গার্হস্থ্যের নয়া মোড়
দা
রোয়ান রফিকুল্লা কাগজটা দিয়ে গেলো।
রুম্পির মুখ নীল। থমথম। এক ঝটকা গরম রক্ত পা থেকে মাথায় ওঠে এসেছে সেকেন্ডেরও কম সময়ে। দাঁত কামড়ে হিসহিস করে বলে, মা দেখেছেন দারোয়ানের ঘরে বসে আছে আপনার ছেলে ! কেমন লাগে বলুন তো !
পঁচাশি বছরের বৃদ্ধার জল ঝরঝর চোখ। খুব স্বাভাবিক। বউমার খারাপ লাগারই কথা। নিজের ঘর থাকতে দারোয়ানের ঘরে বসা যে অশোভন ছেলেকে বুঝালেও বুঝবে না। ছেলে এখন উন্মত্ত। সম্পর্কের পাহাড় ভাঙতে একরোখা। ন্যায় অন্যায়ের দু পয়সা ধার সে এখন ধারে না, তুমি এ নিয়ে মন খারাপ করো না বউমা। যার যা অভিরুচি।
সেতো বটে! বিষিয়ে উঠে রুম্পির মন, ফ্ল্যাটের সবাই কি ভাববে তাই ভাবছি। ছেলেটা ছাদে খেলতে যায় ! কেউ যদি----
চিনির বয়ামের মুখ অসমর্থ হাতে খোলার চেষ্টা করেন খোদেজা খাতুন, সত্যিটা বলে দিও মা। তোমাকে তো টিকতে হবে। তোমার তো আর খেয়াল খুশির জীবন নয়।
কাগজটা হাতে নিয়ে গভির ভাবনায় ডুবে যায় রুম্পি। এই নিয়ে তিনবার পাঠালো লোকটা। সে সিগ্নেচার করেনি। কিন্তু সিগ্নেচার করার ইচ্ছাটা চরম হয়ে উঠছে দিনকে দিন। সহ্য করা যাচ্ছে না আর। বেডরুমের টেবিলে লোকটার ফেলে যাওয়া বইগুলোর উপর কাগজটা রেখে ভাবতে বসে রুমকি, ভাঙ্গনটা ঠিক কোন পথ ধরে এলো ? মানুষটা ত এরকম ছিল না। তবে!
চা খাও বউমা।
শাশুড়িমার শীর্ণ হাত। অসংখ্য রগ উঁচু মুখ করে অজস্র আঁকিবুঁকিতে জেগে আছে। লজ্জা পায়, আমি করে নিতাম মা !
বউমার পাশে এসে বসেন তিনি। বয়সে ভারানত। প্রতিটি হাড় মাঝে মাঝে কটকট করে ওঠে। মনে হয় সমস্ত শরীরটা বুঝি হাড়েই তৈরি । তাতে কোনো মাংস নেই, তল নেই, গর্ভপুকুর নেই, নেই কোনো দুধ সাগর।
শুকনো শিকড়ের মত নেমে আসা স্তনে সঙ্গগোপনে ডান হাতটা রেখে কি যেন খুঁজে ফেরেন। হয়ত শেষ কবে তার ছোট সন্তানটি স্তনের দুধ খেয়েছিল চাঁদমুখ করে তাই মনে করার চেষ্টা করতে করতে তিনি আচমকা কেঁপে ওঠেন। এত বড় সংসার, এতগুলো শিশু, এত এত রান্না শেষে শরীর কি তিনি কি জানতেন কখনো কোনোদিন ? ঘুমের অতলে যেতে না যেতে স্বামী ঝাঁপিয়ে পড়তেন শরীরিক্রিয়ায়। কি সব দিনরাত কেটেছে । জন্তুর মত। তিনি না বলতে পারেন নি। ইচ্ছে হয়েছে। কতবার। বিদ্রোহ জমেছে। ফেটে পড়েছে মন। কতবার ভেবেছেন , লোকটা মরে না কেনো ! অমানুষ। অমানুষ।
রুম্পি কথা ভাঙে , সিগ্নেচারটা করেই দিই মা। ও বাঁচুক।
তুমি ? তোমার ছেলেমেয়ে ? খোদেজা খাতুন চির অভ্যাসে শশকের মত ভয় পান, তোমরা একা বাঁচতে পারবে? ভেবে দেখেছ ত ?
কিন্তু মা আপনার ছেলে তো অস্থির হয়ে ওঠেছে। তিনবার ডিভোর্সের কাগজ পাঠানো মানে তিন তালাকের সমান। জোর করে কি কাউকে আটকে রাখা যায় !
একবারের জন্যেও চায়ে মুখ দেয়নি রুম্পি। হাতের মুঠো উষ্ণ করে সাহস নিচ্ছে সে পাথরের কাপ থেকে। দ্বিতীয়বার কাগজ পাঠালে ছেলেমেয়েদের সাথে কথা বলে নিয়েছিল রুম্পি। সামাজিক, আর্থিক, আত্মীয়বন্ধুদের প্রতিক্রিয়া সহ্য করতে পারবে কিনা খোলাখুলি জানতে চেয়েছিল। মেয়ে বলেছিল, ঝামেলামুক্ত হও তো মা। আর ভাল্লাগে না। ছেলে ব্যাট ঘুরিয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল, স্ক্রাউন্ডেল ফাদার। ডিলিট হিম, মাম।
পুরনো সোফায় বসা খোদেজা খাতুনের ঠোঁট থরথর করে। শরীরের কোথাও পেট নামের একটা গর্ত আঁতকে ওঠে, খাবে কি তোরা? পড়াশুনা, জামাকাপড়, ফ্ল্যাটভাড়া! বাপের পরিচয় সে না হয় কম পড়লে ক্ষতি নেই। কিন্তু এগুলো?
ঠান্ডা হয়ে আসা চা খেয়ে নেয় রুম্পি, মা আপনি যদি আমাদের সাথে থাকেন ত আমি শক্তি পাই মা। থাকবেন তো ? আমি না হয় আর কেউ থাকবো না আপনার। কিন্তু অতুল অরণি ত আপনার নাতি! চোখ ফেটে পানি আসে , এই বৃদ্ধ বয়সে তার ওষুধের খরচ ত কম নয়। পারবে এই একলা হয়ে যাওয়া সামান্য চাকুরে বউমাটি? কিম্বা তার অন্য ছেলেমেয়েরা কি তাকে এখানে আর থাকতে দেবে বিচ্ছিন্ন সম্পর্কের অসন্মানিত পরিবেশের আঁচড়ে?
বুক থেকে বেরিয়ে আসে এক উদ্বেল দীর্ঘশ্বাস। অন্য ছেলেবউদের চেয়ে এই মেয়েটা বোকা। চালাকি শেখেনি। সবাইকে আপন করে নিয়ে এক মায়ার সংসার বেঁধে নিয়েছিল আপনালোয়। কেউ খারাপ বলেনি কখনো। কোন কিছু না ভেবেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে অন্যের বিপদে। আজ মেয়েটা হেনস্থা হচ্ছে তার নিজের ছেলের কাছেই। পারিবারিক মিটিঙে ছেলে সরাসরি বলেই দিয়েছে , ও ভয় পায় রুম্পিকে। এরকম বউ নিয়ে সে কি করবে? তার চাই ঘরে বসা আলুথালু একজন নারী। যে তাকে ভয় পাবে। তার কথাকে ঈশ্বরের আদেশ বলে মেনে নেবে। রুম্পি তো স্বামী হিসেবে পাত্তাই দেয় না। তার কোনো কথা কাজেই লাগে না সে এ সংসারের। ঘরে বাইরে আপনারাও সবাই রুম্পি রুম্পি করে পাগল।
বড় মেজ ছেলে বুঝিয়েছিল, ওরে ছাগল তোর ত গর্ব হওয়ার কথা। কিন্তু তার ছেলে বোঝেনি। বুঝতে চায়নি।
স্তব্ধ হয়ে গেছিল সবাই। সে মিটিঙ্এ রুম্পি ছিলো না। থাকলে হয়ত অনেক আগেই সিগ্নেচার করে দিতো। ছেলের কুৎসিত মনের চেহারা দেখে স্তম্ভিত হয়ে উনি জানতে চেয়েছিলেন, তোর ছেলেমেয়ের কি হবে ? অম্লান মুখে বলেছিল তার ছেলে, কেনো ওর মা দেখবে। আমি ত ফালতু বাপ।
একটা সপাট চড়ের স্মৃতিতে মাথা ঘুরে ওঠে তার। চল্লিশ বছরের পুরনো চড়। পুরনো সেই রাতে শ্রান্তিতে সামান্য অনুনয় বেজেছিল তার গলায়, ভাল্লাগছে না। আজ না হয় বাদ দাও। চড়ের পরেও কি থেমেছিল তার স্বামী নামের লোকটা? নারীর কি দেওয়ার শেষ আছে! সংসারে মায়া দাও, সন্তানকে স্তন দাও, স্বামীকে দেহ দাও।
সিগ্নেচার করে দেয় রুম্পি। সময় নিয়ে এনভেলাপে ভরে কাগজটা। ইন্টারকমে দারোয়ানকে আসতে বলে টলটলে চোখে তাকায়, মা কিছু খাবার পাঠিয়ে দিই? এতক্ষণ ত না খেয়ে থাকার অভ্যেস নেই আপনার ছেলের!
---------------------------------------
লেখক পরিচিতি-রুখসানা কাজল সহযোগী অধ্যাপক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তনী। সচেতনভাবে লেখালেখি থেকে দূরে ছিলাম। পারবারিক পরিবেশের লেখালেখির আবহ বিরক্ত লাগত। কিন্তু বই পড়তে এবং কিনতে প্রচুর আগ্রহ ছিল বরাবর। এমনকি চাঁদা তুলেও বই কিনেছি। রাজনীতি সম্পর্কিত , সাহিত্য সমৃদ্ধ লেখা খুব ভাল লাগে। লেখালেখির অঙ্গনে আমি শিশু। সাহিত্যের ধুলো মাখছি বেহিসেবি আনন্দে । শব্দ নিয়ে খেলতে খুব ভাল লাগে। নিজের লেখা অখাদ্য হিসেবে পুড়িয়ে দিতে মন চায়। তবে লিখছি যখন তখন একদিন খুব ভাল লিখে ফেলব এই প্রত্যাশায় লিখে যাচ্ছি ।
প্রকাশিত বইঃ দুটি ছোট উপন্যাস আর দুটি ছোটগল্পের বই।
লেখক পরিচিতি-রুখসানা কাজল সহযোগী অধ্যাপক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তনী। সচেতনভাবে লেখালেখি থেকে দূরে ছিলাম। পারবারিক পরিবেশের লেখালেখির আবহ বিরক্ত লাগত। কিন্তু বই পড়তে এবং কিনতে প্রচুর আগ্রহ ছিল বরাবর। এমনকি চাঁদা তুলেও বই কিনেছি। রাজনীতি সম্পর্কিত , সাহিত্য সমৃদ্ধ লেখা খুব ভাল লাগে। লেখালেখির অঙ্গনে আমি শিশু। সাহিত্যের ধুলো মাখছি বেহিসেবি আনন্দে । শব্দ নিয়ে খেলতে খুব ভাল লাগে। নিজের লেখা অখাদ্য হিসেবে পুড়িয়ে দিতে মন চায়। তবে লিখছি যখন তখন একদিন খুব ভাল লিখে ফেলব এই প্রত্যাশায় লিখে যাচ্ছি ।
প্রকাশিত বইঃ দুটি ছোট উপন্যাস আর দুটি ছোটগল্পের বই।
সুচিন্তিত মতামত দিন