নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত

মায়াজম
0
             আয়নায় হেরে যাওয়া মুখ








টা কে?বেশ ন্যাকা ন্যাকা মুখে তাকিয়ে আছে? যেন সব কিছু ঠিক ঠাক আছে। তাকাও আরে মুখ উঁচু করে তাকাও। হেরে যাওয়া। হ্যাঁ সম্পূর্ণ পরাস্ত। হেরে যাওয়া ভালো । সত্যি ভালো। আঙ্গুলে নিজের বলে যা যা ধরে রেখেছ সব বালির মতন ...।মুঠো খোলো হে।তোমার হৃদয়রেখা ,শিরোরেখা জুড়ে প্রবল বিষণ্ণতা-নিখাদ, অপূর্ব। এই সিমেন্ট, বালি,উড়াল পুল,শপিংমল,বস্তি,খাল,বিউটি পার্লারের পাস দিয়ে যেতে যেতে যদি মল্লিকা ফুলের গন্ধ পাও। বুক টা ধক্‌ করে ওঠে না?এক মন-কেমন বিকেলে তোমার মায়ের পাশে এক কিশোরী বলে না, “দিদা ঐ গান টা একবার বলেন- আমার মল্লিকা বনে ...”। 

 মল্লিকা । ওর বাবা মরে গিয়েছিল মদ খেয়ে , লিভার পচিয়ে। বিহারী পরিবারে সদ্য বিধবা মা “নষ্ট” হোল দেওরের সাথে। মল্লিকার একটা বোন হোল। তারপর লাথি, ঝাঁটা ঝগড়া, গালিগালাজ...। মল্লিকার মা ঐ বাড়ী ছেড়ে পাশের পাড়ায় চলে যায়। মল্লিকা আর ওর বোন কি ভাবে বড় হয় আমি জানি না। মল্লিকা এইটে পড়ে যখন তখন ওর সাথে দেখা। লোকের বাড়ী কাজ করে আর পড়ে। হোস্টেল ফেরত আমি বেকার। হেব্বি বিপ্লবী মনোভাব। দিদিগিরি শুরু করলাম। পড়তে শুরু করলো আমার কাছে। বন্ধুত্ব হোল। নাটক হোল। গান হোল। কিঞ্চিৎ রেজাল্ট ভালো হোল। কায়দা করে একবার রচনা লিখতে দিয়েছিলাম “মা”।ভেবেছিলাম লিখতে পারেনি ।লেখেনি।আমি বেশ জমিয়ে বলেছিলাম। “সবচেয়ে বড় সুরক্ষা হোল মা।”---“ মার মতো ভালোবাসা আর কেউ দেয় না” ।গান কবিতা গদ্যের বাইরে যে আরও কত রঙের পৃথিবী আছে সেটা আমি জানি না। ও সেটা ভোগ করতো।“আমার গান টা করেন দিদা” বলে মার কাছে ‘ মল্লিকা বনের’ আবদার করতো। কমলাপাড়ের সাদা শাড়ি পড়া আমার দিদিমনি মাকে জুঁইফুল হাসি দিয়ে বলতো , “আপনাকে কি সুন্দর লাগছে দিদা।”প্রাণপণে ভালো হাতের লেখা করছিল...।সুদকষা অঙ্ক অনুশীলন করছিল। একটা ভালবেসে এগিয়ে যাওয়া। 

আমি বিনে পয়সার টিউশানির সুখ ছেড়ে ঢঙ করতে কলকাতায় এলাম বি’এড পড়তে।এক ভোরবেলা জেঠু ফোন করে জানালো, “ মল্লিকা বিষ খেয়ে মারা গ্যাছে”। বিষ। তিন দিনের অভুক্ত পেটের ওপর ফলিডল। ছুটিতে বাড়ী গিয়ে জানতে পেলাম। জারজ ছোট বোনের সুরক্ষা চেয়ে ছিল সে। নিজের পেট সে নিজে চালিয়ে নেয় । ওর ঠাকুমা কাকা দাদারা পছন্দ করে না ওদের।মার কাছে দাবী করে সুরক্ষার। অর্ধাহারে থাকা মা জানায় সে পারবে না। তুলকালাম ঝগড়া হয়। শেষ অবধি মা বলে দেহব্যাবসা করবে নাকি সে বাচ্চা মানুষ করতে। আসলে সুরক্ষা । মা বলে জড়িয়ে থাকার আনন্দ । সেটাই চেয়ে ছিল বোধ হয়। মনে কষ্ট নিয়ে এ বাড়ী ও বাড়ী ঘুরে বেড়ায় তিন দিন। অভুক্ত। কাউকে কিছু বলেনি। তারপর...। 

পাড়াসুদ্ধ লোক ওর শেষযাত্রায় গিয়েছিল।গরীব মানুষ ওরা।চোখের জলে সেদিন সারা পাড়া চুপ হয়ে গিয়েছিল।আমাকে ডেকে ওর ঠাকুমা বলে দাহ করার আগে দেহ নগ্ন করে তেল ঘি মাখাবার যে নিয়ম ওকে টা করা হয় নি... কুমারী মেয়ে। কারো ছোঁয়া লাগেনি তার গায়ে। পাড়ার বৌদি বলেছিল, “তুই থাকলে হয়তো বিষ খেত না...তোকে ঠিক কিছু বলতো...”।পাড়ার বন্ধুনী রা বলেছিল , কিছু দিন আগে নাকি বলেছিল, “কি করে যে লোকে বিষ খায়... কি বাজে গন্ধ”। ঘুমের মধ্যে বহুদিন হাসি মুখ টা এসেছে।মেয়েটা একেবারে নাই হয়ে গেল। শুনতে পাই মল্লিকার বোন এখন মায়ের কাছে থাকে।

উহ্‌ আমার নিজের ওপর খুব রাগ হয় । কোথায় আমি যেন তার মৃত্যুর জন্যে দায়ী বলে মনে হয়। ও তো বেশ ছিল ওর “ না পাওয়া নিয়ে” । আমি আমার সৌখিন পৃথিবীর ভালোবাসা স্নেহ এই সব নিয়ে না জানালে হয়তো কষ্টের বোধ টা তৈরি হতো না ওর।না পাওয়া নিয়ে দিব্যি থাকতো। এঁটো পাতার মতন জীবন হয়তো অন্য কোন ভাবে সফল হতো। আর আমি ? আমি কোথায় ক্ষমা চাইবো। ভালো বই পড়ার বদভ্যাসে অনেক ভালো ভালো কথা কপচাতে পারি । এখন খুব ভয় পাই।ওসব কথা অনেক সময় অনেক কিছু কেড়ে নেয়। এই লেখা টা লিখতে গিয়ে চোখে অনেক নুন এলো। আর বুক টা খুব ভারী হোল। 
ফিরে আয় না ,মল্লিকা।সব সময় মা সব দায় নিতে পারে না। সেও মানুষ। সব সময় ভালবাসতে পারে না। কিংবা ভালোবাসে ,কিন্তু আগলাতে পারে না। 

এখন তুই থাকলে হয়তো মা হয়ে যেতিস। তুই খুব ভালো মা হতিস। 
একবার মরে গেলে সত্যি আর ফিরে আসা যায় না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)