মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যামসমান
লেখক পরিচিতি-
লেখক পরিচিতি-
যুক্তিবাদী এই লেখক মূলত প্রবন্ধ লেখেন। আশির দশকের লেখক প্রবন্ধের পাশাপশি কবিতা, অণুগল্পও লেখেন। প্রথম কবিতার বই "বিপন্ন সত্তার চিতাভস্ম" প্রকাশিত হয় 2002 সালে। এরপর দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানের পর প্রথম প্রবন্ধের বই "লিঙ্গপুরাণ" প্রকাশিত হয় 2015 সালে। 2017 সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় প্রবন্ধের বই "গণিকামঙ্গল"। এ বছর "নাস্তিকের ধর্মকথা" এবং "ভিন্নপাঠে রামায়ণ শিরোনামে দুটি প্রবন্ধের বই প্রকাশিত হবে দুটি ভিন্ন প্রকাশনা থেকে।
--
"মরণ রে,/তুঁহুঁ মম শ্যামসমান/মেঘবরণ তুঝ, মেঘজটাজুট,/রক্ত কমলকর, রক্ত অধরপুট,/তাপবিমোচন করুণ কোর
তব/মৃত্যু-অমৃত করে দান।/তুঁহুঁ মম শ্যামসমান।।/মরণ রে,/শ্যাম তোঁহারই নাম।........" -- রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত
এই মৃত্যু বিষয়ক কবিতা দিয়েই শুরু করি প্রবন্ধটি।
মৃত্যু ! ছোট্ট একটি শব্দ। এই সেই শব্দ, যা আমাদের নিয়ে যায় অজানা
কোনো রাজ্যে, যার সম্পর্কে আমরা
প্রায় কিছুই জানি না। সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে যেতে কত না কষ্ট! যখন মৃত্যুর ডাক এসে
যায়, প্রিয়তমা স্ত্রী, আদরের সন্তানেরা, বাবা-মা কেউ তাদের বন্ধন দিয়ে
ধরে রাখতে পারে না আমাদের। ক্ষণিকের জীবন, তা সত্ত্বেও কত সুন্দর করে আমরা সাজাতে চেয়েছি আমাদের জীবন, কত পরিকল্পনা ছিল -- সব
মিলিয়ে যায় মাত্র দুটি অক্ষরের এই শব্দের দ্বারা। আমরা প্রতিদিন এই মৃত্যুকে কত
আপনভাবে নিজের সঙ্গে বয়ে বেড়াই আমরা নিজেরাও জানি না।জীবদ্দশায় মৃত্যু কী আমাদের
যারপরনাই বিব্রত করে না ! আমরা এই প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে জেনে নেওয়ার চেষ্টা করব
মৃত্যু কী ? মৃত্যু কীভাবে ? মৃত্যু কেন ? মৃত্যুর পরে কী? মৃত্যুর পরে কী কিছু আছে ? নাকি মৃত্যুই শেষ ? আবার শুধু মৃত্যুতেই শেষ নয়, মৃত্যুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে – স্বর্গ, নরক, পাপ,
পুণ্য, কর্মফল, জন্মান্তরবাদ, জাতিস্মর ইত্যাদি বিষয়।
স্মতর্ব্য, মানুষ ব্যতীত পৃথিবীর
অন্যান্য মানবেতর প্রাণীরা জন্ম-মৃত্যু নিয়ে মোটেই ভাবিত নয়। মৃত্যু যেভাবে
মানুষকে বিব্রত করে তেমন অন্য প্রাণীর হয় না। কারণ মানবেতর প্রাণীরা মানুষের মতো
বিচক্ষণ নয়।তাই মৃত্যুকে ঘিরে মানুষের সমাজে অনেক মিথ এবং সংস্কার প্রচলিত আছে, যা সমগ্র মানবজাতিকে
নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
মৃত্যু কী ? মৃত্যু (Death)
বলতে
জীবনের সমাপ্তি বোঝায়। জীববিজ্ঞানের ভাষায় প্রাণ আছে এমন কোনো জৈব পদার্থের (বা
জীবের) জীবনের সমাপ্তিকে মৃত্যু বলে। অন্য কথায়, মৃত্যু হচ্ছে এমন একটি অবস্থা যখন সকল শারিরীক কর্মকাণ্ড যেমন শ্বসন, খাদ্যগ্রহণ, পরিচলন, ইত্যাদি থেমে যায়। কোনো
জীবের মৃত্যু হলে তাকে মৃত বলা হয়। মৃত্যু বিভিন্ন স্তরে ঘটে থাকে। সোমাটিক
মৃত্যু হল সামগ্রিকভাবে কোনো জীবের মৃত্যু। নির্দিষ্ট অঙ্গ, কোশ বা কোশাংশের মৃত্যুর আগেই
এটি ঘটে। এতে হৃৎস্পন্দন, শ্বসন, চলন, নড়াচড়া,
প্রতিবর্ত
ক্রিয়া ও মস্তিষ্কের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়। সোমাটিক মৃত্যু ঠিক কখন ঘটে তা
নির্ণয় করা দুরূহ, কেন-না কোমা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, এবং ঘোর বা ট্রান্সের মধ্যে
থাকা ব্যক্তিও একই ধরনের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে থাকেন। সোমাটিক মৃত্যুর পর অনেকগুলি
পরিবর্তন ঘটে যা থেকে মৃত্যুর সময় ও কারণ নির্ণয় করা যায়। মারা যাওয়ার পরপরই
পার্শ্ববর্তী পরিবেশের প্রভাবে দেহ ঠান্ডা হয়ে যায়, যাকে বলে Algor
mortis। মারা যাওয়ার পাঁচ
থেকে দশ ঘণ্টা পরে কংকালের পেশিগুলি শক্ত হয়ে যায়, যাকে বলে Rigor
mortis এবং এটি তিন-চার দিন পরে শেষ হয়ে যায়। রেখে দেওয়া দেহের নীচের অংশে যে
লাল-নীল রং দেখা যায়, তাকে বলে Livor mortis; রক্ত জমা হওয়ার কারণে এমন
হয়। মৃত্যুর খানিক বাদেই রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করে। আর তারপরে দেহের যে পচন শুরু
হয়, তার জন্য দায়ী
এনজাইম ও ব্যাক্টেরিয়া। দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিভিন্ন হারে মারা যায়।
সোমাটিক মৃত্যুর ৫ মিনিটের মধ্যেই মস্তিষ্কের কোশগুলির মৃত্যু ঘটে। অন্যদিকে
হৃৎপিণ্ডের কোশগুলি ১৫ মিনিট এবং বৃক্কেরগুলি প্রায় ৩০ মিনিট বেঁচে থাকতে পারে।
এই কারণে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সদ্যমৃত দেহ থেকে সরিয়ে নিয়ে জীবিত ব্যক্তির দেহে
প্রতিস্থাপন করা সম্ভব।
এতদিন মৃত্যু বলতে হৃৎক্রিয়া স্তব্ধ হয়ে যাওয়াকেই
বোঝাত। কিন্তু “অঙ্গ প্রতিস্থাপন আইন
১৯৯৪” কার্যকর হওয়ায় বদলে
গেছে মৃত্যুর ধারণা। “Brain
Death” বা “মস্তিষ্কের মৃত্যু”-তেই এখন কেবল কোনো মানুষকে
মৃত বলা যাবে। কোনো মানুষের ব্রেন ডেথ হয়েছে কী হয়নি, তা ঠিক করতে দুজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের লিখিত অভিমত বাঞ্ছনীয়।
এরপর যন্ত্রাদি দ্বারা পরীক্ষিত নথিভুক্ত ফলাফলও যদি ওই অভিমতের পক্ষে যায়, তাহলেই কেবলমাত্র “ব্রেন ডেথ” হয়েছে বলে ধরা হবে। তবে ওই
দুই চিকিৎসক কোনোভাবেই সংস্থাপক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবেন না। “মস্তিষ্ক মৃত্যু” ঘোষণা করার আগে দেখে নিতে হবে
রোগী যেন কোনোরকম নিস্তেজক বা ঘুমের ওষুধের প্রতিক্রিয়ার বশবর্তী না হন।
“ব্রেন ডেথ”
বা “মস্তিষ্ক মৃত্যু” বলতে আসলে ব্রেনস্টেমের
মৃত্যুকে বোঝায়। “প্রকৃত মৃত্যু” ও “মস্তিষ্ক মৃত্যুর মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। প্রকৃত মৃতদেহে
ধমনীপ্রবাহ থাকে না। শ্বাস-প্রশ্বাসের লক্ষণ থাকবে না, হৃদস্পন্দনের আওয়াজ থাকবে না এবং বাইরের উদ্দীপনায় প্রতিক্রিয়া
থাকবে না। এই ধরনের মৃত্যুকে বলা হয় “কার্ডিওরেসপিরেটরি ডেথ”। “মস্তিষ্ক মৃত্যু” এর থেকে আলাদা। আমাদের চেতনা, শ্বাস-প্রশ্বাস ও অন্যান্য
শারীরবৃত্তীয় কার্যের কেন্দ্রবিন্দু হল মস্তিষ্ক। মস্তিষ্কের যে বিশেষ অংশ দ্বারা
এই জরুরি কাজগুলি নিয়ন্ত্রিত হয় তাকেই বলে “ব্রেন স্টেম” বা “মস্তিষ্ক কাণ্ড”। এই অংশের মৃত্যু হলে মানুষকে আর বাঁচানো যায় না। অনেক রোগী
দেখা গেছে, যাঁরা অজ্ঞান হয়ে
আছেন, শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ
হয়ে গেছে – কিন্তু তাঁদের
হৃৎপিণ্ড কাজ করে যাচ্ছে। এই অবস্থায় যদি কৃত্রিমভাবে শ্বাসকার্য ও হৃৎপিণ্ডকে সচল
রাখা যায় তাহলে একসময় দেখা যাবে শ্বাস-প্রশ্বাস চালানোর যন্ত্র ছাড়া হাজার চেষ্টা
করলেও শ্বাস-প্রশ্বাস আর ফিরবে না এবং মস্তিষ্কের কেন্দ্রবিন্দু আর সজাগ হবে না।
হৃৎপিণ্ডের নিজস্ব সংকোচন-প্রসারণ ক্ষমতা থাকার ফলে এমন ক্ষেত্রেও হৃৎপিণ্ড তার
কাজ চালিয়ে যেতে পারে এবং ধমনীপ্রবাহ সচল থাকতে পারে। এই অবস্থাকেই আমেরিকায় “ব্রেন ডেথ” এবং ইংল্যান্ডে “ব্রেনস্টেম ডেথ” বলে।
মৃত্যুর পরে শরীরে ধীরে ধীরে পচন ধরতে শুরু করে--
এ কথা সবাই জানেন। কিন্তু মৃত্যুর পর মুহূর্ত থেকে পচন ধরা পর্যন্ত কী কী শারীরিক
পরিবর্তন হয় বা কোন্ কোন্ পথ ধরে শরীর পচতে শুরু করে, তা কি জানা আছে? চিকিৎসাশাস্ত্র মতে মৃত ঘোষণার অর্থ এই নয় যে, শরীরের প্রতিটি কোশের মৃত্যু হয়েছে। হৃদযন্ত্র পাম্প করা
বন্ধ করলে, কোশগুলি অক্সিজেন
পায় না। মস্তিষ্কে শেষ মুহূর্তে সক্রিয়তার ঢেউ খেলে যায়, এর পরই 'সবকিছু অন্ধকার'। অক্সিজেন পাওয়া বন্ধ হলে পেশিগুলি শিথিল হতে শুরু করে।
পাশাপাশি অন্ত্র এবং মূত্রস্থলী খালি হতে শুরু হয়। শরীরের মৃত্যু ঘটলেও, অন্ত্র, ত্বক বা অন্য কোনো অংশে
বসবাসকারী ১০০ ট্রিলিয়ন ব্যাক্টিরিয়া তখনও জীবিত থাকে। মৃত্যুর পর শরীরের
অভ্যন্তরে যা ঘটে, সে সবের পিছনেই এই
১০০ ট্রিলিয়ন ব্যাক্টিরিয়ার যোগদান থাকে। মৃত্যুর পর সর্বপ্রথম শরীরে কোনো
পরিবর্তন আসে? প্রথমেই হয় অ্যালগর
মরসিট ঘরের তাপমাত্রায় না-আসা পর্যন্ত শরীরের তাপমাত্রা প্রতি ঘণ্টায় ১.৫ ডিগ্রি
ফারেনহাইট কমতে থাকে। লিভোর মরটিস বা লিভিডিটির ক্ষেত্রে শরীরের নিম্নাংশে রক্ত
এবং তরল পদার্থ জমা হয়। ব্যক্তির ত্বকের আসল রঙের ভিত্তিতে তা ধীরে ধীরে গাঢ়
বেগুনি-নীল রঙে পরিবর্তিত হতে শুরু করে।রিগর মরটিস- শেষে শরীরে রিগর মরটিস হয়, এ ক্ষেত্রে অত্যধিক
ক্যালসিয়াম ক্ষরণের ফলে পেশিগুলি শক্ত হয়ে যায়। ২৪-৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত এই অবস্থা
থাকে। রিগর মরটিসের সময় চোখ খোলা থাকলে, বেশ কিছু ক্ষণের জন্য মৃতের চোখ খোলাই থাকে। এর পর শরীরে পচন ধরতে শুরু করে।
রক্ত চলাচল বন্ধ হলে কার্বন-ডাই অক্সাইডের গঠন শুরু হয়, অম্লের মাত্রা বাড়তে থাকে। এর ফলে কোশগুলিতে ভাঙন ধরে। ২-৩
দিনে শরীর পচতে থাকে। পরিপাক নালিতে থাকা ব্যাক্টেরিয়া এবং আণুবীক্ষণিক প্রাণীরা
শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় তলপেট সবুজ বর্ণ ধারণ করে এবং তাতে
গ্যাস তৈরি হয়। তার চাপে শরীরের মল-মূত্র নিষ্কাশিত হয়। পিউট্রেসিন এবং
ক্যাডাভেরিনের মতো জৈবিক যৌগ শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে পড়লে, দুর্গন্ধ বের হতে শুরু করে। এই গন্ধই মৃতদেহের অন্যতম
বৈশিষ্ট। নেক্রোসিস পদ্ধতিতে এরপর শরীরের রং সবজেটে থেকে কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করে।
মৃতদেহের দুর্গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে ভিড় জমায় উচ্ছিষ্টভোগী পোকামাকড়। মৃত শরীরকে
খাদ্যভাণ্ডার হিসাবে ব্যবহার করা ছাড়াও, এই সমস্ত পরজীবী কীট সেখানে ডিমও পাড়ে। ডিম ফুটে বেরোনো শূককীট মাত্র এক
সপ্তাহে শরীরের ৬০ শতাংশ নিকেশ করতে পারে।
এ তো গেল শুধু প্রথম সাতদিনের বৃত্তান্ত। এর পর
ধীরে ধীরে প্রাণহীন মানবদেহ ক্রমে মাংস-চামড়ার খোলস ত্যাগ করে পরিণত হয় হাড়
সর্বস্ব কঙ্কালে।
মৃত্যু, কিন্তু মৃত্যু নয়। এক অনন্তকালের ফিরে আসার অপেক্ষা। দু-একজন ফিরলেও, অনেকেই ফেরে না। এমন দুর্বিষহ
এবং ব্যয়বহুল অপেক্ষার অবসান হয় একদিন। সেই অবস্থার নাম কোমা, কোমাচ্ছন্ন এবং কোমাচ্ছন্নতা।
কোমা কী ? কোমা মৃত্যুর কোন্ অবস্থাকে বোঝায় ? Wikipedia বলছে, “In medicine, a coma is a state of
unconsciousness lasting more than six hours in which a person: cannot be
awakened; fails to respond normally to painful stimuli, light, or sound; lacks
a normal sleep-wake cycle; and, does not initiate voluntary actions. A person
in a state of coma is described as being comatose.
A comatose person exhibits a complete absence of
wakefulness and is unable to consciously feel, speak, hear, or move. For a
patient to maintain consciousness, two important neurological components must function.
The first is the cerebral cortex—the gray matter that covers the outer layer of
the brain. The other is a structure located in the brainstem, called reticular
activating system (RAS). Injury to either or both of these components is
sufficient to cause a patient to experience a coma. The cerebral cortex is a
group of tight, dense, "gray matter" composed of the nuclei of the
neurons whose axons then form the "white matter", and is responsible
for perception, relay of the sensory input (sensation) via the thalamic
pathway, and many other neurological functions, including complex thinking.
RAS, on the other hand, is a more primitive structure in the brainstem that is
tightly in connection with reticular formation (RF). The RAS area of the brain
has two tracts, the ascending and descending tract. Made up of a system of
acetylcholine-producing neurons, the ascending track, or ascending reticular
activating system (ARAS), works to arouse and wake up the brain, from the RF,
through the thalamus, and then finally to the cerebral cortex. A failure in
ARAS functioning may then lead to a coma.”
যুক্তরাষ্ট্রের সান্তাক্রুজ শহরের ৩৯ বছর বয়স্ক
এক মহিলা কোমাচ্ছন্ন অবস্থায় একটি সুস্থ শিশুর জন্ম দিয়েছিলেন। মহিলাটি প্রায় ৭০
দিন যাবৎ কোমায় আচ্ছন্ন হয়ে আছেন।সেই অবস্থাতেই সিজার করে শিশুটিকে প্রসব করানো
হয়। মেলিসা স্কারলেট নামের এই ৩৯ বছর বয়সি মহিলাটি চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায়
সেমিকোমাটেজ অবস্থায় আছেন।
কোমা থেকে ফিরে এসে বিদেশি ভাষায় অনর্গল কথা বলে
যাওয়া ! বাস্তবে সম্ভব ?
বাস্তব ঘটনাগুলি নিরীক্ষণ করা যাক -- তার নাম বেন
মেকমাহন। বয়স যখন ২২ তখন সে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় কোমায় চলে যায়। অন্তত এক সপ্তাহ
লেগেছিল তার ওই স্থবির অচলায়তন পরিধি থেকে জ্ঞান ফিরে পাওয়ার জন্য। আর যখন তার
জ্ঞান ফিরল তখন ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন নিবাসী এই তরুণ
পুরোপুরি ভুলে গেছে নিজের মাতৃভাষা ইংরেজি। সবাই অবাক হয়ে শুনতে থাকল তার মুখে
ইংরেজির পরিবর্তে চৈনিক ভাষা। জানা গেছে, বেন কেবল তার স্কুলেই অল্পবিস্তর চিনের মান্দারিন ভাষা শিখেছিল। কিন্তু সেটা
বলা কিংবা লেখার জন্য যথেষ্ট নয়। অথচ কোমা থেকে জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর বেন চিনা
ভাষায় স্বাভাবিকভাবেই কথা বলতে শুরু করে। তার চিকিৎসকরা জানান, সে যে ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার
হয়েছিল সেখান থেকে তার বেঁচে ফিরে আসাটা অনেক বড়ো ব্যাপার।বেন তার কোমা থেকে জেগে
উঠার মুহূর্তটি স্মরণ করতে পারে। সে সময় সে দেখেছিল এশীয়দের মতো একজন সেবিকা
(নার্স) তার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সে নার্সকে ডেকে চিনা ভাষায় জানালো, ক্ষমা করবেন, আমি এখানে সুস্থবোধ করছি
না।এরপর সে নার্সকে একটা কলম এবং কাগজ আনতে বলে। নার্স এনে দিলে বেন তাতে
মান্দারিন হরফে লিখে, ‘আমি মাকে ভালোবাসি, বাবাকে ভালোবাসি, আমি সুস্থ হয়ে উঠব।’ বেনের বাবা-মা তখন ছেলে বেঁচে
গেছে তাতেই খুশি। মজার ব্যাপার হল পরবর্তী সে চিনের সাংহাই বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্য
বিভাগে পড়ছে।
এ ধরনের ঘটনা কেবল তার ক্ষেত্রেই ঘটেনি। রয়েছে
আরও নজির। ২০১০ সালের কথা। সে বছর এ রকম কোমায় থাকার পর ১৩ বছরের ক্রোশিয়ান এক
বালিকা যখন জেগে উঠল তখন সে পুরোপুরি জার্মানি ভুলে গিয়ে নিজের গ্রামীণ ভাষা বলা
শুরু করল। আবার খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, গেল বছর ২০১৩ সালে এক আমেরিকান নেভিকে তার মোটেল রুম থেকে
অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। সাময়িক কোমা বা চেতন ফেরত পাওয়ার পর দেখা গেল সে আর
নিজেকে চিনতে পারছে না। এমনকি সে সুইডিশ ভাষায় কথা বলা শুরু করেছে।
বিদেশি জার্মান ভাষাশিক্ষায় সবে হাতেখড়ি। থেমে
থেমে পড়া, কিছু কিছু লেখা আর
আধো আধো বুলি পর্যন্তই দৌড়। এরই মধ্যে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে কোমায় চলে যাওয়া। তবে
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এই কোমাই যেন তাকে
রাতারাতি জার্মান ভাষা শিখিয়ে দিয়েছে। এখন সে জার্মান ভাষা এতটাই অনর্গল বলা
শুরু করেছে যে নিজের ভাষাই ভুলে গেছে সে। ক্রোয়েশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় কেনিন
শহরের ১৩ বছর বয়সি এক মেয়ের জীবনে ঘটে গেছে এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা। শিশুটির
অভিভাবকেরা জানান, শিশুটি সবে একটি
বিদ্যালয়ে জার্মান ভাষা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছে। তবে অনর্গল কথা বলা দূরে থাক, ভাষাটি এখনও খুব একটা শেখা
হয়ে ওঠেনি তার। শিশুটির পরিবার জানায়, সম্প্রতি আকস্মিক অসুস্থ হয়ে সে কোমায় চলে যায়। প্রায় ২৪ ঘণ্টা সে কোমায়
ছিল। তবে কোমা থেকে ফেরার পর সে মাতৃভাষা ভুলে যায়। আর শুদ্ধ জার্মানিতে কথা বলা
শুরু করে। কেবি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা দাবি করেন, ঘটনাটি একেবারেই ব্যতিক্রম। বিষয়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞরা
পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছেন। হাসপাতালের পরিচালক দুজোমির মারাসোভিক বলেন, “এভাবে স্নায়ুরোগ (ট্রমা)
থেকে সেরে উঠে মস্তিষ্ক কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে, আপনি কখনোই তা জানবেন না। তবে ওই ঘটনায় অবশ্যই আমাদের কিছু
তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা আছে”। মনস্তত্ত্ববিশেষজ্ঞ মিজো
মিলাস বলেন, “আগে এ ধরনের ঘটনাকে
অলৌকিক আখ্যা দেওয়া হত। তবে আমরা মনে করি, এর অবশ্যই যৌক্তিক ব্যাখ্যা আছে। যদিও আমরা এখনও তা খুঁজে
পাইনি”।
কোন ধর্মের মানুষ কেমনভাবে মৃতদেহের সৎকারে
বিশ্বাস করেন, সেটা দেখা যাক।
মিশরীয়রা : প্রাচীনকালে
মিশরীয়রা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করত,
মৃত্যুর
পরও তাদের আত্মা বেঁচে থাকে। কাজেই পরবর্তী জীবনে যাতে কোনো সমস্যা না হয়, জীবনটাকে যাতে উপভোগ করা যায়, সে চিন্তায় মিশরীয়রা অস্থির
থাকত। ব্যক্তির গুরুত্বের উপর নির্ভর করে গুরুত্ব আরোপ করা হত এ ব্যাপারে। ব্যক্তি
যত গুরুত্বপূর্ণ হত এ কাজে গুরুত্ব তত বেশি বেড়ে যেত। পরবর্তী জীবনের
আরাম-আয়েশের জন্য স্বভাবতই ফারাওদের ব্যাপারেই পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল।
ক্ষমতায় আসা নতুন ফারাওয়ের প্রথম কাজ সম্পন্ন করা। প্রত্যেকেই চাইতেন বিশাল
আয়তনের হোক তার সমাধিক্ষেত্র। অনেকেই মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত সমাধিক্ষেত্র
তৈরির কাজ চালিয়ে যেত। এসব সমাধিক্ষেত্র আসলে মৃতের আত্মার ঘর। মিশরীয়রা মনে করত, লাশ বা মৃতদেহ টিকে থাকার
উপরই নির্ভর করে আত্মার বেঁচে থাকা বা ফিরে আসা। এ কারণেই মৃতদেহ সংরক্ষণের
উদ্দেশ্যে মমি করত তারা। আত্মার বেঁচে থাকার জন্য চাই প্রয়োজনীয় নানা জিনিস। তাই
নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র,
বিশেষ
করে খাবার-দাবার মৃতদেহের সঙ্গে দিয়ে দিত তারা। সমাধি-স্তম্ভ প্রধানের দায়িত্ব
ছিল দস্যুদের হাত থেকে মৃতদেহ আর তার ব্যবহার্য জিনিসপত্র রক্ষা করার। কিন্তু কবরে
সমাধিত ব্যক্তিটি কত বিপুল পরিমাণ বিত্ত আর ক্ষমতাবান ছিল তা জাহিরের উদ্দেশ্যেও
নির্মাণ করা হত পিরামিড। তাই ফারাওদের মৃতদেহের সঙ্গে কবরস্থ করা হত বিপুল
ধন-সম্পদ। সমাজের বিত্তশালীদের কবরেও মূল্যবানসামগ্রী দেয়া হত। এমনকি, নিন্মশ্রেণীর মানুষদের কবরেও
সামান্য পরিমাণ হলেও কিছু খাবার রেখে দেয়া হত।
খ্রিস্টান ধর্মে সৎকার : খ্রিস্ট
ধর্মাবলম্বীরা মৃতদেহকে কবর দিয়ে থাকেন। এটাই রীতি। প্রাচীন যুগে পোপগণ মৃতের সুখের জন্য স্বর্গের জায়গা বিক্রি
করতেন। জমি কিনলে যেমন দলিল থাকে,
তেমনই
পোপগণও একটা দলিল লিখে দিতেন –
যাকে Indulgence বা পাপক্ষয়পত্র বলা হত।যখন
কোনো ধনী ব্যক্তি স্বর্গে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে পোপকে প্রচুর ধনদৌলত দিত। এবং
পোপ জিশুর ও মেরির মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে একপ্রকারের হুন্ডি লিখতেন। কী লেখা থাকত
তাতে ? –- “হে ঈশ্বরের বান্দা
জিশুখ্রিস্ট ! অমুক ব্যক্তি স্বর্গে যাওয়ার জন্য তোমার নামে আমার কাছে লক্ষ মুদ্রা
জমা করে দিয়েছে। সে স্বর্গে উপস্থিত হলে তুমি তোমার পিতার স্বর্গরাজ্যে পঞ্চবিংশ
সহস্র মুদ্রা মূল্যের ভোজ্য পানীয় ও বস্ত্রাদি, পঞ্চবিংশ সহস্র মুদ্রা মূল্যের বাগানবাড়ি, পঞ্চবিংশ সহস্র মুদ্রা
মূল্যের যান-বাহন-ভৃত্য এবং পঞ্চবিংশ সহস্র মুদ্রা আত্মীয়স্বজন-ভাই-বন্ধু প্রভৃতির
নিমন্ত্রণের জন্য প্রদান করা হবে”। যাঁরা যত বেশি টাকা পুরোহিত
বা পোপদের কাছে জমা দিতে পারবেন তাঁদের পিতা-মাতা-আত্মীয়স্বজন ততবেশি স্বর্গে জমি
বা জায়গা পাবেন। তবে প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানরা এমন ব্যবস্থাপত্রে রাখেন না, বিশ্বাস রাখেন ক্যাথলিক
খ্রিস্টানরা।
ইসলাম ধর্মে সৎকার : মৃতদেহকে কবর দেওয়া
হয় এবং আত্মীয়রা জামাজার নমাজ পাঠ করেন।আত্মীয়-পরিজনদের মৃত্যুর খবর পেলেই
মুসলিমগণ মৃতের উদ্দেশ্যে –
ইন্নালিল্লাহে
ওয়া ইন্নালিল্লাহে রাজেউন –
বলে
থাকেন। “ইন্নালিল্লাহে ওয়া
ইন্নালিল্লাহে রাজেউন”, অর্থাৎ -- নিশ্চয়
আমরা আল্লাহরই জন্য এবং নিশ্চয় আমরা তাঁরই দিকে ফিরে যাব। এরপর সম্মিলিতভাবে
মৃতদেহটিকে মাটি (কবর) দেওয়ার পর ৪০ (চল্লিশ) দিনের মিলাদ দেওয়া হয়। এবং “লা ইলাহা ইল্লাহ মহম্মদু রসুলাল্লাহ”(আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, মোহম্মদ তাঁর প্রেরিত
পুরুষ)-- আয়াতটি বারে বারে পাঠ করা হয়। পুরোহিত নিয়োগে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তাই
মৌলভি বা মাওলানা বা যে-কোনো মুসলিম ব্যক্তি যিনি আয়াতটি জানেন তিনিই পাঠ করতে
পারেন। যে ব্যক্তির পিতা বা মাতা বা আত্মীয়ের মৃত্যু হয়েছে তিনি স্বাভাবিক পোশাকই
পরবেন, স্বাভাবিক
খাদ্যদ্রব্যই গ্রহণ করবেন এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন করবেন আর পাঁচজনের মতো।মুসলিম
সম্প্রদায়গণের মধ্যে দুটি শ্রেণি আছে। যেমন – (১) মোহম্মদী এবং (২) হানাফি। পিতা-মাতার মৃত্যু হলে
মোহম্মদী সম্প্রদায়গণ লোকজন নেমন্তন্ন করে ভোজ দেন না। এঁদের মত – মৃত মানুষের জন্যে আবার ভাত
রান্না কেন ? এটা তাঁর কোন্ কাজে
লাগবে ? অপরদিকে হানাফি
সম্প্রদায়গণ আত্মীয়-বন্ধুবান্ধব ডেকে ভোজের ব্যবস্থা করবেন।
ইহুদি ধর্মে সৎকার : ইহুদিরা আত্মায়
বিশ্বাস করেন না বলে আত্মার শান্তির উদ্দেশ্যে কোনো যাগযজ্ঞ-অনুষ্ঠানাদিও
নেই।এঁদের পরলোকবাদেও কোনো বিশ্বাস নেই। মোট কথা, ইহুদিরা ঈশ্বর, অবতার, পুনর্জন্ম, বর্ণভেদ ইত্যাদিতে বিশ্বাস
করে না – মৃত্যু এবং মৃতদেহকে
কেন্দ্র করে যাগযজ্ঞাদিও করে না।
বৌদ্ধধর্মে সৎকার : বৌদ্ধধর্মে মৃতের
সৎকারাদি বৌদ্ধভিক্ষুই করে থাকেন(যে-কোনো বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ধর্মশাস্ত্রে পণ্ডিত
হলে তাকে ভিক্ষু পদে উন্নীত করা হয়)। বৌদ্ধরা আত্মাকে নিত্য স্বীকার করে না এবং
ঈশ্বরেও বিশ্বাস করেন না।তবে বৌদ্ধরা মনে করেন, মানুষ মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওই ব্যক্তির চিত্তপ্রবাহের
সংস্কাররাশি যা চুম্বকের মতো গুণসম্পন্ন তা নিকটতম গর্ভের সন্তানের মধ্যে চলে যায়।
এইভাবেই তাঁর পুনর্জন্ম হয়। সে কারণে তাঁরা মৃতের কল্যাণে উদ্দেশ্যে কিছু করেন না।
বৈষ্ণবধর্মে সৎকার : বৈষ্ণব মতে মৃতদেহকে
সমাধি (কবর) দেওয়াই নিয়ম। একটা গর্ত খুঁড়ে তার মধ্যে মৃতব্যক্তিকে যোগাসনে বসিয়ে
দেওয়া হয়। এরপর মৃতদেহের মাথায় এক মালসা লবণ বা নুন ঢেলে দেওয়া হয়। বৈষ্ণব
সম্প্রদায়গণ সাধারণত ১১ দিনের দিন মৃতের আত্মাকে মন্ত্রপুত করে বিষ্ণুলোকে পাঠান।
সাঁওতালি সৎকার : সাঁওতালদের সৎকারে
তাদের কেউ মারা গেলে মৃতদেহকে দাহ করে বাড়িতে ফেরার সময় একখণ্ড অস্থি নিয়ে এসে
কোনো এক রাস্তার মোড়ে পুঁতে রাখে।এরপর তিন দিনের দিন নির্দিষ্ট অস্থিখণ্ডটি তুলে
কেন্দুগাছের তিনটি ডালের মাথায় সরা বসিয়ে সেটার উপর রাখে।গ্রামের মোড়ল বা অভিজ্ঞ
ব্যক্তির নির্দেশমতো মৃতের পুত্র ওই খুঁটির গোড়ায় ফুল, জল প্রভৃতি দিয়ে মৃতককে শ্রদ্ধা জানায়। ওই দিনেই ওখান থেকে
অস্থি তুলে নিয়ে যে-কোনো নদীতে দিয়ে দিলেই মৃতের সৎকার শেষ হয়ে যায়। এরপর
যে-কোনোদিন সুবিধামতো আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবদের নিমন্ত্রণ করে ভোজের ব্যবস্থা
করা।
বৈদিক মতে সনাতন সৎকার : প্রাচীনকালে সমস্ত
সনাতনপন্থীরা বেদের নিয়মেই মৃতের শেষকৃত্য সম্পন্ন করতেন। এখনও অনেকে বৈদিক নিয়মেই
মৃতকের শেষকৃত্য করে থাকেন। বৈদিক ক্রিয়া মতে “শ্রাদ্ধ”
হল
শ্রদ্ধা সহকারে যেটা করা হয়(সেই শ্রাদ্ধ করতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে যে মৃত হতেই
হবে এমন কোনো কথা নেই, কোনো ব্যক্তির
জীবদ্দশাতেই তা করা হয়।জীবিত পিতামাতার সেবা-শুশ্রূষা করার নামই শ্রাদ্ধ।)।বৈদিক
নিয়মানুসারে কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে দুই থেকে তিনদিন সময়
লাগে।কী সেই নিয়ম ? কোনো ব্যক্তি মারা
গেলে তাঁকে দাহ করার সময়ে মন্ত্রের মাধ্যমে অগ্নির এবং মৃতদেহের গুণগান করা হয়।
মৃতদেহকে শ্মশানে চন্দন, ঘি, অগুরু, তগর, কস্তুরী,
মাসা
ইত্যাদি সহযোগে কাষ্ঠ দ্বারা দাহ করা হয়। তৃতীয় দিনে মৃতকের কোনো আত্মীয় শ্মশানে
গিয়ে চিতা থেকে অস্থি উঠিয়ে সেই শ্মশানের ভূমির কোথাও সেগুলি আলাদাভাবে রেখে দেয়।
মৃতকের জন্য আর কোনো কর্ম করা কর্তব্য নয়। কেন-না “ভস্মান্তম্ শরীরম্” এই যজুর্বেদ মন্ত্রের প্রমাণে স্পষ্ট হয় যে দাহ ও অস্থি
সঞ্চয়ণ ব্যতীত মৃতকের জন্য কোনো কর্ম করা কর্তব্য নয়।
“অন্ত্যেষ্টি” শব্দটি শব্দটি স্বয়ং ঘোষণা করছে – মৃতদেহ দাহ করাই পুণ্যকর্ম। অন্ত্যা অর্থে অন্তিম, চরম বা সর্বশেষ এবং ইষ্টি অর্থে যজ্ঞ, শুভকর্ম বা সংস্কার বোঝায়।
মৃত্যুর পর বিধিপূর্বক শবদাহ করাই অন্ত্যেষ্টি কর্ম।
পৌরাণিক মতে হিন্দুদের মৃতদেহ
সৎকার : পৌরাণিক শাস্ত্রমতে (আসলে গরুড়পুরাণ মতে) হিন্দু সম্প্রদায়গণ শবদাহ এবং
শবদাহান্তে অস্থি গঙ্গায় অস্থি প্রদান। তদুপরি বর্ণ অনুযায়ী নির্দিষ্ট মেয়াদ যেমন – ১০, ১১,
১৫ বা
৩০ দিন পর পুরোহিত ডেকে আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবকে নিমন্ত্রণ করে শ্রাদ্ধাদি
ক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়।এরপর মৃতদেহটি যাতে স্বর্গে যান তার জন্য যথাসম্ভব উপায়
প্রয়োগ করা হয়। মৃতব্যক্তিকে স্বর্গে যেভাবে পাঠানো যায় তার কয়েকটা বন্দোবস্ত
এখানে উল্লেখ করার চেষ্টা করছি।যেমন – (১) মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তির কানের সামনে জোরে জোরে গীতা পাঠ করা, (২) সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মৃত্যু
সম্পন্ন হলে বুকের উপর নামাবলি অথবা গীতা অথবা উভয়ই রাখা হয়, (৩) মৃতদেহ শ্মশান নিয়ে যাওয়ার
পথে “হরি বলো” ধ্বনি তোলা, (৪) মৃতদেহ ভস্মীভূত হওয়ার পর
অস্থি তুলে গঙ্গায় নিক্ষেপ করা,
(৫)
ব্রাহ্মণকে সবৎসা গোরু দান,
(৬)
মৃতের দোষ কাটানো, (৭) নানাবিধ কারণে
প্রায়শ্চিত্ত করা, (৮) যোড়শ দান
(শ্রাদ্ধের সময় ব্রাহ্মণকে ১৬টি দ্রব্য দান করলে মৃতব্যক্তি ৯৬০ হাজার বছর স্বর্গে
সুখে কাল কাটাতে পারবেন। যতগুলি পুত্র এই অনুষ্ঠান করবেন মৃতব্যক্তি ততগুণ
স্বর্গলাভ করবেন। একজন পুত্র হলে ৯৬০ হাজার বছর, ১০ জন পুত্র হলে অবশ্যই ৯৬০০ হাজার বছর), (৯) হেম গর্ভ তিল দান। (১০) বিলক্ষণা শয্যা দান, (১১) মৃত ব্যক্তির নামে ষাঁড় ছেড়ে দেওয়া, (১২) অতিথি ভোজন, (১৩) ব্রাহ্মনভোজন, (১৪) বাড়িতে কীর্তন বা
রামগানের আয়োজন করা, (১৫) গয়ায় পিণ্ডদান, (১৬) সাংবাৎসরিক শ্রাদ্ধ, (১৭) পিতৃতর্পণ ইত্যাদি।
পিণ্ডদানও হিন্দুদের মৃতদেহের একটি সৎকার বিষয়ক
ব্যবস্হা। পিণ্ডদানের মাধ্যমে প্রেতলোক থেকে অমৃতলোকে যাত্রা। হিন্দুধর্মের
বিশ্বাস, মৃত আত্মা ঘুরে বেড়ায়
মানুষের হাত থেকে জল চেয়ে। অর্থাৎ, বংশের জীবিত কারোর হাত থেকে পিণ্ড গ্রহণ করে তবেই আত্মার মুক্তি। এ ক্ষেত্রে বংশের কেউ জীবিত
না-থাকলেও অন্য কেউ মৃত আত্মার জন্য জল দান করতে পারেন। নিজের আত্মীয়ের পিণ্ডদানের
সূচনাপর্বে জীবিতের হাত থেকে জীবজগতের সকল মৃত প্রাণীর (তা সে কীটপতঙ্গ, জন্তুজানোয়ার, এমনকী মৃত বৃক্ষাদি পর্যন্ত)
জন্য জলদানের আচার বড়ো বিস্ময়কর। পিণ্ডদানের ধর্মীয় আচারস্থল হিসাবে নদীসঙ্গম, সমুদ্রস্থল, অভাবে বড়ো দিঘি বা পুষ্করিণী
বেছে নেওয়া হয়। গয়ায় পিণ্ডদান বিশ্বাসীদের কাছে বিরাট ব্যাপার।এর কারণ হিন্দুপুরাণ
। দেবতা বনাম অসুরের দ্বন্দ্ব। মহাদেব হত্যা (বধ ?) করলেন ত্রিপুরাসুরকে।ত্রিপুরাসুরের পুত্র গয়াসুর পুরোনো
হিসাব বুঝে নিতে নারায়ণের সঙ্গে শতাব্দীকাল যুদ্ধ করে। কোনো পক্ষই হারছে না, কোনো পক্ষই জিতছে না।
এমতাবস্থায় নারায়ণের ইচ্ছেমতো গয়াসুর পাষাণে রূপান্তরিত হয়ে গেল। এরপর নারায়ণ
গয়াসুরের মাথায় পা রাখলেন। তখন থেকেই সেই পদচিহ্নে পিণ্ডদান হয়। আচার-বির্বতনের
মধ্য দিয়ে বর্তমানে এরকম চল্লিশটি বেদিতে পিণ্ডদানের প্রথা চালু আছে।
রামায়ণের নায়িকা সীতাদেবী স্বামী রাম এবং দেবর
লক্ষ্মণের অনুপস্থিতিতে ফল্গুনদীর তীরে মৃত শ্বশুরের উদ্দেশে বালির পিণ্ডদান
করেন।রাম ও লক্ষ্মণ ফিরে এসে সীতার কাছে পিণ্ডদানের ঘটনায় অবগত হলেন। কিন্তু সীতার
বিবৃতি ওরা কেউ বিশ্বাস করলেন না। অবশেষে সীতাদেবী সাক্ষী মানলেন ফল্গু ও
বটবৃক্ষদের। এক অজ্ঞাতকারণে ফল্গু নদী ঠিক সাক্ষ্য দিল না। সীতা অভিশাপ দিলেন
ফল্গুনদীকে। বললেন, “অন্তঃসলিলা হও”। সেই থেকেই ফল্গুনদী নাকি মাটির নীচ দিয়ে বয়ে যায়। অপরদিকে
বটবৃক্ষ যথাযথ সাক্ষ্য দেওয়াতে সীতার আশীর্বাদে অমরত্ব পায়। সে কারণেই অক্ষয় বটের
পাদদেশে পিণ্ডদান কর্মসূচি হয়। যাঁরা দুর্ঘটনা বা আত্মঘাতী বা অপঘাতে মারা যান
তাদের জন্য প্রেতশিলায় পিণ্ডদান প্রচলিত। আগ্রহী পাঠকগণ যদি আরও জানতে কৌতূহলী হন, তাহলে গরুড়পুরাণের
উত্তরখণ্ডের ষষ্ঠ, ষোড়শ এবং চতুস্ত্রিংশ
অধ্যায় পাঠ করতে পারেন।
শব সমাধিস্থকরণ ও শবদাহ এবং
একটি অপ্রিয় সত্যভাষণ : প্র্রাচীন ভারতে লোকসংখ্যা ছিল অনেক কম, কিন্তু সেই তুলনায় গাছপালা
তথা জ্বালানি ছিল অনেক বেশি। কিন্তু
বর্তমানে লোকসংখ্যা যেমন অনেক বেশি তেমনই আবার দিন দিন গাছপালা ও জ্বালানিও হ্রাস
পাচ্ছে। এখানে যৌক্তিক, মানবিক, ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে
শব সমাধিস্থকরণ ও শবদাহের সুবিধা-অসুবিধাগুলি
এখানে উল্লেখ করা যাক – (১) ব্যতিক্রম ছাড়া
খুব অল্প খরচে একটি মৃতদেহকে সমাধিস্থ করা যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খরচ লাগে না
বললেই চলে। অন্যদিকে একটি মৃতদেহকে আগুনে পুড়িয়ে ছাইভস্ম করতে প্রচুর জ্বালানির
দরকার হয়। (২) মাটিতে যে জৈবিক উপাদান আছে সেগুলি মানুষের দেহেও থাকে। ফলে
মৃতদেহকে সমাধিস্থ করলে মাটির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি পায়। অপরদিকে মৃতদেহকে আগুনে
পুড়িয়ে ফেললে জৈবিক উপাদান নষ্ট হয়ে যায়। (৩) মৃতদেহকে সমাধিস্থ করলে পরিবেশের
কোনো ক্ষতিসাধন হয় না। অন্যদিকে মৃতদেহকে আগুনে পোড়ালে পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব
পড়ে। (৪) মৃতদেহকে সমাধিস্থকরণ একটি মানবিক প্রক্রিয়া। অন্যদিকে মৃতদেহকে আগুনে
পোড়ানো একটি অমানবিক ও ভয়ংকর প্রক্রিয়া। শিশু ও দুর্বল হার্টের লোকজনের উপর এর
বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। এই কারণেই অনেকেই শ্মশানে যেতে চায় না, নানা কারণে যেতে হলেও শবদাহ
প্রত্যক্ষ করেন না। এই কারণেই আজকের প্রজন্মের ছেলেরা মুখাগ্নিতে আপত্তি
জানাচ্ছেন। (৫) বৃষ্টি-বাদলের দিনেও মৃতদেহকে সমাধিস্থ করা যায়। কিন্তু
বৃষ্টি-বাদলের দিনে মৃতদেহকে আগুনে পোড়ানো খুবই কঠিন কাজ। আর মৃতদেহকে ঠিকমতো
পোড়াতে না পারলে সেটি পরিবেশের জন্য আরও ক্ষতিকর। (৬) সর্বোপরি, মৃতদেহকে সমাধিস্থকরণের
ক্ষতিকর কোনো দিক নেই। সমাধিস্থকরণের জন্য জায়গা লাগলেও পরবর্তীতে সেই জায়গাকে
আবার রি-সায়ক্লিং করা যায়। তা ছাড়া কবরস্থান ছাড়াও তো অনেক পতিত জায়গা-জমি পড়ে
আছে। ফলে এটি মোটেও কোনো সমস্যা নয়। অন্যদিকে মৃতদেহকে পোড়ানোর সবগুলো দিকই
ক্ষতিকর এবং অযৌক্তিক বা অমানবিক বা অবৈজ্ঞানিক।
মৃতের সৎকার তো হল, সৎকারের মাধ্যমে মৃত ব্যক্তিকে স্বর্গে পাঠিয়েই কী সব শেষ !
মৃত্যুর পরে কী কিছুই নেই ?
মৃত্যুতেই
কী একটা জীবনের সব শেষ ? আত্মা বলে কী কিছু
আছে ? তবে আত্মা কী ? আত্মার স্বরূপ কী ? আত্মাই পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে ? পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আমরা
খুঁজতে চেষ্টা করব মৃতব্যক্তির পরিণতি এবং আত্মার ব্যাখ্যার উত্তর।
অবশেষে মানুষ একদিন মৃত্যুকে স্পর্শ করে কিংবা
মৃত্যু মানুষকে স্পর্শ করে। জীবনের প্রথমবার এবং শেষবারের মতো চরম সত্যের মুখোমুখি
হয় মানুষ।নানাভাবে মানুষের মৃত্যু আসতে পারে। যদিও সব মৃত্যুই মৃত্যু হলেও, সব মৃত্যু একরকম হয় না।
মৃত্যু যেরূপে মানুষকে আলিঙ্গন করে – (১) বার্ধক্যজনিত মৃত্যু,
(২)
প্রাকৃতিক দুর্যোগে মৃত্যু (বন্যা, সাইক্লোন, বজ্রপাত, ভূমিকম্প, দাবানল ইত্যাদি), (৩) দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু, (৪) অসুখে-বিসুখে মৃত্যু, (৫) যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যু, (৬) রাজনৈতিক কারণে মৃত্যু, (৭) আত্মহত্যায় মৃত্যু, (৮) অনুমতি সাপেক্ষে মৃত্যু
(ইচ্ছামৃত্যু), (৯) রাষ্ট্র দ্বারা
মৃত্যু (আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ড), (১০) ধর্মীয় কারণে মৃত্যু (সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা), (১১) শত্রুতার কারণে মৃত্যু, (১২) আততায়ীর হাতে মৃত্যু (ইন্দিরা গান্ধি, রাজীব গান্ধি, মুজিবর রহমান, জন কেনেডি প্রমুখ), (১৩) সামাজিক অশিক্ষার কারণে
মৃত্যু (ডাইনি হত্যা ইত্যাদি),
(১৪) না
খেতে পেয়ে বা অনাহারে মৃত্যু,
(১৫)
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অনশনে মৃত্যু (চেট্টি) (১৬) পুলিশী হেফাজতে মৃত্যু ইত্যাদি।
মানুষ ছাড়া এত প্রকারের মৃত্যু পৃথিবীর আর কোনো প্রাণীর হয় না। তা মৃত্যু যেভাবেই
হোক -- মৃত্যুর পর কী, তা নিয়ে আমাদের অপার
কৌতূহল। নানা জনের নানা মত।সত্যটা কী ? সবটাই ধোঁয়াশা !
জীবের মৃত্যুর কথা জানার আগে ‘জীবন’ কী সেটা জেনে নেওয়া প্রয়োজন। যদিও বিজ্ঞানীরা আজও জীবন বা
প্রাণের কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দিতে পারেননি, তবু বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের ভাষায় জীবন হল – (১) জীবন বা প্রাণ এমন এক
সত্তা যার থেকে অনুরূপ সত্তার জন্ম হতে পারে। পরিবেশের প্রভাবে যার আকস্মিক
পরিবর্তন বা মিউটেশন ঘটলে তার থেকে উন্নততর জীবন-সৃষ্টির পথ সুগম হতে পারে। (২)
প্রতিনিয়ত পরিবর্তনোন্মুখ পরিবেশে মানিয়ে নিতে ইচ্ছুক জটিল সুসংবদ্ধ
প্রোটোপ্লাজমের সুনির্দিষ্ট শক্তির বহিঃপ্রকাশই হল জীবন। (৩) বৃদ্ধি, জনন, পরিব্যক্তি ও বিবর্তন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সজীব, জটিল, কোষীয় জৈব যৌগকে জীবন বা প্রাণ বলে। (৪)
পরিবেশ ও সজীব বস্তুর আন্তঃবিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশই হল জীবন।
জীবের মৃত্যু অনেকাংশেই প্রোটোপ্লাজমের উপস্থিতির
উপর নির্ভর করে। প্রোটোপ্লাজম বিশেষ এক প্রকার জটিল যৌগ।উদ্ভিদ বা প্রাণী যে-কোনো
জীবদেহ এক বা একাধিক কোশের সমন্বয়ে গঠিত। সাধারণত কোশের প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ থেকে এই
প্রোটোপ্লাজম সবরকম শারীরবৃত্তীয় কাজ সম্পন্ন করে। সে জন্য প্রোটোপ্লাজমকে “প্রাণের ভৌত ভিত্তি” বা “Physical basis of life” বলা হয়। প্রতিটি জীবদেহে
প্রোটোপ্লাজম বর্তমান, অর্থাৎ যেখানেই প্রাণ
সেখানেই জীবন্ত প্রোটোপ্লাজম। প্রোটোপ্লাজম গঠনের ৭৫% জল। তাই জীবদেহের জলের অভাব
হলে প্রোটোপ্লাজমের ক্রিয়া ব্যাহত হয়।ফলে জীব বাঁচতে পারে না। তাই জীবকোশে
প্রোটোপ্লাজমের মৃত্যু হলে জীব জড়বস্তুতে পরিণত হয়।জন্মের পর অধিকাংশ জীবদেহ
নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। বাল্য, কৈশোর,
যৌবন
এবং পৌঢ়ত্বের পর প্রাকৃতিক নিয়মে জীবদেহে বার্ধক্যের লক্ষণ ফুটে ওঠে। দেহের
কর্মক্ষমতা কমে আসে এবং জরার লক্ষণ প্রকাশ পায়৳ কর্মক্ষমতা কমে আসার ফলে দেহের
বিভিন্ন বিপাকীয় কাজে কোশ আর ঠিকমতো অংশগ্রহণ করতে পারে না। ফলে কোশস্থিত
অঙ্গাণুগুলি ধীরে ধীরে অক্ষম হয়ে পড়ে এবং জীব একসময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, নশ্বর শরীর নিথর হয়।বর্তমানে
বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানবদেহের হৃৎপিণ্ডের
ছন্দোবদ্ধতা স্তব্ধ হওয়া মানেই মৃত্যু নয়, যতক্ষণ-না মস্তিষ্কের মৃত্যু ঘটছে ততক্ষণ মানুষের মৃত্যু
বিলম্বিত হয়। অতএব মৃত্যু জীবের অবধারিত এবং স্বাভাবিক পরিণতি।মৃত্যুর কোনো
দিনক্ষণ হয় নাকি ? হয় না। কারণ রোগীর
মৃত্যুর ‘সঠিক’ সময় নির্ধারণ করাটাও
অনেকক্ষেত্রে অসুবিধাজনক, কারণ দেখা গেছে
বিভিন্ন অংগপ্রত্যংগ দেহের মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকে, যেমন মস্তিষ্ক ৫ মিনিট, হৃৎপিণ্ড ১৫ মিনিট, কিডনি ৩০ মিনিট, কঙ্কাল পেশি ৬ ঘণ্টা। অঙ্গ বেঁচে থাকার অর্থ হল তার কোশগুলি বেঁচে থাকা। কোশ
বেঁচে থাকে ততক্ষণই যতক্ষণ এর মধ্যে শক্তির জোগান থাকে। শক্তি উৎপন্ন হয় কোশের
অভ্যন্তরস্থ মাইটোকন্ড্রিয়া থেকে। মাইটোকন্ড্রিয়ার কার্যকারিতা ক্ষুণ্ণ হলে কোশেরও
মৃত্যু হয়। কাজেই বোঝা যাচ্ছে যে,
মৃত্যু
কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং একটি প্রক্রিয়া।
দেহের মৃত্যু দিয়ে এর প্রক্রিয়া শুরু হয়, শরীরের শেষ কোশটির মৃত্যু পর্যন্ত এ প্রক্রিয়া চলতে থাকে।
মৃত্যু তো হল, কিন্তু মৃত্যুর ওপারে কী সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই উপনিষদের
কথা মনে পড়ে গেল। কঠ উপনিষদের প্রথম অধ্যায়ে যম ও নচিকেতার উপাখ্যানে আমরা জানতে
পারছি, বাজশ্রবস নামক মুনি
যজ্ঞফল কামনা করে পুরাকালে বিশ্বজিৎ যজ্ঞ সম্পাদন করে সেই যজ্ঞে তাঁর সর্বস্ব দান
করেছিলেন।বাজশ্রবসের পুত্র নচিকেতা পিতাকে বারবার “আপনি আমাকে কোন্ ঋত্বিকের উদ্দেশ্যে দান করিবেন ?” বলে বিরক্ত করলে পিতা ক্রুদ্ধ
হয়ে পুত্রকে বললেন, “তোমাকে যমের উদ্দেশ্যে
দান করিলাম”। অতঃপর নচিকেতা যমের গৃহে
উপস্থিত হলেন এবং তিন রাত্রি অনাহারে থাকলেন। গৃহস্থের বাড়িতে সমাগত
ব্রাহ্মণ-অতিথি অনাদৃত হয়ে অনাহারে থাকলে গৃহস্থের অমঙ্গল হয়, সেই কারণে যম নচিকেতাকে বললেন, “হে ব্রাহ্মণ, তুমি আমার অতিথি এবং ব্রাহ্মণ, কাজেই আমার নমস্কারের
যোগ্য।যেহেতু তুমি আমার গৃহে তিন রাত্রি অনাহারে যাপন করিয়াছ, সেই কারণে প্রতি রাত্রির জন্য
একটি করিয়া মোট তিনটি বর প্রার্থনা কর”।যমের
শুনে নচিকেতা বললেন, “হে যম, আমাকে যমালয়ে পাঠাইয়া পিতার
যে দুশ্চিন্তা হইয়াছে তাহা প্রশমিত হউক।… তোমার দ্বারা প্রেরিত হইয়া আমি গৃহে প্রত্যাগমন করিলে তাঁহার পূর্বস্মৃতি যেন
জাগিয়া ওঠে এবং আমাকে চিনিতে পারিয়া যেন সাদর সম্ভাষণ করেন। বরত্রয়ের মধ্যে ইহাই
প্রথম বর প্রার্থনা করিতেছি”।
প্রথম বরপ্রাপ্তির পর দ্বিতীয় বর প্রার্থনার
উদ্দেশ্যে নচিকেতা বললেন,
“হে
মৃত্যু, স্বর্গলোকে কিছুমাত্র
ভয় নাই, আপনারও সেখানে কোনো
অধিকার নাই, বার্ধক্যজনিত জরার
ভয়ও সেখানে নাই। সেখানে যাঁহারা গমন করেন, তাঁহারা ক্ষুধা-তৃষ্ণার কোনো কষ্ট পান না, সমস্ত শোক ও মানসিক দুঃখ
অতিক্রম করিয়া তাঁহারা আনন্দ ভোগ করেন। হে মৃত্যু, যে অগ্নির চয়ন দ্বারা মানুষ স্বর্গে করে, সেই অগ্নির বিষয় আপনি সম্যক্
অবগত আছেন। শ্রদ্ধাবান আমাকে তাহা সবিস্তারে বলুন। যাঁহারা মৃত্যুর পরে স্বর্গলোকে
গমন করেন তাঁহাদের অমৃতত্ত্ব লাভ হয়, এই কারণে স্বর্গলাভের অভিলাষী হইয়া আমি দ্বিতীয় বরে স্বর্গলাভের সাধনভূত
অগ্নিবিদ্যা আপনার নিকট প্রার্থনা করিতেছি”।যম
বললেন, “তুমি তৃতীয় বর
প্রার্থনা করো”। যমরাজের কথা শুনে নচিকেতা
বললেন, “কেহ কেহ বলেন মৃত্যুর
পর আত্মা থাকে, কেহ কেহ বলেন আত্মা
থাকে না। পরলোক সম্বন্ধে
মানুষের মনে এই যে সন্দেহ বিদ্যমান আপনার উপদেশে সেই আত্মার তত্ত্ব আমি সম্যক্
জানিতে ইচ্ছা করি। বরসমূহের মধ্যে ইহাই আমার প্রার্থনীয় তৃতীয় বর।যম বললেন, “নচিকেতা, তুমি যে বিষয়ে বর প্রার্থনা
করিয়াছ সে বিষয়ে দেবতারাও পূর্বে সংশয় প্রকাশ করেছেন।প্রাকৃত লোকে সহজে ইহা জানিতে
পারে না, কারণ এ আত্মতত্ত্ব
অতি সূক্ষ্ম।তুমি অন্য বর প্রার্থনা করো। আমাকে এ বিষয়ে আর উপরোধ করিয়ো না, আমার নিকটে এই বর প্রার্থনা
ত্যাগ করো।যে বিষয়ে দেবতারাও পূর্বে সংশয় প্রকাশ করেছেন, সে বিষয়ে সাধারণ মানুষ জানবে কীভাবে ! তবে কঠ উপনিষদ বলছে, “ন প্রাণেন নাপানেন মর্ত্যো
জীবতি কশ্চন।/ইতরেণ তু জীবন্তি যস্মিন্নেতাবুপাশ্রিতৌ”।। অর্থাৎ “কোনো মরণশীল মানুষই প্রাণবায়ু, অপানবায়ু বা অন্য কোনো বায়ু
দ্বারাই জীবন ধারণ করে না,
পরন্তু
এই প্রাণ ও অপান যাকে আশ্রয় করে আছে দেহ থেকে পৃথক সেই আত্মা দ্বারাই জীবন ধারণ
করে”।
মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস প্রণীত “মহাভারত”-এর অষ্টাদশ পর্ব
স্বর্গারোহণপর্বে বকরূপী ধর্ম যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন করেছিলেন, “এ জগতে আশ্চর্য কী ?” ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির উত্তরে
বলেছিলেন, “মৃত্যু অবধারিত জেনেও
মানুষ বেঁচে থাকে – এটাই আশ্চর্য।“
আসলে এই বেঁচে থাকা এবং ক্রিয়মান জীবনের
পরিসমাপ্তি-রেখা -- যার অপর নাম মৃত্যু – আশ্চর্য দুই-ই। জন্মলাভের মধ্য দিয়ে যে জীবনের শুরু এবং ক্রম-অভিব্যক্তি যার
প্রকৃতি – এ যেমন নিশ্চিত, তেমন নিশ্চিত মৃত্যুতে তার
শেষ পরিণতি।
“বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় নবানি গৃহ্ণাতি নরোঽপরাণি।/তথা
শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্যান্যানি সংযাতি নবানি দেহী”।। -- অর্থাৎ “মানুষ যেমন জীর্ণ
পোশাক ত্যাগ করে নতুন পোশাক গ্রহণ করে, তেমনই আত্মা জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে অন্য নতুন শরীর গ্রহণ করে”। “জীর্ণ পোশাক” কী, কখন, কীভাবে তা তো আমরা সবাই বিলক্ষণ জানি। কিন্তু “জীর্ণ শরীর” বলতে কী বোঝায় তার ব্যাখ্যা
কিন্তু বক্তা কোথাও দেননি। অতএব “জীর্ণ শরীর” বলতে আমি বার্ধক্য বয়সকেই
বুঝব, তাই নয় কি ? বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন
এই শরীরটির নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করার সক্ষমতা লোপ পায় এবং বার্ধক্যজনিত
রোগগুলি শরীরে বাসা বাঁধতে শুরু করে তখনই ধরে নিতে হবে আমরা বার্ধক্যে পৌছে গেছি।
তাই বার্ধক্যে পৌছোনোর বয়স ব্যক্তিবিশেষে ভিন্ন হতেই পারে। প্রতিটি মানবকোশে
অজস্র (নির্দিষ্ট সংখ্যক) ডিএনএ (DNA) আছে, আর তারই একটা ছোট্ট
অংশকে বলা হয় জিন (Gene)।এই জিনগুলিই আমাদের বংশগতির
ধারক ও বাহক। আর এই জিনজনিত কারণকেই এখনও বৃদ্ধ হওয়ার প্রধান কারণ হিসাবে
তাত্ত্বিকভাবে ধরে নেওয়া হয়।
পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে তৈরি হয় প্রচুর
বিষাক্ত উপাদান, যাদের বলা হয়
রি-অ্যাকটিভ অক্সিজেন স্পিশিস (Reactive
oxygen species), যার সংক্ষিপ্ত ভিন্ন একটি নাম ‘ফ্রি র্যা ডিকেল’
(Free radical)। তবে
আনন্দের বিষয় এই যে, আমাদের শরীরে এন্টি-অক্সিডেন্ট
(antioxidant) নামক এমন কিছু উপাদান
আছে যা সহজেই এইসব ফ্রি র্যা্ডিকেলকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। আর যখন এদের ভারসাম্য
নষ্ট হয়ে যায় এবং ফ্রি র্যামডিকেল প্রাধান্য বিস্তার করে তখন এরা আমাদের বিভিন্ন
জিন তথা ডিএনএকে ধ্বংস অথবা ক্ষতিগ্রস্ত করে তোলে। আরো মজার একটি ব্যপার হল আমাদের
শরীরে এমন কিছু জিন আছে যারা সেই ক্ষতিগ্রস্ত ডিএনএগুলিকে সারিয়ে তুলতে পারে।
ফ্রি র্যা ডিকেল যখন সেইসব সারিয়ে তোলার মতো জিনকেও ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত করে, তখন কিন্ত সত্যি সত্যিই
আমাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গগুলি ব্যাপকভাবে তাদের কর্মক্ষমতা হারাতে শুরু করে।
মস্তিস্ক, হৃদপিন্ড, ফুসফুস, বৃক্ক, অগ্নাশয়, পেশি, ত্বকসহ সকল অঙ্গগুলি এমনিভাবে প্রতিকুলতার সঙ্গে লড়াই করার
শক্তি হারিয়ে ফেলে এবং সহজেই বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হতে শুরু করে। এভাবেই
একটি মানুষ একসময় বার্ধক্যে উপনীত হয়। অর্থাৎ শরীর জীর্ণ হয়। গীতার বয়ান অনুসারে
এই শরীর যদি জীর্ণই, তবে সেই জীর্ণ শরীর
ছেড়ে আত্মা নতুন শরীরের খোঁজে ত্যাগ করতেই পারে। কিন্তু শূন্য (zero) বয়স থেকে যুবক বয়সে যাদের
হঠাৎ মৃত্যু হয় তাদের শরীর তো জীর্ণ নয়, তাহলে শরীর থেকে আত্মা বেরিয়ে কোন্ শরীরের সন্ধানে ? সে কথা গীতার বক্তা বলেননি। শুধু গীতার বক্তা শ্রীকৃষ্ণ কেন, কোনো ধর্মবেত্তাই এর জবাব
দেয়নি।
প্রশ্ন হল, মৃত্যুই কী শেষ ? অনেকে মনে করেন মৃত্যুই শেষ নয়। আছে আত্মা, আছে জন্মান্তর, আছে বিচার – বিচারে কারোর স্বর্গে
(বেহেস্ত বা জন্নত), কারোর-বা নরকে
(জাহান্নাম বা দোজখ) গমন ইত্যাদি। আবাল্য যাকে পাশে নিয়ে বেড়ে উঠলেন, জীবনের গুরুত্বপূর্ণ
ঘটনাগুলিতে যার আন্তরিক সাহচর্য,
কিংবা
স্নেহ-ভালোবাসা লাভ করে তৃপ্ত হয়েছেন, প্রেরণা পেয়েছেন, কিংবা জীবনের পথে
চলতে গিয়ে যাদের পাশাপাশি দেখেছেন-পেয়েছেন – তারপর একদিন হঠাৎ করে স্তব্ধ বিস্ময়ে দেখতে হল মৃত্যু তাদের
ছিনিয়ে নিয়ে গেল বিনা কৈফিয়তে। চিরতরে হারিয়ে গেল পরম প্রিয়জন। কোনোদিন আর সে
ফিরবে না। জন্মমুহূর্তে যেমন একা এসেছিলাম, তেমনই একাই যেতে হয়। মর-জগতের কোনো বস্তুই সঙ্গে করে নিয়ে
যাওয়া চলে না, নিয়ম নেই যে ! নিয়ে
যাওয়া যায় না কারোকেই। যে যায় সে একা
শূন্য হাতেই যায়। যায় কি ?
কোথায়
যায়? কেন যায় ? কে যায় ? আত্মা ?
আত্মার অস্তিত্ব বিষয়ে বিশ্বাস থাক বা না-থাক
আগ্রহ সকলের মধ্যেই কমবেশি বর্তমান। পণ্ডিতপ্রবর কোচ গ্রুনবার্গ মনে করেন, কতকগুলি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার
পদ্ধতি দেখে মনে হয় – হাড়গোড়ই জীবাত্মার
শেষ আশ্রয়স্থল। দেহের মৃত্যু হলে এই কঙ্কালের মধ্যেই জীবাত্মা থাকে। ঠিকই তো ! আজ
পর্যন্ত ভূতপ্রেতের রূপকল্পনা করতে কঙ্কালের কল্পনাই আগে করে নিই। টিউটনরা মনে
করেন, মৃত্যুর জগৎ ছায়া
জাতীয়। দেবী হেল এই মৃত্যুর জগৎ শাসন করেন। সূক্ষ্ম কোনো সত্তা স্থূলদেহীর মৃত্যুর
পর ভিন্নলোকে গেলেও চিরকাল সেখানে থাকতে পারে। আবার শ্লাভজাতিরা মনে করত, স্থূলদেহের মৃত্যু হলেই সব
শেষ হয়ে যায় না। তাই তাঁরা মৃতের সঙ্গে কবরে পার্থিব জীবনে ভোগের সব কিছুই দিয়ে
দিত। অন্যদিকে তিব্বতীয়রা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, মৃত্যুর পরও জীবাত্মা বেঁচে থাকে। তাঁরা বিশ্বাস করে, মৃত্যু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই
জীবাত্মা দেহ ছেড়ে চলে যায় না,
চারদিন
পর্যন্ত আত্মা দেহের সঙ্গে লেগে থাকে।
মধ্য প্রাচ্যের আন্নামাইটদের মধ্যে রীতি ছিল
গোষ্ঠীর পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে তর্পণ করা। এক্ষেত্র অবশ্য তিনপুরুষ পর্যন্ত
পূর্বপুরুষদেরই নাম স্মরণ করা যেত (হিন্দুরা যেমন তর্পণে সাতপুরুষের বা কোনো কোনো
হিন্দু চোদ্দোপুরুষের নাম স্মরণ করে থাকে)। তবে আন্নামাইটরা পূর্বপুরুষদের সকলেই
একত্রে যুক্ত করে পারিবারিক “এক আত্মা” রূপে কল্পনা করেও পুজো দিত।
এমন অনেক নরগোষ্ঠী আছে যাঁরা মৃতের নাম উচ্চারণ পর্যন্ত করে না। দক্ষিণ আমেরিকার
আদিবাসীদের অনেকেই পিতৃপুরুষদের ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে। মৃতের আত্মা দুষ্ট
আত্মাতে পরিণত হয় বলে তারা মনে করে। সেইজন্য নামরূপ জীবাত্মাকে স্মরণ করে তাকে
ডেকে আনতে চায় না। ফলে মৃত ব্যক্তির নাম মুখেও আনে না। কোথাও কোথাও মৃত ব্যক্তির
নাম উচ্চারণ করলে শাস্তিদানের ব্যবস্থাও আছে। গুয়াজিরো জাতিদের মধ্যে কেউ মৃতের
নাম উচ্চারণ করলে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হত। গায়ানার প্রাচীন অধিবাসীরা দেহের নানা
অংশের জন্য ভিন্ন ভিন্ন আত্মার কল্পনা করত। যেমন – হৃৎপিণ্ডের আত্মা, মস্তিষ্কের আত্মা, রক্তের আত্মা, থুতুর আত্মা ইত্যাদি। চিনের
পিকিং মানবজাতিরা মৃতের মাথা ভেঙে ঘিলু খেয়ে নিত। ভক্ষিত মস্তিষ্ক-ঘিলু সেই
ব্যক্তির শক্তি ও সাহস ভক্ষকের শরীরের ভিতর নিয়ে আসবে। হয়তো পিকিং মানুষেরা এরকম
তত্ত্বেই বিশ্বাস করত। কোনো কোনো জনগোষ্ঠীদের মধ্যে শুধুমাত্র মুণ্ড কবর দেওয়ার নিয়ম
ছিল। যেমন নিয়ানডার্থাল যুগের মানুষদের মধ্যে এ রীতি ছিল। মুণ্ডের মধ্যেই জীবাত্মা
থাকে – এরকম কবর দেওয়ার
পিছনে কাজ করেছে। জানা যায়,
নব্যপ্রস্তর
যুগের প্রথমদিকে কোথাও কোথাও নাকি মৃতদেহ থেকে মস্তিষ্ককে বিচ্ছিন্ন করে কবর দেওয়া
হত। মস্তিষ্ক জীবাত্মার বসবাস –
এরকম
ধারণা যে নব্যপ্রস্তর যুগেও ছিল এ থেকে তা প্রমাণিত হয়। এমনকি,, নিউজিল্যান্ডের মাওরিরাও
জীবাত্মার মস্তিষ্কে বাস করে –
এ রকম
ধারণাই পোষণ করে।
একটি নয়, একটি মানুষের কমপক্ষে সাতটি ভিন্ন ভিন্ন আত্মা আছে – এমনটা মনে করে মেলানেশিয়ান
জনগোষ্ঠীরা। তবে বগোবো জনগোষ্ঠীরা বিশ্বাস করে, প্রত্যেক মানুষেরই দুটি আত্মা আছে – একটি ভালো,
অপরটি
মন্দ। মৃত্যুর পর ভালো আত্মাটি স্বর্গে যায় এবং খারাপ আত্মাটি যায় নরকে। বহু
আফ্রিকান এবং পলিনেশিয়ান জনগোষ্ঠীর একটা অংশ এক অদ্ভুত তত্ত্বে বিশ্বাস করত।
বিশ্বাস করত -- মহিলা ও নীচুজাতের লোকেদের আত্মা থাকে না। তাদের কাছে পুরুষের
আত্মিক শক্তির পরিচয় ছিল কয়টি বিয়ে তিনি করেছেন তার উপর। অর্থাৎ, যে যত বিয়ে করে তার আত্মিক
সত্তা তত বেশি। “নেফেস” বলতে জীবাত্মা বোঝালেও একে
দেহযুক্ত আত্মার বাইরে খুব বোধহয় ইহুদিরা ভাবতে পারত না। তবে গ্রিক চিন্তার প্রভাবে
ইহুদিরা আত্মার অমরত্ব সম্পর্কে ভাবতে শুরু করে। এই অমরত্ব তাদের মতে জীবাত্মিক
সত্তাতেই হত। অর্থাৎ, কোনো জীবাত্মা
চিরকালের জন্য নরক ভোগ করবে,
কোনো
আত্মা চিরকালের জন্য স্বর্গ ভোগ করবে। ভারতের আদিবাসীরা আত্মা-ভাবনায় বারবার তাদের
ধারণা বদলেছে। তার কারণ, ভারত স্মরণাতীত কাল
থেকেই হাজারো জাতি দ্বারা অধ্যুষিত। পরিবেশ, জলবায়ু,
খাদ্য, পোশাক প্রভৃতি যেমন
মুহুর্মুহু বদলেছে – ঠিক তেমনই আত্মার
ধারণাও বদলেছে। আজও ভারতের নানা স্থানের জাতিদের নানা রকমের আত্মার ধারণা
বিদ্যমান। ভিন্ন ভিন্ন নরগোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন দর্শন। জীবাত্মা বলতে নির্ভেজাল এক
ভারতীয় বিশ্বাস বলতে যা বোঝায়,
তা নেই।
ভারতে প্রাগার্য নরগোষ্ঠীর জীবাত্মা সম্পর্কে নানা বিশ্বাস যেমন আছে, ঠিক তেমনই আর্যদেরও যুগে যুগে
বিভিন্ন দর্শনে বিভিন্ন ধরনের বিশ্বাসের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। আবার প্রাগার্য এবং
আর্য বিশ্বাস পরস্পর মিশে গিয়েও নতুন ধারণার জন্ম নিয়েছে। ভারতে সাধারণ বিশ্বাস হল, একটি দেহে একটিমাত্র আত্মা
থাকে। আদি বৈদিক সাহিত্যে জীবাত্মার চিন্তা তেমন করে প্রতিফলিত হয়নি। কারণ আর্যরা
প্রথমদিকে জীবনেরই উপাসক ছিলেন,
মৃত্যুর
নয়। ঋগ্বৈদিক আর্যরা মৃত্যুর চিন্তা তেমন করে করেননি। তার কারণ, তাঁরা বিশ্বাস করতেন
মৃত্যুতেই সব শেষ হয়ে যায় না। তবে ঋগ্বৈদিক আর্যরা মৃত্যুলোকের একটা কল্পনা
করেছিলেন। ভাবতেন – মৃত্যুলোক একটা
বহুদূর ধূসর দেশ, যেখানে সূর্য তার
জ্যোতি হারিয়ে অন্ধকার সৃষ্টি করে। সেই ধূসর জগতেরও একজন দেবতা আছেন বলে তাঁরা মনে
করতেন। সেই দেবতার নামই যম,
যম
মৃত্যুরই সমার্থক মাত্র। অথচ পরবর্তীকালে এই যমই ভয়াবহ রূপে কল্পনা করা হল।
ঋগ্বৈদিক যম মোটেই ভয়াবহ নয়। বলা হয়েছে – যম ও যমী হলেন প্রথম মানব ও মানবী, যাঁরা মৃত্যুর পর অস্তাচলের জগতে গিয়ে তাঁর অধীশ্বর ও অধীশ্বরী হয়েছিলেন।
প্রথম মানব-মানবীর “লোক” হিসাবে সেই মৃত্যুলোক
ঋগ্বৈদিক আর্যদের কাছে পিতৃলোক নামে পরিচিত হয়েছিল। ফলে পিতৃলোকে পরলোক ভীতির
স্থান তো নয়ই, বরং সুখকর লোক হিসাবে
তাঁদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছিল। তবে মৃত্যুর পর যে এই স্থূলদেহ থাকে না এটা
ঋগ্বৈদিক ঋষিরা জানতেন। সেইজন্য মৃত্যুর পর রূপান্তর ঘটে এরকম ধারণা হয়েছিল।
মৃত্যুর পর মানুষ অমর হয়, এরকম একটা ধারণাও
ছিল। মৃত্যু তাদের কাছে ছিল স্থূলদেহের নাশ মাত্র, আর কিছুই নয়। কিন্তু স্থূলদেহ নাশ হওয়ার পর জীবনের সত্তা কী
থাকে, এ সম্পর্কে তাঁরা
কিছু বলেননি। জীবাত্মার স্বরূপ কী সেটা তাঁরা স্পষ্ট করে কিছু জানাতে পারেননি।
ঋগ্বেদের ধারণা, মৃত্যুর পর পাপীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়, পুণ্যবান অমরজীবন লাভ করেন।
কিন্তু ব্রাহ্মণ সাহিত্যে বলা হয়েছে – পাপী এবং পুণ্যবান উভয়ই মৃত্যুর পর কর্মফল ভোগের জন্য পুনর্জন্ম লাভ করবে।
কর্মফলের জন্যই মানুষ জন্ম-মৃত্যুর আবর্তে চিরকাল ঘূর্ণায়মান, এমনই ধারণা ছিল। উপনিষদে বলা
হয়েছে, কামনা-বাসনা থাকলে
স্থূলদেহের মৃত্যু হলে জীবাত্মা পুনরায় জন্মগ্রহণ করে জন্মান্তরের হাত থেকে রেহাই
পাওয়া যায় এমন চিন্তাভাবনাও শুরু হল। বলা হল, জন্ম-মৃত্যুর আবর্ত থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় হল নিষ্কাম
কর্ম।
বেদান্ত মতে -- আত্মা কখনো চলে যায় না, আসেও না, জন্মগ্রহণ করে না, মৃত্যুও হয় না। আত্মা যেসব
কাজ করেছে, যেসব চিন্তা করেছে, সেগুলিই একে কোনো বিশেষ দিকে
পরিচালিত করবে। ওই আত্মা নিজের মধ্যে ওইসব সংস্কার নিয়ে গন্তব্য পথে এগিয়ে যাবে।
যদি সমবেত কর্মফল এমন হয় যে,
পুনর্বার
ভোগের জন্য তাকে একটা নতুন শরীর গড়তে হবে, তবে তা এমন পিতামাতার কাছে যাবে, যাদের থেকে সেই শরীর গঠনের উপযোগী উপাদান পাওয়া যেতে পারে।
আর সেইসব উপাদান নিয়ে আত্মা একটি নতুন শরীর গ্রহণ করবে। এইভাবে ওই আত্মা দেহ থেকে
দেহান্তরে যাবে, কখনো স্বর্গে যাবে, আবার পৃথিবীতে এসে মানবদেহ
পরিগ্রহ করবে; অথবা অন্য কোনো
উচ্চতর বা নিম্নতর জীবশরীর পরিগ্রহ করবে। এভাবে আত্মা ততদিন অগ্রসর হবে, যতদিন-না তার অভিজ্ঞতা অর্জন
শেষ হয় এবং পূর্বস্থানে প্রত্যাবৃত্ত হয়।
ভারতীয় দর্শনে জড়বাদী চার্বাক দার্শনিকরা
দেহাতিরিক্ত কোনো আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করে না। চার্বাকদের মতে চৈতন্যবিশিষ্ট
দেহই আত্মা। আত্মার অমরতা, কর্ম ফলভোগ, জন্মান্তর, বন্ধন, মুক্তি সবই অর্থহীন – প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ
এবং প্রত্যক্ষের মাধ্যমে কোনো অজড় নিত্য চৈতন্যবিশিষ্ট আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণ করা
যেতে পারে না। অভিজ্ঞতাবাদী বৌদ্ধ দার্শনিকগণও কোনো শাশ্বত বা চিরন্তন আত্মার
অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। তাঁদের মতে, কোনো এক মুহূর্তে আমাদের মধ্যে আমরা যেসব মানসিক প্রক্রিয়াগুলি দেখি, সেইসব মানসিক প্রক্রিয়ার ধারা
বা প্রবাহই আত্মা। ভগবান বুদ্ধের মতে, জন্মান্তর অর্থে কোনো চিরন্তন আত্মার নতুন দেহ পরিগ্রহণ নয়। জন্মান্তর অর্থে
বর্তমান জীবন থেকে পরবর্তী জীবনের উদ্ভব। জৈন দার্শনিকরা অবশ্য আত্মার সত্তা
স্বীকার করেন। তাঁদের মতে,
চৈতন্যধর্মবিশিষ্ট
এবং চৈতন্য আত্মার স্বরূপ লক্ষণ। আত্মা নিত্য এবং দেহাতিরিক্ত সত্তা। আত্মার জন্ম
বা মৃত্যু নেই। কর্মফল ভোগের জন্য আত্মা যখন যে দেহ ধারণ করে, তখন সেই দেহের অবস্থা লাভ
করে।
চৈনিক তাওবাদীরা মনে করতেন, প্রত্যেকটি লোকের দুটি করে
আত্মা আছে – “কি” এবং “লিঙ”। “কি” হল প্রাণ এবং “লিঙ” হল যথার্থ জীবাত্মা
বা দেহের সূক্ষ্ম সত্তা। “কি” দেহের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত
থাকে। “লিঙ” দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অপরদিকে
মুসলিম সম্প্রদায়গণের একটা অংশের বিশ্বাস, আত্মা মৃত্যুকালে মুখ দিয়ে নির্গত হয়। আবার কেউ কেউ মনে
করেন, মস্তিষ্কের পিছন দিয়ে
আত্মা নির্গত হয়। মৃত্যুর পর ফেরেস্তা বা দেবদূতেরা আত্মাকে বেহেস্তে নিয়ে গেলেও
সেখান থেকে আল্লাহতালা আবার তাদের নীচে পাঠিয়ে দেন। স্বর্গ থেকে ফিরে এসে এইসব
আত্মারা কেউ বেশিদিন, আবার কেউ কমদিন কবরে
বাস করে। তাদের বিশ্বাস, রোজাকেয়ামতের দিন
পর্যন্ত আত্মা পাখির আকারে জীবিত থাকে। বিশ্বাসী ব্যক্তি যে পাখিটিকে আশ্রয় নেয়
তার রং সবুজ, পাপীদের আত্মা যে
পাখিটিতে আশ্রয় নেয় তার রং কালো। কোরানের মতে, প্রত্যেককেই মৃত্যুর স্বাদ ভোগ করতে হবে। শেষের দিনে
পরমপিতার তুর্যনাদে যাঁরা বেঁচে থাকবেন তাঁরা মারা যাবেন। উচ্চস্তরীয় কিছু দেবদূতই কেবল বেঁচে থাকবেন। কে, কবে মারা যাবেন তা
পূর্বনির্দেশিত। মৃত্যুকালে যার মুখ থেকে “আল্লা ছাড়া দ্বিতীয় ঈশ্বর নেই” কালিমাটি উচ্চারিত হবে তিনি নিশ্চয় বেহেস্তে যাবেন।
জীবাত্মা আছে – এ বিশ্বাস ইসলামে
দৃঢ়। মুসলমানরা মনে করেন, যাঁরা ইসলামে বিশ্বাস
করেন মৃত্যুর পর দয়ার্দ্র কোনো দূত সাদা পোশাক পরে তাঁর আত্মার কাছে আসেন এবং
পরমপিতার শান্তিতে স্থান লাভ করার জন্য আমন্ত্রণ জানান। আত্মাকে এক দেবদূতের কাছ
থেকে অন্য এক দেবদূতের কাছে দেওয়া হয়। শেষপর্যন্ত তাঁকে ইসলাম বিশ্বাসীরা যেখানে
আছেন সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে ইসলামীরা মনে করেন, ইসলামে অবিশ্বাসী আত্মা দুর্গন্ধ ছড়িয়ে দেহত্যাগ করে।
ঈশ্বরের দূতেরা বিরক্ত হয়ে তাকে অবিশ্বাসীদের আত্মা যেখানে আছে সেখানে নিয়ে যান।
মৃত্যুর পর আত্মার পুনরুত্থানের ধারণা সর্বপ্রথম
পারস্যেই সৃষ্টি হলেও পরে নিউ টেস্টামেন্টের পাতায় ওই ধারণা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং
তখন থেকেই পাশ্চাত্য জগতের খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা পরিমাণে ওই ধারণা গ্রহণ বা
স্বীকার করে আসছিল। মথি, লুক মার্ক লিখিত
সুসমাচারের মধ্যে আত্মার যে পরিচয় পাওয়া যায় তাতে মৃত্যুর পর একটি সূক্ষ্ম সত্তার
অস্তিত্ব আছে – এই রকমের ধারণা
অত্যন্ত স্পষ্ট। নিউ টেস্টামেন্টে যে প্রেতাত্মার কথা পাওয়া যায় তা শেষপর্যন্ত Holy Ghost-এ পরিণত হয়েছে। খ্রিস্টানগণ
মনে করেন, আত্মা হল অধ্যাত্ম
সত্তা।
আত্মা বিষয়ে দার্শনিকগণ কী বলেছেন সেটা একবার
দেখে নেওয়া যাক। দার্শনিক প্লেটো বলেছেন, দেহের সঙ্গে আত্মার কোনো সম্পর্ক নেই। জন্মের সময় আত্মা দেহের সঙ্গে যুক্ত হয়
এবং মৃত্যুর পর আত্মা নিজের রাজ্যে চলে যায়। দার্শনিক ডেকার্তের মতে আত্মা এবং জড়
পরস্পর-বিরুদ্ধ ধর্মবিশিষ্ট। চেতনার মাধ্যমে আমরা আত্মাকে জানতে পারি। আত্মাকে
প্রত্যক্ষ করা যায় না। আমরা অনুভবের মাধ্যমে আত্মাকে জানতে পারি। বার্কলের মতে --
ধারণা নিষ্ক্রিয়, আত্মা সক্রিয়। আত্মা
আশ্রয়, ধারণা বিষয়। আত্মা
জ্ঞাতা, ধারণা জ্ঞেয়।
এবার আত্মা বিষয়ে বিজ্ঞানীরা কী বলেন সেটাও দেখে
নিতে পারি। তবে তার আগে স্বামী নিগূঢ়ানন্দের বিজ্ঞানীরা কী বলেছেন সেটা আগে দেখব।
নিগূঢ়ানন্দের “মৃত্যুর পরে” গ্রন্থটিতে বলছেন, রুশ বিজ্ঞানীরা মৃতদেহ থেকে
চার গজ দূরে সারগেয়েভ ডিটেকটর বসিয়ে দেখেছেন যে, মৃতদেহে কোনো সাড়া না থাকলেও সেই দেহের চার গজ দূরত্বে
শক্তির সাড়া পাওয়া যায়। এই দূরত্বে দেহের ফোর্সফিল্ড থাকে বলে বিশ্বাস। আমেরিকার
নিউ জার্সির টমসন ডঃ জ্যাক ওয়ার্ডের সাহায্যে আবিষ্কার করেন যে, একটি মানুষের এই ফোর্সফিল্ড
আর-একটি মানুষের ফোর্সফিল্ডের স্পন্দন দূর থেকেই অনুভব করতে পারে। মানুষের এই
ফোর্সফিল্ড বা দ্বিতীয় সত্তাই বিপদ-আপদ এবং ভালোমন্দের কথা আগে থেকেই বুঝতে পারে।
তদানীন্তন চেকোশ্লোভাকিয়ার বিজ্ঞানীরাও দেহের একটা আত্মিক ক্ষেত্র বা Psi-field রূপী আবরণ আবিষ্কার করেছেন।
এই সত্তা নিয়ে তারা Psychotronics
নামে এক
বিজ্ঞানের সৃষ্টি করেছেন। এই বিজ্ঞান জীবের এই দ্বিতীয় সত্তা নিয়ে কাজ করে। চেকরা
দেখিয়েছেন যে, সকল জৈবসত্তার
চারদিকেই এই তেজাবরণ থাকে। এই তেজাবরণ বা সাইকোট্রনিক-এনার্জিই হল আত্মা – যা স্থূলদেহ থেকে মৃত্যুকালে
বেরিয়ে যায়।
বিজ্ঞানীরা স্থূলদেহ থাকাকালীন সূক্ষ্মদেহ বা
বায়ো-প্লাজমিক বডির একটা অনুমান করতে পেরেছেন মাত্র। মৃত্যুর পর স্থূলদেহ থেকে এই
তেজকায়া বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এটাও বুঝতে পেরেছেন। স্থূলদেহের উপর এই তেজকায়ার বিরাট
একটা প্রভাব আছে তাও তাঁরা অনুমান করতে পেরেছেন। কিন্তু স্থূলদেহ থেকে বিচ্ছিন্ন
হয়ে শেষপর্যন্ত তা কোথায় যায়,
কীভাবে
থাকে – তা অনুমান করতে
পারেনি। -- মন্তব্য নিগূঢ়ানন্দের।
আত্মার অস্তিত্ব নিয়ে আরও অনেক মতামত এখানে হাজির
করা সম্ভব। যদি হাজির করি শুধু
এই প্রবন্ধটিই নয়, একটা মোটকা একটা বই
লিখে ফেলা সম্ভব। যুগ যুগ ধরে আত্মা বিষয়ে হাজার মানুষের হাজার মত প্রকাশিত হয়েছে।
অবশ্যই সেগুলি স্ববিরোধিতায় বিভ্রান্ত। আসলে সবই অনুমাননির্ভর, প্রত্যক্ষ নয়। প্রত্যক্ষ নয়
বলেই ধারণারও শেষ নেই। সৃষ্টির আদি থেকেই যে যার মতো ভেবেছেন এবং প্রকাশ করেছেন
প্রত্যক্ষদর্শীর ভণিতায়।
বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষের মধ্যে আমিও একজন
ব্যক্তিমানুষ। তাই আত্মার অস্তিত্ব বিষয়ে আমারও মত থাকা অনুচিত হবে না। আমি মনে
করি – পৃথিবীর সব জায়গাতেই
কোনো একটি নির্দিষ্ট বস্তুর সংজ্ঞা নির্দিষ্ট হওয়া উচিত। কিন্তু আত্মার বিভিন্ন
প্রকার অসংলগ্ন অসামঞ্জস্য ধারণাই প্রমাণ করে দেয় আত্মা বলে আদৌ কিছু নেই। আত্মা
যদি থাকে এবং সেটি যদি জন্মহীন,
মৃত্যুহীন
হয় – তাহলে পৃথিবীতে
প্রাণের আবির্ভাবের পূর্বে আত্মারা কোথায় ছিল ? আত্মার ক্ষয় নেই, মৃত্যুও নেই – তাহলে জনসংখ্যা
বৃদ্ধির কারণই-বা কী ? আত্মা বিশেষজ্ঞদের
কাছে যথার্থ উত্তর উত্তর মেলে না। সুতরাং আমি বলবই আত্মা নামক কোনো কিছুর অস্তিত্ব
নেই। আত্মা আমার কাছে হাঁসজারু,
বকচ্ছপ, ঘোড়ার ডিম, পক্ষ্মীরাজের সমান মনে হয় --
তার বেশি কিছু নয়। আত্মা একটি কাল্পনিক বস্তু, ম্যানমেইড – যার কোনো অস্তিত্ব নেই। এর একমাত্র অস্তিত্ব অন্ধবিশ্বাসী, যুক্তিহীন প্রশ্নহীন, গতানুগতিকার আনুগত্যতায় বিবশ, ধর্মভীরু মানুষের তমসাচ্ছন্ন
মানসিকতায় ।
মোহমুগ্ধতার চশমা খুললেই পাঠ করতে পারবেন, কর্মফলকে কেন্দ্র করেই এসেছে
শোষক ও শোষণের নতুন দিক। দাস সম্প্রদায়কে কর্মফলের আফিম খাইয়ে প্রতিবাদহীন করা হল
নানা চতুরতায়। এইভাবে সৃষ্টি হয়েছিল আত্মার অবিনশ্বরতার ধারণা, যার সঙ্গে যুক্তিবাদী
বিজ্ঞানচিন্তার কোনো সম্পর্ক নেই। পুরুষদেহজাত শুক্রাণু নারীর দেহনিঃসৃত ডিম্বাণুর
মিলনেই নতুন প্রাণের সৃষ্টি হয়। সেখানে আত্মার কোনো সম্পর্ক বা ভূমিকা নেই। যদি
থাকত, তাহলে যৌনমিলন ছাড়াই
নারী এবং পুরুষ যথাক্রমে গর্ভবতী এবং গর্ভবান হত। যৌনতারও প্রয়োজন হত না, যৌনতাড়নাকে কেন্দ্র করে
ব্যভিচারিতাও থাকত না।
আত্মা যদি মন, চেতনা,
হৃদয় বা
মস্তিষ্ক ছাড়া যদি আত্মা হিসাবে অন্য কিছু কল্পনা করা হয়, তবে সেটা স্রেফ ভাঁওতাবাজি। এ রকম আত্মার অস্তিত্ব কোনোদিনও
ছিল না, আজও নেই। জীবজগতের
মস্তিষ্ক, হৃদয়, রক্ত, পেশি,
হাড়, স্নায়ু – সবকিছুই নশ্বর। মন বা আত্মা
বলে দেহের ভিতর কিছু বসবাস করে না, ঘরবদলও করে না। এটা ভিন্ন মানুষের ভিন্ন ধারণা, যা ভিত্তিহীন। কেউই প্রত্যক্ষ করেননি। তাই কারোরই
আত্মাজ্ঞান গ্রহণযোগ্য নয়।
এইসব জ্ঞানী-পণ্ডিতগণ শুধু আত্মাতেই ক্ষান্ত হননি।
আত্মার সঙ্গে সঙ্গে জন্ম দিয়েছেন জন্মান্তরবাদের, আছে স্বর্গ-নরক। আমরা খুঁজতে চেষ্টা করব জন্মান্তরবাদ বা
পুনর্জন্মবাদ কী তার উত্তর।
আদি মানুষ প্রথম যে ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করে চরম
বিস্ময়াভুত হয়েছিলেন, সেই ঘটনাটি অবশ্যই “মৃত্যু”। আর সেই প্রাচীনকাল থেকেই মৃত্যুকে ঘিরে হাজারো অনুসঙ্গ, জল্পনা-কল্পনা, নানা ফন্দি-ফিকির, তত্ত্ব-তালাশ। মৃত্যুকে
কেন্দ্র করে আত্মা, পরমাত্মা, মোক্ষ, পাপ, পুণ্য,
স্বর্গ, নরক, ভুত-পেতনি-ব্রহ্মদত্যি, কর্মফল,
জন্মান্তর, জাতিস্মর এরকম হাজারো বিমূর্ত
ধারণা।বাস্তবে যাঁরা আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন তাঁরাই জন্মান্তর বা
জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস করেন। ভারতীয়রা প্রাচীনকাল থেকেই জন্মান্তরে বিশ্বাসী।
আর্যধর্মে এই জন্মান্তর সম্পর্কিত বিশ্বাস আর্য-পূর্ব ভারতীয়দের কাছ থেকে এসেছিল
বলে পণ্ডিতজনেরা মনে করেন। গ্রিক দার্শনিক পিথাগোরাসও নাকি জন্মান্তরে বিশ্বাস
করতেন। অবশ্য খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা জীবাত্মায় বিশ্বাস রাখলেও জন্মান্তরে
বিশ্বাস নেই। যাঁরা পুনর্জন্মবাদ মানেন না তাঁরা একজন্মবাদেই আস্থাবান।তাঁদের
বিশ্বাস, ব্যষ্টি-আত্মা
সর্বপ্রথম শূন্য থেকেই সৃষ্ট।
সুচিন্তিত মতামত দিন