পারফেক্ট প্ল্যান
হোটেলের সুইমিংপুলে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা দাপাদাপি করছে। সুইমিংপুলের প্রতি বরাবরের আসক্তি কুণালের। পুলে নামলে সহজে উঠতে চায় না। মিমিদের বাড়ীর মত কুণাল ওর বাংলোতেও সুইমিংপুল বানিয়েছে। সদ্যসমাপ্ত বাংলোটা মিমিকে কুণালের বিবাহবার্ষিকীর উপহার। যদিও আজ ওদের বিবাহবার্ষিকীর দিনে মিমির থেকে অনেক দূরে মুম্বাইয়ে বসে রয়েছে কুণাল। সাড়ে ছটা বাজে, মুম্বাইয়ে সন্ধ্যে নামেনি। ওদের সোনারপুরের বাংলোয় সন্ধ্যের নরম পরিবেশে মিমি সুইমিংপুলে অজয়ের সাথে রিল্যাক্স করছে! এদিকে কুণাল অপেক্ষা করছে একটা খবরের জন্য।
এছাড়া কুণালের কোনও উপায় ছিল না। ধারে দেনায় জর্জরিত কুণালের টাকার খুব দরকার। নাহলে ওর ধুঁকতে থাকা ব্যবসাটা আর বাঁচানো যাবে না। ইনস্যুরেন্সের প্রিমিয়াম জমা করার নোটিফিকেশনটা দেখেই কুণালের মাথায় ফন্দিটা আসে। টার্ম-ইনস্যুরেন্স রয়েছে দুজনের নামেই। পলিসি চলাকালীন মৃত্যু হলে নমিনির প্রাপ্য এক কোটি টাকা। মিমি এসব বিষয়ে কোনোদিন মাথা ঘামায় না, তবে ওর বাবা মিমির নামে এই টার্ম-ইনস্যুরেন্স করানো নিয়ে ঘোরতর আপত্তি জানিয়েছিলেন। ধোপে টেকেনি। কুণালকে বিয়েও করেছিল মিমি বাবার অমতে, কুণালের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ঘটনাটাকে কেন্দ্র করে বাবার আপত্তিকে আমল দেয়নি।
সেদিন মিমি অগাধ বিশ্বাসে কুণালকে কাছে টেনে নিয়েছিল। অবশ্য রঞ্জনকেও পাশে পেয়েছিল কুণাল। রঞ্জন মিমির মামাতো দাদা, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে একসাথে পড়ত কুণালের সাথে। কুণাল দেখেছে বিপদ যখন ওর ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলে, ভরসা করার মত একজনকে পাশে ঠিক পেয়ে যায় ও। আজও যেমন মিমিকে ওর জীবন থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার সময় পাশে পেয়েছে অজয়কে।
-“তুই তো নিজেকে ছাড়া কাউকে ভালবাসিস না। ব্লাডি অপরচুনিস্ট!” রুচিরার চোখদুটোয় ঘৃণা উপচে পড়ছিল। পুরো কলেজলাইফে ক্লাস টপার রুচিরার ল্যাংবোট হয়ে পড়াশোনার ক্ষেত্রে যাবতীয় সুযোগসুবিধা ভোগ করে ফাইনাল সেমের পর রুচিরাকে ডিচ করেছিল কুণাল। কলকাতার নামী ধনী বাপের একমাত্র কন্যা মিমি তখন কুণালের প্রেমে পাগল। পুণের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে কুণাল রুচিরার প্রেমকাহিনীর ভার্বাটিম রিপোর্ট মিমির কাছে ছিল না। ডিপ্রেশনে ভুগে রুচিরা সুইসাইড করলে থানাপুলিশের চক্কর কাটতে হয়েছিল কিছুদিন কুণালকে। অত ব্রাইট কেরিয়ারের মেয়ে রুচিরা কুণালের দেওয়া ধাক্কাটা সামলাতে পারেনি। সব জানার পরে মিমির বাবা কুণালের হাতে মেয়েকে তুলে দিতে চাননি স্বাভাবিকভাবেই। রঞ্জন সেসময় কুণালকে ক্লিনচিট দিয়েছিল!
গত সাত-আট মাস ধরে আজকের দিনের প্রস্তুতি নিয়েছে কুণাল। অজয় ছেলেটা বিশ্বস্ত। অফিসের কাজে সিন্সিয়ার, অনেস্ট। মিমিকে সরিয়ে দেওয়ার প্ল্যান ছকতে বসে হ্যাণ্ডসাম, আকর্ষনীয় স্বাস্থ্যের অধিকারী অজয়ের কথাই মাথায় এল কুণালের। বুদ্ধিমান ছেলেটাকে বেশী বুঝিয়ে বলতে হয়নি। কিছুদিন পর ওর কাছে মিমি আর অজয়ের ঘনিষ্ঠতার খবর আসতে শুরু করায় নিশ্চিন্ত হয়েছিল কুণাল।
-“আমার দিকে তাকানোর সময় নেই তোমার! নিজের ব্যবসা, স্বপ্ন, উচ্চাকাঙ্খা...সব তোমার নিজের...” বিয়ের দুবছর না পেরতেই রুচিরার সুর মিমির গলাতে। কুণাল কি এতটাই আত্মমগ্ন! আসলে দুনিয়ার রীতিটা আত্মস্থ করেছে কুণাল। ইমোশনের কোনো ভ্যালু নেই আজকের সময়ে। অনেক টাকা, অঢেল সম্পত্তির অধিকারী হওয়ার স্বপ্ন ছোটবেলা থেকেই দেখছে কুণাল। টেকনিক্যাল লাইনে পড়বার জন্য বাড়ী ছেড়ে পুণে চলে যেতে দুবার ভাবেনি। সাধারণ দেখতে রুচিরার সাথে প্রেমের অভিনয় করেছে, ওর নিজের রেজাল্ট যাতে ভালো হয়। বড়লোক শ্বশুরের আনুকূল্য লাভের সম্ভাবনায় সেই সম্পর্কে দাঁড়িও টেনেছে নির্দ্বিধায়।
-“আমি বাবাকে আর বলতে পারবো না টাকার জন্য” মিমিকে খুব ভালোবেসেছিল কুণাল। আদরে সোহাগে ভরিয়ে রেখেছিল বাপ আহ্লাদী মেয়েটাকে। গোলামী করা ওর ধাতে নেই, চাকরি না করে ব্যবসা চালু করল কুণাল। মেয়ের মুখ চেয়ে ব্যবসা দাঁড় করাতে শ্বশুরমশাই অনেক টাকা ঢেলেছিলেন শুরুতে। কম্পিটিশনের বাজারে ব্যবসা মন্দা যাচ্ছে কুণালের অনেকদিন ধরেই। এদিকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেলেও আর কাজ হচ্ছে না। কুণালের জন্য টাকা খরচ করতে আর রাজি নয় মিমির বাবা। মিমির এই কথার পরে কুণালের মনে মিমিকে ঘিরে আর কোনো ইমোশন কাজ করছে না।
মোবাইল বাজছে কুণালের, স্ক্রীনে অজয়ের নাম। পারফেক্ট টাইমিং, ছেলেটা বেশ কাজের আছে। মনে মনে তারিফ করল কুণাল। সোনারপুরের বাংলোতে যখন অজয় কুণালের প্ল্যান সাক্সেসফুলি এক্সিকিউট করছে, সেসময় অনেক দূরে মুম্বাইয়ের হোটেলে রয়েছে কুণাল। অকাট্য আলিবাই, সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। ক্লায়েন্ট মিটিং ইচ্ছে করেই আজ রেখেছিল কুণাল। বিবাহবার্ষিকির মত দিনে ওকে ছেড়ে কুণালের দূরে যাওয়াটা ভালভাবে নিতে পারবে না মিমি, জানতো কুণাল। মেয়েটা ইমোশনাল, আরো আঁকড়ে ধরতে চাইবে সহমর্মীতার মোড়কে থাকা নতুন বন্ধু অজয়কে।
সুইমিংপুলের একদিকের গভীরতা বেশী রেখেছে কুণাল। সেখানেই মিমির তলিয়ে যাওয়ার খবরটা আসছে ইথার তরঙ্গ বেয়ে। সাধারণের চোখে আক্সিডেন্ট! মামলা কিছুটা থিতিয়ে গেলে ইনস্যুরেন্সের টাকাটা ক্লেম করবে কুণাল। ওর এখনকার অর্থনৈতিক ডামাডোলে এক কোটি টাকা অনেকটাই স্বস্তি এনে দেবে।
অজয়ের ফোনের রিং বেজে যেতে দিল, ধরল না কুণাল। সেরকমই কথা ছিল, দুমিনিট বাদে রিং ব্যাক করবে কুণাল।
-“বলো অজয়” কুণালের গলাতে উত্তেজনার লেশমাত্র নেই। ওর নিখুঁত প্ল্যানে কোনো ফাঁক নেই কুণাল জানে।
-“স্যার... স্যার... ম্যাডাম সুইমিং করতে করতে ডীপ জলে চলে গেছিলেন...জলে ডুবে...”
বাঃ, বেশ গুছিয়ে অভিনয় করছে তো ছেলেটা। তাল মিলিয়ে গলাতে যথাসম্ভব উত্তেজনা ফুটিয়ে তুলল কুণালও।
-“কি বলছ অজয়? লোকাল থানাতে খবর দিয়েছো? ওরা কি পোস্টমর্টেমের জন্য বডি নিয়ে গেছে?”
-“আমরা থানাতেই বসে আছি কুণালবাবু। অজয় কনফেস করেছে সবই, তবু আপনার কথাবার্তার অসঙ্গতিটাও দরকার ছিল আমাদের। যেটা আপনি এখনি করলেন। আপনার মিসেস মারা গেছে এই কথাটা না শুনেই আপনি কি করে ধরে নিলেন যে ওনার বডি পোস্টমর্টেমে পাঠাতে হবে...” ইন্সপেক্টরের বাকি কথা কানে ঢুকছিল না কুণালের। মুম্বাইয়ে সন্ধ্যের কালো আকাশ ওকে আরও কোনো এক অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল যেন।
পুলিশ স্টেশনে মিমির দিকে অপলক তাকিয়ে অজয়। অকালে ঝরে যাওয়া দিদির মুখটা আজ চোখে বারবার ভেসে আসছে। অজয়কে কাজে বহাল করার সময় ভালোকরে খোঁজ নিলে কুণাল জানতে পারতো অজয় রুচিরার কাজিন। কুণালের প্ল্যান কষার অনেক আগে থেকেই অজয় চালু করেছিল ওর পারফেক্ট প্ল্যান!
সুচিন্তিত মতামত দিন