অনির্বান বন্দ্যোপাধ্যায়

মায়াজম
3
                         জ্যোতিষ না শাস্ত্র না বিজ্ঞান





র্তমানে জ্যোতিষবাবুরা জ্যোতিষকে শাস্ত্র বলে চালাতে চায়, অনেকে আবার একটু দুঃসাহসিক হয়ে বিজ্ঞানও বলে থাকেন। বেদে জ্যোতিষশাস্ত্রের কথা নেই।বৈদিক যুগে জ্যোতিষ বলতে বোঝাত দিন, বছর, ঋতু ইত্যাদির গণিতসিদ্ধ বিচার পদ্ধতি।সেখানে আছে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থানের সঙ্গে বৃষ্টি ও কৃষি সম্বন্ধীয় বিষয়। এই গ্রহ-নক্ষত্রদের সঙ্গে মানুষের ভাগ্য যুক্ত করা হয়নি।এই জ্যোতিষে ভবিষ্যকথন নেই, ভাগ্যকথা নেই, গ্রহ-নক্ষত্রের অহেতুক রাগরোষের কথা নেই। শুভাশুভ বিচার মুখ্য নয়। সংখ্যার রহস্যে আরোপ নেই। এই জ্যোতির্বিজ্ঞান গ্রিস যাযাবরদের হাত ধরে জ্যোতিষ হয়ে গেল।বস্তুত ভারতে গ্রিক শাসনের অবসানের পর রেখে গেছে মূর্তিপুজোর ধারণা, গণিত এবং অবশ্যই জ্যোতিষ।গ্রিকদের এই জ্যোতিষের মধ্যেই যেমন জ্যোতির্বিদ্যা ছিল, ছিল ঋতুকাল নির্ণয়।তেমনই গ্রহ-নক্ষত্র ইত্যাদি মানুষের ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণের আজগুবি বকওয়াস।এই বকওয়াসের জনক ছিলেন ব্যাবিলনের রাজারা, যাঁরা একইসঙ্গে পুরোহিত। তৎকালীন সমাজে ধর্মযাজকরাই শাসক হতেন। সম্ভবত ইরানের আয়াতোল্লা খোমেইনিই ছিলেন সর্বশেষ ধর্মীয় শাসক।যাই হোক, ব্যাবিলন থেকে গ্রিস, গ্রিস থেকে ভারতে সংক্রামিত হল জ্যোতিষ-ভণ্ডামি।আলেকজান্ডারের আগমনের পর থেকে ষষ্ঠ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ সময়কাল ‘ফলিত-জ্যোতিষ’, অর্থাৎ মানুষের ভাগ্য গণনার বকওয়াস পদ্ধতি ভারতে টিমটিম করত -- যত দিন যাচ্ছে,  মানুষের চাহিদা বাড়ছে, না-পেয়ে হতাশ হচ্ছে ততই জ্যোতিষীবাবুদের রমরমা বাড়ছে। গলিতে গলিতে এখন জ্যোতিষী গড়াচ্ছে। হোর্ডিংয়ে ছড়াছড়ি। কত জ্যোতিষবাবু সরকারি চাকরিও করছেন, তৎসহ অতিরিক্ত রোজগার করছেন হাত দেখে, পাথর বেচে। অফিসের কলিগদের কাছেও পাথর বেচছেন। অথচ তৎকালীন সময়ে এইসব গ্রিক যাযাবর সম্প্রদায়ের মানুষরা ব্রাত্য বা পতিত বলে বিবেচিত হত (‘বৃহৎসংহিতা’ পড়ুন)।বৈদিক যুগে যে ভাগ্য বিচার ছিল ব্রাত্য, সেই ব্রাত্য সমাজের উঁচুস্তরে উঠে এসেছে এক শ্রেণির অন্ধ মানুষদের জন্য।
ভারতীয় জ্যোতিষীদের কাছে বরাহমিহিরই ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্রের জনক। তিনিই ভারতীয় ফলিত-জ্যোতিষের, অর্থাৎ গ্রহ-নক্ষত্রের সঙ্গে ভাগ্যযুক্ত তত্ত্ব আদলটি সৃষ্টি করেন। কোন্ গ্রহদোষ কাটাতে কোন্ রত্ন ধারণ করতে হবে সেটাও বরাহমিহিরের মস্তিষ্কপ্রসূত। বরাহমিহিরের সময়কালে ফলিত-জ্যোতিষকে ‘যবনশাস্ত্র’ বলা হত।আর্যরা এদেরকে ঘৃণা করতেন। গ্রিক যাযাবরেরাই মানুষের ভূত-ভবিষ্যৎ বলে রোজগার করত, পেট চালাত। বস্তুত সমাজে ভাগ্য-গণকদের কোনো মর্যাদা ছিল না। ‘ম্লেচ্ছ’ বলে অবজ্ঞা করা হত।অবশ্য ভাগ্য-গণকদের হয়ে বরাহমিহিরই এগিয়ে এলেন। বরাহমিহির বুঝলেন মানুষের ভূত-ভবিষ্যৎ বলে দিলে মানুষ খুব খুশি হয়। মানুষকে খুশি করলে রোজগারও মন্দ হয় না। অতএব বরাহমিহিরই ভাগ্য-গণকদের জাতে তুলতে উঠেপড়ে লাগলেন।কিছু বইপত্রও লিখে ফেললেন।মনে রাখতে হবে, এই বরাহমিহিরই আর্যভট্টের আহ্নিক গতি তত্ত্ব মানতেন না।আর্যভট্টের সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ তত্ত্বও বিশ্বাস করতেন না।আমরাও কি আর্যভট্টের সিদ্ধান্ত বা তত্ত্ব মানলাম ! যদি মানতাম তাহলে আর্যভট্টের চাইতে বরাহমিহির কিংবদন্তি হতে পারত না। ভারতে আজ আর্যভট্ট চরম উপেক্ষিত, অপরদিকে বরাহমিহিরের পুজো হচ্ছে।বরাহমিহিরের মতো ব্রহ্মগুপ্তও আর্যভট্টকে মানতেন না। ব্রহ্মগুপ্ত আর্যভট্টের গ্রহণতত্ত্বকে না-মেনে রাহু-কেতুর গল্পকেই বিশ্বাস করতেন। ভাবা যায়, ইনিই নাকি ষষ্ঠ শতকে ভারতীয় বিজ্ঞান চর্চায় বিশিষ্ট ব্যক্তি !
বিজ্ঞানের কিছু প্রাচীন শাখার মতো জ্যোতির্বিজ্ঞানও একটি সময় পর্যন্ত জ্যোতিষশাস্ত্রের মতো অপ-বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। ভেবে দেখুন তো, কেমিস্ট্রি মানে রসায়ন ছিল অ্যালকেমি বিদ্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত।কারণ প্রাচীনকালে পর্যবেক্ষণের সীমাবদ্ধতা ও গাণিতিক হিসাব পদ্ধতি অনুন্নত থাকার ফলে সে সময় ব্যক্তি বিশ্বাসের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ তালগোল পাকিয়ে এ ধরনের অপ-বিজ্ঞানের জন্ম নেয়। যাই হোক, সেই সময়কার মানুষজন রাতের আকাশ দেখে বুঝতে পেরেছিল যে, বছরের বিভিন্ন সময়ে কিছু নিদিষ্ট নক্ষত্রমণ্ডলের আবির্ভাব ঘটে। এসব পর্যবেক্ষণ তাদেরকে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সম্পর্কে বেশ আগে থেকেই পূর্বাভাস দিতে পারত। যেমন মিশরের প্রাণ নিলনদের বন্যা বছরের একটি নিদিষ্ট সময়ে হত এবং বন্যায় ভেসে আসা পলিতে উর্বর জমিতে ভালো চাষ হত। একটি নিদিষ্ট নক্ষত্রমণ্ডলে সূর্যের অবস্থানই তাদের বন্যার আগমনের কথা জানান দিত। এইভাবে ক্রমেই তারা চন্দ্র–সূর্য-নক্ষত্রের নিয়মবদ্ধ চলাচল আবিষ্কার করেছিল এবং আকাশে চন্দ্র–সূর্য–নক্ষত্রের অবস্থান ধীরে ধীরে তাদের ধর্মীয়, সামাজিক রীতিনীতিতে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। আকাশে চন্দ্র-সূর্য-নক্ষত্রের নিয়মবদ্ধ চলাচল আবিষ্কার হওয়ার ফলে ‘বর্ষপঞ্জি’ তৈরি হয়। কোথাও তৈরি হয় সৌর বর্ষপঞ্জি, আবার কোথাও চন্দ্র বর্ষপঞ্জি ।সুমেরীয়রা ও ব্যাবিলনীয়ানরাই প্রথম বছরকে ১২ টি মাসে ভাগ করে ।জ্ঞাত তথ্য অনুযায়ী বিভিন্ন মাসে বিভিন্ন নক্ষত্র মণ্ডলের উপস্থিতি দেখে ব্যাবিলনীয়ানরাই ৭০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে সর্বপ্রথম রাশিচক্র প্রণয়ন করে ।পরে তা মহাবীর আলেকজান্ডারের হাত ধরে মিশর, গ্রিসে, ভারতে আসে। এছাড়া ব্যাবিলনীয়ানরা ৭৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দেই তখনকার আবিষ্কৃত পাঁচটি গ্রহের সুশৃঙ্খল ও ধারাবাহিক তালিকা প্রণয়ন করেন। এর প্রায় ৯০০ বছর পর এই তালিকা ব্যবহার করে টলেমি গণিত সহযোগে ভূকেন্দ্রিক মানে পৃথিবী কেন্দ্রিক বিশ্ব মডেলের ধারণা দেন। কোপার্নিকাসের পূর্ব পর্যন্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানে এই মডেলের ব্যাপক প্রভাব ছিল। আর এটিই এখন জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রামাণ্য মডেল। এই টলেমিতেই জ্যোতির্বিজ্ঞান আর জ্যোতিষশাস্ত্র মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।একদিকে তার ‘আলমেজেস্ট’ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক অনন্য গ্রন্থ, অপরদিকে তাঁর ‘টেট্রাবিবলস’ জ্যোতিষশাস্ত্রের একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসাবে ব্যবহৃত হয়, বলতে গেলে এটি জ্যোতিষীদের কাছে বাইবেলের মতো। অর্থাৎ, সে সময় একই ব্যক্তি একসঙ্গে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষশাস্ত্র চর্চা করত। আর সে সময়ের রাজা বাদশাহদের জ্যোতির্বিজ্ঞানের বদলে জ্যোতিষশাস্ত্রে পৃষ্ঠপোষকতা এর অন্যতম একটি কারণ। তবে জ্যোতিষশাস্ত্র থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞান আলাদা বা স্বতন্ত্র  হতে শুরু করল ষোড়শ শতকে কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক সৌর মডেলের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে।এর ফলে টলেমির ভূকেন্দ্রিক মডেল বাতিল হয়ে যায়। তবে মোটা দাগে বলতে গেলে কেপলারের (১৫৭১-১৬৩০) পর থেকেই এই দুটি বিষয় পৃথকভাবে চর্চা হতে শুরু করে। কেপলারের সকল কাজ জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর হলেও তাঁর মাঝে জ্যোতিষশাস্ত্রের ভালো রকমের চর্চা লক্ষ করা যায়। পর্যবেক্ষণ ও গাণিতিক হিসাব পদ্ধতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কোপার্নিকাস, টাইকো, কেপলার, গ্যালিলিওদের হাত ধরে ধারাবাহিক ক্রমবিকাশের মাধ্যমে জ্যোতির্বিজ্ঞান তাঁর আজকের অবস্থানে এসেছে। অপরপক্ষে ধীরে ধীরে রাজতন্ত্র বিলোপ এবং জ্যোতিষীদের রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় উপস্থিতি, কদর হ্রাস পেতে থাকলে এই শাস্ত্রটির ব্যাপক ভাবে সামাজিকীকরণ ঘটে।
কাকে বলবেন ! ভূত তো সরষের মধ্যেই ঢুকে বসে আছে। আমাদের দেশে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে তাবড় তাবড় শিক্ষিতজন বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত জ্যোতিষ বিশ্বাস করে, এরাও কোনো যুক্তি-ব্যাখ্যা-কার্য-কারণের ধার ধারে না। এ যেন আর্ক লাইটের নীচে দাঁড়িয়ে নিজেই নিজের গায়ে কালি ঢেলে দেওয়া। সেই কারণে এরাও দিন-ক্ষণ-তিথি-নক্ষত্র বিচার করেই বিয়ে-শ্রাদ্ধ-অন্নপ্রাশন-গৃহপ্রবেশ করে থাকেন। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীও দিন-ক্ষণ মেনেই প্রধানমন্ত্রীর সিংহাসনে বসেন। চলচ্চিত্রের পরিচালক- অভিনেতাও দিন-ক্ষণ দেখেই শুভ মহরৎ করেন। এমনকি সেই মুভি যদি জ্যোতিষ ও জ্যোতিষীদের বিরুদ্ধেও হয়, সেটাও দিন-ক্ষণ দেখেই হবে। দিন-ক্ষণ-তিথি-নক্ষত্রের কথাই যখন উঠল, তাহলে বাঙালিদের একমাত্র প্রিয় গ্রন্থ ‘পঞ্জিকা’ নিয়ে আলোকপাত করা যাক। এমন একটি বাঙালি হিন্দুঘর পাওয়া যাবে না, যাঁর ঘরে ‘পঞ্জিকা’ নেই। অবশ্য শুধু বাঙালি-হিন্দু নয়, ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও ‘শুভদিন’ দেখার প্রথা আছে।
বর্ষপঞ্জি বা পঞ্জিকাকে বাদ দিয়ে ধর্মপ্রাণা ভিতু মানুষদের এক দণ্ডও চলে না। জ্যোতিষবাবুদের মতেপঞ্জিকা’ বছরের প্রতিদিনের তারিখ, তিথি, শুভাশুভ ক্ষণ, লগ্ন, যোগ, রাশিফল, বিভিন্ন পর্বদিন ইত্যাদি সংবলিত গ্রন্থ। একে পঞ্জি বা পাঁজিও বলা হয়। প্রাচীন  সংস্কৃত সাহিত্যে একে বলা হয়েছে ‘পঞ্চাঙ্গ’। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও এটি এই নামে পরিচিত। এর কারণ এতে বার, তিথি, নক্ষত্র, যোগ ও করণ প্রধানত এই পাঁচটি অঙ্গ থাকে। বাংলায় অবশ্য এটি ‘পঞ্জিকা’ নামেই সুপরিচিত। সভ্যতা বিকাশের শুরু থেকেই সমাজসচেতন ব্যক্তিদের চিন্তা-চেতনায় কালবিভাগের ধারণাটি আসে। প্রয়োজনের তাগিদে তখন বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন উপায়ে বছর, মাস, দিন ও তারিখ গণনার কৌশল আবিষ্কৃত হয়। কালক্রমে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনের পাশাপাশি পূজা-পার্বণের সময় নিরূপণও পঞ্জিকা প্রণয়নের অন্যতম লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। কালনিরূপণে বিভিন্ন দেশে ভিন্নরকম পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে। বৈদিক যুগের ঋষিরা বিভিন্ন ঋতুতে নানারকম পূজা-পার্বণ করতেন। সেই কারণে তাঁরা বিশেষ ঋতুবিভাগের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করেন। এসব উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তাঁরা ঋতুভিত্তিক বছর হিসাব করে বছরকে উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়ন এই দু-ভাগে ভাগ করতেন। সূর্য উত্তরদিকে আগমন করা থেকে উত্তরায়ণ এবং দক্ষিণদিকে যাত্রা করা থেকে দক্ষিণায়ন গণনীয় হত। প্রাচীন মনীষিগণ বছরকে বারো ভাগে বিভক্ত করেন। যেমন -- তপঃ, তপস্যা, মধু, মাধব, শুক্র, শুচি, নভস্, নভস্য, ইষ, ঊর্জ, সহস্ ও সহস্য। তপঃ থেকে শুচি পর্যন্ত উত্তরায়ণ এবং নভস্ থেকে সহস্য পর্যন্ত দক্ষিণায়ন। অনুমান করা হয় যে, এরূপ সময়বিভাগ যর্জুবেদের কালে (১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) প্রচলিত ছিল। তিথির প্রচলন হয় অনেক পরে। শুধু সেই সময়কালে পূর্ণিমা, অমাবস্যা ও অষ্টকা ব্যবহৃত হত। কৃত্তিকা নক্ষত্র থেকে গণনা করে ২৭টি বা ২৮টি নক্ষত্রে ভূচক্রকে বিভক্ত করা হত। এটাই এতদঞ্চলের পঞ্জিকা গণনার আদিরূপ। বৈদিক সাহিত্যে ফাল্গুনী পূর্ণিমার উল্লেখ পাওয়া যায়। এতে অনুমিত হয় যে, তখন চান্দ্রমাস গণনার প্রচলন ছিল, যা পূর্ণিমান্ত মাস নামে পরিচিত।
১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি পঞ্জিকায় বছর আরম্ভ হত উত্তরায়ণ দিবস থেকে এবং তাতে ১২টি চান্দ্রমাস ব্যবহূত হত। এই পঞ্জিকায় ৩০টি তিথি এবং ২৭টি নক্ষত্র গণনার নিয়ম ছিল। তখন প্রতি পাঁচ বছরে একটি যুগ গণনা করা হত এবং এক যুগ পরপর এই পঞ্জিকা গণনার পদ্ধতি আবর্তিত হত। ওই সময় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তিথ্যন্ত প্রভৃতি কাল গণনার পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি। মাত্র মধ্যমমানে প্রতিদিন এক তিথি এক নক্ষত্র এই হিসেবে তিথ্যাদি নির্ণয় করা হত এবং মাঝে মাঝে এক-একটি তিথি হিসাব থেকে বাদ দেওয়া হত। পঞ্চবর্ষাত্মক যুগ ব্যতীত কোনো অব্দ গণনার প্রথা তখনও প্রবর্তিত হয়নি। দেড় হাজার বছর ধরে কালগণনা ও পূজা-পার্বণের সময় নিরূপণের কাজে এরূপ বেদাঙ্গজ্যোতিষ পঞ্জিকা খুবই সমাদৃত ছিল। গবেষকরা খ্রিস্টীয় চতুর্থ বা পঞ্চম শতকে তাঁরা সূক্ষ্ম গণনার কৌশল আয়ত্ত করেন। এসব বিষয়ে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তাঁরা হলেন আর্যভট্ট, বরাহমিহির, ব্রহ্মগুপ্ত প্রমুখ। তাঁরা পঞ্জিকার গণনাকে জ্যোতির্বিদ্যার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং তিথ্যাদির সূক্ষ্ম কালগণনার সূত্রাদি দ্বারা দৈনিক গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান, লগ্ন, ক্ষণ, তিথি প্রভৃতির পূর্তিকাল পঞ্জিকার মধ্যে পরিবেশনের ব্যবস্থা করেন। এতে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সহজেই পঞ্জিকা থেকে পাওয়া যেত। এক্ষেত্রে সূর্যসিদ্ধান্ত জ্যোতির্বিদ্যার একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও মূল্যবান গ্রন্থ। পরে সূর্যসিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই পঞ্জিকার সবকিছু গণনা করা হত। পঞ্জিকার মধ্যে তখন স্থান পেত বার, তিথি, নক্ষত্র, যোগ ও করণযুক্ত প্রতিদিনের পঞ্চাঙ্গ এবং তা তালপাতায় লিপিবদ্ধ করে গণকঠাকুর বা ব্রাহ্মণরা বছরের প্রারম্ভে গ্রামে-গঞ্জে গিয়ে মানুষদেরকে অবহিত করতেন বা জনগণের সুবিধার্থে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এর অনুলিপি সংরক্ষণ করতেন। এসবের ভিত্তিতে পূজা-পার্বণাদি বা ধর্মকৃত্য সাধনের কালও নির্ণয় করা হত।
সিদ্ধান্ত জ্যোতিষশাস্ত্রের উদ্ভবের আগে পঞ্জিকায় দৈনন্দিন গ্রহাবস্থান লেখা হত না। ক্রমে ক্রমে পঞ্চাঙ্গের সঙ্গে গ্রহসঞ্চারকালও পঞ্জিকায় লিপিবদ্ধ হতে থাকে। বিগত ১০০ বছরের অধিককাল যাবৎ বাংলা পঞ্জিকা মুদ্রিত হচ্ছে। পঞ্জিকায় এখন ফলিত জ্যোতিষের অনেক কিছু অর্থাৎ গ্রহ-নক্ষত্রের দৈনিক অবস্থানসমূহও পাওয়া যাচ্ছে। এখনকার পঞ্জিকায় ফলিত জ্যোতিষও বিশেষ স্থান দখল করেছে। জনগণের চাহিদার দিকে দৃষ্টি রেখে এখন পঞ্জিকায় বর্ষফল, মাসফল, রাষ্ট্রফল, দৈনিক রাশিফল প্রভৃতি মুদ্রিত হচ্ছে।
প্রাচীনের মধ্যে স্মার্ত  রঘুনন্দন সম্পাদিত নবদ্বীপ পঞ্জিকার নাম পাওয়া যায়। রঘুনন্দনের পরে এর গণনার দায়িত্ব পালন করেন যথাক্রমে রামরুদ্র বিদ্যানিধি (রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সময়ে) এবং বিশ্বম্ভর জ্যোতিষার্ণব। কিছুদিন পরে এর গণনাকার্য বন্ধ হয়ে যায়। ইংরেজ আমলে কৃষ্ণনগরের জনৈক সমাহর্তার প্রচেষ্টায় বিশ্বম্ভর পুনরায় পঞ্জিকা প্রকাশের কার্যক্রম আরম্ভ করেন। এটি তখন পুথির আকারে লিখিত হত। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে পঞ্জিকাটি মুদ্রিতাকারে প্রকাশিত হতে থাকে। তখন এটিই ছিল প্রথম মুদ্রিত পঞ্জিকা। পরবর্তীকালে ১২৯৭  বঙ্গাব্দ (১৮৯০) থেকে বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা প্রকাশিত হতে থাকে। অনুরূপ পঞ্জিকা বোম্বাই ও পুনা থেকেও প্রকাশিত হয়। পঞ্জিকার সর্বশেষ সংস্কার করা হয় ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকারের তত্ত্বাবধানে। প্রখ্যাত বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার সভাপতিত্বে একটি পঞ্চাঙ্গ শোধন সমিতি (ক্যালেন্ডার রিফর্ম কমিটি) গঠন করে প্রচলিত পঞ্জিকাগুলির গণনাপদ্ধতির নিরীক্ষা ও প্রয়োজনবোধে সংস্কারের জন্য সুপারিশ করা হয়। এই সমিতির পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পঞ্জিকা প্রকাশনার দায়িত্ব গ্রহণ করা হয়। সে মতে ভারতে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে পঞ্জিকা প্রকাশিত হতে থাকে। বর্তমানে তা ১২টি ভাষায় প্রকাশিত হচ্ছে। বাংলা পঞ্জিকায় বাংলা, ইংরেজি ও হিজরি সনের তারিখ, মাস ও বছরের উল্লেখ থাকে। বাংলা বর্ষপঞ্জি গণনার সনাতন নিয়মে কোন্ বছরের কোন্ মাস কত দিনে হবে তা আগে থেকে নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। তা ছাড়া উক্ত গণনাপদ্ধতিতে কোনো মাস ২৯ দিনে আবার কোনো মাস ৩২ দিনে হয়ে থাকে। এ বিষয়টিকে জীবনের সর্বত্র বাংলা সন ব্যবহারের প্রধান অন্তরায় হিসাবে বিবেচনা করে ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে মোহম্মদ শহিদুল্লাহর সভাপতিত্বে একটি সংস্কার কমিটি গঠন করা হয়। উক্ত সংস্কার কমিটির প্রস্তাব অনুসারে বছরের প্রথম ৫ মাস ৩১ দিনের এবং পরবর্তী ৭ মাস ৩০ দিনের করা হয়। ১৯৮৮ সাল থেকে সরকারিভাবে খ্রিস্টীয় সনের পাশাপাশি বাংলা সন লেখার রীতি চালু হয় এবং তখন থেকে শহিদুল্লাহ কমিটির প্রস্তাবিত গণনাপদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গে বাংলা বর্ষপঞ্জির সম্পৃক্তির বিষয়টি মনে রেখে এবং প্রস্তাবিত গণনাপদ্ধতিকে সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত ও গ্রেগরীয় বর্ষগণনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার লক্ষ্যে একই বছর বাংলা একাডেমিতে একটি শক্তিশালী বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। পঞ্জিকাকে আরও উন্নত ও ত্রুটিমুক্ত করার জন্য ১৯৯৫ সালে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রেরণায় একটি ‘টাস্ক ফোর্স’ গঠন করা হয়। পঞ্জিকা সংস্কারের জন্য তাদের সুপারিশ ছিল এরকম – (১) সাধারণভাবে বাংলা বর্ষপঞ্জি বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত প্রতিমাস ৩১ দিনে এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র পর্যন্ত প্রতিমাস ৩০ দিনে গণনা করা হবে। (২) গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির অধিবর্ষে যে বাংলা বছরের ফাল্গুন মাস পড়বে, সেই বাংলা বছরকে অধিবর্ষরূপে গণ্য করা হবে এবং সেই বছরের ফাল্গুন মাস ৩১ দিনে গণনা করা হবে। (৩) ১৪০২ সালের ১ বৈশাখ থেকে এটি কার্যকর হবে এবং তারিখ পরিবর্তনের সময় হবে আন্তর্জাতিক রীতি অনুসারে রাত ১২টায়। জনকল্যাণে গৃহীত এ পদক্ষেপ সর্বত্র প্রশংসিত হয়।
পঞ্জিকার ক্ষেত্রে চাঁদের তিথি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হয়। পূর্ণ চান্দ্রমাসের স্থায়িত্ব ২৯ দিন ১২ ঘণ্টা, ৪৩ মিনিট ১২ সেকেন্ড বা ২৯.৫ দিন। চাঁদ ৩৬০ ডিগ্রি অতিক্রম করে ২৯.৫ দিনে, তা হলে এক দিনে অতিক্রম করে ৩৬০ ÷ ২৯.৫ = ১২.২০ ডিগ্রি, অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টায় অতিক্রম করে ১২.২০ ডিগ্রি। তার মানে এক দিনের চাঁদ পশ্চিম দিগন্তের ১২.২০ ডিগ্রি ওপরে ওঠে। আবার চাঁদ যখন অস্ত যায় তখন ১ ডিগ্রি অতিক্রম করতে সময় লাগে ৪ মিনিট, তা হলে ১২.২০ ডিগ্রি অতিক্রম করতে লাগে ১২.২০ x ৪ = ৪৮.৮০ মিনিট এবং সর্বোচ্চ ৫০.৫২ মিনিট বা ৫১ মিনিট। অর্থাৎ প্রথম দিনের চাঁদ ৫১ মিনিটের বেশি পশ্চিম আকাশে থাকতে পারে না।
এই হল পঞ্জিকা। বস্তুত তিথি ও দিনের অংশকে বিভিন্ন করণ এবং যোগ নাম দিয়ে, তাদের শুভ অথবা অশুভ হিসাবে নির্ণয় করা সম্পূর্ণভাবে কল্পনাবিলাস, অবৈজ্ঞানিক জ্যোতিষগিরি ! একটু আলোচনা করা যাক।মূলগতভাবে ভারতে দুই প্রকারের পঞ্জিকা দেখা যায়। একটি দৃকসিদ্ধ, অপরটি অদৃকসিদ্ধ। বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত, রাষ্ট্রীয় পঞ্চাঙ্গ ইত্যাদি হল দৃকসিদ্ধান্ত। অন্যটি গুপ্তপ্রেস, পি এম বাগচি ইত্যাদি পঞ্জিকাগুলি অদৃকসিদ্ধ (বাংলাদেশের হিন্দু বাঙালিরা ‘লোকনাথ ডাইরেক্টরি পঞ্জিকা’ এবং মুসলিম বাঙালিরা ‘মোহাম্মদী পকেট পঞ্জিকা’ অনুসরণ করেন)। দূরবীন দিয়ে দেখা জ্যোতিষ্কদের অবস্থানের সঙ্গে গণিতের অবস্থানের সমন্বয় সাধনের নিরন্তর প্রক্রিয়ার ফলে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এফিমেরিসে অবস্থানগত নির্ভুল তথ্যাদি পাওয়া যায়। দৃকসিদ্ধ পঞ্জিকা জ্যোতিষ্কদের অবস্থান সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এফিমেরিস থেকে সংগ্রহ করা হয়।প্রতিনিয়ত সব তথ্য আপডেট হয়ে থাকে। অপরদিকে, আনুমানিক ৪০০ খ্রিস্টাব্দে রচিত ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ গ্রন্থের উপর ভিত্তি করেই অদৃকসিদ্ধান্ত পঞ্জিকার প্রণেতাদের যত দৌড়াদৌড়ি।সূর্যসিদ্ধান্ত যে সময় রচিত হয়েছিল তখনও পর্যন্ত দূরবীন আবিষ্কার হয়নি।খালি চোখে জ্যোতিষ্কদের কতটুকু দেখা যায়! বস্তুত অদৃকসিদ্ধ পঞ্জিকার প্রণেতারা সূর্যসিদ্ধান্ত অনুসারে যে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান গণনা করেন তা প্রকৃত অবস্থানের সঙ্গে এক্কেবার মেলে না। কারণ বিশাল মহাকাশে গ্রহদের নির্ভুল অবস্থান জানার জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানের ‘অয়নচলন’ সূর্যসিদ্ধান্ত গ্রন্থে নেই। অদৃকসিদ্ধান্ত অনুসারে সূর্যগ্রহণ এবং চন্দ্রগ্রহণ নির্ণয় করলে সব গুবলেট হয়ে যাবে। তাই এঁরা সূর্যগ্রহণ এবং চন্দ্রগ্রহণ নির্ণয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের নিয়ম অনুসারেই করে থাকেন। এসব ক্ষেত্রে অদৃকসিদ্ধান্তের প্রণেতাদের একমাত্র অবলম্বন ‘বাণবৃদ্ধিরসক্ষয়’।‘বাণবৃদ্ধিরসক্ষয়’ সূত্র অনুসারে তিথি বৃদ্ধি ৬৫ দণ্ডের বেশি এবং তিথি হ্রাস ৫৪ দণ্ডের কম হবে না, জ্যোতির্বিজ্ঞান এ সংজ্ঞা মেনে চলে না।
আমাদের পঞ্জিকায় যেন দেবতার বাণী। পঞ্জিকা ছাড়া এক পা-ও চলতে পারে না। কতটুকু মানেন ? ঠিক যতটুকু ব্যক্তিগতভাবে কোনো অসুবিধা হয় না ততটুকুই। সামান্যতম অসুবিধা থাকলে নিকুচি করেছে পঞ্জিকার ! অতএব নৈব নৈব চ। পঞ্জিকা বলছে – রবিবারের পঞ্চম, সোমবারের দ্বিতীয়, মঙ্গলবারের ষষ্ঠ, বুধবারের তৃতীয়, বৃহস্পতিবারের সপ্তম, শুক্রবারের চতুর্থ, শনিবারের যামার্দ্ধ এগুলিকে বলে কালবেলা। কালবেলা মানে, এ সময় যাত্রা করলে মৃত্যু হয়, বিবাহ দিলে কন্যার মৃত্যু হয়, মাথা ন্যাড়া করলেও মৃত্যু অনিবার্য। কে আছেন ? কোন্ নিকম্মা মেনে চলেন এসব নিষেধাজ্ঞা ? ভাবুন তো, বলছে আপনি যদি এমন কোনো বারে সেই বারের অধিপতির দিকে পিছন ফিরে যাত্রা শুরু করে, তাহলে তার মৃত্যু ঠেকায় কে ! কে ঠেকায় জানি না। তবে আমি নিজে বহুবার এ ধরনের যাত্রা করেছি। কিন্তু এখনও পর্যন্ত বহাল তবিয়তেই আছি। দিকশূলের বিধান শুনবেন নাকি ? শুনুন – রবিবার ও শুক্রবারে পশ্চিমদিক, মঙ্গলবার ও বুধবারে উত্তরে, সোমবার ও শনিবারে পূর্বে এবং বৃহস্পতিবারে দক্ষিণে যাত্রা করলে ভয়ানক বিপদ। ‘যাত্রা নাস্তি’ বলছে যে ! বিবাহ প্রকরণে বলছে – দিনের বেলা বিয়ে করা চলবে না। দিনের বেলায় বিয়ে করলে কন্যা পুত্রকন্যাবিবর্জিতা হন, বিরহানলদগ্ধা ও স্বামীঘাতিনী হয়, উচ্চবর্ণের কোনো মেয়েকে যদি নিম্নবর্ণের ছেলে বিয়ে করে তাহলে নির্ঘাত মৃ্ত্যু। আমি প্রত্যন্ত গ্রামে-গঞ্জে দেখেছি রাত্রিবেলা অভ্যাগত অতিথিদের জন্য নিরাপদ নয় বলে দিনেরবেলাতেই বিয়ে সহ সমস্ত মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয় । অন্যান্য ধর্মেও বিয়ে অনুষ্ঠান দিনেরবেলাতেই হয়। এ নিয়ম এ বিধান যদি বুজরুকি না-হয়, তাহলে তো গ্রাম-গঞ্জ-অন্য ধর্মের সমাজ তো বিধবায় ভরে যেত, পুত্রকন্যাহীনা কন্যায় ভরে যত সেসব অঞ্চল।এখানেই শেষ নয়, পঞ্জিকা বলছে – “সুখপ্রসবমন্ত্র অশত্থপত্রে লিখিয়া প্রসূতির কেশের সহিত বাধিয়া দিলে প্রসবে কষ্ট হয়না।” হয়েছে নাকি এমন কোনো মিষ্টিমধুর অভিজ্ঞতা, কোনো অভিজ্ঞতা ? এমন ঘটনা কি ঘটেছে কারোর, কখন আপনার সন্তান যন্ত্রণাহীন ভূমিষ্ঠ হয়ে গেছে আপনি বুঝতেই পারেননি ?
সাহা পঞ্জিকা কমিটির প্রস্তাব অনুসারে ভারত সরকার বাংলা দৃকসিদ্ধ পঞ্জিকা ‘রাষ্ট্রীয় পঞ্চাঙ্গ’ রচিত হয়।রাষ্ট্রীয় পঞ্চাঙ্গতেও সংযোজিত হয়েছে পৈতে, অন্নপ্রাশন, বিয়ের দিনক্ষণ, গণ-দশা, শুভাশুভ বিচার। দৃকসিদ্ধ পঞ্জিকা ‘বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত’-এ পাওয়া যাবে শুভদিনের নির্ঘণ্ট, তর্পণবিধি, নিত্যপূজাবিধি, জ্যোতিষ বচনার্থ, শবদাহ ব্যবস্থা, ব্যক্তিগত বর্ষফল, রাষ্ট্রগত বর্ষফল, স্তব-কবচ প্রকরণ, ব্রত প্রকরণ ইত্যাদি।ভাষাচার্য সুকুমার সেন পঞ্জিকা বা পাঁজি  প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন – প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের পাঁজির মূল পার্থক্য হল, আমাদের পাঁজি ধর্মকর্ম করার জন্য। ওদের পাঁজি জ্যোতির্বিজ্ঞানের চর্চা করে। পাওয়া যায় কবে জোয়ারভাটা হবে, কোনদিন চাঁদের আলো পাওয়া যাবে, কোনদিন চাঁদের আলো পাওয়া যাবে না ইত্যাদি।অপরদিকে আমাদের পাঁজি জ্যোতিষবিজ্ঞানের চর্চা করে।তার সঙ্গে শ্রাদ্ধ-শান্তি জাতীয় পারফরমেন্স মিলেছে। তাই বলি আমাদের পাঁজিটা বুজরুকি।
আমি কালিদাস নামে এক জ্যোতিষবাবুকে জানতাম তিনি হাত-পা দেখতেন না, তিনি কেবলই রাশি রাশি কোষ্ঠী তৈরি করতেন। বেশিরভাগ হাত-পা দেখা জ্যোতিষবাবুরা কোষ্ঠী তৈরি করেন না। ওটা করা নাকি খুবই হ্যাপা ! তাই অন্য কোনো অভিজ্ঞ জ্যোতিষবাবুকে দিয়ে অল্প কিছু অর্থের বিনিময়ে করিয়ে নেন। কোষ্ঠীর বিজ্ঞান-অপবিজ্ঞান নিয়ে আলোচনার আগে জ্যোতিষবাবুরা কী বলছেন সেটা দেখে নিই।
কোষ্ঠী হল জন্মপত্রিকা। এতে নবজাতকের জন্মসময়ে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান ও সঞ্চরণ অনুযায়ী তার সমগ্র জীবনের শুভাশুভ নির্ণয় করা হয়। খ্রিস্টপূর্বকালে ভারতবর্ষে কোষ্ঠী গণনার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের পরে শাকদ্বীপ (পারস্য-কান্দাহার-সাইথিয়া-কাশ্মীরের উত্তরের দেশ) থেকে আগত জনগোষ্ঠী এ দেশে কোষ্ঠী গণনা পদ্ধতি প্রবর্তন করে বলে মনে করা হয়। খ্রিস্টীয় ছয় শতকের ভারতীয় জ্যোতিষী বরাহমিহিরের গ্রন্থে কোষ্ঠীপদ্ধতির প্রথম পরিচয় পাওয়া যায়। তাই অনুমান করা হয়, এর দু-তিনশ বছর পূর্বে ভারতবর্ষে কোষ্ঠী গণনা শুরু হয়। কোষ্ঠী গণনা পাশ্চাত্যের অনেক দেশেও প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত আছে। কোষ্ঠী গণনার ক্ষেত্রে রাশি, গ্রহ ও লগ্ন তিনটি প্রধান বিষয়। মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট, সিংহ, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, মকর, কুম্ভ ও মীন – এই বারোটি রাশি  এবং রবি, চন্দ্র, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, রাহু ও কেতু – এই নয়টি গ্রহকে একটি চক্র বা ছকে বারোটি প্রকোষ্ঠে এ রাশিগুলি দেখানো হয়। পরে  পঞ্জিকা অনুযায়ী জাতকের জন্মকালে গ্রহগুলির রাশিভিত্তিক অবস্থান নির্ণয়পূর্বক উক্ত চক্র বা ছকে রাশি অনুযায়ী গ্রহগুলির নামের আদ্যক্ষর লেখা হয়। এরপর লগ্ন নির্ণয় করে লগ্নবোধক রাশিটিকে ‘লং’ শব্দ দ্বারা নির্দেশ করলেই জন্মপত্রিকা তৈরি হয়ে যায়।
কোষ্ঠী গণনার এই চক্র বা ছকের অঙ্কনপদ্ধতি সর্বত্র একরকম নয়। ভারতবর্ষেই তিন রকম এবং পাশ্চাত্যে অন্যরকম। দক্ষিণ ভারত ব্যতীত অন্য সব স্থানের চক্রের গতি বামাবর্তী। বঙ্গদেশ ও দক্ষিণ ভারতের রাশিচক্র স্থির -- মেষ রাশি থাকে সর্বদা শীর্ষদেশে এবং লগ্ন পরিবর্তনশীল। কিন্তু উত্তর ভারত ও পাশ্চাত্যে রাশিচক্র স্থির নয়, যে-কোনো স্থানে রাশি অবস্থান করতে পারে, তবে লগ্ন সর্বদাই একটি নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে। উত্তর ভারতের ছকে লগ্ন থাকে শীর্ষদেশে এবং পাশ্চাত্যে থাকে বাম পাশে।প্রতিটি রাশির নির্দিষ্ট অধিপতি গ্রহ থাকে, যেমন মকর ও কুম্ভ রাশির অধিপতি শনি, মীন ও ধনু রাশির বৃহস্পতি, মেষ ও বৃশ্চিক রাশির মঙ্গল, বৃষ ও তুলা রাশির শুক্র, মিথুন ও কন্যা রাশির বুধ, কর্কট রাশির চন্দ্র এবং সিংহ রাশির রবি। লগ্ন হল সূর্য কর্তৃক মেষাদি রাশি সংক্রমণের মুহূর্ত, অর্থাৎ সূর্য যখন যে রাশিতে অবস্থান করে তখন লগ্নও হয় সে রাশির নামানুসারে। যেমন সূর্যের মেষ রাশিতে অবস্থানকালে যদি কারও জন্ম হয় তাহলে তার লগ্ন হবে মেষলগ্ন। লগ্নের মেয়াদ হল দুই ঘণ্টা, অর্থাৎ দুই ঘণ্টা পরপর লগ্ন পরিবর্তিত হয়। কোষ্ঠী তৈরির সময় এ রাশি, গ্রহ ও লগ্ন নির্ণয়ে কোনোরূপ ভুল হলে জাতকের ভবিষ্যৎ গণনাও ভুল হবে। কোষ্ঠী অনুযায়ী কারও ভবিষ্যৎ গণনার সময় তার জীবনের বিভিন্ন ঘটনা বারোটি ভাগে ভাগ করা হয়, যার নাম ‘ভাব’। বারোটি ভাব হচ্ছে তনু (শরীর), ধন, সহজ (সহোদর), বন্ধু (এবং মাতা), পুত্র (এবং বিদ্যা), রিপু (এবং রোগ), জায়া (বা স্বামী), নিধন (মৃত্যু), ধর্ম (এবং ভাগ্য), কর্ম (এবং পিতা), আয় ও ব্যয়। যে রাশিতে লগ্ন অবস্থিত সেখান থেকে তনুর বিচার শুরু হয়, তারপর পর্যায়ক্রমে অন্যান্য ভাব গণনা করা হয়। কোষ্ঠীবিচারের এসব মূল সূত্র প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সর্বত্রই প্রায় একরকম। তবে ভারতীয় জ্যোতিষে একটি বিশেষ বিষয় হল দশা গণনা পদ্ধতি। জাতকের ভবিষ্যৎ জীবনে কখন কী ঘটবে তা এ পদ্ধতিতে নির্ণয় করা হয়। জাতকের জন্মনক্ষত্র অনুযায়ী দশা নির্ণীত হয়। দশা গণনার ৪২ রকম পদ্ধতি থাকলেও অষ্টোত্তরী ও বিংশোত্তরী পদ্ধতি দুটিই বেশি ব্যবহৃত হয়। অতীতে সম্ভ্রান্ত পরিবারে নবজাতকের কোষ্ঠী তৈরি একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল। কোষ্ঠী তার জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিশেষত বিবাহের ক্ষেত্রে গুরুত্ব সহকারে বিচার করা হত। পাত্রপাত্রী উভয়ের কোষ্ঠী বিচার করে কোনো বিষয়ে কোনো অশুভযোগ দেখা না-গেলে তবেই তাদের মধ্যে বিবাহ অনুষ্ঠিত হত। বর্তমানে কোষ্ঠী তৈরির তেমন প্রচলন না-থাকলেও জন্মানোর ও জন্মক্ষণ অনুযায়ী রাশি নির্ণয় করে হস্তরেখাবিদগণ মানুষের ভাগ্যগণনা করে থাকেন এবং  হস্তরেখাবিদ্যা এখন একটি প্রায়োগিক বিদ্যা হিসেবে সমাজে প্রচলিত। (কৃতজ্ঞতা : দুলাল ভৌমিক)
জটিলতা এবং অনিশ্চয়তায় ভরা আমাদের জীবন।জীবন ছোটোই হোক কিংবা বড়ো – অনেক চড়াই-উৎড়াই পথ বেয়ে চলতে হয় সকলকে।অনেক ঘটনার স্রষ্টা আমরা নিজেরা হলেও, সব ঘটনাই আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না।তবে আপনি আমগাছ পুঁতলে কখনোই সেই গাছে আম না-ফললেও জাম ফলতে পারে না।ফলাতেও পারবেন না।যেমনভাবে জীবন গড়বেন ফল পাবেন তেমনই। খুব বেশি অন্যথা হয় না, যদি ফাঁকি না-থাকে।কোষ্ঠীতে যাই-ই লেখা থাক, সব বদলে যাবে আপনার অধ্যবসায়ে। কত বদলে যায় এরকম ! কোষ্ঠীতে লেখা অনেক কিছুই মেলে না। আমরা মেলানোর ভান করি। ছল করি। যা মেলে তাতে মানুষের কিছু যায় আসে না। কোষ্ঠীতে হয়তো আছে ২৩ বছর বয়সে জাতক/জাতিকা মাথার কোনো সমস্যা হতে পারে। দেখা গেল ২৩ বছর বয়সে জাতকের পিতৃবিয়োগ হওয়ার দরুন মস্তক মুণ্ডন করতে হল। কোষ্ঠী পিতৃবিয়োগের সংবাদ আগাম না-জানাতে পারলেও মাথার মুণ্ডন অবস্থাকে ‘মাথার সমস্যা’ বলে মিলিয়ে দেওয়া যাবে !
সিন্ধুলিপি এখনও পড়তে পারিনি ঠিকই, কিন্তু মানুষের বিধিলিপি পড়ে ফেলতে জ্যোতিষবাবুরা খুবই পটু। আপনার মৃত্যু পর্যন্ত জ্যোতিষবাবুরা দেখতে পান কোষ্ঠী-কোডে। চ্যানেলে চ্যানেলে কী আওয়াজ তাঁদের ! সব ভেক ধরে বসে আছে ছক হাতে ছকবাজিতে।  কোষ্ঠী যে সম্পূর্ণ ভাঁওতা তা আমি প্রবন্ধের শুরুতেই আকাশবাণীর ঘটনাতেই (দুর্ঘটনাই বলতে পারেন) জানিয়েছি।
শুধু হাত-পা দেখলেই কি জ্যোতিষবাবুদের পেট মানবে ! শুধু হাত দেখে বেড়ানো মানে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো বোঝায়। তাই হাত দেখে জাতককে খুশি করার জন্য যতই ভালো ভালো কথা বলি-না কেন, মন্দ কথা তো বলতেই হবে। আপনাকে ভয় পাইয়ে দিতে না-পারলে আমার রোজগার আসবে কোত্থেকে ! পাথর বেচতে না-পারলে ফায়দা কীসের ? আপনি ভিখারি হবেন, আমার অট্টালিকা। সেটা অবশ্য আপনার আর্থিক অবস্থা কেমন সেটা আঁচ করে নেওয়া হবে। তারপর রবি, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শুক্র, রাহু, কেতু – যেকোনো একটার অবস্থা খুব খারাপ এবং খারাপ থাকার জন্য আপনার ভয়ংকর হতে পারে। যদি পাথরের ব্যবস্থা নেন – তবে আপনি মামলা-মোকদ্দমায় জিতে যাবে, আপনার বা আপনার ছেলের বা মেয়ের চাকরি হয়ে যাবে, স্বামী বা স্ত্রী পরকীয়া ছেড়ে ঘরে ফিরে আসবে ইত্যাদি। ঘরের সোনা বিক্রি করেই হোক বা জমি জমি বিক্রি করেই হোক, পাথর যে আপনাকে ধারণ করতেই হবে। জ্যোতিষবাবু বলেছেন !  কত রকম ভয় দেখিয়ে যে জ্যোতিষবাবুরা পাথর বেচেন, তা বলে শেষ করা যাবে না। সত্যিই পাথর পারে এসব করে দিতে ? পাথর কী ?
রত্নের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরদিনের। সুপ্রাচীন কাল হতে রত্ন-পাথর ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মানুষ বিশেষ ভাবে মূল্য দিয়েছে রত্নকে আজও দিচ্ছে। পান্না, হীরা, মুক্তা, পোখরাজ, ওপ্যাল, গোমেদ ইত্যাদি রত্ন-পাথরগুলোর বেশীর ভাগই খনিজ পদার্থ। যুগ যুগ ধরে প্রচন্ড চাপ ও তাপে ভূগর্ভে সৃষ্টি হয়ে থাকে রত্ন-পাথর। সে কারণেই প্রাকৃতিক বা খাঁটি রত্নগুলো দুষ্প্রাপ্য ও মূল্যবান। অনেক সাধারণ মানুয়ের ক্রয়ক্ষমতা ও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। আসল রত্নের মূল্য প্রচুর। রাজা-বাদশারাই সেগুলি ব্যবহার করতে পারে। যেমন কোহ-ই-নুর বা কোহিনুর হিরে। একরকম বহু মূল্যবান রত্ন মণিমাণিক্য দিয়ে রাজা-বাদশা-রানিদের মুকুট, কোমরবন্ধ, বাজুবন্ধে খোচিত করে বারফাট্টাই দেখাত। কোন্ রাজা কত শৌখিন কত তাঁর রত্নভাণ্ডার আছে তা দেখানোর আয়োজন চলত পোশাকে-মুকুটে।কোহিনুর হিরে ছিল শাহজাহানের অহংকার, এখন ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথের অহংকার।
সেই মহামূল্যবান রত্নের মর্যাদা এখন গ্রহশান্তির জন্য তলানিতে এসে ঠেকেছে। এখন ঠগ-প্রতারক জ্যোতিষীবাবুদের রুজিরোজগারের পথ দেখাচ্ছে।রত্ন (Gems) এখন পাথরে  (Stone) এসে জলের দামে বিকোচ্ছে। মামলা-মোকদ্দমা জিতিয়ে দিচ্ছে, সন্তানের চাকরি পাইয়ে দিচ্ছে, মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে, অশান্ত সংসারে শান্তি ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে। মুরগি, থুড়ি রোগীদের মহামূল্যের রত্ন ব্যবহার করতে বললে তো সব অজ্ঞান হয়ে যাবে। তাই ভুখা থেকে চোখা – সকলেই যাতে পাথর কিনে ব্যবহার করতে পারে তার ব্যবস্থা হল। আধুনিক প্রযুক্তি আজ এগিয়ে এসেছে রত্নকে সুলভ করার কাজে।যাতে জ্যোতিষবাবুরা খেয়েপড়ে বেঁচে থাকে। কৃত্রিম উপায়ে রত্ন-পাথর তৈরি করতেও সক্ষম হয়েছে মানুষ।ফলে তৈরি করা সম্ভব হয়েছে কৃত্রিম রত্ন, যেগুলি সৌন্দর্যে প্রাকৃতিক রত্নের মতোই। কৃত্রিম রত্ন তৈরি হওয়ার ফলে রত্ন-পাথর চলে এসেছে সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার নাগালের ভিতর এবং পাওয়া যাচ্ছে দেশে দেশে। কৃত্রিম রত্ন তৈরির প্রচেষ্টাটি প্রচীনকালেও ছিল। প্রাচীন মিশরীয় এবং রোমানদের তৈরি বিভিন্ন রকম নমুনা জাদুঘরে দেখা যায়। তবে সেগুলি গুণগত মানে ও রূপে অক্ষম। কৃত্রিমভাবে তৈরি রত্ন-পাথরকে কয়েকটি সম্পূর্ণ আলাদা দলে বিভক্ত কর যায়। যেমন -- (১) ইমিটেশন অর্থাৎ নকল রত্ন।(২) সিনথেটিক অর্থাৎ সংশ্লেষিত রত্ন এবং(৩) কৃত্রিম ভাবে তৈরি ডাবলেট রত্ন। (১) ইমিটেশন বা নকল রত্ন প্রাকৃতিক রত্নের অনুকরণেই করা হয়। চোখে দেখার মিলটুকু ছাড়া আর কোনো অর্থেই এরা প্রাকৃতিক বা আসল রত্নের মতো সাধারণত হয় না। এতে একই রকম দেখতে অন্য জিনিসকে সুকৌশলে রত্নের মতো করে তোলা হয়। কিছুটা আসলের মতোই এই রত্ন প্রচুর তৈরি করে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। এদিক থেকে এদের উপযোগিতা আছে বৈকি।ইমিটেশন বা নকল রত্নের অধিকাংশ তৈরি হয় বিশেষ ধরনের কাঁচ থেকে। এ কাঁচ যেন খুব বিশুদ্ধ হয়, ক্ষুদ্র বাবলস বা বুদবুদ ইত্যাদি থেকে মুক্ত হয়, সে ব্যাপারে বিশেষ যত্ন নেওয়া হয় প্রাকৃতিক বা খাঁটি রত্নের মতো অনুরূপ রং দেওয়ার জন্য গলিত অবস্থায় এ কাঁচের সঙ্গে বিভিন্ন রকম ধাতব অক্সাইড মেশানো হয়। যেমন নীলের জন্য -- কোবালট অক্সাইড, সবুজের জন্য -- কুৎপ্রিক অক্সাইড, বেগুনির জন্য -- ম্যাঙ্গানিজ অক্সাইড ইত্যাদি। কাঁচকে বিভিন্ন তলে ঘষে কাটা প্রাকৃতিক রত্নের রূপ ও ঔজ্জ্বল্য দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এ সব কাটা তলের নিম্ন পৃষ্ঠগুলিতে অনেক সময় আয়নার মতো প্রতিফলকের ব্যবস্থা করা হয় যাতে প্রাকৃতিক বা আসল রত্নের দীপ্তিও খানিকটা আসে। এ ধরনের নকল রত্নকে অবশ্য প্রাকৃতিক রত্ন থেকে আলাদা করা মোটেই কোনো কঠিন কাজ নয়। এরা কম শক্ত বলে অনায়াসে এদের গায়ে আঁচড় কাটা যায়। খনিজ বা প্রাকৃতিক রত্নের তুলনায় এদেরকে স্পর্শে উষ্ণ অনুভূত হয়। আলোর প্রতিসরণাঙ্কের ক্ষেত্রেও এদের সঙ্গে প্রাকৃতিক রত্নের অনেক তফাত। তা ছাড়া এক্সরে ছবি নিলেই বোঝা যায় যে নকল রত্নের সত্যিকার কোনো কেলাসিত রূপ নেই।
(২) অপরদিকে সংশ্লেষিত রত্ন সব অর্থেই প্রাকৃতিক রত্নের অনুরূপ। প্রকৃতিতে ধীরে ধীরে তৈরি না-হয়ে এটি বিভিন্ন উপাদানের সংশ্লেষণে যন্ত্রপাতির মাধ্যমে তৈরি হয়, এই অর্থেই শুধু এটি কৃত্রিম। বস্তুগত দিক থেকে, যেমন রাসায়নিক গঠন, কেলাসন, আলোকগুণ এবং অন্যান্য সব ভৌত গুণে এরা প্রাকৃতিক রত্নের সঙ্গে অভিন্ন। সংশ্লেষিত রত্ন তৈরি অনেক বেশি ব্যয়সাপেক্ষ, তাই শুধু দামি রত্নগুলির ক্ষেত্রেই এটি করা হয়। আজকাল সংশ্লেষিত হিরে, চুনি, নীলা, পান্না সবই পাওয়া যাচ্ছে। সংশ্লেষিত হিরের একটি সুবিধা হল একে ইচ্ছামতো রঙিন করা সম্ভব নানা রকম বিজাতীয় পদার্থের স্বল্প অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে। প্রথমদিকে কৃত্রিম হিরের আকার এত ছোটো হত যে তা রত্ন-পাথর হিসাবে ব্যবহারের উপযুক্ত ছিল না। কিন্তু সত্তরের দশক থেকে আকারে ও সৌন্দর্যে রত্ন হওয়ার উপযুক্ত হিরে সংশ্লেষিত হচ্ছে, এদের উৎপাদন ব্যয়ও ধীরে ধীরে কমে আসছে। চুনি ও নীলা আসলে একই রত্ন-পাথর, শুধু এদের রংটুকু ছাড়া অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের প্রবাহের মাধ্যমে সৃষ্ট তীব্র উত্তাপে অ্যালুমিনিয়াম অক্সাসাইডের গুঁড়োকে গলিয়ে এবং পরে তাকে কেলাসিত হতে দিয়ে চুনি ও নীলা সংশ্লেষিত করা হয়। তৈরির সময় সঙ্গে পরিমাণমতো ক্রোমিয়াম অক্সাইড মেশালে তা চুনির লাল রং হয়। আবার এর বদলে টিটানিয়াম অক্সাইড দেওয়া হলে সৃষ্টি হয় নীল রঙের নীলা। ১৯৩০ সালে প্রথম পান্না তৈরি সম্ভব হয়।(৩) কৃত্রিম ডাবলেট রত্নগুলি হল এতে উপরে সত্যিকার রত্নের পাতলা করে কাটা একটু আবরণ থাকলেও তাকে জুড়ে দেওয়া হয় নকল অথবা নিকৃষ্ট রত্নের ব অংশের সঙ্গে। ডাবলেট রত্ন তৈরি করার কৌশলটিও কিন্তু বেশ লক্ষণীয়। এতে উপরের পাতলা দামি রত্নের অংশ নীচের নকল অংশের সঙ্গে উপযুক্ত আঠা দিয়ে জুড়ে দেওয়া হয়। হিরের ডাবলেটের ক্ষেত্রে পাতলা আসল হিরে, জারকন অথবা রক ক্রিস্টালের মতো অপেক্ষাকৃত সস্তা। কিন্তু অনুরূপ কেলাসের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। অন্যান্য দিক থেকে একইরকম দেখতে হলেও চুনি, নীলা বা পান্নার ডাবলেটের জন্য সাধারণত উপরে এলমেডাইন নামক স্বচ্ছ কেলাসের পাতলা আবরণ এবং নীচে সঠিক রঙের কাঁচ ব্যবহৃত হয়।
কৃত্রিম রত্ন আধুনিক প্রযুক্তির একটি চমৎকার সুকৌশল। ইমেটেশন বা নকল রত্ন ও কৃত্রিম ভাবে তৈরি ডাবলেট রত্ন-পাথরগুলি বিচার-বিশ্লেষণের অনুপযুক্ত।
যদিও আসল রত্ন আপনি কোনোদিন দেখতে পাবেন না দু-একটা ছাড়া (কারণ সেগুলি পাথর নয়), তবুও সুযোগ পেলে রত্ন-পাথর আসল কি নকল  কীভাবে বুঝবেন সেটা জেনে নেওয়া যেতেই পারে।বাজারে নানারকম রত্ন-পাথর পাওয়া যায়। চোখ ধাঁধিয়ে যায় তাদের রং আর উজ্জল বর্ণচ্ছটার আভা দেখলে। জ্যোতিষবাবু কিংবা জুয়েলারি থেকে যে রত্ন-পাথরটি কিনছেন হাজার হাজার টাকা গাঁটগচ্ছা দিয়ে, সেসব রত্ন-পাথরের ভিড়ে কী করে চেনা যাবে কোনটা আসল । রত্ন-পাথর আসল কি নকল বোঝার জন্য অভিজ্ঞ চোখ প্রয়োজন। প্রথমত, রত্ন-পাথরের আকৃতি, রং, স্বচ্ছতা ও এর ভিতর সুক্ষ্ণ যেসব অবাঞ্চিত পদার্থ থাকে, তার বিন্যাস দেখে প্রাথমিক ধারণা তৈরি করতে হবে।এ ব্যাপারে সঠিক ধারণা পাওয়ার জন্য অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্য নিতে হবে। তবে রত্ন-পাথর যাচাই করার সব চেয়ে ভাল উপায় হল রত্ন-পাথরের প্রতিসরণাংক (Refractive Index)যাচাই করা। রত্ন-পাথরের প্রতিসরণাংক জানা থাকলে তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে রত্ন-পাথরের সঠিক পরিচয় পাওয়া সম্ভব। কারণ কোনো বিশেষ রত্ন-পাথরের প্রতিসরণাঙ্ক নির্দিষ্ট, এর হেরফের বিশেষ দেখা যায় না। যেমন হিরের প্রতিসরণাংক ২.৪১৭। এ ছাড়া বিচ্ছুরণ (Dispersion)ধর্ম যাচাই করেও রত্ন-পাথর আসল কিংবা নকল তা যাচাই করা সম্ভব। তাছাড়া রত্ন-পাথরের কাঠিন্যতা (hardness), আপেক্ষিক গুরুত্ব (Specific gravity) ইত্যাদি ধর্ম যাচাই করে সহজেই নকল ও আসল রত্ন-পাথর চেনা যায়।
আসল রত্ন রাসায়নিক বিশ্লেষণ করলে – (১) চুনি বা Ruby : লাল রঙের এই রত্নটির বৈজ্ঞানিক নাম কোরান্ডাম (Corundum), অ্যালুমিনিয়াম এবং অক্সিজেনই হল এর মূল উপাদান (AI2O2)। (২) নীলা বা Blue Sapphire : নীল বা হলুদ রঙের এই রত্নটির বৈজ্ঞানিক নামও কোরান্ডাম (Corundum), অ্যালুমিনিয়াম এবং অক্সিজেনই হল এর মূল উপাদান (AI2O2)।(৩) পান্না বা Emerald : সবুজ বা স্বচ্ছ রঙের এই রত্নটির বৈজ্ঞানিক নাম বেরিল (Beryl)।বেরিলিয়াম, সিলিকন, অক্সিজেন এবং অ্যালুমিনিয়াম হল মূল উপাদান (3BeO.AI2O3,6SiO2)। (৪) বৈদুর্যমণি বা Cats Eye : হলুদ বা সবুজ বা খয়েরি রঙের রত্নটির বৈজ্ঞানিক নাম ক্রাইসোবেরিল (Chrysoberyl)। বেরিলিয়াম, অক্সিজেন, অ্যালুমিনিয়াম এই রত্নটির মূল উপাদান (BeO.AI2O2)।(৫) গোমেদ বা Garnet : লাল বা বাদামি বা কমলা রঙের এই রত্নটির বৈজ্ঞানিক নাম গারনেট (Garnet)।লোহা, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, সিলিকন এবং অক্সিজেনই মূল উপাদান [(Ca,Mg,Fe)3AI2(SiO4)3]।(৬) চন্দ্রকান্ত বা Moon Stone : ধূসর রঙের এই রত্নটির বৈজ্ঞানিক নাম ফেলসপার (Feldspar)।পটাশিয়াম, সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, সিলিকন এবং অক্সিজেন এই রত্নটির মূল উপাদান (KAISi3O8NaAISi3O8CaAI2SiO8)। (৭) সূর্যকান্তমণি বা Sun Stone : স্বচ্ছ এই রত্নটির বৈজ্ঞানিক নাম কোয়ার্টজ (Quartz)।মূল উপাদান সিলিকন, অক্সিজেন (SiO2)।(৮) সন্ধ্যামণি বা Amethyst : স্বচ্ছ এই রত্নটির বৈজ্ঞানিক নাম কোয়ার্টজ (Quartz)।মূল উপাদান সিলিকন, অক্সিজেন (SiO2) (৯) পোখরাজ বা Sapphire : স্বচ্ছ বা হালকা হলুদ বা হালকা নীল রঙের এই রত্নটির বৈজ্ঞানিক নাম টোপাজ (Topaz)।মূল উপাদান অ্যালুমিনিয়াম, সিলিকন, অক্সিজেন, হাইড্রোজেন এবং ফ্লোরিন [AI2SiO4(OH/F)2](১০) নীলকান্তমণি বা Tarquous : অস্বচ্ছ নীল বা নীলাভ সবুজ  রত্নটির বৈজ্ঞানিক নাম টারকোয়েস (Tarquous)। কপার, ফসফরাস, অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, ফ্লোরিন হল মূল উপাদান [CuO(AI2O3(P2O3)2, 9H2O]।(১১) বৈক্রান্তমণি বা Zircon :  অস্বচ্ছ এই রত্নের বৈজ্ঞানিক নাম জারকন (Zircon)।মূল উপাদান জার্কনিয়াম, সিলিকন ও অক্সিজেন (ZrSiO4)।(১২) মুক্তা বা Pearl : এটি খনিজ পদার্থ নয়, প্রাণীজ পদার্থ। স্বাভাবিক মুক্তা ঝিনুকের মাংসল শরীরের ভিতর পাওয়া যায়। সাদা রঙের এই জৈব রত্নটির বৈজ্ঞানিক নাম Organic Gems মূল উপাদান হল ক্যালসিয়াম, কার্বন ও অক্সিজেন (CaCO3)।(১৩) প্রবাল বা Corel : এটি খনিজ পদার্থ নয়, প্রাণীজ পদার্থ। এক ধরনের ক্ষুদ্র জীবের মৃতদেহ।শুধুমাত্র সমুদ্রের নীচেই পাওয়া যায়।গাঢ় রক্তবর্ণ বা হলুদাভ রক্তবর্ণ, গেরুয়া সাদা রঙের রত্নটির বৈজ্ঞানিক নামও Organic Gemsমূল উপাদান হল ক্যালসিয়াম, কার্বন ও অক্সিজেন (CaCO3)।
রত্নগুলি কীরকম ভাটের জিনিস দেখুন : (১) চুনি এবং নীলার মূল উপাদান একই। অথচ গ্রহ আলাদা।অথচ গ্রহরোষও আলাদা। অথচ রবি খারাপ হলে চুনি দেওয়া হয় এবং শনি খারাপ হলে নীলা ধারণ করতে বলা হয়। মানে আমার হার্টের সমস্যা হলে যে ওষুধ নেব, আমাশয় হলেও সেই একই কন্টেন্টের ভিন্ন নামেরওষুধ নেব ? (২) সূর্যকান্তমণি এবং সন্ধ্যামণি রত্নের উপাদান একই। গ্রহ আলাদা। গ্রহরোষও আলাদা। রবি খারাপ হলে সূর্যকান্তমণি এবং শনি খারাপ হলে সন্ধ্যামণি। চুনি ও নীলার উপাদান এবং সূর্যকান্তমণি ও সন্ধ্যামণির উপাদান একেবারেই এক নয়। তাহলে ভিন্ন উপাদানে একই গ্রহের মাথা ঠান্ডা হয় কী করে ? জ্যোতিষবাবুরা উত্তর দিতে পারেন না।কোনো জ্যোতিষীবাবু উপর-চালাকি করতে গিয়ে বা ওভার স্মার্ট ন্যাজে-গোবরে হয়ে যান।
রত্ন আসল হোক কিংবা নকল হোক – জ্যোতিষবাবুরা সেগুলি ব্যবহার করার নিদান দেন গ্রহশান্তির জন্য। এই রত্নগুলি কীভাবে ক্রোধী গ্রহদের মাথা ঠান্ডা রাখার দায়িত্ব নেয় ! জ্যোতিষবাবুরা কী বলেন সেটা আগে জেনে নিই – “মানবদেহের প্রতিটি অঙ্গ পরমাণুর সমন্বয়ে সৃষ্ট। সৌরমণ্ডলের গ্রহগুলিও পরমাণুর সমষ্টি। আর বিভিন্নপ্রকার রত্নগুলি এমন সব পদার্থের সমন্বয়ে সৃষ্ট যার উপস্থিতি মানবদেহেও বিদ্যমান। বিভিন্ন প্রকার রত্ন সরাসরি মানবদেহের ত্বককে স্পর্শ করে শরীরের উপর ইলেকটো ম্যাগনেটিক (Electro Magnetic) প্রভাব বিস্তার করে, মানবদেহের বিদ্যমান যে-কোনো পদার্থের অসামঞ্জস্যপূর্ণ উপস্থিতির সামঞ্জস্য রক্ষা করে।বিভিন্নপ্রকার রত্ন বিভিন্ন গ্রহের রশ্মি অতিমাত্রায় আকর্ষণ বা বিকর্ষণ করতে পারে। তাই রত্ন ধারণ করে স্নায়ুর উপর বিশেষ বিশেষ গ্রহের রশ্মি যোগ বা বিয়োগ করে শক্তিশালী করা সম্ভব। ফলে স্নায়ুগুলি শক্তিশালী হবে ও নতুন চিন্তা চেতনায় জীবন প্রবাহের ক্ষেত্রে সুশৃঙ্খলভাবে এগিয়ে নেবে। আলোকরশ্মি, বায়ুমণ্ডল  ভেদ করে পৃথিরীর ভূভাগের উপর পতিত হয়। গ্রহদের যেমন নিজস্ব তেজ বিকিরণের ক্ষমতা আছে, প্রতিটি রত্মেরও তেমনই পৃথক পৃথক তেজ আহরণের ক্ষমতা আছে। সূর্য এবং গ্রহমণ্ডল থেকে বেরিয়ে আসা এই আলোকরশ্মিই আমাদের উপর নানাভাবে কাজ করে। ভুগর্ভে বা সমুদ্রগর্ভে যে সকল রত্ন-পাথর সৃষ্টি হয় তাহাও ওই সৌররশ্মিরই রাসায়নিক ক্রিয়ার ফল। মানবদেহের উপর কসমিক রশ্মির (Cosmic Ray)  প্রভাব বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত। সূর্যের আল্ট্রা-ভায়োলেট রশ্মি (Ultra-Violet Ray) ও অপরাপর রং বিভিন্ন প্রকার রত্ম-পাথর এবং এর অভ্যন্তরীণ প্রচ্ছন্ন শক্তির উপর পরোক্ষ ও প্রত্যেক্ষভাবে ক্রিয়াশীল হয়ে মানবদেহে সংক্রামিত বিভিন্ন প্রকার ব্যাধির প্রতিকার করতে পারে। উল্লেখ্য, রত্নগুলিতেও বিভিন্ন রং বিদ্যমান।প্রাচীন জ্যোতিষবিগদগণ হাতের বিভিন্ন স্থানে বিবিধ গ্রহের অবস্থান ধরে সে স্থানগুলিকে বিবিধ রঙের Reflection উল্লেখ করেছেন। আর বিভিন্ন প্রকার রত্ন-পাথরের রং যে ভিন্ন ভিন্ন তার সঙ্গে গ্রহ ও নক্ষত্রের রঙর সাদৃশ্যও তাঁরা এভাবে পেয়েছেন।সুতরাং জ্যোতিষে রত্নের ব্যবহার অভ্রান্ত নয় বলেই মনে হয়।তবে রত্ন-পাথরের যথাযথ প্রয়োগ কৌশল সম্পর্কে খুব অল্প সংখ্যক মানুষ অবহিত। একথা মনে রাখতে হবে যে, ভুল ঔষধ সেবনের কারণে বা প্রয়োজন ব্যতিত ঔষধ ব্যবহারে যেমন জীবননাশ বা ক্ষতি হতে পারে,  তেমনই প্রয়োজন ছাড়া রত্ন ব্যবহার বা যথার্থ রত্নের ভুল ব্যবহারের কারণেও মারাত্বক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাও প্রচুর। তাই রত্ন-পাথর ব্যবহারে বিশেষজ্ঞ বা অভিজ্ঞ জ্যোতিষের পরামর্শ একান্ত কর্তব্য। ভুললে চলবে না যে অণুর সমম্বয়েই রত্নের উৎপত্তি আর দ্রব্য গুণ অনস্বীকার্য।”
এই হল জ্যোতিষবাবুদের রত্ন-পাথরের সপক্ষে বিবৃতি। পশু বা মানুষের রক্ত গায়ে মাখলে মানুষের শরীরের রক্তাল্পতা কমে যায় ? যদি কেউ বলেন – হ্যাঁ, যায়। মাফ করবেন, তবে তার মানসিক সুস্থতা নিয়ে সন্দেহ জাগছে। তাহলে কি আপনি আয়রন ট্যাবলেট বা কুলেখাঁড়া শাকের রস না-খেয়ে পাথর বা ধাতু বা শিকড় ধারণ করবেন ? তাই কি করেন ? মানবদেহে অল্প বা নির্দিষ্ট পরিমাণে বিভিন্ন ধরনের মৌলিক দ্রব্যের বা ধাতুর উপস্থিতি আছে, শরীরে তার প্রভাবও আছে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে সেইসব ধাতুর সঠিক ভারসাম্য রাখতে পরোক্ষভাবে প্রয়োগ করা হয়। সরাসরি লোহা চিবিয়ে চিবিয়ে খেলে বা শরীরে টন টন লোহা বাঁধলেও রক্তাল্পতা সারবে না।
তবে রত্নগুলির সৌন্দর্য অস্বীকার করা যায় না। রত্ন দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশ সাজিয়ে নিতে কার-না ভালো লাগে। সে তো অন্য কথা। পাঁচ রতি ছয় রতি নয়, শয়ে শয়ে রতি রত্ন দিয়ে শরীর সাজিয়ে ফেলুন না। কে বারণ করেছে ? কিন্তু গ্রহশান্তির নামে নীলা-পোখরাজ মানুষকে পরিয়ে দেবেন মাথায় বাড়ি দিয়ে, সেটি হবে না।ভয় দেখিয়ে, রত্ন কিনতে বাধ্য করানো মানুষের জন্য আমরা লড়াই করব।মানুষের শরীরে রত্ন-পাথরের কোনো ভূমিকা নেই। রত্ন-পাথরের কোনো ক্ষমতা নেই। ভালো কিছু করার ক্ষমতাও নেই, খারাপ কিছু করারও ক্ষমতা নেই।দুষ্ট প্রভাব বলতে যেমন কিছু নেই, তেমনি দুষ্ট প্রভাব হটানোরও কোনো ক্ষমতা রত্ন-পাথরের।রত্ন-পাথর আমাদের কোনো অবস্থা থেকেই বিচ্যূত ঘটাতে পারে না।রত্ন-পাথর মানুষের শরীরে কোনো বিক্রিয়া করে না। সারা শরীরে যেখানেই আপনি রত্ন-পাথর বাঁধুন-না কেন, একটাই কাজ করবে – সৌন্দর্য বৃদ্ধি।বেশ বিজ্ঞের মতো জ্যোতিষবাবুরা চরম আত্মবিশ্বাসের উপর ভর দিয়ে বলে থাকেন – রত্ন-পাথর বিভিন্ন ক্ষতিকারক রশ্মি শোষণ করে মানুষের শরীরকে রক্ষা করে।সেকি, কীসের রশ্মি ? সেই রশ্মি আমাদের কী ক্ষতি করে ? মামলা-মোকদ্দমায় হারিয়ে দেয় ? আমার মেয়ের পরীক্ষায় পাস আটকে দেয় ? আমার ছেলের চাকরি হতে বাধা দেয়, আমার পরকীয়ায় কাঠি দেয় ? আমার জীবনের জীবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দিলাম কোনোরকম রত্ন-পাথর ছাড়াই।আমার পুরো জীবনটাই কুসুমাস্তীর্ণ।কণ্টক এলে দু-হাতে উপড়ে ফেলে দিয়েছি।যে ক্ষতিকারক রশ্মির কথা জ্যোতিষবাবুরা বলে থাকেন সেগুলি কী ওই গ্রহগুলি আসে ? নাকি অন্য কোথা থেকে ? গ্রহদের নামে যখন রত্ন-পাথর দেওয়া হয়, তাহলে ধরে নিতেই রশ্মি গ্রহগুলি থেকেই আসে।নানারকম মহাজাগতিক রশ্মি আছে বইকি।সেগুলি সত্যিই ক্ষতিকর। সেইসব ক্ষতিকর কোনোভাবেই পৃথিবীতে আসতে পারে না। বাস্তবে মহাজাগতিক রশ্মি হল এক ধরনের তড়িৎকণার অদৃশ্য বিকিরণ। শব্দ বা বিদ্যুতের মতোই অদৃশ্য এই বিকিরিত তড়িৎকণা বর্ণহীন। মহাকাশ থেকে নেমে আসা এই মহাজাগতিক রশ্মির অনেকটাই পৃথিবীতে পৌঁছোবার আগে বাধা পায় পৃথিবীকে ঘিরে রাখা চৌম্বক ক্ষেত্রে। এরপর যেটুকু মহাজাগতিক রশ্মি এসে পড়ে আমাদের পৃথিবীতে তা ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া পৃথিবীর ওজোনস্তর পেরিয়ে সরাসরি পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা অসম্ভব।এক-আধটু রশ্মি যে পৃথিবীতে আসে না, তা নয়। সেই রশ্মি রত্ন-পাথর কেন -- পৃথিবীতে এখনও পর্যন্ত এমন কিছু আবিষ্কার হয়নি, যা দিয়ে ওইসব রশ্মি আটকে মামলা-মোকদমা ইত্যাদি জিতিয়ে দেওয়া যায়।  অনেক জ্যোতিষবাবু বলেন – বিভিন্ন রত্ন-পাথরের মধ্য দিয়ে সূর্যরশ্মি প্রতিসৃত হয়ে শরীরে প্রবেশ করে গ্রহশান্তির কাজ করে। তাই নাকি ?  প্রতিসৃত হয়ে শরীরে প্রবেশ করে ? প্রবাল বা পলা, মুক্তা, সূর্যকান্তমণি ইত্যাদি রত্নগুলি তো অস্বচ্ছ। অস্বচ্ছ বস্তুর মধ্য দিয়ে রশ্মি প্রতিসৃত কোনো সম্ভাবনা নেই।কোনো কোনো জ্যোতিষবাবুদের (জেম থেরাপিস্ট !!!) মতে – মানবদেহের নানা রোগের কারণ নাকি রং।রামধনুর সাতটি রং নাকি মানবদেহে বিদ্যমান সাতটি স্নায়ুচক্রকে নিয়ন্ত্রণ করে।মানবদেহের সমস্ত অসুখবিসুখের নিয়ন্ত্রক নাকি ওই রং। কোন্ রঙের অভাবে কোন অসুখ হবে সেটা তাদের জানা। যেমন হলুদ রঙের অভাবে অর্শ, নীল রঙের অভাবে মৃগী হয়। এই রংগুলি শরীরে গুঁজে দিতে পারলে রোগমুক্তি।কীভাবে গুঁজবে ? কেন ? লাল রঙের জন্য চুনি পরিয়ে দেওয়া হবে, নীল রঙের জন্য নীলা বা নীলকান্তমণি বা পোখরাজ, খয়েরি বা সবুজ রঙের জ্ন্য বৈদুর্যমণি বা পান্না, কমলা বা বাদামি রঙের জন্য গোমেদ ইত্যাদি।নাঃ, বিজ্ঞানে এসব ধান্দাবাজির কোনো জায়গা নেই।  
জ্যোতিষ বিষয়ক বইগুলিতে দেখলাম কেতু খারাপ হলে ক্ষয়রোগ ও শুচিবাই আনে।কেতুর সঙ্গে শনিও যদি খারাপ হয় তবে অর্শ, ক্যান্সার ইত্যাদি হতে পারে। তা বৈদুর্যমণি রত্ন বা ক্যাটস আই ধারণ করালে ক্যান্সার ইত্যাদি সেরে যাবে ? নীলা ধারণ করলেও ক্যান্সার সেরে যাবে।হিরে বা পীত পোখরাজ ধারণ করলে ডায়াবেটিস থেকে মুক্তি হবে। পীত পোখরাজ ধারণ করে বৃহস্পতিকে খুশি করতে পারলেই বন্ধ্যা নারীও গর্ভবতী হবে। নেতা-মন্ত্রীও হওয়া যায়। এরকম কঠিন কঠিন রোগ সারাতে পারে রোগীরা। তাহলে আর দরকার কী চিকিৎসা আর চিকিৎসকের ?
জুয়েলারির মালিক, রত্ন-পাথরের ভেন্ডার-বিক্রেতা, উৎপাদনকারী, খননকারী, উত্তোলনকারীদের একমাত্র ভরসা এই জ্যোতিষবাবুরা। জ্যোতিষবাবুরাই একমাত্র সক্ষম নিন্মবিত্ত মধ্যবিত্ত সাধারণদের রত্ন-পাথর বিক্রি করা। রত্ন-পাথর বিক্রির বাজার তৈরি করে দিয়েছেন এই জ্যোতিষবাবুরাই। নাহলে একচেটিয়াভাবে ধনীরাই শুধুমাত্র রত্ন ব্যবহার করত।ব্যাবসা কী জমত ? গ্রহরত্ন বা অন্য কোনো যদি মানুষের ভাগ্যকে বদলে দিতে পারে, তবে তো বলতে হবে মানুষের ভাগ্য এক্কেবারেই পূর্বনির্ধারিত নয়। প্রচেষ্টা এবং পরিবেশই মানুষের ভাগ্যের নির্ণায়ক।
গ্রহশান্তির জন্য জ্যোতিষবাবুরা রত্ন-পাথর ছাড়াও গাছের মূল বা শিকড় ও ধাতু বা মেটাল ব্যবহারের নিদান দেন। নাকের বদলে নরুন আর কী ! কী আছে শিকড়-বাকড়ে ? শরীরে শিকড়-বাকড় বাঁধলে দুষ্ট গ্রহরা পালিয়ে যায় ? শিকড়-বাকড়ের দোকানে লোকজন দেখি ভিড় করে থাকে, বিশেষ করে শনি-মঙ্গলবারে। মূল-বিক্রেতারা মূল-ক্রেতাদের একটা কার্যকরী আপ্ত্যবাক্য শুনিয়ে থাকে, তা হল – গাছ কথা বলে। গাছ তো কথা বলেই। কিন্তু জ্যোতিষবাবু, গাছকে কথা বলানোরক্ ক্ষমতা আপনাদের নেই। মানে গাছদের কথা বলিয়ে গ্রহদের খেদাতে পারবেন না। ওটা চিকিৎসকদের কাজ, চিকিৎসকরাই পারেন। চিকিৎসকরাই পারেন চিকিৎসা পদ্ধতিতে। দেখুন কীভাবে পারে -- জ্যোতিষবাবুদের মতে সূর্য বা রবি গ্রহের কোপ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে বিল্বমূল অর্থাৎ বেলের শিকড় হাতে-গলায় বাঁধতে হবে। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য বলছেন--(১) বেলের শিকড়ের ছাল ৩/৪ গ্রাম মাত্রায় গরম জলে ৪/৫ ঘণ্টা ভিজিয়ে ছেঁকে তার সঙ্গে একটু বার্লি বা খইয়ের মণ্ড ও অল্প চিনি মিশিয়ে খাওয়ালে শিশুদের বমি ও অতিসার বন্ধ হয়ে যায়। (২) বেলের মূলের ছালচূর্ণ ৬ থেকে ১২ মাত্রায় দুধের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে হৃদ্দৌর্বল্য দূর হয়। এছাড়া অনিদ্রা ও ঔদাসীন্যভাবও কেটে যায়।(৩) বিল্বমূলের ছাল ১২ থেকে ১৪ গ্রেনের সঙ্গে ৬ গ্রেন জিরে বেটে গাওয়া ঘিয়ের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে ধাতুতারল্যে বা শুক্রতারল্যে উপকার পাওয়া যায়।জ্যোতিষবাবুরা বলেন রবির প্রকোপে হৃদরোগ, শিরঃপীড়া হয়। আয়ুর্বেদশাস্ত্র এ অসুখগুলি সারবে বলেনি যে। তাহলে বিল্বমূল ব্যবহার করবেন কেন ? ভেবেছেন ?
জ্যোতিষবাবুদের মতে চন্দ্র বা চাঁদ গ্রহের কোপ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে ক্ষীরিকা বা ক্ষীরা বা শশার মূল হাতে-গলায় বাঁধতে হবে। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য বলছেন--(১) সৌন্দর্য পিপাসু নারী-পুরুষেরা শশা ত্বকের যত্নে ব্যবহার করতে পারেন। (২) পরিপাকতন্ত্র সুস্থ রাখতে এবং শরীরের অতিরিক্ত মেদ ঝরাতে শশার বিকল্প নেই। (৩) জলশূন্যতা দূর করে সারাদিন কাজের ব্যস্ততার কারণে পর্যাপ্ত জল পান করা হয় না অনেকেরই। এই জল ঘাটতি দূর করতে শশার তুলনা হয় না। শশায় ৯০ ভাগ জল থাকায় শরীরের প্রয়োজনীয় জলের অভাব দূর করে শরীর সুস্থ রাখে। (৪) শশা আমাদের শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। বাইরে রোদে ঘুরা-ফেরা করার কারণে সূর্যের তাপে শরীরের চামড়ায় যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তা থেকে শশা আমাদেরকে অনেকটাই স্বস্তি দিতে পারে। এজন্য শশা চাক চাক করে কেটে শরীরের রোদে পোড়া অংশে লাগালে উপকার পাওয়া যায়।(৫) শশার ভিতরের জলীয় অংশ শরীরের অপ্রয়োজনীয় বর্জ্য শরীর থেকে বের করে দিতে সক্ষম। নিয়মিত শশা খেলে কিডনিতে পাথর হওয়া থেকে মুক্ত থাকা যায়।(৬) সুস্থ থাকার জন্য আমাদের শরীরে প্রতিদিন যে পরিমাণ ভিটামিন দরকার হয় তার অধিকাংশের অভাব পূরণ করে থাকে শশা। ভিটামিন এ, বি ও সি--যেগুলি শরীরে শক্তি উৎপাদন ও শরীরের স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাকে সক্রিয় রাখে, তার অধিকাংশই পূরণ করে থাকে শশা।(৭) শশায় রয়েছে উচ্চ মাত্রায় পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও সলিকন। তাই শরীরে এসবের অভাবজনিত সমস্যার মূল সমাধান হলো শশা।(৮) শশায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে জল এবং অত্যন্ত কম পরিমাণে ক্যালরি। তাই আমার যারা শরীরের ওজন কমানোর ব্যাপারে সচেতন তাদের জন্য শশা বা ক্ষীরিকার একটি প্রধান উপাদান। আয়ুর্বেদশাস্ত্র তন্নতন্ন করে তালাশ করেও শিকড় বা মূলের সন্ধান পেলাম না।জ্যোতিষবাবুরা বলেন চন্দ্রের প্রকোপে অতি আবেগপ্রবণতা, মানসিক অসুস্থতা, বাত, শ্লেষ্মা হয়। আয়ুর্বেদশাস্ত্র এ অসুখগুলি সারবে বলেনি যে। তাহলে ক্ষীরিকা মূল ব্যবহার করবেন কেন ? ভেবেছেন ?
জ্যোতিষবাবুদের মতে মঙ্গল গ্রহের কোপ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে অনন্তমূল হাতে-গলায় বাঁধতে হবে। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য বলছেন – (১) ৩ গ্রাম আন্দাজ অনন্তমূল জলে বেটে দুধের সঙ্গে জ্বাল দিয়ে সেই দুধ দই পেতে পরের দিন সকালে খেতে হবে। অর্শে ভালো কাজ করে।(২) অনন্তমূল ৩ গ্রাম আন্দাজ জলে বেটে অল্প সৈন্ধব লবণ মিশিয়ে সরবতের মতো দু-বেলা খেলে একজিমা ও হাঁপানি সেরে যায়।(৩) ৩ গ্রাম আন্দাজ অনন্তমূল বেটে সকালে ও বিকালে দুধ বা জল সহ খেলে অনিয়মিত ঋতুস্রাবে উপকার হয়। (৪) অনন্তমূল বেটে অল্প ঘি মিশিয়ে গায়ে মেখে কিছুক্ষণ বাদে স্নান করে নিলে গায়ের দুর্গন্ধ দূর হয়।(৫) অনন্তমূলের ক্বাথ সেবনে স্তনে দুধ বাড়ে। (৬) গোরুর দুধে অনন্তমূল বেটে খাওয়ালে পাথুরি রোগে যন্ত্রণার উপশম হয়। জ্যোতিষবাবুরা বলেন মঙ্গল প্রকোপে অর্শ, রক্তপাত, ফোঁড়া, হাম, বসন্ত হয়। আয়ুর্বেদশাস্ত্র কিছু কিছু অসুখ সারবে বললেও সেগুলি নির্দিষ্টভাবে তৈরি করে সেবন করতে হবে, বাঁধতে বলেনি। তাহলে অনন্তমূল ব্যবহার করবেন কেন ? ভেবেছেন ?
জ্যোতিষবাবুদের মতে রাহু গ্রহের কোপ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে শ্বেতচন্দন মূল হাতে-গলায় বাঁধতে হবে। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য বলছেন – (১) যাদের ঋতুস্রাবে দুর্গন্ধ, পুঁজ বা মজ্জাবৎ স্রাব হতে থাকে, সেক্ষেত্রে চন্দন ঘষা অথবা ওই কাঠের গুঁড়ো গরম জলে ভিজিয়ে রেখে ছেঁকে নিয়ে দুধে মিশিয়ে খেতে হবে। (২) ঘামাচি নিশ্চিহ্ন করতে শ্বেতচন্দন ঘষার সঙ্গে হলুদবাটা ও অল্প একটু কর্পূর মিশিয়ে অথবা চন্দন ও দারুহরিদ্রা একসঙ্গে ঘষে মাখতে হবে।(৩) হিঞ্চে শাকের রসে শ্বেতচন্দন ঘষা মিশিয়ে খেতে দিলে গুটি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ে এবং ভয়াবহতার উপশম হয়।
জ্যোতিষবাবুদের মতে কেতু গ্রহের কোপ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে অশ্বগন্ধা মূল হাতে-গলায় বাঁধতে হবে। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য বলছেন – (১) শ্বেতী রোগে অশ্বগন্ধার মূল চূর্ণ করে দেড় বা দুই গ্রাম মাত্রায় সকালে ও বিকালে দু-বেলা দুধসহ খেতে হবে।(২) অশ্বগন্ধার মূল চূর্ণ এক বা দেড় গ্রাম মাত্রায় নিয়ে গাওয়া ঘি এক চা-চামচ ও মধু আধ চা-চামচ মিশিয়ে সকালের একবার এবং বিকালে দিকে একবার একটু একটু করে চেটে খেলে ক্রনিক বঙ্কাইটিস সারে।
জ্যোতিষবাবুদের মতে বুধ গ্রহের কোপ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে বৃহদ্বারক বা বিদ্যাধারক মূল, বৃহস্পতি গ্রহের কোপ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে ব্রহ্মষষ্ঠী মূল এবং  শুক্র গ্রহের কোপ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে রামবাসক মূল হাতে-গলায় বাঁধতে হবে। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য রচিত ‘চিরঞ্জীব বনৌষধি’ গ্রন্থে এই গাছটি সম্বন্ধে কিচ্ছু পাইনি।যা পাওয়া গেছে তাতে কোথাও বলা নেই মূলগুলি হাতে-পায়ে শনি/মঙ্গলবার বাঁধতে হবে। তা ছাড়া এই বিশেষ নিয়মে কিছু অসুখ-বিসুখ সারে বইকি, গ্রহ তুষ্ট হয় বলে কোথাও কিছু উল্লেখ নেই।নিমের ডাল বা শিকড় হাতে-পায়ে বাঁধলে যদি কারর তেতো স্বাদ অনুভূত হয় তাহলে মানবো শ্বেতচন্দনের মূল হাতে-পায়ে বাঁধলে রাহু তুষ্ট হবে।
জ্যোতিষবাবুরা ধাতু বা মেটাল ব্যবহার করতে বলেন। এইসব ধাতু ফুটপাথে বিক্রি হয়, জ্যোতিষবাবুদের কাছে থাকে না। এইসব ধাতুবিক্রেতারাও আবার অল্পবিস্তর জ্যোতিষী হাতফাতও দেখেন।রবির জন্য তামা বা সোনা ব্যবহার, চন্দ্রের জন্য রূপো, মঙ্গলের জন্য রূপো ইত্যাদি। মানবদেহে বিভিন্ন পরিমাণে ধাতুর উপস্থিতি আছে। ধাতুর কম/বেশি উপস্থিতিতে নানা ধরনের অসুখ-বিসুখ হয়। আয়ুর্বেদ, হোমিওপ্যাথ, অ্যালাপ্যাথিতে ওষুধ প্রস্তুতিতে ধাতুর প্রয়োগ হয়, ধাতুর ভারসাম্য রক্ষা হয়।মানুষ এবং অন্যন্য প্রাণীরা তাদের আহার্য ফল-মূল-সবজি-মাছ-মাংস-ডিম খাওয়র মাধ্যমে তার শরীরের ধাতুর চাহিদা মেটায়। ফল-মূল-সবজি-মাছ-মাংস-ডিমে নির্দিষ্ট পরিমাণে লোহা, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, জিংক সালফেট,  দস্তা, সোনা, রূপা থাকে।এইসব ধাতুর অভাবে বা ধাতুর প্রাবল্যে মানুষের নানাবিধ অসুখবিসুখ হয়। সরাসরি কোনো ধাতু খাওয়া যায় না। তাই ওষুধ তৈরি করতে সেইসব ধাতুর প্রবেশ ঘটাতে হয়।ওষুধের স্ট্রিপ বা প্যাকেটে Composition পড়ে দেখুন। আয়ুর্বেদে স্বর্ণভস্ম, রৌপ্যভস্ম প্রয়োগ করা হয় নিশ্চয়। তাই বলে তামা-লোহা-সোনা-রূপা হাতে-পায়ে বাঁধলে অসুখবিসুখ সেরে যাবে ? গ্রহরা সব পালিয়ে যাবে ? তা কোনোদিন হয়? তাহলে দিল্লিতে উনুন জ্বালিয়ে কলকাতায় বসে ভাত রান্না করা যায় বিশ্বাস করতে হবে !
ভেবেছিলাম ধাতুর কথা লেখার পর উপসংহারে চলে যাব। হঠাৎই আমার এক বন্ধু রুদ্রাক্ষের কথা মনে করিয়ে দিলেন। রুদ্রাক্ষও নাকি গ্রহশান্তিতে করিৎকর্মা। দেখা যাক -- আয়ুর্বেদের সংহিতাগ্রন্থে রুদ্রাক্ষ নামের কোনো বস্তুর ব্যবহার, এমনকি নামোল্লেখ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। তবে অন্য নামে এটি ব্যবহৃত হয়েছে কি না সেটা আজও আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। ‘রাজনিঘণ্টু’ নামে এক বৈদ্যক দ্রব্যাভিধানে এই গাছটির গুণাগুণের বর্ণনা দেওয়া আছে -- এটি উষ্ণগুণসম্পন্ন; বাত, কৃমি, শিরোরোগ, ভূতগ্রহ, বিষনাশক এবং রুচিকারক। অসুখবিসুখের ব্যাপারে পরে আসছি। তার আগে দেখে নিই রুদ্রাক্ষের মাহাত্ম্য কতটা ? একমুখী থেকে শুরু করে আটত্রিশমুখী পর্যন্ত রুদ্রাক্ষের সন্ধানও পাওয়া যায়। সহজলভ্য নয় বলে চোদ্দোমুখী থেকে একুশমুখী রুদ্রাক্ষের মূল্যও বেশি। গৌরীশঙ্কর, ত্রিযুতি -- রুদ্রাক্ষ জগতে অত্যন্ত সুবিদিত হলেও সাধারণের ক্রয়-ক্ষমতার বাইরে। “গৌরীশঙ্কর রুদ্রাক্ষ” দেখলে মনে হয় দুটি রুদ্রাক্ষ বীজ একসঙ্গে জোড়া দেওয়া হয়েছে -- যাকে শিব ও পার্বতীর প্রতীক বলে মনে করা হয়। যাঁরা বৌদ্ধ অনুসারী তাঁদের মধ্যে কলাবতীর শক্ত বীজের সঙ্গে রুদ্রাক্ষের দানা মিশিয়ে সংকর মালা তৈরি করতে দেখা যায় । রুদ্রাক্ষের মধ্যে সবচেয়ে দুর্লভ বোধ হয় সুশ্রী এবং গোলাকার একমুখী রুদ্রাক্ষ, যা আজকাল অতিশয় দুর্লভ। শোনা যায়, টাটা কোম্পানি ৭০ লক্ষ টাকা মূল্যের একটি একমুখী রুদ্রাক্ষ বংশপরম্পরায় রক্ষা করে আসছে।
জ্যোতিষবাবুদের ব্যাবসায়িক প্রবণতার কারণে প্রচার হয়েছে, রুদ্রাক্ষ যে-কোনো ধর্মের এবং যে-কোনো বয়সের নারী-পুরষই ধারণ করতে পারে। গলায়, বাজুতে এবং কবজিতে। প্রচার হয়েছে গাছের তলায় পড়ে থাকা রুদ্রাক্ষ ব্যবহার্য নয়, গাছ থেকে চয়ন করতে হবে তবেই কাজে দেবে। রুদ্রাক্ষের লাল কালো হলুদ ধূসর নানা রং এবং এর সঙ্গে গ্রহ নক্ষত্রের প্রভাব, পাপস্খালন, দাম্পত্য জীবনে সুখ, ব্যাবসায়িক সাফল্য ইত্যাদি বিষয়গুলিকেও সম্পৃক্ত করা হয়েছে, যার পরিপূর্ণ বৈজ্ঞানিক ভিত্তি সম্পর্কে আমরা অজ্ঞাত।
অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছাড়া রুদ্রাক্ষ ও ভদ্রাক্ষ নির্ণয় করা কঠিন ব্যপার। বাজারে নকল রুদ্রাক্ষ প্রায় ৯৮ শতাংশ। ২ শতাংশ খাঁটি রুদ্রাক্ষ ব্যবহার উপযোগী, তাও অনেক মূল্য। বিশেষ প্রক্রিয়ায় কাঠের গুড়ার সঙ্গে লোহা, সিসা, গ্যালিলিথ নামক রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রণ করে রুদ্রাক্ষ তৈরি করা হয়, যার বড়ো বাজার হচ্ছে নেপাল, বোম্বে ও বাঙ্গালোরে সহ গোটা বিশ্বে । যেহেতু নেপালে রুদ্রাক্ষ বৃক্ষ জন্মে, তাই বিদেশিরা মনে করে থাকেন নেপালেই খাঁটি রুদ্রাক্ষ পাওয়া যায়। নেপালে ব্যবসায়ীরা ৩/৪ হাজার টাকায় খাঁটি রুদ্রাক্ষের একটি পিসও সরবরাহ করতে পারেন  না অপরদিকে ৮/৯ টাকায় নকল পেয়ে যাবেন ।  আগে নকল জিনিস চেনার চেষ্টা করতে হবে, কারণ নকল না চিনলে নকল সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলে আসল চেনা যায় না।  খাঁটি রুদ্রাক্ষের দানাতে ৫০.০৩১% কার্বন, ০.৯৫% নাইট্রোজেন, ১৭.৮৯% হাইড্রোজেন এবং ৩০.৫৩% অক্সিজেন বিদ্যমান। ভালো বা আসল রুদ্রাক্ষ চেনার উপায় বা লক্ষণ -- যে রুদ্রাক্ষ সবদিকে সমান, কোথাও বিকৃত, বাঁকা, উঁচু-নীচু বা ভাঙ্গা-চোরা নেই সেই রুদ্রাক্ষ সব থেকে ভালো। এর কিনারাগুলি বেশ স্পষ্ট থাকবে আর গায়ের কাঁটা কাঁটা দাগগুলি বাইরে বেরিয়ে থাকে। যে রুদ্রাক্ষ জলে ডুবে যায়, দুটো তামার টুকরোর মধ্যে রাখলে ঘুরতে থাকে উজ্জল ও ভারী হয় এমন রুদ্রাক্ষ সবচেয়ে ভাল। একে সর্বোত্তম বলে মানা হয়। এই রুদ্রাক্ষ সবচেয়ে বেশি উপকারী হিসাবে বলা যায়। কবিরাজি মতানুসারে যে ব্যক্তি রুদ্রাক্ষ সঠিক নক্ষত্র, তিথি, সময় অনুযায়ী ধারণ করেন তার কোনো রোগ হতে পারে না। সেকি, পৃথিবীর ৭০০ কোটি মানুষ যদি সকলেই রূদ্রাক্ষ ধারণ করে বসে থাকে তবে তো সব চিকিৎসকদের চিকিৎসা ছেড়ে আকাশের তারা গুণতে হবে ! বিশ্বাসীদের ধারণা -- রুদ্রাক্ষের ক্ষমতা, ধারণ করার নিয়ম, পুজো মন্ত্র  যা সঠিকভাবে অনুসরণ করলে মানুষের জীবনে শান্তি আসবেই।বাপ রে, এদের তো ধরে দশ-পাঁচটা নোবেল দিয়ে দেওয়া দরকার।
জ্যোতিষবাবুরা বলেন যেমন মুখ, তেমন ফল। এটাই মানুষের বিশ্বাস। যেমন ধরুন -- (১) সপ্তমুখী রুদ্রাক্ষ: এই শ্রেণির রুদ্রাক্ষের নাম ‘অনন্ত মাতৃকা’। এ রুদ্রাক্ষ ধারণে সামাজিক প্রতিষ্ঠা, অর্থ মান, যশ ও প্রতিপত্তি লাভের পথ সুগম হয়ে থাকে। রাশিচক্রে রাহুগ্রহ রবি ও চন্দ্র যুক্ত হয়ে লগ্নে দ্বিতীয়ে, চতুর্থে, পঞ্চমে, ষষ্ঠে, সপ্তমে, অষ্টমে, নবমে, দশমে এবং দ্বাদশে অবস্থান করলে বা কোনোভাবে অশুভ হলে এ গ্রহের শান্তির নিমিত্ত উক্ত রুদ্রাক্ষ উজ্জীবন করতে হয়। ১০৮ বার মন্ত্র জপ করে উক্ত রুদ্রাক্ষ কণ্ঠে ধারণ করলে রাহু গ্রহের সমস্ত কুফল বিনষ্ট হয় অনেকের বিশ্বাস। (২) অষ্টমুখী রুদ্রাক্ষ: এই রুদ্রাক্ষের দুটি নাম ‘বিনায়ক’ ও ‘বটুকভৈরব’। শনিগ্রহ ও রাহুর অশুভ প্রভাব খর্ব করে। এ রুদ্রাক্ষ ধারণে হঠাৎ আঘাত পাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। দুষ্কৃতকারীদের হাতে আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। রাশিচক্রে শনি ও রাহু অশুভ থাকলে উক্ত রুদ্রাক্ষ যথাবিধি সংস্কারপূর্বক পুরুষের ডান বাহুতে এবং স্ত্রীলোকের বাম বাহুতে ধারণীয়। এ রূপে বিনায়ক মন্ত্র পাঠ করে বা বটুক ভৈরব মন্ত্র এ মন্ত্রে বটুক ভৈরবের পুজো করে এবং পরে জপ করে ও পরে বীজমন্ত্র জপ করে উক্ত রুদ্রাক্ষ ধারণ করলে সমস্ত অশুভ প্রভাব দূরীভূত হয়। (৩) নবমুখী রুদ্রাক্ষ: এই রুদ্রাক্ষের অন্য নাম ‘মহাকাল ভৈরব’। ধারণে জীবনে উন্নতির সূচনা যায়, সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও জয়লাভ করা হয়। দুর্ঘটনা ও হঠাৎ মৃত্যুর হাত থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়। ধারণের পূর্বে মন্ত্র উচ্চারণ করে এ রুদ্রাক্ষের উজ্জীবন বা প্রাণসঞ্চার করে নিতে হয়। মন্ত্র পাঠের পর উচ্চারণ করতে হয়। বুদ্ধিবৃত্তিজনিত কাজকর্মের ক্ষেত্রে নানাভাবে প্রচুর সুফল দান করে এ রুদ্রাক্ষ। রাশিচক্রে বৃহস্পতি গ্রহ মকরে নীচস্থ, মকরস্থানে অবস্থান করলে, বা মারকস্থ হলে এবং ষষ্ঠ, অষ্টম, দ্বাদশ স্থানে অবস্থান করলে কিংবা কোনোভাবে অশুভ হলে এ গ্রহের শান্তির নিমিত্ত উপরোক্ত রুদ্রাক্ষ যথাবিধ সংস্কার পূর্বক ধারণের পর মন্ত্র জপ করে বৃহস্পতয়ে’ এ বীজমন্ত্র জপের পর পুরুষের দক্ষিণ বাহুতে এবং স্ত্রীলোকের বামবাহুতে ধারণ করলে সকল অশুভ বিনাশ হয়। (৪) দশমুখী রুদ্রাক্ষ: এ শ্রেণির রুদ্রাক্ষ দুর্লভ। এর অন্য নাম ‘মহাবিষ্ণু’। মর্যাদা, প্রতিষ্ঠা, সুনাম, খ্যাতি, সন্মান, পার্থিব সমৃদ্ধি, কর্মদক্ষতা এবং ব্যাবসায়িক সাফল্য অর্জনে সহায়ক এ রুদ্রাক্ষ। প্রেতাদি কর্তৃক অনিষ্টকর প্রভাব থেকেও মুক্ত হওয়া যায়। রাশিচক্রে বুধ গ্রহ নীচস্থ শত্রুযুক্ত ও শত্রুক্ষেত্রগত, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ, অষ্টম ও দ্বাদশ স্থানে অবস্থান করলে বা কোনোভাবে পীড়িত হলে উক্ত রুদ্রাক্ষ যথাবিধি মন্ত্রোচ্চারণপূর্বক সংস্কার করে ধারণ করতে হয়। মন্ত্র পাঠ ও জপ করে জপের পর উক্ত রুদ্রাক্ষ কণ্ঠে ধারণ করলে সমস্ত অশুভ দূরীভূত হয়। (৫) একাদশমুখী রুদ্রাক্ষ: এটি একটি বিশেষ জাতের রুদ্রাক্ষ। এর অন্য নাম ‘মহামৃত্যুঞ্জয়’। মেয়েদের নানা অসুখের ক্ষেত্রে একান্তভাবেই সুফল প্রদানকারী, আত্মবিশ্বাসের অভাব ঘটলে, আত্মহনন চিন্তা এসে মনকে ও মেজাজ খিটখিটে স্বভাবের হয়ে উঠলে এ রুদ্রাক্ষ ধারণে তার উপশম হয়। মন্ত্র উচ্চারণযোগে রুদ্রাক্ষ উজ্জীবিত করে ধারণ করা প্রয়োজন। রাশিচক্রে শুক্র ও মঙ্গল অশুভ থাকলে মন্ত্রে যথাবিধি সংস্কার করে মন্ত্র জপ করে ডান হাতে ধারণ করলে সমস্ত অশুভ প্রভাব নাশ হয়। (৬) দ্বাদশমুখী রুদ্রাক্ষ: এর অন্য নাম ‘অর্ক’ বা ‘আদিত্য’। এ রুদ্রাক্ষ রবি ও রাহুর অশুভ প্রভাবকে প্রশমিত করে। রবি যখন মকরে বা কুম্ভরাশিতে অবস্থিত হয়ে অশুভদশা প্রাপ্ত হয় তখন এ রুদ্রাক্ষ ধারণ করলে সকল কুফল নষ্ট হয়। ব্যাবসায়িক মন্দা বা অসাফল্য নিবারণ করতে মন্ত্র সহযোগে এ রুদ্রাক্ষকে উজ্জীবন করে ধারণ করতে হয়। মন্ত্র উচ্চারণ করে ১০৮ বার জপের পর রুদ্রাক্ষটি কণ্ঠে ধারণ করলে সমস্ত অশুভ বিনষ্ট হয়। (৭) ত্রয়োদশমুখী রুদ্রাক্ষ: এর অপর নাম ‘কাম’। এর ধারণে সর্বভাবেই কামনীয় বিষয়ের প্রাপ্তিযোগ ঘটে। এ রুদ্রাক্ষ ধারণে উচ্চাকাঙ্ক্ষার পরিপূরণ হয়। চিন্তামণি মন্ত্র সহযোগে এ রুদ্রাক্ষ উজ্জীবন করতে হবে।  অতঃপর মন্ত্র ১০৮ বার বীজমন্ত্র জপ করে ডান হাতে ধারণ করলে সমস্ত পাপ দূর হয় ও সকল মনোরথ সিদ্ধি হয়। এর ধারণে চন্দ্র ও শুক্রের অশুভ প্রভাব নাশ হয়ে থাকে। (৮) চতুর্দশমুখী রুদ্রাক্ষ: এই রুদ্রাক্ষ ‘শ্রীকণ্ঠ’ নামে পরিচিত। এই রুদ্রাক্ষ ইন্দ্রিয় সংযমে সাহায্য করে। পঞ্চমুখ হনুমানমন্ত্র সহযোগে একে উজ্জীবিত করতে হয়। মন্ত্র পাঠ করে বীজমন্ত্র জপ করে ধারণ করলে শুক্রগ্রহের সমস্ত অশুভ বিনষ্ট হয়। মন্ত্র ১০৮ বার জপ করে ধারণ করলে বৃহস্পতি ও রবির সমস্ত অশুভ প্রভাব নষ্ট হয়ে থাকে।
রুদ্রাক্ষ মৃগীরোগীদের জন্যেও উৎকৃষ্ট। সংক্রামক রোগ, বিশেষত বসন্তরোগ প্রতিষেধক বলে বহু মানুষ শরীরে ধারণ করে। রাজস্থানের বৈদ্য সম্প্রদায় এই রোগে রুদ্রাক্ষ ঘষে গায়ে লাগাতে দিয়ে থাকেন। শ্লেষ্মার আধিক্যে যেসব রোগ-বিসুখ সৃষ্টি হয়, কোনো কোনো প্রদেশে এটি ঘষে খাওয়ানো হয়। যক্ষারোগের প্রথমাবস্থায় তুলসীমঞ্জরীর সঙ্গে রুদ্রাক্ষ ঘষে খাওয়ালে চমৎকার ফল দেয় শুনেছি। এছাড়া রোগীর নাড়ী ক্ষীণ হয়ে আসতে থাকলে হৃদযন্ত্র সক্রিয় রাখতে গ্রামবাংলার প্রাচীন বৈদ্যকুলের ‘কোরামিন’ ছিল, রুদ্রাক্ষ ঘষা ও মধু দিয়ে মকরধ্বজ খাওয়ানো হত।ভারতীয় চিকিৎসা শাস্ত্রকে যাঁরা প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন তাঁদেরই উত্তরসূরি আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য এ বিষয়ে বলেন -- আয়ুর্বেদের মূল সিদ্ধান্ত হল, প্রতি দ্রব্যের মধ্যে চারটি জিনিসের অস্তিত্ব বর্তমান। যেমন -- রস, বীর্য, বিপাক ও প্রভাব। প্রথমোক্ত তিনটির প্রত্যক্ষতা প্রমাণ করা যায়, শেষোক্ত ‘প্রভাব’-টি কিন্তু দ্রব্যগুণাদির সম্পর্কশূন্য নয়। কারণ প্রতিটি দ্রব্যের প্রভাবের ক্ষেত্রটিও বিশেষ গুণান্বিত। অর্থাৎ শ্লেষ্মানাশক দ্রব্যের প্রভাব কখনো বাত-পিত্তকে প্রকুপিত করে হয় না, বিরোধীও হয় না।
এতক্ষণ নিশ্চয় আপনি হাজারো সংশয় নিয়ে ভাবছিলেন – জ্যোতিষ যদি অযৌক্তিকই হবে তবে এত মানুষ যে এতকাল ধরে জ্যোতিষ এবং জ্যোতিষীদের পিছনে ছুটছে, কেন ? আপনার উত্তর নিশ্চয় এরকম – তারা জ্যোতিষের অভ্রান্ততার প্রমাণ পেয়েছেন বলেই-না জ্যোতিষীদের কাছে যাচ্ছে। শুধু আপনি নন, জ্যোতিষীবাবুদের যুক্তিও এরকমই হয়। এর বেশি কুলায় না যে! বড়ো রকমের ফাঁপড়ে পড়ে গেলে মাসলম্যান তো আছেই। মাসলম্যান অবশ্য সবার নেই। যাঁদের নেই ন্যাজে-গোবরে হন, অথবা ত্যাদোর পাবলিকের ধোলাই খান।আর যাঁদের মাসলম্যান আছে তাঁরা হলেন জ্যোতিষজগতের রাঘববোয়াল।সাংবাদিকদের ক্যামেরার ‘দেখে নেব’ বলে হুমকি দিতে ছাড়েন না। ট্যাবলেট-জ্যোতিষীর এহেন হুমকি নিশ্চয় অনেকেই নিশ্চয় দূরদর্শনে দেখেছেন।
১৯৯৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। কাঁকুড়গাছির শ্রমিক কল্যাণ কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত তথাকথিত প্রাচ্য-পাশ্চাত্য জ্যোতিষ সম্মেলনে “ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি”-র সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। উদ্দেশ্য : উদ্যোক্তাদের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে খোলামেলা চ্যালেঞ্জের আবেদন। আবেদন : ‘ভবিষ্যদ্বক্তা’ জ্যোতিষীরা পাঁচজন বিখ্যাত ব্যক্তির মৃত্যুদিন আগাম গণনা করে বলে দিন। আর সেই গণনার ফলগুলি আলাদা আলাদাভাবে খামবন্দি করে একটি নিরপেক্ষ জায়গায় সংরক্ষণ করে রাখা হবে। ওই পাঁচজন ব্যক্তির মধ্যে যে দিন যিনি মারা যাবেন সেসময় সেই ব্যক্তির নামাঙ্কিত খামটি খুলে দেখা হবে জ্যোতিষীদের ভবিষ্যদ্বাণী মিলেছে কি না।এই পদ্ধতিতে যদি কমপক্ষে চারজনের ভবিষ্যদ্বাণী মিলে যায়, তাহলে “ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি” জ্যোতিষীদের হাতে চ্যালেঞ্জের টাকা (ভারতীয় রূপিতে ৫০,০০০ টাকা) তুলে দেবে এবং সমিতির পক্ষ থেকে জ্যোতিষবিরোধী সমস্ত আন্দোলন বন্ধ করে দেবে।
জ্যোতিষ-বিশ্বাসীরা কী ভাবছেন ? জ্যোতিষীবাবুরা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন ? না, জ্যোতিষীবাবুরা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেননি। উলটে সম্মেলনের কক্ষটির সমস্ত বন্ধ করে দেওয়া হল, যাতে যুক্তিবাদী সমিতির সদস্যরা ঘরের বাইরে বেরোতে না পারে। এরপর জনাকয়েক মাসলম্যান এসে প্রচণ্ড প্রহার করল। বাধা দিতে গিয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সাংবাদিক , দ্য টেলিগ্রাফের সাংবাদিকরাও লাঞ্ছনা ও নিগ্রহের শিকার হন। এ ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে স্থানীয় এক যুবকও প্রহৃত হন। এক্কেবারে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটেছিল সেদিন। জ্যোতিষীদের ফাঁদে ফেলতে চাইলে জ্যোতিষবাবুরা এভাবেই উত্তর ফেরত দিয়ে থাকে। পরীক্ষা প্রার্থনীয়।
পদার্থ বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা তাঁর এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন। একটি হল -- “গণয়তি গণনে গণকশ্চন্দ্রেন সমাগমং বিশাখায়া। বিবিধ-ভুজঙ্গ-ক্রীড়াসক্তাং গৃহিণীংন জানাতি।।” - গণক আকাশে বিশাখা নক্ষত্রে চন্দ্রের সমাগম গণনা করছে। (ওদিকে) নানান উপপতির সঙ্গে ক্রীড়ায় আসক্ত (নিজের) গৃহিণীকে (অর্থাৎ তার খবর) সে জানে না। অপরটি হল -- “গণিকা গণকৌ সমান ধর্মৌ নিজপঞ্চাঙ্গ-নিদর্শকাবুভৌ।/জনমানস মোহকারিনৌ তৌ বিধিনা বিত্তহরৌ বিনির্মিতৌ।।” গণিকা আর গণক -- দুয়েরই এক ধর্ম। দুজনেই নিজের পঞ্চাঙ্গ দেখায়। দুজনেই লোকের মনকে মোহগ্রস্ত করে। বিধাতা এই বিত্তহরণকারীদের তৈরি করেছেন। পঞ্চাঙ্গ হল দুটি হাত, দুটি পা ও মাথা (গণিকা পক্ষে)। বার, তিথি, নক্ষত্র, যোগ, করণ -- এই পাঁচ (গণক পক্ষে)। গণক লোকের সত্য-মিথ্যা ঠিকুজি তৈরি করার পর যদি ফলে যায় তাহলে নিজের কেরামতি জাহির করে। না ফললে সেটাকে বলে লগ্নদ্রষ্টার ভুল। না মিললে বলে – “জ্যোতিষীরা ভুল করেন, তাঁদের গণনা ভুলও হতে পারে অনেক সময়। নামী ডাক্তারদেরও তো ভুল হয়। অঙ্কের ভালো শিক্ষকরাও অঙ্ক ভুল করে। বানান সংশোধকরাও (Proof Reader) বানান ভুল করেন। প্যাথোলজিস্টরা ভুল রিপোর্ট দেয়। বিশ্বের এক নম্বর ইঞ্জিনিয়ারদের তৈরি ব্রিজও ভেঙে পড়ে। তার মানে কি সেই বিদ্যা বা শাস্ত্রগুলি মিথ্যা ? তা ছাড়া জ্যোতিষ গণনা-পদ্ধতি ভুল না ঠিক সেটা একমাত্র জ্যোতিষীরাই বলতে পারবেন, আপনি নন।” ভণ্ড গণকরা এভাবেই মানুষকে ঠকিয়ে তাদের টাকা পয়সা হাতিয়ে নেয়।
আপাতদৃষ্টিতে জ্যোতিষীবাবুদের যুক্তিগুলি সঠিক মনে হতেই পারে। কিন্তু জ্যোতিষবাবুদের ভুলের সঙ্গে অন্য ভুলগুলির কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে।ডাক্তার অথবা শিক্ষকদের ভুলটা বিমূর্ত নয়, সম্পূর্ণটাই চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণিত। জ্যোতিষবাবুদের ভুলটি বিমূর্ত, প্রমাণ করা যায় না। ভুলটা প্রমাণ করা গেলেও ঠিকটা প্রমাণ করা যায় না। যেমন ধরুন আপনার বর্তমান বয়স ৩০। আপনাকে বলা হল ৪০ বছর বয়সে গিয়ে আপনার বড়ো একটা দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, এমনকি মৃত্যু হওয়ারও আশঙ্কা আছে। আপনি আর আপনার পরিবার খুব ভয় পেয়ে গেলেন এবং মুক্তির উপায় জানতে চাইলেন। জ্যোতিষবাবু আপনাকে পাঁচ রতির একটা নীলা ব্যবহার করতে বললেন।৪০ বছর বয়সে গিয়ে আপনার কোনো দুর্ঘটনা ঘটল না, মৃত্যুও হল না। কিংবা ওই সময় আপনি এমনভাবে হোঁচট খেয়ে পড়লেন যে আপনার সামনের দুটো দাঁত ভেঙে গেল। জ্যোতিষীবাবু বলবেন – সঠিক ভবিষ্যদ্বাণীই উনি করেছিলেন ও বিধানও সঠিক দিয়েছিলেন। পাথর কথা বলে। সেদিন পাথরটি ব্যবহার না করলে মৃত্যু ঠেকানো যেত না।” আপনার ৪০ বছর বয়সে দুর্ঘটনা বা মৃত্যু হত কি না, সেটা আর প্রমাণ করা গেল না। কিন্তু যদি উলটোটা হত, অর্থাৎ ৩৫ বছর বয়সে আপনি কোনো দুরারোগ্য অসুখে মারা গেলেন। তখন কি আপনার পরিবার ভুল বলার জন্য জ্যোতিষবাবুর বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেবেন ? এরকম ঘটনা আকছার ঘটে থাকে। কিন্তু আমাদের চরম উদাসিনতার জন্য জ্যোতিষবাবুদের এই বুজরুকির ব্যাবসা চালিয়ে যেতে এক্কেবারেই বেগ পেতে হয় ন। জ্যোতিষবাবুরা যখন ভবিষ্যদ্বাণী করেন এবং ভাগ্য বদলানোর কথা বলেন, তা এমনই অস্পষ্ট ও অর্থহীন যে তার ঠিক-ভুল বিচারের কোনো মানেই হয় না।বিজ্ঞানের তত্ত্বকে নির্দিষ্টভাবে ভুল প্রমাণ করা যায়, তাই ভুল বলে প্রমাণিত না-হলে সেটি ‘ঠিক’-এর মর্যাদা পায়। জ্যোতিষবাবুদের ক্ষেত্রে সেই সুযোগ নেই, কাজেই ‘ঠিক’-এর মর্যাদাও প্রাপ্য নয়।
অদ্বৈত আশ্রম থেকে প্রকাশিত “কমপ্লিট ওয়ার্কস অফ স্বামী বিবেকানন্দ, বার্থ সেন্টিনারি এডিশন”- এর অষ্টম খণ্ডে “ম্যান দি মেকার অফ হিজ ডেস্টিনি” প্রবন্ধে লেখা আছে -- I have seen some astrologers who predicted wonderful things ; but I have no reason to believe they predicted them only from the stars, or anything of the sort. In many cases it is simply mind-reading some times wonderful predictions are made, but in many cases it is arrant trash. অর্থাৎ, “আমি কোনো কোনো জ্যোতিষীকে দারুণ দারুণ ভবিষ্যদ্বাণী করতে দেখেছি ; কিন্তু একথা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, তারা শুধুমাত্র নক্ষত্র বা ওই জাতীয় জিনিস থেকে ভবিষ্যদ্বাণী করে। অনেকক্ষেত্রেই এ হচ্ছে নিছক মনের কথা আঁচ করার ব্যাপার। কখনো-কখনো চমৎকার ভবিষ্যদ্বাণী হয়, কিন্তু অনেকক্ষেত্রেই সেগুলি পুরোপুরি ভূষিমাল।”
যৌবনের প্রারম্ভে আমিও বইপত্র কিনে জ্যোতিষগিরি শুরু করেছিলাম। বইপত্র পড়ে দেখলাম এ বিদ্যা কোনো কাজে আসবে না। শুধু টার্মসগুলি আয়ত্ব করে নিলাম। প্রত্যেক পেশারই একটা নির্দিষ্ট স্টাইল থাকে, এক্ষেত্রেও সেটা আয়ত্ব করলাম। কথায় বলে ভেক না থাকলে ভিখ মেলে না। ভেকও বদলে ফেললাম। মুখে মুখে প্রচার চালাতে লাগলাম, যাকে বলে বিজ্ঞাপন করা। প্রথম প্রথম বিনাপয়সাতেই ভবিষ্যদ্বাণী করে দিতাম। লিখিতভাবেই ভবিষ্যদ্বাণী করতাম। বেশ পসার হল। পারিশ্রমিক নিতে শুরু করলাম। আমি ঠিক বলতে পারি সেটা সবাই বলতে থাকল।পূর্ণ উদ্যোমে কাজে লেগে পড়ার আগে বিবেকের ডাকে থমকে গেলাম। লোক ঠকানোর এ কাজ করাটা কি ঠিক ! আমি তো জানি এসব বলায় কোনো ভিত্তি নেই। পুরোটাই ‘মন পড়া’ ব্যাপার।ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে রোগীকে পড়ে ফেলা। ব্যস, কেল্লা ফতে।আপনিও পারবেন মানুষের অতীত ও ভবিষ্যৎ বলে দিতে। কোনো জ্যোতিষবিদ্যার পাঠ নিয়ে সাগর-সম্রাট হওয়ার প্রয়োজন নেই। কৌশলটুকু আয়ত্ব করলেই হবে। কীভাবে ?
আমি যেভাবে কিছুদিন জ্যোতিষগিরিতে পসার জমিয়ে জমিয়ে ছিলাম, সেটা তো আপনাদের শেয়ার করবই, এর সঙ্গে যুক্তিবাদী প্রবীর ঘোষেরও কিছু মূল্যবান টিপস দেব। তার আগে বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ : এটি একটি মানুষকে প্রতারণা, অর্থাৎ প্রতারক হওয়ার টিপস। প্রতারক হতে চাইলে নিজের দায়িত্বেই হবেন। এ টিপস সচেতন ও যুক্তিনির্ভর ব্যক্তিদের স্বার্থেই নিবেদিত হচ্ছে।
টিপস – ১ : আমি মনে করি জ্যোতিষ ব্যাবসায় শিখরে উঠতে চাইলে জ্ঞানী অবশ্যই হতে হবে। জ্যোতিষ ব্যাবসা অজ্ঞানী বা মূর্খদের জন্য নয়। মনে রাখতে হবে আপনার জ্ঞানবুদ্ধি দিয়েই আপনার প্রতি জাতক-জাতিকাকে আকৃষ্ট করতে হবে। “বিদ্বান সর্বত্র পূজতে”, জ্ঞানেই নারীপুরুষনির্বিশেষে মুগ্ধ হয়। ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞানের কিছু শাখায় জ্ঞান থাকলে উত্তম।ইংরেজি ভাষাটাকে ভালোভাবে আয়ত্ত করা প্রয়োজন। মানুষ ইংরেজি ভাষাকে সমীহ করে। জানতে হবে সংস্কৃত ভাষাও। আমাদের সমাজে এ ভাষাও সমীহ আদায় করে নেয়। জাতক বা জাতিকার সঙ্গে কথা বলার সময় ঠিকঠাক সংস্কৃত বাক্য বা শ্লোক গুঁজে দিতে পারলে কেল্লা ফতে। আপনি দোষেগুণে মানুষ থেকে ঈশ্বর বা ক্রান্তিদর্শীতে  উন্নীত হবেন খুব সহজেই।
টিপস – ২ : ফোর টোয়েন্টিগিরি (ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪২০ ধারায় প্রতারণার দায়ে শাস্তির বিধান) করে এভাবে বাকিজীবন চালিয়ে যেতে পারবেন, এরকম মানসিক জোর ও আত্মবিশ্বাস চাই।
টিপস – ৩ : দূরদর্শী, নির্লজ্জ, দুঃসাহসী, তুখোড় বুদ্ধি, ধূর্ত এবং বিচক্ষণ হতে হবে।
টিপস – ৪ : সাগর, সম্রাট ইত্যাদি সার্টিফিকেট নিয়ে নিন কোনো জ্যোতিষ সংস্থা থেকে। সার্টিফিকেট দেনেওয়ালে সংস্থা ভুড়ি ভুড়ি আছে। নগদ রেস্তো খরচ করে কিনে নিন ডিগ্রি, পদক, পি এইচডি ইত্যাদি।
টিপস – ৫ : স্পেশালিস্ট হিসাবে নিজেকে প্রচার করুন। বিদ্যার জন্য সরস্বতী কবচ, বিয়ের জন্য প্রজাপতি কবচ, ব্যাবসার উন্নতির জন্য বিশ্বকর্মা কবচ ইত্যাদির ব্যবস্থাও রাখুন।
টিপস – ৬ : ৫০০ বছরের কিংবা ২০০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পারিবারিক জ্যোতিষী বলে বিজ্ঞাপন দিন।
টিপস – ৭ : আপনার নামের সঙ্গে শাস্ত্রী, আচার্য, আনন্দ জুড়তে ভুলবেন না।
টিপস – ৮ : আপনার নামে ওজন না থাকলে পালটে ফেলুন।
টিপস – ৯ : আপনার নামের শেষে প্রথম বন্ধনীর ভিতর ‘তন্ত্রসিদ্ধ’, ‘অলৌকিক মাতা’, ‘কামাখ্যাসিদ্ধ’, ‘বাকসিদ্ধ’ ইত্যাদি প্রচারে রাখবেন।
টিপস – ১০ : ভালো কপি রাইটারদের একটা জুতসই বিজ্ঞাপন তৈরি করান।
টিপস – ১১ : কোনো চ্যানেলের সঙ্গে যুক্ত থাকুন। এমন প্রচুর জ্যোতিষের চ্যানেল আছে। স্লট কিনুন। চ্যানেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বললে তারাই আপনাকে বলে দেবে কী করতে হবে, কীভাবে করতে হবে, কত দিতে হবে ইত্যাদি।
টিপস – ১২ : ভেক বদলান। কথায় বলে ভেক না-হলে ভিখ মেলে না।
টিপস – ১৩ : বাড়িতে বড়ো করে পূজো দিন। বাড়িতে মন্দির থাকলে ভালো। আপনি যে দেবতাকে জড়িয়ে জ্যোতিষ ব্যাবসা চালাবেন সেই দেবতার পুজো করবেন বছরের নির্দিষ্ট সময়ে। খুব ভালো কাজ দেয় কালীপুজো করলে।টিভিতে সম্প্রচারের ব্যবস্থা করুন আপনার পুজো।
টিপস – ১৪ : বিপদের হাত থেকে বাঁচতে স্থানীয় থানা এবং ক্লাবের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন।
টিপস – ১৫ : আপনার ব্যাবসা রমরমিয়ে চললে দু-একটি মাসলম্যান পুষবেন। দুঃসময়ে কাজে দেবে।
টিপস – ১৬ : বাজারে প্রচুর জ্যোতিষবিদ্যার বই পাওয়া যায়। কিনে জ্যোতিষী-ভাষা বা টার্মগুলি রপ্ত করুন। প্রতিটি পেশার নিজস্ব ভাষা আছে, জ্যোতিষেও আছে।
টিপস – ১৭ : আবহাওয়া তথা রাজনীতিতে ভবিষ্যদ্বাণী করতে হলে সে বিষয়ে এলেম না থাকলে বিষয়টি এড়িয়ে যওয়াই শ্রেয়। যেমন আগামী লোকসভায় কোন দল সরকার গড়বে ? পশ্চিমবঙ্গে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে কে মুখ্যমন্ত্রী হবেন ? ভবিষ্যতে ভারতবর্ষ হিন্দু রাষ্ট্র হবে কি না? ইত্যাদি।
টিপস – ১৮ : অবশ্যই পাথর বেচুন। পাথরই আপনাকে ধনী করবে। ‘বিফলে মূল্য ফেরত’ বলে দিন। পাবলিক এটা খুব খায়। ঘাবড়াবেন না, মূল্য ফেরত দিতে হয় না। কেউ দাবিও করে না। যদি কেউ মূল্য ফেরত নিতেও আসে, সেটা বুদ্ধি খরচ নিজের নিয়ন্ত্রণে আনুন। সবাই পারে, আপনিও পারবেন।
টিপস – ১৯ : আপনি যদি আপনার বা অন্য মন্দিরে বসতে পারেন, তাহলে হাত দেখার জন্য কোনো পয়সা নেবেন না।পাশে প্রণামীর বাক্স দেখিয়ে দেবেন। বলবেন -- মায়ের পুজোর জন্য আপনার সাধ্য অনুযায়ী দিলেই হবে।
টিপস – ২০ : বিখ্যাত মানুষদের হাত দেখার সুযোগ পেলে অনুমতি সাপেক্ষে ফোটো তুলে রাখতে ভুলবেন না। ওটা বিজ্ঞাপনে দারুন কাজে দেবে।
টিপস – ২১ : মানুষের কিছু কমন জিজ্ঞাস্য বা জানাবার কৌতূল থাকে, সেগুলিই সে জানতে আগ্রহী। একজন অবিবাহিত মেয়ে এবং একজন অবিবাহিত ছেলে জিজ্ঞাস্য ভিন্ন, একজন বিবাহিত মহিলা এবং একজন বিবাহিত পুরুষের জিজ্ঞাস্য আলাদা। একজন অবিবাহিতের প্রেম বিষয়ক, চাকরি বিষয়ক, বিয়ে বিষয়ক প্রশ্ন থাকে।অপরদিকে একজন বিবাহিতের স্বামী/স্ত্রী বিষয়ক, সন্তান বিষয়ক ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর জানে আগ্রহী। প্রশ্ন যেমনই হোক, উত্তর দিতে হবে বিচক্ষণতার সঙ্গে। হবেই এমন কথা কখনোই বলবেন না, ‘সম্ভাবনা’ উল্লেখ করে বলুন। ‘সম্ভাবনা’ শব্দটির মানে হতেও পারে, না হতে পারে।
টিপস – ২২ : ভয় দেখাতে ভুলবেন না। নাহলে পাথর/কবচ বেচতে পারবেন না।পাথর/কবচই আপনার ভবিষ্যৎ যে !
টিপস – ২৩ : সব বয়সের মেয়েদের ‘মা’ বলে সম্বোধন করে কথা বলুন। অবশ্যই সকলকে ‘তুই’ সম্বোধন করাটা রপ্ত করে নেবেন।
টিপস – ২৪ : মানুষ নিজের সম্বন্ধে ভালো ভালো কথা শুনতে ভালোবাসে। প্রথম দর্শনেই সেই ভালো ভালো কথাগুলি বলুন। যেমন – আপনি খুব দয়ালু, আপনি খুব উদার, আপনি মানুষকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসেন কিন্তু আপনি তেমন ভালোবাসা পান না ইত্যাদি। খুব বেশি বেশি পজিটিভ কথা বলুন। দু-একটা নেগেটিভ কথা বলবেন পেটের জন্য।
টিপস – ২৫ : আপনার ‘মুরগি’-কে যে মোক্ষম বাণীগুলি শোনাতেই হবে।৯৯%ভাগ মিলে যাবে, আপনি অব্যর্থ হয়ে যাবেন। দুটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে – (১) মানুষ নিজের সম্বন্ধে যে কথাগুলি শুনতে ভালোবাসে এবং (২) প্রতিটি মানুষ সে যে স্তরেই অবস্থান করুক না-কেন কিছু বিষয় আছে যেগুলি সকলের সঙ্গেই মিলে যাবে। যেমন এই পয়েন্টগুলো বলুন -- আপনি স্পষ্টবক্তা, দৃঢ়চেতা। আপনি অনুসন্ধিৎসু মনের অধিকারী। স্পষ্টবাদিতার জন্য আপনি অপ্রিয় হন, কিন্তু আপনি আপনার জ্ঞানতৃষ্ণার জন্য অনেকের কাছে শ্রদ্ধাভাজনও হন। সংসারের জন্য আপনি অনেক করেন, কর্মক্ষেত্রেও আপনি অনেক করেন – কিন্তু আপনার মূল্যায়ন কেউ করতে পারে না।জীবনে যত বিপদেই পড়েছেন শেষপর্যন্ত আপনি উদ্ধার পেয়েছেন আপনার কনফিডেন্সের জন্য। আপনি খুব তাড়াতাড়ি মানুষের সঙ্গে মিশতে পারেন। আপনি মানুষকে খুব বিশ্বাস করেন, বিশ্বাস করে কখনো-কখনো ঠকেনও, তবু বিশ্বাস হারান না।আপনি রেগে গেলে সাংঘাতিক হয়ে ওঠেন, কিন্তু রেগে গেলেও আপনার বুদ্ধিভ্রম হয় না। আপনি সাধারণভাবে জীবনযাপন করতে চাইলেও বাঁকা পথ ধরতেও বাধ্য হন। সুশ্রী-সুন্দরী জাতিকা হলে বলুন – আপনার কাছে অনেক পুরুষই প্রেম নিবেদন করতে চায়। আপনি পাত্তা দেন না। আপনার গুণমুগ্ধ পুরুষের সংখ্যা বেশ ভালো। পুরুষরা অবলীলায় আকৃষ্ট হয়ে পড়ে, সান্নিধ্য প্রত্যাশা করে। আপনি চাইলেই যে-কোনো পুরুষকেই দখলে নিতে পারেন, কিন্তু আপনি খুবই ক্যালকুলেটেড। বিভ্রান্ত হন না। ইত্যাদি-- দেখবেন আপনার ‘মুরগি’ কী খুশি। আসলে সাধারণত মানুষ তোষামোদে খুব খুশি হয়। নিজের সম্বন্ধে ভালো ভালো কথা শুনতে কার-না ভালো লাগে ! মানুষ স্বীকৃতি চায়। আবিষ্কার চায়। নিজেকে জানতে চায়। পিঠ চাপড়ানো মানুষের মন্দ লাগে না।
এবার মিলতেও পারে, না-ও মিলতে পারে এমন কিছু বলুন। তবে মেলার সম্ভাবনা বেশি। বলুন – মাঝেমধ্যেই আপনাকে একাকীত্বে পেয়ে বসে। আপনার প্রচুর ভালো বন্ধু আছে, শত্রুও আছে ঘাপটি মেরে। সন্মান আপনি পেয়েছেন, কিন্তু যতটুকু আপনার প্রাপ্য ততটুকু আপনি পান না। গোপন প্রণয় আপনার অজ্ঞাতসারে সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করতে পারে। পেট ও অম্বল নিয়ে মাঝে মাঝে সমস্যা দেখা দিতে পারে। ইত্যাদি। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করলে জ্যোতিষী হিসাবে সফল হবেনই।
টিপস – ২৬ : কোনো বিবাহিত এসে আপনার কাছে এসে জানতে চাইত পারেন – তার বিয়ে হবে কি না, হলে কবে হবে ? কোনো সরকারি চাকুরে এসে আপনার কে এসে জানতে চাইতে পারে তার চাকরি হব কি না, হলে কবে হবে ? এমন ফাঁপড়ে পড়লে ধূর্ততার সঙ্গে উত্তর দিতে হবে। না-হলে কেলানি একটাও  মাটিতে পড়বে না। অবশ্য তাবড় তাবড় জ্যোতিষীবাবুরা এ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারেন না।
টিপস – ২৭ : সবশেষে সবাইকে একথা বলতে ভুলবেন না – “আপনার হাতখানি খুব সুন্দর। এমন অপূর্ব হাত খুব একটা পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও কোটিতে গুটি। যাকে তাকে এ হাত দেখাবেন না। নষ্ট করে দেবে।”
দেশের রোজকার দৈনিক পত্রিকাগুলোয় দিনের অনেক গুরুত্বপুর্ণ খবর বাদ গেলেও “আপনার দিনটি কেমন যাবে” বা “আপনার রাশিফল” বিভাগটি কখনো বাদ যায় না। আবার কিছু কিছু টিভি চ্যানেলে সকালের বিশেষ আয়োজন থাকে এই রাশিফল নিয়ে। অথচ এমন অনেক পত্রিকা রয়েছে যাদের বিজ্ঞান নিয়ে সাপ্তাহিক আয়োজনটুকুও নেই। বরঞ্চ বিজ্ঞাপন কম আসে বলে কোনো কোনো পত্রিকা সেই সাপ্তাহিক আয়োজনটুকুও বাদ দিয়ে দেয়।কিন্তু এই বিশেষ বিভাগ চালু রাখতে তাদের কোনো সমস্যা নেই। কারণ একটাই এদেশে তো এই কু-খাদ্যের ভোক্তার অভাব নেই।হয়তো কেউ কেউ বলতে পারেন তাদের কাছে বিষয়টি নিছক বিনোদনের ।হ্যাঁ, সেটা হতেই পারে।কিন্তু বিষয়টি যদি শুধু বিনোদনের জায়গায় থাকত তাহলে কি জ্যোতিষীদের চেম্বার, পাথরের দোকান বড়ো বড়ো শপিং মলে কি দেখা যেত ? রাস্তার মোড়ে মোড়ে পত্রিকার দোকানগুলিতে কি দেখা যেত মাসিক, বাৎসরিক ভাগ্যলিপির পঞ্জিকা ? আর টিভি চ্যানেলগুলিতেই-বা কি দেখা যেত এদের রমরমা বিজ্ঞাপন ? না, মোটেই দেখা যেত না ।
কোনো কোনো জ্যোতিষীবাবু জ্যোতিষকে বিজ্ঞান বলে প্রমাণ করতে চায়, কোনো কোনো জ্যোতিষবাবু আবার শাস্ত্র বলে প্রমাণ করতে চায়, কাউকে আবার শাস্ত্রও বলতে শুনেছি বিজ্ঞানও বলতে শুনেছি। যাঁরা বিজ্ঞানের তর্কে পর্যুদস্ত হয়, তাঁরা বলেন জ্যোতিষকে শাস্ত্র বলে মেনে নিতে অসুবিধা কোথায় আপনাদের ! যেন শাস্ত্র হলেই অব্যর্থ, দৈব কিছু ! বিজ্ঞানের প্রথম শর্ত হল ‘স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন’। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোনো ‘সিদ্ধান্ত’ নেওয়া হয় ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষার পর। সেইসব পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের ফলাফল সুনির্দিষ্টভাবে নথিভুক্ত ও প্রকাশ করা হয়। যে কেউ তা যাচাই করে দেখে নিতে পারে। বিজ্ঞানে দ্ব্যর্থকতার কোনো জায়গা নেই। পটাশিয়াম সায়ানাইড শরীরে প্রবেশ করালে মৃত্যু অবধারিত। যে এটি করবেন তারই এ ঘটনা ঘটবে। অন্যথা হবে না। এটাই বিজ্ঞান, ফল সবসময় সকলের জন্য একই হবে। নিমপাতা চিবালে তেতো লাগবে সকলের, কারোর মিষ্টি লাগবে না – এটাই বিজ্ঞান। বারবার একই ফল পাওয়ার নামই বিজ্ঞান। যুক্তির কাছে অন্ধবিশ্বাস বা ব্যক্তিবিশ্বাসের কোনো জায়গা নেই, মূল্যও নেই। যুক্তি সিদ্ধান্তে পৌঁছায় পরীক্ষার পথ ধরে, পর্যবেক্ষণের পথ অতিক্রম করতে করতে। জ্যোতির্বিদা বাস্তবিকই জ্যোতির্বিজ্ঞান হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষশাস্ত্রের মধ্যে অবিরাম গতিতে বিশ্লেষিত হয়ে চলল পার্থক্যের ব্যাপকতা। বহু পরীক্ষানিরীক্ষা এবং নিয়ত গবেষণার মধ্য দিয়ে জ্যোতির্বিদ্যা প্রতিষ্ঠা পেল বিজ্ঞানের অলিন্দে।তৎসহ জ্যোতিষশাস্ত্র অবিজ্ঞান হিসাবে ডাস্টবিনে পরিত্যক্ত হল।
ভারতে দারিদ্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ৪০%, অতি নিম্নবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের সংখ্যাও ৪০%। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত মানুষ বাকি শতংশের মধ্যে পড়ে। ৫% উচ্চবিত্ত ধরলে ১৫% মধ্যবিত্ত – এরা বেশ সচ্ছল প্রজাতির। দেখা যায় মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরাই মূলত জ্যোতিষের সমর্থক। বহু বছর আগে ‘ফলিত জ্যোতিষ’ শিরোনামে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী লিখেছেন – “কোনও একটা ঘটনার খবর পাইলে সেই খবরটা কি না এবং  ঘটনাটা প্রকৃত কি না তাহা .........জানিবার অধিকার বিজ্ঞানবিদদের প্রচুর পরিমাণে আছে। এই অনুসন্ধান কার্যই বোধ করি তাঁর প্রধান কার্য। প্রকৃত তথ্য নির্ণয়ের জন্য তাঁহাকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়।..... তিনি অতি সহজে অত্যন্ত ভদ্র ও সুশীল ব্যক্তিকেও বলিয়া বসেন, তোমর কথায় আমি বিশ্বাস করিলাম না।...... নিজের উপরেও তাঁর বিশ্বাস অল্প।..... কোথায় কোন্ ইন্দ্রিয় তাঁহাকে প্রতারিত করিয়া ফেলিবে ........ এই ভয়ে তিনি সর্বদা আকুল।.......ফলিত জ্যোতিষে যাঁহারা অবিশ্বাসী তাঁহাদিগের সংশয়ের মূল এই। তাঁহারা যতটুকু প্রমাণ চান ততটুকু পান না। তাহার বদলে বিস্তর কুযুক্তি পান।....... একটা ঘটনার সহিত মিলিলেই দুন্দুভি বাজাইব। আর সহস্র ঘটনার যাহা না মিলিবে তাহা চাপিয়ে যাইব, অথবা গণকঠাকুরের অজ্ঞতার দোহাই দিয়া উড়াইয়া দিব এরূপ ব্যাবসাও প্রশংসনীয় নহে।.......একটা সোজা কথা বলি। ফলিত জ্যোতিষকে যাঁহারা বিজ্ঞানবিদ্যার পদে উন্নীত দেখিতে চাহেন তাঁহারা এইরূপ করুন। প্রথমে তাঁহাদের প্রতিপাদ্য নিয়মটা খুলিয়া বলুন। মানুষের জন্মকালে গ্রহনক্ষত্রের স্থিতি দেখিয়া কোন্ নিয়মে গণনা হইতেছে তাহা স্পষ্ট ভাষায় বলিতে হইবে।..... ধরি মাছ না ছুঁই পানি হইলেও চলিবে না। তাহার পর হাজার খানেক শিশুর জন্মকাল ঘড়ি ধরিয়া দেখিয়া প্রকাশ করিতে হইবে; এবং পূর্বের প্রদত্ত নিয়ম অনুসারে গণনা করিয়া তাহার ফলাফল স্পষ্ট ভষায় নির্দেশ করিতে হইবে।...... পূর্বে প্রচলিত ফলাফলের সহিত প্রত্যক্ষ ফলাফল মিলিয়া গেলেই ঘোর অবিশ্বাসীও ফলিত জ্যোতিষে বিশ্বাসে বাধ্য হইবে।হাজারখানা কোষ্ঠীর মধ্যে যদি নয়শো মিলিয়া যায় তবে মনে করিতে হইবে যে ফলিত জ্যোতিষে অবশ্য কিছু আছে। যদি পঞ্চাশখানা মা্র মেলে তবে মনে করিতে হইবে, তেমন কিছু নাই। হাজরের বলে যদি লক্ষটা মিলাইতে পারো, আরও ভালো। সহস্র পরীক্ষাগারে ও মানমন্দিরে বৈজ্ঞানিকেরা যে রীতিতে ফলাফল গণনা ও প্রকাশ করিতেছেন সেই রীতি আশ্রয় করিতে হইবে। কেবল নেপোলিয়নের ও বিদ্যাসাগরের কোষ্ঠী বাহির করিলে অবিশ্বাসীর বিশ্বাস জন্মিবে না। চন্দ্রের আকর্ষণে জোয়ার হয়, তবে রামকান্তের জজিয়তি কেন হইবে না, এরূপ যুক্তিও চলিবে না।”
জ্যোতিষী নিয়ে স্বামী বিবেকানন্দের অভিমত : “জ্যোতিষে বিশ্বাস সাধারণত দুর্বল মনের লক্ষণ। সুতরাং মনে এরকম দুর্বলতা এলেই আমাদের উচিত সুচিকিৎসক দেখিয়ে ভালোভাবে ওষুধ খাওয়া, ভালো পথ্য খাওয়া। আর বিশ্রাম করা।” বলেছেন – “In many cases it is simply mind-reading some times wonderful predictions are made, but in many cases it is arrant trash.”
এহেন বিষয়কেই ইউজিসি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে রেখে যুবকযুবতীদের স্বনির্ভরতার সন্ধান দিতে আগ্রহী হয়ে পড়েছে। এরপর কি ডাইনি বিদ্যা, ভূত-প্রেত-জিন চর্চা, ডাকিনী চর্চা, ওঝা-গুণিন বিদ্যা, কালাজাদু, ঝাড়ফুঁক বিদ্যা, তেল-পড়া, জল-পড়া, বাটি চালান, ক্ষুর চালান, বশীকরণ বিদ্যাও সিলেবাসে আনবেন ? অবাক হব না। কারণ আদি যুগ থেকে রাষ্ট্রই এইসব বিষয়ের পৃষ্ঠপোষক।রাষ্ট্রকে নির্বিঘ্নে থাকতে হলে নিয়তী বা অদৃষ্টবাদকে প্রতিপালন করতে হবে। তাই পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রই অবিশ্বাসী বা নাস্তিকদের সুরক্ষা দেয় না, আস্তিকদের মদত জোগান। নাস্তিকরা এইসব অবৈজ্ঞানিক বিষয়গুলোর সমালোচনা করলে সবক শেখাতে চান। বলেন – অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কথা নাস্তিকদের বলা উচিত হয়নি। আস্তিকরা নাস্তিকদের উপর হামলা করলে রাষ্ট্র প্রায় নির্লিপ্ত থাকে। এবার ইউজিসির কথা একটু উল্লেখ করা যাক।ইউজিসি (University Grant Commission) বলছেন – জ্যোতিষ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে তিন বছরের স্নাতক পাঠক্রম এবং দুই বছরের স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি পর্যায়ে গবেষণাভিত্তিক পাঠক্রম চালু করবেন। আর এই জ্যোতিষচর্চায় নতুন নামকরণ করা হবে জ্যোতির্বিজ্ঞান। অ্যাঁ, হাসবেন না কাঁদবেন ! আরও শুনুন – উৎসাহী বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে দেওয়া হবে এককালীন ১৪ লক্ষ টাকা। দেওয়া হবে জ্যোতিষবিদ্যার উপযুক্ত সরঞ্জাম কেনার জন্য। ইউজিসির পরিসংখ্যান অনুযায়ী সেইসব জ্যোতিষ বিভাগে একজন অধ্যাপক, দুইজন লেকচারার, একজন লাইব্রেরিয়ান এবং একজন কম্পিউটার চালক থাকবেন। এর ফলে যদি দেশে কুড়িটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পাঠক্রম চালু করা হয় তাহলে এই পাঁচজনের জন্য বাৎসরিক খরচ হবে ১ কোটি টাকা। বুজরুকি জারি রাখার জন্য এত অর্থের অপচয় ! এ সংবাদ শুনে ভারতের অগ্রগণ্য পদার্থবিদ ও ইউজিসির প্রাক্তন চেয়ারম্যান অধ্যাপক যশপাল ক্ষোভ করে বললেন—“এ খবর শুনে আমি মর্মাহত। এ এক নিদারুণ লজ্জা, এক কলঙ্ক। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করছি ইউজিসির সভ্যদের মতোই আজ এদেশে মশা-মাছির মতো অজ্ঞানদের অভাব নেই।” বেঙ্গালুরু রামন রিসার্চ সেন্টারের বৈজ্ঞানিকগণও একসুরে বললেন – “পশ্চাদে এগিয়ে চলার এ এক বিরাট পদক্ষেপ। এরপরে ভারতের বৈজ্ঞানিক গবেষণার আর কোনো মূল্যই রইল না।” ইন্ডিয়ান ডেমোক্র্যাটিক টিচার্স ফ্রন্টের বক্তব্য – “এই প্রস্তাব অবান্তর, হাস্যকর এবং ভয়ংকরও।”
আত্মপক্ষসমর্থনে ইউজিসি কী বলছেন বিজ্ঞপ্তি জারি করে, একটু দেখে নেব – (১) বৈদিক জ্যোতিষবিদ্যা শুধু আমাদের জ্ঞানার্জনের শাস্ত্র নয়, বরং এটি এমন এক বিদ্যা যা আমাদেরকে সুশৃঙ্খলভাবে চলার পথ দেখায়। জ্যোতিষবিদ্যা আমাদের জানায় জীবনে ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে প্রতিনিয়ত কেমন করে ঘটনাগুলি ঘটে চলেছে। (২) বিভিন্ন সময়ে যে ঘটনাগুলি ঘটে তা আমাদের জীবনের উপর কীভাবে প্রভাব ফেলে এ বিষয়ে আমাদের অবহিত করে। সাহায্য করে প্রতিকূল অবস্থাকে অনুকূলে আনতে।(৩) এটি এমন এক বৈদিক শাস্ত্র যার থেকে আমরা জানতে পারি কীভাবে কখন আমাদের জীবন হতাশা, দুঃখ, অস্থিরতা আসে। যা আমরা আমরা বুঝতে পারি না সে সম্বন্ধে অবহিত করা। (৪) বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতিষচর্চা শুধু মানুষের জ্ঞান বৃদ্ধি ঘটাবে তা নয় – বৈদিক গণিত, বাস্তুশাস্ত্র, কৃষিবিজ্ঞান, মহাকাশবিজ্ঞান ইত্যাদি সম্পর্কেও একটা পরিপূর্ণ ধারণা দেবে।(৫) এই মূল্যবান পাঠক্রম থেকে একদিকে যেমন শিক্ষক ও ছাত্র উপকৃত হবেন – অপরদিকে চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ সহ সকল পেশার মানুষজন সুফল লাভ করবে ইত্যাদি। রামো রামো !!!
বাকি রইল এবার বশীকরণবিদ্যার পাঠক্রম, তাবিজ-কবচবিদ্যার পাঠক্রম, ঝাঁড়ফুকবিদ্যার পাঠক্রম, জল-পড়া আর তেল-পড়াবিদ্যার পাঠক্রম, ধর্ষণ-খুনের পাঠক্রম ইত্যাদি। গেরুয়া-সংস্কৃতি নিশ্চয় সেই স্বপ্ন পূর্ণ করবে। নিষ্পাপ প্রতারকরাই রাষ্ট্র চালাবেন, এবার থেকে প্রতারকরাই রাষ্ট্রের নাগরিকরা কী করবেন কী করবেন না ঠিক করে দেবেন ? প্রতারকরা ফলাও করে বিজ্ঞাপন দেবেন, বলবেন – “আসুন, সাক্ষাৎ ধর্ষণ-খুন করলেও অকাট্য সাক্ষ্যসবুত থাকলেও মামলায় জিতিয়ে দেব।পরস্ত্রীতে আসক্ত ? বিছানায় আনতে পারছেন না কিছুতেই ? পাঁচ মিনিটে অব্যর্থ বশীকরণের মাধ্যমে স্বর্গসুখ অনুভব করুন। আপনার সন্তানকে সৌরভ গাঙ্গুলি কিংবা শচীন তেণ্ডুলকর কিংবা কল্পনা চাওলা কিংবা সানিয়া মির্জা কিংবা সানি লিওনে বানাতে চান ? খাঁটি গ্রহরত্ন ব্যবহার করে অব্যর্থ ফল পান।”
এ পোড়া দেশে আইন আছে প্রচুর। কিন্তু আইন রক্ষা করার কেউ নেই। আইন প্রয়োগ করার কেউ নেই। প্রতারক জ্যোতিষীদের বিরুদ্ধে কি মামলা করা যায় এমন আইন আছে? বুজরুকির বিরুদ্ধে কি ভারতে কোনো আইন নেই ? গোখলে বলেছিলেন – “What Bengal thinks to-day, India think tomorrow.” বেঙ্গল, মানে পশ্চিমবঙ্গ কি এইসব অপবিজ্ঞানের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে ? দিল্লি হাইকোর্টের এক বেঞ্চ দিল্লি সরকারকে নোটিস পাঠিয়ে নির্দেশ দিয়েছেন – অলৌকিক ক্ষমতা বলে অসুখ বা কোনো সমস্যার সমাধানের প্রলোভন দেখালে তান্ত্রিক, জ্যোতিষী, বিজ্ঞাপনদাতা ও বিজ্ঞাপন, প্রকাশক ও প্রচার মাধ্যমের বিরুদ্ধে যেন ‘ড্রাগস অ্যান্ড ম্যাজিক রেমেডিজ (অবজেকশনাবল অ্যাডভার্টাইজমেন্ট) অ্যাক্ট, ১৯৫৪’ অনুসারে অভিযুক্ত করে মামলা দায়ের করা হবে। (দৈনিক বর্তমান ১ মে, ২০০৩) এই নোটিস জারি করা হয় ২৮ নভেম্বর ২০০১ সালে। বলা হয়েছে – ম্যাজিক বা অলৌকিক ক্ষমতাবলে অসুখ সারানো বা মানসিক কোনো সম্যা সমাধানের প্রলোভন দেখানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এসবের বিজ্ঞাপন দেওয়াও বেআইনি। এই আইন চালু আছে ১৯৫৪ সাল থেকেই। এই আইন প্রথমবার ভাঙলে ছয় মাসের জেল ও ১০০০ টাকা জরিমানা হতে পারে। পরবর্তী অপরাধের জন্য এক বছর কারাদণ্ড হতে পারে। এই আইনের ঠ্যালায় যেসব স্বনামধন্য জ্যোতিষীরা দিল্লিতে জ্যোতিষগিরি করতে যেতেন তাঁদের ক্ষমতা হল খতম। দিল্লির তল্পিতল্পা গুটিয়ে জ্যোতিষীবাবুরা কলকাতায় পিছটান দিলেন। যাবে কোথায় ! আইনের হাত অনেক লম্বা। ১৯৯৭ সালের ১৮ জানুয়ারি, ‘The Indian Expressপত্রিকায় যে খবরটি প্রকাশিত হয়েছিল তা দেখে তাবড় তাবড় জ্যোতিষী এবং জ্যোতিষবিশ্বাসীদের চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গিয়েছিল, তা হল – “Gang of six impostors arrested। এরা হলেন পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত ছয় জ্যোতিষী। অপরাধ অবশ্যই ‘দ্য ড্রাগস অ্যান্ড ম্যাজিক রিমেডিস (অবজেকশনাবল অ্যাডভার্টাইজমেন্ট) অ্যাক্ট, ১৯৫৪ আইনের ৪, ৫, ও ৭ ধারা ভঙ্গ। তবু আজও জ্যোতিষচর্চা আর জ্যোতিষবাবুদের লোক ঠকানোর ব্যাবসা বহাল তবিয়তে চলছে।পাশাপাশি চলছে এই বুজরুকি ব্যাবসার অবলুপ্তির আন্দোলন। নিষিদ্ধ হোক প্রতারণা, জ্যোতিষ ব্যবসা। কঠোর থেকে কঠোরতর হোক আইন।
আমার এই লেখা পড়ে কোনো জ্যোতিষবাবু যদি বলেন জ্যোতিষ শাস্ত্র জ্যোতিষ বিজ্ঞান জ্যোতিষ চাঁদ-সূর্যের মতো সত্য, তবে তাঁদের জন্য আমার কাছে সুখবর আছে। রেইকি গ্রান্ডমাস্টার, ফেং শুই ক্ষমতার দাবিদার, জ্যোতিষ ও অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদারদের জন্য ২০ লক্ষ ভারতীয় টাকার চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করেছেন যুক্তিবাদী প্রবীর ঘোষ। এই চ্যালেঞ্জ ওনার মৃত্যু পর্যন্ত বলবৎ থাকবে, যতদিন প্রথম অলৌকিক ক্ষমতাবানের সাক্ষাৎ না হবে। অংশগ্রহণকারীরা কীভাবে তাঁদের সত্যতা প্রমাণ করবেন, তার বিস্তারিত প্রবীরবাবুর কাছেই পাবেন। প্রবীরবাবু আপনার জন্য আপনার অলৌকিক ক্ষমতা দর্শন করার জন্য অপেক্ষা করে আছেন। যোগাযোগের ঠিকানা  : প্রবীর ঘোষ, ৭২/৮ দেবীনিবাস রোড, কলকাতা – ৭০০০৭৪।
=======================================
কৃতজ্ঞতা সূত্র : (১) রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী – ফলিত জ্যোতিষ (২) বিজ্ঞান বার্তা প্রকাশনী -- জ্যোতিষের জালিয়াতি (৩) অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় -- জ্যোতিষ কি আদৌ বিজ্ঞান ? (৪) রত্নজিজ্ঞাসা – পীযূস দাস (৫) অর্জুন রায় -- জ্যোতিষ সম্পর্কে কয়েকটি অপ্রিয় প্রশ্ন (৬) ডাঃ পার্থসারথী গুপ্ত – বিজ্ঞানের আলোয় জ্যোতিষ (৭) গৌরীপ্রসাদ ঘোষ -- মহাবিশ্বে মহাকাশে (৮) নন্দলাল মাইতি – ইতিহাসে জ্যোতিষ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান (৯) অরূপরতন ভট্টাচার্য – প্রাচীন ভারতে জ্যোতির্বিজ্ঞান (১০) প্রবীর ঘোষ – জ্যোতিষীর কফিনে শেষ পেরেক (১১) প্রবীর ঘোষ – অলৌকিক নয়, লৌকিক (তৃতীয় খণ্ড)।

সমাপ্ত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

  1. নতুন কর অনেক কিছুই জানলাম। মানুষের মনের দুর্বলতার সুযোগ সবাই নেয় তাহলে জ‍্যোতিষরাই বা নেবেনা কেন।

    উত্তরমুছুন
  2. সব বুঝলাম। আমি ও জ‍্যোতিষ বিশ্বাস করি না। তাই আপনি যখন এত বড় প্রতিবেদন লিখলেন। আপনাকে ধন্যবাদ। তার সাথে আপনার কাছে একটি অনুরোধ রাখছি আপনি পারলে গ্রহ উপগ্রহ নক্ষত্র দিয়ে বারের নাম পালটে দিন যেমন রবিবার বাদ দিয়ে কলা বার সোমবার বাদ দিয়ে হনুমান বার একটি রাখুন পৃথিবী বার বা Earth day etc সপ্তাহ সাতদিন বাদ দিয়ে আটদিন করুন। চুনি এবং নীলা দুটি sapphire হলেও দুটো র রং আলাদা কেন বললেন না তো। দেখুন আমি কিন্তু জ‍্যোতিষ বিশ্বাস করি না। আপনি হয়ত google ঘেটে বলবেন বারের নাম দিয়েছিল গ্রীকরা তাদের দেবদেবতার নাম অনুযায়ী। কিন্তু মশাই ঋষি পরাশর কি 3500 বছর আগে চোখে telescope লাগিয়ে দেখেছিলেন মঙ্গল গ্রহ লাল শনি নিলাভ বৃহস্পতি হলুদ বুধ সবুজ শনির উপগ্রহ 119 যেমন পরিবেশ গুলিক কায়রন ধুম উপকেতু ইত‍্যাদি। পন্তিতি করার আগে পুরো পরাশর হোরা ভালো ভাবে পড়ুন। আবার বলছি আমি astrology বিশ্বাস করি না। কিন্তু সূর্য র আলো পৃথিবীতে না এলে কিছু ই থাকবে না। তেমনি গ্রহের উপর sun light reflection হয়। তার প্রভাব আছে। বিষয়টি অত্যন্ত জটিল। তবে আমাদের সমাজে সমস‍্যা জর্জরিত মানুষ অশিক্ষিত অলপবিদ‍্যা বেশভূষণধারী নামক জোতিষ এর কাছে ভাগ‍্য ফেরানো র জন‍্য প্রতি নিয়ত ঠকছে। তাই আপনার প্রতিবেদনর জন‍্য ধন‍্যবাদ। আমি ও কিছু পড়াশুনা করেছি এ বিষয়ে। তাই সব শেষে বলি astrology মানুষের ভাগ‍্য ফেরাতে পারে না। তবে কিছু দিশা দেখাতে পারে এবং কর্মই একমাএ ভাগ্য ফেরাতে পারে।

    উত্তরমুছুন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন