ছাড়া, মাঝরাতের একাকীত্বে ছাড়া । একলা না হতে পারলে কিছুতেই না। আজ কি জানি কেন দুচোখ থেকে ঝরঝর করে গঙ্গা-যমুনা বইছে। পেট ব্যথা করছে কি প্রচণ্ড, পৃথিবী ঝাপসা তখন ।
হঠাত মনে হল, একটা হামিংবার্ডকে দেখতে পেলাম। বিশ্বাস হলনা। আজ দশ বছর ধরে নিজের হাতে রস বানিয়ে ওদের খাওয়াচ্ছি নিজের ব্যাক-ইয়ার্ডে, তারা কখনো ভুল করেও কাছে আসেনা, এমন কি ছবি তুলছি জানতে পারলেও ফাঁই করে উড়ে সবুজে মিশে যায় আর আজ দু ইঞ্চি দূরে...? ভুল দেখছি ভেবে দু-চোখ মুছে কচলালাম কয়েকবার, বার বার। না, ওদের ওই ডানা থেকে ভেসে আসা গানটিও শুনতে পাচ্ছি। সব ভুলে ভালো করে, পাঁচ ছয়বার ওই কান্নাভাসা চোখ মুছলাম, ওমা ডান হাতের কি কাছে বসে আছে। হাল্কা সবুজ সরু ডালে বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কি করবো বুঝতে পারলাম না, এই এক ফোঁটা ক্ষুদি পাখী, কত যে আকাঙ্ক্ষার, আর কি তার রূপ । যেন সকালটা তার রূপে জ্যোতির্ময় হয়ে উঠল । সেও তখনো আমার দিকে শুভদৃষ্টির মত মুগ্ধতাসহ তাকিয়ে আছে। ভাবতে পারছিনা, শুনেছি এই পাখী মনের ইচ্ছে পূর্ণ করে। এরা এলে নাকি সব সৌভাগ্য সঙ্গে করে আনে। তার মানে আমার আর ভাবনার কিছু নেই, যা পরীক্ষা হল, সব রেজাল্ট ভালোই আসবে । অসম্ভব হলেও বন্ধু ভালো হয়ে যাবে । তার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে দেখি জায়গাটা মথে, প্রজাপতিতে, মৌমাছিতে, ভোমরায় ভরে গেছে, এক একটা ফুলে চার পাঁচটা করে প্রজাপতি ও মথ বসছে...একটা প্রজাপতি এসে আমার বাহুতে যেখানে এক রাক্ষসী আজ ইনজেকশন দিয়েছে সেইখানে বসল একটু, যেন চুমু খেল, তারপরে উড়ে গেল। মনে পড়ল আমরা পাঁচটা ভাইবোন হলেও যখনি ব্যথা পেতাম, কষ্ট পেতাম পড়ে ছড়ে গিয়ে বা ঝগড়া করে, মা সব ব্যস্ততা সরিয়ে কোলে টেনে নিয়ে ব্যথার জায়গায় চুমু দিয়ে বলত, “এইবার সব ঠিক হয়ে যাবে।“ কেমন করে যেন ভালো হয়েও যেত তার ভালোবাসার জোরে । মা কি আজ ওই প্রজাপতির বেশে এসে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে দেখে চুমু খেয়ে গেল? ওই প্রজাপতিটাকে নাম দিতে ইচ্ছে হল, “ফুলপরী”, নাহলে সে কি করে জানবে আমার কোথায় “বুবু” হয়েছে, সেখানে আদর করবে কি করে? অনেক বছর পরে বাচ্চাদের মত মায়ের অভাবটা আবার বুকের মধ্যে চাড়া দিয়ে উঠল । মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে আবছা হয়ে গেল বন্ধুর বিপদের কথা, পেটের অসহ্য যন্ত্রণার কথা । মধুর এক ভালোবাসায়, তার এক চেনা আশীর্বাদে ভরে উঠলাম, যেন আবৃত হয়ে গেলাম আবার সেই নিবিড় শান্তির চাদরে । আর তক্ষুনি সাঁই করে উড়ে বেরিয়ে গেল হামিংবার্ডটা, ফিরে এল মাকিংবার্ড, সোনালী ফিঞ্চ, কাঠপাখীরা, লাল কার্ডিনাল । হলুদ প্রজাপতি আর সাদাকালো মথেরা হলুদ ফুলে বসে দুলে দুলে মধু খেতে লাগলো আর সেই সুযোগে মশাতে না সেই ক্ষুদি পোকাতে ছিঁড়ে খেয়ে দিল আমার পা দুটি । পা দুটো হুশ হুশ করে কামড়াতে কামড়াতে ফিরে এলাম প্রিয় গাজিবোর কাছে, সেখানে তখনো গোলাপি মার্টলের স্মৃতি, পুরনো কালের গল্পে ভরা একাকী আলোক-স্তম্ভ আর চেনা বন্ধুর মত চারদিক ঘিরে থাকা সবুজ গাছেরা আমার অপেক্ষায় ।
সুচিন্তিত মতামত দিন