রিমি মুৎসুদ্দি - মায়াজম

Breaking

১১ আগ, ২০১৭

রিমি মুৎসুদ্দি





ট্রামলাইন










‘এখানে ছিলাম আমি
আমার মাথাটা ছিল প্রজাপতি
হাজার আলোকবর্ষ উড়ে এসে 
শহরের প্রেত আমি শহরে জন্মিয়ে
শহরেই পচে মরে গেছি।’- ভাস্কর চক্রবর্তী

আমাকে আজ কোন প্রশ্ন করো না। আমি জানি না কেন আমার জিভে নোনা স্বাদ লেগে রয়েছে? এ কি রক্তের স্বাদ না কি তোমার প্রিয় ভদকা? তোমার ঘামে ভেজা শরীরের লোনা গন্ধ এসে মিশেছে ওই ঠোঁটে। অথচ চুম্বন তো হয় নি কখনও আমাদের। শহর জুড়ে উৎসব আর তোমার চোখে শহরের রঙীন আলো। তুমি এ গলি সে গলি ঘুরে কোন নির্জন গলি খুঁজছিলে। গতজন্মের কবর খুঁড়ে অন্য এক শহরের অলিগলি সেদিন আমায় ডাকছিল। 
আমি ভাবছিলাম নিজের মত করে ঘুরব। ইতালি, ভেনিস থেকে রোম। আবার গ্রীস, সিরিয়া, প্যালেস্তাইন। আড্ডা দেব লিওনার্দো মিকেলাঞ্জেলোর সঙ্গে। আমি আমার শিল্পবোধের কথা বলব। আমার মুগ্ধতা জানাব। আমি ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন চাপানোতরের কথা আলোচনা করব না। বেয়োনেটের উদ্ধত নলের সামনে প্রতিদিন যে জুয়ারি মৃত্যুকে হারিয়ে দিয়ে জীবনকে জিতে নিচ্ছে অথবা জীবন নিজেই জিতিয়ে দিচ্ছে মৃত্যুকে, আমি তার গল্প করব না। মৃত্যু ঘটছে এক একটা বিশ্বাস, ভালবাসা আর ভরসার। আমি সে গল্প কখনও করব না। আমি সিরিয়ার মৃত শিশুটির কথা বলব না, যার নিথর দেহ মৃত্যু বিজ্ঞাপনের দূত হয়ে ছায়াপথের দেওয়াল জুড়ে অসংখ্য মানুষের অলীক সহানুভূতির বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। আমি গ্রীসের মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে যাওয়া অর্থনীতির বিষয়ে কোন কথা বলব না। 

আমি সেই সব শহরে যাব, যে শহরে ট্রামলাইন আছে। আবেগ বেশী বলে তুমি তো কোনদিন বসলে না মুখোমুখি। অনিবার্য দুপুরগুলোও আশ্চর্য এক মৃতনগরীর ভ্রমণকাহিনী হয়ে উঠেছে। তোমার থাকা না থাকার অনুভূতিগুলো একটা বাক্সের মধ্যে গুছিয়ে নিয়েছি। এই বাক্সের নাম দিলাম ‘আমার পৃথিবী।’ আমার প্রথম যাত্রা হল দেশপ্রিয় পার্কের সেই ট্রামলাইন বরাবর হেঁটে যাওয়া। যেখানে কখনও ধানক্ষেত ছিল। সেই ধানক্ষেতে আরও একশবছর আগে শুয়ে ছিল কোন এক রোমান্টিক পুরুষ। যার ভালবাসায় শুধুই হাইপারবৌল বা অতিশয়োক্তি ছিল না। যার ভালবাসায় লুপ্ত নগরীর রাতের কল্পনা সীমানা ছাড়িয়ে পাড়ি দিয়েছিল দূর থেকে আরো দূরে। সেই বিমূর্ত ভালবাসার কাছে আমি দুদণ্ড শান্তির খোঁজ করব। নতজানু হব সেই অদৃশ্য অভিজাত কবরের কাছে। 
আমি কবি নই, তবু আমার জীবনেও একটা ট্রামলাইন আছে। আর তাই তো কবি তোমাকে সঙ্গে করে অভিজাত রেস্তোরাঁয় বা তোমার প্রিয় পানশালায় আর যাওয়া হল না। রাস্তা পেরিয়ে উল্টোদিকের ফুটপাথে আসতে গেলে তোমায় গাড়ী থেকে নামতে হত। দামী গাড়ীর এখনও এম আই শোধ করা হয় নি। অহেতুক ঝুঁকি নিয়ে কোন ইতিহাসের সমাপতন কি সম্ভব? 

রেস্তোরাঁর কথায় মনে পড়ে গেল কোন এক কুস্তীগির রেস্তোরাঁ মালিকের কথা। যিনি ট্রামের নীচ থেকে টেনে বার করেছিলেন আধুনিক বাংলা কবিতার প্রবল প্রতিভাসম্পন্ন কবিকে। সেই অশুভ মুহুর্তে অনিবার্যভাবে থেমে যায় যে রোমান্টিসিজম, তা আর কখনই কোন আকুতি ছড়িয়ে বলে উঠবে না- 

‘ফিরে এসো সুরঞ্জনাঃ
নক্ষত্র রুপালি আগুন ভরা রাতে;
ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়েঃ
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;
দূর থেকে দূরে- আরো দূরে
যুবকের সাথে যেয়োনাকো আর।’- (সাতটি তারার তিমির, জীবনানন্দ দাশ)


পুরুষতন্ত্রের ফাঁদে আটকে যাওয়া প্রেম আর তুল্যমূল্য বিচার, পরিমাপের আশায় তুলাদণ্ডে রাখা দেশপ্রেম কোন এক অযুত-নিযুত কাল থেকেই ধরা ছোঁয়ার বাইরে। পেলেট গানের শাসনে আটকে রাখা গণতন্ত্র আর অনিচ্ছুক যোনিপথে ঢুকে যাওয়া গরল শয়ে শয়ে শব হয়ে গড়ে তোলে কোন এক মৃত্যু উপত্যকা। আমি ভয়ে পেয়ে ছুঁতে চাই বহুযুগ আগের হারানো বালি পাহাড়কে। ট্রামলাইন বারবার ফিরে আসে আমার কাছে। হয়ত বা আমি নিজেই চলে যাই ব্ল্যাক কফির কড়া গন্ধ অথবা কোল্ড কফি উইথ ক্রীমের মিষ্টি গন্ধে জীবনকে চিনে নিতে। ট্রাইমলাইন ধরে আমি অনেকটা এগিয়ে যাই। 

কলেজ-স্কোয়ারে বৃষ্টি ভেজা ভিজতে ভিজতে, ইউনিভার্সিটির সামনে থেকে ট্রাম ওঠার সময় এক অদ্ভুত আদিম গন্ধ ডাকাডাকি করত। ঠিক সোঁদা নয় কেমন যেন জলের গন্ধ! ব্যস্ত কলেজ-স্কোয়ার, হাজার লোকের আনাগোনা, ভীড় ট্রাম-এই সব ছাপিয়েও গন্ধটা লেগে থাকত ফেভিকলের আঁঠার মত। ট্রামটা হেদুয়ায় এলে আবার অন্য বায়বীয় জগতে পৌঁছে যেতাম। হেদুয়ায় সুইমিং-পুল থাকলেও সেনাপতির রোল বা চাউমিনের গন্ধই বাতাসে ভেসে বেড়াত। ট্রামটা হাতিবাগানে এলে আবার সে সব গন্ধ মিলিয়ে যেত। যদিও মালঞ্চ, মিত্র-কাফে, কে-সি-গোপ সব ওই একই অঞ্চলে। তা’ও হাতিবাগানের গন্ধটা একটু অন্যরকম ছিল। তখনও স্টার-থিয়েটার ছিল না হাতিবাগানের মোড়ে! সদা ব্যস্ত হাতিবাগানে বরং নতুন জামা-কাপড় বা বাটা-শ্রীলেদার্সে জুতোর গন্ধ পেতাম। এইসব মধ্যবিত্ত গন্ধবিলাসের মধ্যেও উত্তর কলকাতার ফুটপাথ জুড়ে পলিথিনের শীটের আড়ালে প্যাকিং বাক্সে গোছানো সংসারগুলো দেখলে কি আশ্চর্য অনুভূতিহীন মনে হত। সারাদিনের অজস্র মানুষের আনাগোণা আর রাতের ল্যাম্পপোস্টের তীব্র আলোয় আড়াল কোথায়? কী ই বা রহস্য ফুটপাথ জুড়ে কখনও বা বড় রাস্তায় চলন্ত গাড়ীর প্রায় কাছাকাছি চলে আসা অগুণতি শিশুদের? আকাশ জোড়া নক্ষত্রদের জন্মরহস্য বা ঈশ্বরকণার সন্ধান পেলেও এই শিশুদের জন্মরহস্যগুলো আজও অজানাই রয়ে গেল। যদিও আমি জানি পলিথিনের শীটের আড়ালে ওই ফুটপাথেই তাদের বাবা-মা’রা সঙ্গম করেছে। হাঁসপাতালের সাদা বিছানা নয়, ফুটপাথই হল প্রথম আশ্রয়স্থল বহু নবজাতকের। ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া খাবার বা দাক্ষিণ্যই সম্বল সেই শৈশবের।

আমি ট্রামলাইন ধরে কলকাতার রাস্তায় ঘুরলেও আমার চিন্তা ভাবনারা পৌঁছে গিয়েছে দিল্লিতে। আজ আর কোন একলাইনের কবিতার কাছে ঋণী নই। ল্যাম্পপোস্টের আলোর নীচে জমে থাকা অন্ধকারে সমস্ত গাছগাছালিরা প্রেত নৃত্য করে চলেছে। মেরিলিন মনরোর রাত পোশাক পরা প্রচ্ছদের উপর তেরছাভাবে এসে পড়া আলোয় আরো অনেক বেশি বোল্ড মনে হয় শহরের রাতপরীদের। পুরানো দিল্লির এই আদি অঞ্চলেও একসময় ট্রামলাইন ছিল। তখনও দেশভাগের ক্ষত এসে আছড়ে পড়েনি শহরে। দেশভাগ পরবর্তী শহরে লাহোর থেকে, পাঞ্জাব থেকে ক্রমাগত জীবনের সন্ধানে ভীড় করা মানুষের মিছিলে স্থানাভাবের অভাবে কৌলিন্য হারিয়ে অবলুপ্তির পথে যাত্রা করেছিল শতাব্দীর শেষ ট্রাম। 

কোন এক অশুভ ট্রামের ধাক্কা শহরের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত জীবনকে ও মধ্যবিত্তের ফিলগুড বিজ্ঞাপনকে ক্রমশই তিন থেকে ছয়, ছয় থেকে আট লেনে বিন্যস্ত করে ফেলেছে। কঠিন কেজো শহরগুলিতে কোন এক কমিউন কাব্য উৎসবের আয়োজন করতে আজও উৎসাহের অন্ত নেই। এই কবিতাযাপনের ‘কোন ম্যানিফেস্টো নেই, রয়েছে কিছু কিছু সিনড্রোম।’ সেইসব সিনড্রোমের পরিসর ভিন্ন। আপাতত এসপ্ল্যান্ডের ট্রামডিপো থেকে ভোরের প্রথম ট্রাম রাতজাগা ভিক্টোরিয়ার পরিদের দুচোখে ঘুম নামিয়ে, শহরের যাবতীয় নির্লজ্জতাকে সৌরকরময় প্রভাতের মুখোমুখি করে দিচ্ছে।




লেখক পরিচিতি-দিল্লির দ্রুতগামীতার মধ্যে আচমকাই খুঁজে পাওয়া নিজেকে। খোঁজ অবশ্য আজীবনই সঙ্গী হবে। তবে খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেছি অনেক গদ্য(নষ্ট, পবিত্র), সংলাপ, ধোঁয়াশা, আতসবাজি, আরো অনেক কিছু যা বর্ণনা করতেও আবার নতুন করে কোন একদিন বসতে হবে শব্দ, অক্ষর আর বর্ণমালা নিয়ে।
পেশায় অর্থনীতির শিক্ষক, অল্পস্বল্প লেখালেখি কখনও আনন্দবাজার ডিজিট্যাল নিউজে কখনও বা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়, ওয়েবম্যাগাজিনে। ভাল লাগে মানুষকে জানতে, প্রতিটা জানা এক নতুন গল্প হয়ে ধরা দেয়।


                                                                                                                                                                                                                           

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র