স ত জীবন

মায়াজম
0
কাজুলী


মকে দাঁড়ায় কাজুলী। ক'বছরের ব্যবধানে শহরটা মাটিহারা হতে দেখেছে ও। পাষাণের গাঁথুনিতে খাবিখা করে শহর স্পর্শ করছে মেঘ। সূর্যটা দু'বার নরম হয়ে; মাঝখানের সময়টা দহনের কাল। রুদ্রাক্ষের দানার মতো প্রতিদিন প্রভাত আসে। অনেকদিন হলো দুপুরের আকাশটা দেখা হয়নি ওর।
- কাজুলী, এলি?
- হু।
- আজো এসেছিল। যমের অরুচি।
- মা, ছাড়ো তো। ভাল্লাগেনা। 
- বস্তি মাথায় তুলেছিল। বলেছে- বেশ্যামাগি যদি এবার টাকা না দেয়, তবে লোক এনে টাকা কামিয়ে যাবো।
উনুনে চাল ফুটতে থাকে, নগরপিতা খুব ভালোবেসে বস্তির পাশেই আবর্জনার ভাগাড়টা বসিয়েছে। কাক আর কুকুরের নিত্যকলহে ঘুম ভাঙে ওর। প্রায়ই দেড়ি হয় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে যেতে। টয়লেটে লাইন পড়ে যায়। কয়েকদিন আগের কথা- কাজুলী, মিনিটখানেক হয় ঢুকেছে। আশি ছুঁই ছুঁই রমিজ মিয়া খেঁকিয়ে উঠল। 
- কিরে মাগী, ভেত্রে কি ভাতারের লগে রঙ্গতামাসা করতাছস নাহি? বালিশ আইন্ন্যা দিমু? হুইয়া থাক। একগুম পাইরা, হেরপর বের হ, শালী।
যখন ও এই বস্তিতে প্রথম এলো, তখন ওর বয়স খুব হলে সতের। তিনজন ছোট ছোট ভাই বোন। মা নিরুদ্দেশ। বিষ খাইয়েছিল বাবাকে। আজো কারনটা জানা হয়নি ওর। এ প্রসঙ্গটা এলে মা চুপ করে থাকে। গাড়ীয়াল ছিল বাবা। সারারাত গরুর গাড়ী চালাতেন। পাঁচ মাইল দূর হতে তাঁতিপাড়ায় সুতো, রঙ আর সাবান নিয়ে যেতো। ওদের জন্য কতো কি নিয়ে আসতো। শিউলি বলতো- ভাল বাবা। ভাল বাবা পেটে ধরে রাখতে পারলেননা বিষমাখা ভাত। গরগর করে বমি করে দিলেন। বেঁচে গেলেন বাবা। বেঁচে গিয়েছিলেন হয়তো একারনে যে - রোগে-শোকে অনাহারী হয়ে একাকী মরতে হবে! বাবা অভিমানী হয়ে বাড়ী ছাড়া। মাসুম ভাই-বোনের ক্ষুধার্ত চিৎকারে চোখ ভারী হয়ে আসে। অনেক অশ্রু ঝরিয়েছে ও, কোন হৃদয় স্পর্শ করেনি সে কান্না। অবশেষে পাললিক বসত ছেড়ে পাষাণের বুকে ঠাঁই নিতে হলো। অগতির পাশে ভাই-বোনকে বড় করেছে ও। উদরের জন্য শরীর বেচেছে। মানুষের বাড়ী বুয়ার কাজ করেছে। মাটিকাটার কাজ করেছে। চারটা পেটের জন্য কিনা করেছে ও। শিউলি বেলাল অনু বড় হলো। গার্মেন্টসে চাকুরী নিয়ে ওরা দূরে সরে গেল। প্রথম প্রথম কান্না পেলেও, এখন আর কাঁদতে ইচ্ছে করেনা। শুনেছে একাত্তরে নাকি মানুষ কাঁদতে ভুলে গিয়েছিল। পিতার লাশ ডিঙিয়ে ছুটেছে সন্তান। মৃত্যুর পূর্বে একপেয়ালা জল জুটেনি জননীর। বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। সেসব দিনের গল্প শুনতে চাইলে চোখে ঝিলিক খেলে যেতো তাঁর। তারপর অনেকদিন। সংসার চালাতে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন তিনি। পাশের বাড়ির মতিন কাকা যেদিন বলল- এবার মুক্তিযোদ্ধাদের দিন ফিরবে। বাবা একদলা থুথু ফেলে মাটির দিকে তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ। মতিন কাকা আর একটি কথাও বলেনি। আকাশভাঙা বৃষ্টি হলে; বাবার ছুটি। সব ভাইবোনকে নিয়ে গল্পের আসর বসাতেন। এমনই এক দিনে বাবা বলেছিলেন- রাইতে বিষ্টি অইলে, আসমানে তাঁরা গুলান ঘুমাইয়া পড়ে। বুঝছো আম্মাজানেরা? মৌসুমের পরথম বিষ্টিতে চান (স্নান) করলে পাপ ধুইয়া যায়। শরীলে কাঁদা ডইল্যা চান করবা। দেখবা মন পরিষ্কার হইয়া গেছে। 
সবকিছু খোয়া গেছে ওর। স-ব। অন্ধের যষ্টির ন্যায় নিবুনিবু প্রদীপে হয়ে বেঁচে আছে মা। যখন পরিজন বিতাড়িত নিঃস্ব আঁচলে প্রথম শহরে এলো; ফুটপাত ঘর-বসতি ছিলো ওর। ছোট্ট ভাই-বোনের ক্ষুধার অন্ন জোটাতে সস্তা লিপিস্টিকে শরীর বেচেছে ও। তারপর বস্তি। একদিন মা এসে জুটে গেলো। রুগ্ন। ফিরিয়ে দেয়নি ও। মা তো! 
বিয়ে হয়েছিল। স্বামী রিক্সা চালাত। মদের নেশা ছিল আগে থেকেই। মেহেদির রঙ হাত থেকে মুছে যাবার আগেই ওর সর্ব শরীরে ফুটে উঠল নিষ্ঠুরতার খড়গ কৃপাণ। হীন কাজ নেই, ঐ মানুষটি না করে। ফুটপাতে নেশার ঘোরে লুটোপুটি খায় নেড়ি কুকুরের মতো। টাকায় টান পড়লে এ-মুখো হয়। অশ্রাব্য বাক্যবাণে অতিষ্ঠ করে যায়। এ-সব গা সওয়া হয়ে গেছে ওর। হয়তো উপায় ছিলনা তাই। 
বাবার কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে যায়। "মৌসুমের প্রথম বৃষ্টিতে স্নান করলে, পাপ ধুয়ে যায়।" অহরহ বুক কেঁদে উঠে। জীবননাম্নী বিষবৃক্ষ হতে মুক্তি আকুলতায় খুঁজে ফিরে ফেলে আসা উচ্ছল শৈশব। বাবার কাছে শুনা সে পাপমোচনের বৃষ্টিতে ভিজতে খুব করে ইচ্ছে ক'রে ওর। একবুক আকাশভাঙা পবিত্র বৃষ্টি।।
--------------

                                                                                   


লেখক পরিচিতি- ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের টাংগাইল জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবার চাকুরীর সুবাদে বিভিন্ন জেলায় কেটেছে শৈশব এবং কৈশোর। ছাত্রজীবন হতে সাংবাদিকতার মাধ্যমে লেখালেখি শুরু। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্নাতকোত্তর শেষে বিদ্যুৎ বিভাগে কর্মজীবন শুরু। ১৯৯৮ সালে প্রথম কবিতার বই প্রকাশ। নাম- "বিমুগ্ধ বেহেয়া দৃষ্টি"। নাটক লিখেছেন- তিনটি, "স্মৃতির অরন্যে বেঁচে আছো তুমি", "চোরের গোঁসাই" এবং "বাউরী বাতাস"। প্রকাশিত কবিতার বই- "কাছে-দূরে" (২০১৬) এবং "জীবনের যতো কাব্য"(২০১৭)।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)