শৌনক দত্ত - মায়াজম

Breaking

১১ আগ, ২০১৭

শৌনক দত্ত

               মানিক মনের ঘরে বাইরে.......



পুরান দত্ত সাহিত্যিক হিসেবে বেশ পরিচিত নাম। আজ সকালেই দিল্লি এসেছে কি একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে।চিত্তরঞ্জন পার্ক কালীবড়িতে তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।খবরটা পেয়ে ছুটে এসেছে মিত্রা তার ছেলে ও বর কে নিয়ে।ছোট্টবেলার বন্ধু নিখিলেশ,সৌরজিৎ,পৌলমিরা এসেছে গুরগাও থেকে।সন্ধ্যারতির পর কালীবাড়ীর সামনের সবুজমাঠে বসে আড্ডা বেশ জমে ওঠেছে।নিখিলেশ দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়।সৌরজিৎ পেশায় ইঞ্জিনিয়ার হলেও সাহিত্যপ্রেমী,একসময় তুখোড় ছাত্রনেতা ছিলো।পৌলমিকে বিয়ে করে এখন দিল্লিতে সেটেল।পৌলমি বরাবর ভাল ছাত্রী,এখন একটি নামকরা কোম্পানীর সি.এ। 

এলোমেলো কথাই হচ্ছিলো,পৌলমি পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রাজনীতি থেকে আড্ডাটা কে সাহিত্যের তিরিশ চল্লিশের গত দশকে নিয়ে যেতেই সৌরজিৎ হামলে পড়লো,গত শতাব্দীর তিরিশ ও চল্লিশের দশক বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে যেমন, সাহিত্যের ইতিহাসেও তেমনি ঘটনাবহুল ও অবিস্মরণীয় কাল। বাংলা সাহিত্যের জন্যও এ কথা সমভাবে সত্য। এ সময় বাংলা কবিতায় যেমন আধুনিক ধারা সূচিত হয়, একইসঙ্গে বাংলা কথাসাহিত্যে ইস্পিত আধুনিকতা আবির্ভূত হয় এ সময়েই। তবে কবিতার অনুবাদ সংশ্লিষ্ট বা নির্ভর আধুনিকতার তুলনায় কথাসাহিত্য অনেক বেশি স্বায়ম্বর ও প্রাচুর্যময় ছিল। আসলে একইসঙ্গে এতগুলো কর্মচঞ্চল ও শক্তিশালী বিশ্বমানের লেখক-কবির উপস্থিতি বিশ্বের ইতিহাসেই বিরল।

-কেন কথাসাহিত্য কেন।কবিতাতেও তখন বাংলাসাহিত্য উজ্জ্বল।
পৌলমির কথার রেশ ধরে নিখিলেশ বলে,সৌর কিন্তু বলেনি কবিতা অনুজ্জ্বল কিন্তু ও বলছে রবীন্দ্র নাথ থেকে বেরোনোর যে প্রচেষ্ঠা তখন বাংলা কবিতায় তা অনেকাংশে অনুবাদ নির্ভর এবং আমরা বলতে পারি কবিতার বিনির্মাণ।রবীন্দ্র-উত্তর আধুনিকতা, বিশেষত তাঁর ভাব নির্ভরতার বিপরীতে মানুষের বহির্জীবন ও অন্তর্জীবনের বৈচিত্র্য এবং সংগ্রামকে সফলভাবে তখন বাংলা সাহিত্যে ফুটিয়ে তুলেছে কথাসাহিত্য।

মিত্রা ভাল লেখক এবং সম্পাদক।সে এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিলো,আমার মনে হয় কথাসাহিত্যে রবীন্দ্র-উত্তর আধুনিকতা, বিশেষত তাঁর ভাব নির্ভরতার বিপরীতে মানুষের বহির্জীবন ও অন্তর্জীবনের বৈচিত্র্য এবং সংগ্রামকে যিনি সবচেয়ে সফলভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন তিনি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।জীবনবঞ্চিত সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঔদার্য আর চিত্তমহত্ত্বকে সমৃদ্ধ করেছে মানুষের প্রতি বিশ্বাস ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি। জীবন কোনো চেতনার চলমান বিবৃতি নয়, বরং তা অনুভূতিপ্রবণ হৃদয়ের সত্যনিষ্ঠ উচ্চারণ। তাই সত্য ও সুন্দর জীবনের শৈল্পিক অপরিমিতিবোধ সাহিত্যের রসনিষ্পত্তিতে কখনো লেখককে বঞ্চিত করেনি। বিজ্ঞানমনস্কতা আর জীবনের প্রতি একনিষ্ঠ তৃষ্ণায় তাই বৈপরীত্যজনিত কোনো সমস্যার সৃষ্টি হয়নি। কিশোর বয়স থেকেই মানিক সাহিত্যের শিল্পোৎকর্ষ সাধনে সচেষ্ট ছিলেন। সে-সময় ভারতবর্ষের শিল্পবিপ্লব, ইউরোপীয় রেনেসাঁস রোমান্টিসিজমের উদ্ভব, বাংলার নবজাগৃতি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মানুষের বিপর্যয় মনোবিকিরণ - এসবই মানিক মানববৃত্তি-বেষ্টিত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করেছেন। এ জন্য তাঁর অভিজ্ঞতা পরিমন্ডলের জীবনতৃষ্ণা আর সাহিত্যচর্চা এক দেহে লীন হয়ে গিয়েছিল। একদিকে তিনি মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণির জীবনকোষে যেমন গ্লানি, টানাপড়েন, ক্লেদকে দেখেছেন অন্যদিকে বিপন্ন-বিধ্বসত্ম শ্রমজীবী মানুষের হৃদয়ের সুস্থতা ও প্রাণময় দক্ষতাও লক্ষ করেছেন।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যের সূচনা তো কলেজে বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে লেখা প্রথম গল্প ‘অতসীমামী’ দিয়ে।তাই তো?পৌলমির প্রশ্ন।
সৌর উত্তর দেয়-হুম সেটাই প্রথম লেখা তবে খানিকটা আকস্মিক হলেও তা মোটেই সাধারণ ছিল না। প্রথম গল্পগ্রন্থভুক্ত ‘মহাসংগম’ গল্পটি সম্পর্কে অধ্যাপক নির্মাল্য আচার্য বলেছিলেন, ‘এর তুল্য গল্প বিশ্বসাহিত্যে কদাচিৎ মিলবে।’ প্রথম গল্প প্রকাশের সময় তিনি তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক ‘প্রবোধকুমার’ নামের স্থলে ডাক নাম ‘মানিক’ ব্যবহার করেন। ১৯৩৪ সালে ‘বঙ্গশ্রী’ সাহিত্য পত্রিকায় ‘দিবারাত্রীর কাব্য’ উপন্যাসটির ধারাবাহিক প্রকাশের মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর যাত্রা শুরু হয়। পরের বছর ‘পূর্ব্বাশা’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসটি। ১৯৩৫ সালে ‘জননী’, ‘দিবারাত্রীর কাব্য’ উপন্যাস এবং ‘অতসীমামী ও অন্যান্য গল্প’ গল্পগ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাঁর গ্রন্থকার হিসেবে যাত্রা শুরু হয়।


প্রথম উপন্যাসেই মানিক অভিনবত্বের সূচনা করেন। তাঁর সাহিত্য সমসাময়িক ইতিহাস ও সমাজের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। সমাজের তল খুঁজতে গিয়ে, মানুষের প্রতি অধিকতর দায়বদ্ধতা থেকে তিনি অবধারিতভাবেই রাজনীতিতে জড়িয়েছিলেন। সে রাজনীতি মানবমুক্তি-সমাজ প্রগতির রাজনীতি। তাই বলে তার সাহিত্য মান কমে গেছে, নিন্দুকের এমন প্রচার সত্য নয়। বরং তাঁর লেখনি এতটা উর্বর ছিল যে, সমসাময়িক বিষয়ের প্রতি সাবলীল সাড়া দিতে পেরেছেন। পরবর্তী পর্যায়ে তাঁর সাহিত্যে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষাতত্ত্ব ও মার্ক্সীয় বিশ্ববীক্ষাযুক্ত সফলভাবে যুক্ত হয়েছে। সাহিত্যে উঠে এসেছে সেই সব মানুষের জীবন ও সংগ্রাম।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লেখক হিসেবে, সাহিত্যে সৎ থেকেই কমিউনিজমে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। চল্লিশের দশকের প্রথম দিকে তিনি ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ’-এ যুক্ত হন। ’৪৪ এর শেষের দিকে যুক্ত হন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে। যুগপৎ লেখক ও রাজনীতিক হিসেবে তাঁর যাত্রা শুরু হয়। তিনি পরবর্তীতে ‘প্রগতি লেখক সংঘ’র সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। মূলত শ্রমিক ধর্মঘটের প্রেক্ষাপটে দুই খণ্ডে রচিত ‘শহরতলী’ উপন্যাসটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বামপন্থী বুদ্ধিজীবী মহলে তাঁর সাড়া পড়ে। দাঙ্গার পটভূমিতে কলকাতার বেহাল নগরজীবন নিয়ে রচিত হয় তাঁর প্রখ্যাত রাজনৈতিক উপন্যাস ‘স্বাধীনতার স্বাদ।’ বাঙালি সমাজের হতাশা, গ্রামীণ জীবনের অবহেলা, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অসারতা নিয়ে লেখেন শ্লেষাত্মক উপন্যাস ‘অমৃতস্য পুত্রাঃ’।

আমার কি মনে হয় জানিস?পুরান কথাটা বলতেই সবাই ওর মুখের দিকে তাকায়।পুরান সেই স্কুল জীবন থেকে লেখালেখি করছে।সব বন্ধুরা যখন প্রফেশন কেরিয়ার নিয়ে ব্যস্ত তখন পুরান সাহিত্যের বই পড়ে বেড়াচ্ছে।যদিও পুরান ছিলো সাইন্সের ছাত্র।আমার মনে হয়-পরাজয় স্বীকারে কুণ্ঠিতচিত্ত শ্রমজীবী মানুষ জীবনত্রয়ী সংগ্রামে সমগ্রতা দিয়ে আজীবন লড়ে যায় - এই বোধ মানিক তাঁর দৈন্যক্লিষ্ট বেদনামথিত অন্ত:সারশূন্য জীবন থেকেই উপলব্ধি করেছেন। আর এই জীবনদর্শন ও উপলব্ধিজাত অনুভূতিই মানিক-সাহিত্যের শিল্পকর্মকে উজ্জ্বল ও দৃষ্টিগ্রাহ্য করেছে। আবাল্য লালিত জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা আর প্রেরণাই তাঁর উদ্ভাসিত মানবশক্তির মূল উৎস। নিম্নঅধ্যুষিত মানবের জীবন-যন্ত্রণার প্রাবল্যও তিনি বিজ্ঞানপ্রীতি দিয়ে বিচার করেছেন। বিজ্ঞানের প্রত্যয়ই তাঁর চেতনাশ্রয়ী মূল্যবোধ শিল্পসমগ্রতা দান করেছে। ভাববাদ আর বস্ত্তবাদের ব্যবধান তাঁর সৃষ্টিকে গভীর দ্বন্দ্বে আস্থাহীন করে তুলেছিল। পরবর্তীকালে অতীত চিমত্মা-চেতনা থেকে বেরিয়ে এসে বস্ত্তনিষ্ঠ সমাজ-সচেতনতাই তাঁর সাহিত্যের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। মানিকের বস্ত্ত জাগতিক চিন্তা-চেতনা অপ্রাপ্তির মহা অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়েও বিষয় অন্বেষণ, শিল্পদৃষ্টি ও শিল্পরীতিতে প্রোজ্জ্বল এবং আধুনিক হয়েছে। নৈঃসঙ্গ্যবোধের বেদনায় তিনি আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকলেও যুক্তিশৃঙ্খল চেতনামগ্ন বাসত্মবতার রহস্য উন্মোচনে তাঁর মনের গভীরতম প্রদেশে বিজ্ঞানবোধ আর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অধিক ক্রিয়াশীল ছিল। মানুষ ও মানুষের জীবনচিত্রই ছিল মানিক-সাহিত্যের মুখ্য বিষয়। সেখানে অবচেতন মনের বেদনার্ত অনুভূতি-অনুসারিত কল্পনার ঐশ্বর্য সর্বাত্মক হয়ে ওঠেনি। বস্ত্তজগৎ ও মনোজগৎ, হৃদয়জাত অনুভূতি, মননশীলতা, সর্বোপরি মানুষ - এগুলো নিয়েই তাঁর লেখকসত্তা আলাদা মাত্রায় উন্নীত হয়েছে। তাঁর সামগ্রিক নৈতিকতাবোধ, কৃষ্টি, ঐতিহ্য, সভ্যতা, সংস্কৃতি, সমসাময়িক যুগ, ধর্ম প্রতিটি সৃষ্টির শরীরে অনুভবময় আনুগত্য প্রকাশই মানিকের শিল্পবোধকে রসাশ্রিত করেছে। আমৃত্যু মানিক বেদনার্ত অনুভূতিপুঞ্জের অন্তর্গূঢ়তায় জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজেছেন। তাই সাহিত্য তাঁর কাছে ছিল সাধনা আর তপস্যার বিষয়।যন্ত্রণা, সাধনা, কষ্ট আর বিদগ্ধতার মধ্যেই জীবনকে দেখতে হবে পরিশ্রমের দ্বারা। মানুষের মনোময় মনস্তাত্ত্বিক জগৎ-দর্শনেও লেখককে বিরামহীন শ্রম দিতে হবে - এটাই ছিল তাঁর উপলব্ধিজাত অনুভূতি। জীবন-সমষ্টিকে অন্বেষণ, ক্ষুদ্রকে নিয়ে বৃহৎ জীবনোপলব্ধির নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াসেই লেখক সার্থকতার মূলস্তম্ভ নিহিত। তত্ত্বাশ্রয়ী সুস্থির পরিমিত চেতনালোকের শৈথিল্যও লেখকের অসফলতার জন্য দায়ী হতে পারে। এখানে মানিকের অভিজ্ঞতাপুষ্ট বক্তব্য আমি এভাবেই দেখেছি -


ঘরে শিল্প-সাহিত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের পুঁজিপাটা আর ঘরে-বাইরে সর্বত্র সবসময় মানুষকে আর জীবনকে তন্ন-তন্ন করে দেখা ও জানা এবং মনের মধ্যে তাই নিয়ে তোলপাড় করা, যোগ-বিয়োগ করা, মিলিয়ে দেখা আর অমিল খোঁজা ও সব কিছুর মানে বোঝার চেষ্টা - লেখকের বিরামহীন এই শ্রম... শ্রমটা লেখকের ধাতে দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু সাধনা ধাতস্থ হলেও সেটা শ্রম বইকি।... যত বড় প্রতিভা থাক সাধনায় ঢিল পড়ার অর্থই লেখক ও লেখার অধঃপতন।

জীবনীশক্তির সাধনার ওপর দাঁড়িয়েই একজন লেখক দায়িত্ববান ও প্রতিশ্রুতিশীল হয়ে ওঠেন। তাই শুধু রসনিঃসৃত আনন্দ অনুধাবন করাই শিল্পের মূল উদ্দেশ্য নয়। সাহিত্যিককে সর্বদাই সমাজ-সতর্ক হতে হয়। প্রত্যেক লেখকেরই শিল্প-সাধনার মূল বিবেচ্য মাধ্যম হচ্ছে পাঠক। পাঠকের অভিরুচির ওপর আত্তীকৃত লেখক কখনোই হবেন না। লেখক তাঁর তত্ত্বাশ্রয়ী সুস্থির পরিমিত চেতনালোকে উত্থিত প্রবল হৃদয়াবেগের সমৃদ্ধিতে অবনতিশীল পাঠককুলকে সতর্ক করে তুলবেন। আর এটাই লেখকের সামাজিক দায়বদ্ধতা। যে-কোনো সৃষ্টিশীল লেখক তাঁর চারপাশের সামাজিক অসংগতিকে চিহ্নিত করে পাঠকের চেতনালোককে উদ্দীপ্ত করেন। আর পাঠক তাঁর বোধ-বিবেচনা ও মননশীলতায় নিজেকে আরো পরিশীলিত করেন। তাই লেখক এখানে পাঠকের প্রতি শিক্ষাদাতার ভূমিকাই পালন করেন। এ-সম্পর্কিত মানিকের উপলব্ধিজাত অনুভূতি এভাবেই প্রকাশ পেয়েছে -
লেখক কে? পিতার মতো যিনি দেশের মানুষকে সমত্মানের মতো জীবনাদর্শ বুঝিয়ে-শিখিয়ে-পড়িয়ে মানুষ করার ব্রত নিয়েছেন। পিতার মতো, গুরুর মতো জীবনের নিয়ম-অনিয়ম, বাঁচার নিয়ম অনিয়ম শেখান বলেই অল্পবয়সী লেখক-শিল্পীও জাতির কাছে পিতার মতো, গুরুর মতো সম্মান পান। এটাই আসল কথা। দেশের লোকের সত্তা খাতিরকে লেখক-শিল্পী খাতির করেন না। দরকার হলে দেশের মানুষকে কান মলে শাসন করার অধিকার খাটাতে লেখক-শিল্পীর দ্বিধা বা ভয় হওয়ার কথা নয়।

সমাজ আর জীবনের প্রতি দায়বদ্ধতাই মানিকের দৃষ্টিশক্তিকে সমগ্রতা দান করেছে। তাই মানিকের চিন্তা-চেতনা, ভাবনা, চেতনালোক, কর্ম ও বিশ্বাসে কখনো আমরা অবহেলা বা প্রবঞ্চনা দেখিনি। মানবসভ্যতার প্রতি তাঁর আস্থা, জীবনানুভূতির রসআস্বাদন, ব্যক্তি-জীবনোপলব্ধি, শিল্পবোধের অবিচ্ছেদ্য বন্ধনের কথা আমরা বারবার স্মরণ করি। ব্রিটিশশৃঙ্খলিত ভারতবর্ষের অস্তিত্ব বিপন্ন শ্রেণিস্তরের বেদনার্ত জীবনাচরণের সত্যনিষ্ঠ পথ অনুধাবনও এ-ক্ষেত্রে মানিককে সাহায্য করেছে। মধ্যবিত্ত জীবনের টানাপড়েন, যন্ত্রণা, বিকারগ্রস্ততা মানিকের শিল্পবোধকে অনেক বেশি শাণিত করেছে। সমসাময়িক মধ্যবিত্ত জীবনের প্রতি দৃষ্টি দিলেই আমরা তাঁর সৃষ্টির একাগ্রতা ও একনিষ্ঠতার উন্মীলন লক্ষ করি। পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় তাই বলেছেন – ‘তার বীক্ষা তাঁকে এই উপলব্ধিতে নিয়ে গিয়েছিল যে, মধ্যবিত্ত সত্তা বিপর্যসত্ম, ভবিষ্যৎহীন, নানা কানাগলিতে বদ্ধ।’ 
মিত্রার বর ছেলেকে নিয়ে শিবমন্দিরের সিঁড়িতে বসেছিলেন।তিনি কখন উঠে এসে মিত্রার পাশে বসেছে কেউ খেয়াল করেনি।পুরানের কথা শেষ হতেই তিনি বললেন-মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়ে যখন কথা হচ্ছে আমার অনেকদিনের একটা প্রশ্ন আজ আপনাদের কাছে করতে চাই।নিখিলেশ একগাল হাসি ছড়িয়ে দিলো,সেকি মশাই আপনার ঘরে সাহিত্যের এতবড় একজন থাকতেও এতবছর প্রশ্ন পুষে রেখেছেন?নাকি মিত্রা বলার সুযোগ দেয় না?

-নিখিলেশ একদম বাজে বকবি না।ও বরং আমায় বলার সুযোগ দেয় না।

মিত্রার বর বন্ধুদের ইয়ার্কিতে একটু লজ্জাই পেলো মনে হলো পুরানের।পুরান সবাইকে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্নটা শুনতে চাইলো।

-মানিক-সাহিত্যের অধিকাংশ সমালোচক তাঁর সাহিত্যের পর্বকে দুটো ভাগে ভাগ করেছেন।সে সম্পর্কে আপনাদের মতামত কি?আর এই প্রসঙ্গেই জানতে চাই ফ্রডেয়ী প্রভাব কি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে মানিকের লেখাকে পথভ্রষ্ট করেছিলো?
পুরান মুচকি হাসলো।অসাধারণ জিজ্ঞাসা এটা নিয়ে সৌর কিছু বল।

-আমি না এটা নিয়ে নিখিলেশ বলুক।আমি এতটা গভীর জানিনা।

মানিক সাহিত্যে মৃত্যু-চিন্তা, রোমান্টিকতা, বিরহ প্রেমানুভূতির সঙ্গে নৈর্ব্যক্তিক, নারী-সৌন্দর্যের ধ্যান, প্রবৃত্তিতাড়িত বোধ সবকিছুর পশ্চাতে থেকেছে তাঁর নিগূঢ় রহস্যতাড়িত জীবনানুভূতি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিল্পদৃষ্টির স্বরূপ উন্মোচন করতে গেলে তাঁর সাহিত্য-প্রতিভার বহুমুখী বৈচিত্রকে আমাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে আনতে হবে। মানিক-সাহিত্যের অধিকাংশ সমালোচক তাঁর সাহিত্যের পর্বকে দুটো ভাগে ভাগ করেছেন। তাঁর কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদানের পূর্বে (১৯৪৪) আর উত্তরকালের সাহিত্যের দুটি রূপের কথা বলেছেন। আবার কোনো-কোনো সমালোচক তাঁর উত্তরপর্বকে ১৯৪৭-এ ভারতের স্বাধীনতা-পূর্ব ও স্বাধীনতা-উত্তর এই দুভাগে ভাগ করেছে। একদল বলেছে, মানিকের প্রথম পর্বের রচনার চেয়ে উত্তরপর্বের রচনা উৎকৃষ্টমানের - এরা মার্কসীয়। আরেক দল বলেছেন, প্রথম পর্বের রচনাই শ্রেষ্ঠ, উত্তর পর্বের সাহিত্যের শিল্পমান নিকৃষ্ট - এরা সাধারণত অমার্কসীয়। তৃতীয় দলের সমালোচকরা অধিকতর দায়িত্বশীল ও মুক্তমনের। এঁরা মানিকের প্রথম পর্বের বেশির ভাগ রচনার সমৃদ্ধ শিল্পরীতি সম্পর্কে প্রশংসামূলক মন্তব্য করেও তাঁর উত্তরপর্বের সৃষ্টিকর্মের তাৎপর্যকে অস্বীকার করেননি। মানিকের মার্কসীয় চিমত্মা-চেতনার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই তাঁর উত্তরপর্বের রচনার মূল্যায়ন করেছেন। কেউ-কেউ বলেছেন, বিভাগোত্তর কালের মার্কসীয় সাহিত্য-বিতর্কসূত্রে পারস্পরিক মতান্তর ও মনান্তর মানিকের অনেক মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়েছিল - এরূপ মানসিকতা এবং পরিবেশে ভালো কিছু সৃষ্টি করা অসম্ভব ছিল। সবাই এ-যুক্তির পক্ষেও ছিলেন না। পর্ববিভাজনগুলো মানিকের শিল্পরীতির সম্পূর্ণ রূপসন্ধানে পুরোপুরি ব্যর্থ - এমন উক্তিও অনেকে করেছেন।

মিত্রার বর নিখিলেশের কথায় বেশ সন্তুষ্ট হলেন মনে হলো।আর ফ্রডেয়ী প্রভাব।নিখিলেশ পুরানকে বলে তুই বল তোর কি মনে হয়।দেখুন দাদা আমার মনে হয়,মানিকের উপন্যাসে যে-পরিবর্তন - ফ্রয়েডীয় যৌন বাস্তবতা থেকে অর্থনৈতিক ও সমাজবাদী বাস্তবতার দিকে এটাকে বিশেষ এক কালসীমার দ্বারা চিহ্নিত করে, বা তাঁর কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদানের ঘটনার দ্বারা ব্যাখ্যা করা যাবে না। এটা তাঁর হঠাৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ নয়, এটা তাঁর পথভ্রষ্টতাও নয়, এটা তাঁর জীবনবোধের এক স্বাভাবিক সত্য পরিণতি।


দারিদ্র্য, আসক্তি, রোগ - এই তিন যন্ত্রণাময় শত্রম্নর সঙ্গে মানিক আজীবন সংগ্রাম করেছেন; আবার বারবার জয়ীও হয়েছেন। তাঁর শেষ জীবনে বয়োবৃদ্ধি ও ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে এই তিন শত্রম্ন তাঁকে কাবু করে ফেলেছিল। কিন্তু তিনি হেরে গেছেন এই তিন শত্রম্নর আক্রমণে এমনটি নয়। তিনি পরাসত্ম হলেন যাঁদের তিনি সহকর্মী ও সহযোদ্ধা জেনেছিলেন তাঁদের আক্রমণে।
চল্লিশ দশকের শুরুতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর, কাঙিক্ষত স্বাধীনতা-আন্দোলনের পটভূমিতে মানিক নতুন সত্তায় ও আকাঙক্ষায় উজ্জীবিত হয়েছিলেন, যা তাঁর শিল্পসত্তা বিকাশের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। নতুন সমাজ-দর্শন তাঁর শিল্প-মানসকে অনেক পরিমার্জিত ও সংযত করেছে। তাঁর সৃষ্টিশক্তিকে ধরাতলবাসী করেছে মূলত ১৯৪৮-৫০-এর অস্বাস্থ্যকর মার্কসীয় সাহিত্যযুদ্ধ এবং বন্ধুদের মধ্যে অনৈক্যের পীড়ন, এর সঙ্গে ১৯৪৯ থেকে ভাড়াবাড়ির জীবনে দারিদ্রতার অসহনীয় পীড়ন, রোগব্যাধি-আসক্তির আক্রমণ। এসব কারণই তাঁর জীবন-বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। শিল্পীজীবনের সমগ্রতায় সৃষ্টিশক্তির পূর্ণ বিকশিত দুর্লভতায় উচ্ছ্বসিত রূপ বর্তমান - এমন প্রতিভা বাংলা আধুনিক সাহিত্যে বিরল, বরং বেশির ভাগ সময় সৃষ্টির বিপন্ন-বিধ্বসত্ম হ্রাস-বৃদ্ধির রূপই আমরা লক্ষ করি। মানিকের জীবনোপলব্ধির স্বাতন্ত্র্য, রুচিবোধ, চৈতন্যের সূক্ষ্ম রূপান্তরধর্মিতা অধিকতর প্রশংসাযোগ্য। আর তা তাঁর ছোটগল্পের সমাজসত্য উন্মোচনের ক্ষেত্রে আরো বেশি প্রযোজ্য। মানিকের সাহিত্যসৃষ্টি বিশুদ্ধতা-যুক্তির অভিযাত্রায় তাঁর সাহিত্যভান্ডারের প্রতিটি সত্যকে চিহ্নিত করতে পারলেই আমরা তাঁর সৃষ্টির শিল্পরীতির মহত্ত্বকে আবিষ্কার করতে পারব। তাই বাংলা সাহিত্যে মানিকের জীবনাগ্রহ ও তাঁর সূক্ষ্ম আত্মসজাগতা আমাদের অধিকতর মর্যাদা-সতর্ক করে তোলে।
নিখিলেশ কি একটা বলতেই যাচ্ছিলো,একটা ছেলে এসে দাঁড়ালো।

-দাদা,ক্যান্টিন তো বন্ধ হয়ে যাবে।আপনার রাতের খাবারটা যদি খেয়ে নিতেন।পুরান উঠে দাঁড়ায়।ঘড়ির কাঁটা তখন দশ ছুঁই ছুঁই,এক এক করে সবাই উঠে দাঁড়ায়।
-যাও ভাই।আসছি আমি।
সবাই কে বিদায় দিয়ে।সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে উপরে ওঠতে থাকে পুরান।গেইটের কাছে বসার যে বেঞ্চ তাতে বসে কে যেন মোবাইলে গান শুনছিলো তার মৃদু আওয়াজ ভেসে আসছিলো-শুধু তোমার বানী নয় গো হে বন্ধু হে প্রিয়.......

ঝড়ের সন্ধ্যা,বাড়ী






লেখক পরিচিতি-শৌনক দত্ত জন্ম ৭ই আগষ্ট ১৯৮০(২১শে শ্রাবণ) কোচবিহারের ব্যাঙচাতরা রোড।স্কুল জীবন শুরু জেনকিন্সে আর তখন থেকেই লেখালেখির শুরু।সম্পাদনা করছেন বেশ কয়েকটি সাহিত্যপত্রিকা এবং ওয়েবজিন।প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ২টি জল ভাঙে জলের ভেতর(২০১১),ঠোঁটে দাও জোছনার বিষ(২০১২) এবং একটি গল্পগুচ্ছ কারুময় খামে অচেনা প্রেম(২০১২) ডুব সাঁতার(২০১৭)।শখ বইপড়া,লেখালিখি,ছবিতোলা, গান শোনা।বেশ কিছু গান ও লিখেছেন সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন ঘুরে বেড়াতে ঐতিহাসিক জায়গায়, পাহাড়ে জঙ্গলে এবং সমুদ্রে।যাপিত জীবনেও তার লেখার মতই সে এক অদ্ভুত পর্যটক।
যোগাযোগ 918486103085 Snkdtt@gmail.com

                         

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র