উত্তম বিশ্বাস

মায়াজম
0
                             পোষা বাইসন



“পরিখার মতো চতুর্ধারে জলকর, তবু কুকুরগুলো কিভাবে এই লবণ ঢ্যাকে আসে কে জানে! একে বন কর্মীদের ভয়; তার ওপর ত্যাঁদড় কুকুরগুলো যদি পেছন থেকে ফেউ লাগে, এসব কাজে কি আর মস্তি আসে!? যাই হোক হরিণটাকে মেরে, আচ্ছারকম নুন আর সর্ষের তেল মাখিয়ে মাখিয়ে আমরা ছাড়াতে লাগলাম। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে গড়া গোলার বেড়ের মত খুপরি একখান ঘর, নীচে সুড়ঙ্গ---- রক্ত-জল মাটিতে পড়বার আগেই গোপন নালা বেয়ে সোজাসুজি মিশে যায় সাগরে---! তমালের হাতে বাবলাকাঠের খেটে, আর ভীমের হাতে নুনের গামলা। সে কী গন্ধ! আঃ সব কী আর চাপা যায়! গরম গরম তাজা হরিণের মাংস----!”
--“তারপর? তারপর?” ঋতাভরীর হৃদযন্ত্রের রিদিম অস্থির হতে থাকে। কিন্তু রণিত আর বেশিদূর এগোতে চায় না। প্রত্যেকবারই একটি জায়গায় এসেই সে থেমে যায়। ঋতাভরী ব্লাংকেটের নীচে পা দিয়ে গুঁতো দেয়, “কী হলো?--- হবে না?” 
--“হচ্ছে না তো!”
--“চেষ্টা করো। তোমার পছন্দের এসেন্সটাই মেখেছি শুঁকে দ্যাখো?” 
--“ওফ শেট! কিছুতেই সেই মুড আসছে না!”
--“তাহলে আবার প্রথম থেকে শুরু করো।”
রণিত আগ্রহ দ্যাখায় না। ঋতাভরী একরাশ খিদে ক্ষোভ নিয়ে পাশ ফেরে। রণিতও ঘুমোতে চেষ্টা করে; কিন্তু পারে না। মাঝে খানিক ল্যাপটপটা কোলের মধ্যে টেনে নিতে গিয়েও, ঋতাভরীর ভয়ে একসময় সে চেষ্টাটুকুও গুটিয়ে যায়। অর্ধেক ছাড়ানো বুনো হরিণের মাংস তখনও ঋতাভরীর মগ্ন উঠোন জুড়ে বাষ্প ঠ্যালা সরার নীচে সেদ্ধ হতে থাকে। আর ঘুমনোর অছিলা নিয়ে রণিতের লোমশ বুক থেকে মুখ সরিয়ে রোজ রাতেই ঋতাভরী এভাবেই হারিয়ে যায় কাঙ্ক্ষিত আর এক জগতে। এবার সে স্পষ্ট শুনতে পায়--------- 
--“আজ পার্টী, মনে আছে তো?” 
ঋতাভরী মনে করার চেষ্টা করে। হ্যাঁ হ্যাঁ সবকিছু আজ চটপট মনেও পড়ে যাচ্ছে তার,-- সেই যে আধখাওয়া আকাঙ্ক্ষা, উদ্দাম জীবন, আর বলিষ্ঠ বাঘের মতো প্রিয় সব বয়ফ্রেণ্ড,-- যারা কিনা ঋতাভরীর মতো মেয়ের চোখে বাছাই করা হাণ্ডসাম গাইজ! মনে পড়ে যাচ্ছে! সব স্পষ্ট মনে পড়ে যাচ্ছে ঋতাভরীর। 
--“কী রে চিনতে পাচ্ছিস না?-- ভুলে গেলি?” 
--“হ্যাঁ হ্যাঁ পাচ্ছি, ভুলব ক্যান? লবণখাঁড়ি ঠিক ছিল,-- কিন্তু এত গভীর জঙ্গলে গেলি কেন?” 
দাবানলের মতো হাসির হলকা ছড়িয়ে দেয় অনিন্দ্য,--“গভীরে না গেলে মজা কী রে! আদি জিনিসটাই তো পাব না। শুধু মদে কী আর গলা ভিজবে?”
--“ওহ! তাই তো! কিন্তু বোট না পেলে? আমি বাপু ভিজেপুড়ে সাঁতার দিতে পারব না।” 
--“তুই শুধু ঝাঁপ দিবি। ব্যাস!-- বাকী কাজটুকু আমাদের।”
--“দীপক আসছে তো রে?” 
--“ও না আসলে বন্দুক পাব কোথায়? এমন রাজকীয় আয়োজনে বনমুরগীর মতো সিলি খাবার খায় নাকি কেউ? ওসব তো রণিতের মতো একমাত্র শেয়াল যারা, তাদের খাদ্য! তুই তাড়াতাড়ি বার হয়ে আয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা ঝাঁকে ঝাঁকে বেরিয়ে পড়বে।--- আর হ্যাঁ, পারলে তোর বাগান থেকে একমুঠো কচি লেবুপাতা ছিঁড়ে আনিস। ক্যামন?”


ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজে সুবৃহৎ কাঠের দরজাখানি খুলে গেল। ঋতাভরী অভিসারে বেরিয়ে পড়ল। আজ চাঁদ উদ্ধত বড়ায়ী,আর ঋতাভরী রাক্ষুসী রাধা। এই মুহূর্তে যেন যুদ্ধবিদ্ধস্ত পুরুষ শূন্য একটা নগরী পেরিয়ে যাচ্ছে ঋতাভরী। নিবিড় নৈশ নিমন্ত্রণের নেশায় ওর ঘোটকীও ছুটছে দারুণ! ঋতাভরী একাএকাই মমিদেশ, ইগলুঘর পেঙ্গুইন প্রান্তর সব একে একে পেরিয়ে যেতে থাকে। এইমাত্র বোধহয় তুষার ঝড় হয়ে গেল? জীবিত জনপদ, গৃহীর ঘরদোর সব তছনছ হয় পড়ে আছে ইতিউতি! কয়েকটা মাংস লোভী মেরু-কুকুর ছাড়া ওর নৈশপথের অভিসারী আলোয় তেমন আর কেউ জীবিত আর কিছু চোখে পড়ল না। পথের প্রান্তে রণিতও পড়ে আছে মৃত বাইসনের মতো। ওর গায়ের থেকে লোমশ চামড়াটুকু হ্যাঁচকা টানে ছুলে নিজের গায়ে জড়িয়ে নিল ঋতাভরী। ঠিক হরিণের ছাল ছাড়ানোর মতো। যেটুকু আবরণ ওর নিজের জন্যে একান্ত দরকার, সেটুকুই নিলো।

একসময় একটা পাইন গাছের নীচে এসে ওর ঘোটকী থামল। অনিন্দ্য এসে বুকভরে কচি লেবুপাতার গন্ধ নিল। দীপক আগুনের মশাল উঁচিয়ে ঋতাভরীকে স্বাগত সম্ভাষণ জানালো। 
--“সব রেড়ি?”
--“ইয়েস, এভরিথিং ইজ রেডি!”
সার্চলাইটের মতো চোখ জ্বেলে ঋতাভরী দেখল, মদ, মশলা, আগুন ঘি, পানপাত্র কাঁচা কলাপাতা সবই থরে থরে সাজানো আছে। কেবলমাত্র তাজা মাংসটুকুই বাকী। চাঁদটাও স্লোমোশানে পাইনগাছের আড়ালে সরে যেতে লাগল।
--“মাংস কোই? আজ হরিণ বার হয়নি বুঝি? শুধুশুধু কাঠগুলো জ্বলে যাচ্ছে যে!” 
দীপক গোঁফে মোচড় দিতে দিতে বলল,-- “জুতসই হচ্ছে না!”
ঋতাভরী এগিয়ে এসে তার গায়ের লোমশ চাদরখানা আগুনের কুণ্ডে ছুঁড়ে দিলো। এবার সম্পূর্ণ নগ্ন শরীরে কাঁচা কলাপাতার ওপর নিজেকে এলিয়ে দিয়ে কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে বলল,-- “আর দেরী ক্যান? এবার কে আগে বন্দুক বার করবি,-- ডিসাইড কর!”
অনিন্দ্য ভয়ে ভয়ে বলল, “যদি রণিত এসে যায়?--- ভাগ বসায়?”
ঋতাভরীর শুকনো শিরিশ ফলের মতো হাসিতে কেঁপে উঠল গোটা জঙ্গল!
--“এ জঙ্গলে বাইসনও আছে? সে কি পোষা, নাকি ওয়াইল্ড ? জীবিত!--- রিয়েলি?--- ভালোই তো! লড়াইতে লাগাতে পারিস কিনা আগে দ্যাখ! ওর লোমশ ছিনাটা কিন্তু আমার খুব চেনা!”
দীপক টোটার সন্ধানে জিপে টান দিতে গিয়েও একটু ইতস্তত করছিল। এবার অনিন্দ্যর চোখে চোখ রেখে বলল, “কিন্তু----!”
ঋতাভরী অস্থির হয়ে উঠল,--“তেল এনেছিস? অভ্যাস আছে? আর যদি তাও না পারিস, ত্যাঁদড় কুত্তাগুলোকে লেলিয়ে দে!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)