জয়তী রায় - মায়াজম

Breaking

২০ জানু, ২০১৮

জয়তী রায়

                                 শীতের চিঠি
                                 --------------------


রুহি
কলকাতায় জাঁকিয়ে পড়েছে শীত।
শীত আমার প্রিয় ঋতু। তোর ভয়ের।
ঠান্ডা হাওয়া শহরে ঢুকলেই, চাদরে সোয়েটারের দুর্গে ঢুকে নিজেকে আড়াল করতি আপ্রাণ।
মনে আছে? কলেজ থেকে ভর দুপুরে চলে যেতাম দুজনে বই মেলায়। উত্তুরে হাওয়ায় তোর গাল লাল, নাক জলে ভরা, ঘুরে ঘুরে বই কিনে, ঝাল মুড়ি আর চা নিয়ে বসতাম এক কোনে, তোর তখন বেড়ালের মত গুটি সুটি মারা অবস্থা। পারলে আমার কোলের মধ্যে ঢুকে যাস।
রুহি, বেশ বিরক্তি বোধ হত। শীতের মত অমন রোমান্টিক ঋতু। আহা। প্রেমের একেবারে আদর্শ সময়ে তোর ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ , খক খক--ধুর। মন খারাপ হয়ে যেত ।
উত্তর কলকাতার বনেদী বাড়ির অহংকারী ছেলেটা তবু তোকেই ভালোবেসে ফেললাম রে। দুজনেই ফিজিক্স অনার্স। দুজনেই কবিতা ভালোবাসি, এই সব তথ্য আদান প্রদানের থেকেও ভালো লেগেছিল,তোর শান্ত দীঘির মত চোখ আর মায়াময় হৃদয়। সেই বিকেলের কথা খুব মনে পড়ে।
অল্প ভাষী , দুর্বল শরীরের তুই হঠাৎ আমার কাছে এসে বলেছিলি--
“ কি হয়েছে তোর রাহুল?"
শীতের বিকেল। অন্ধকার নামছে একটু একটু করে। কমলা সাদা বুটির শাল, সোয়েটার, মোজা পরা জুবুথুবু তুই কি করে বুঝলি , মানি ব্যাগ হারিয়েছে আমার? সেদিন জোর করে তোর বাড়ি নিয়ে গেলি। অনেক আড্ডা ,হৈ হৈ এর পরে তোদের গাড়ি আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিলো। কাকিমা স্নেহের সুরে আমাকে বললেন
--”রাহুল। নিজের বাড়ি মনে করে এসো। “
বুকের গভীরে নাড়া দিয়েছিল তোর ওই আশ্চর্য বোধ। ভালো লাগলো।
তারপর থেকে একটু একটু করে কাছে এসেছি দুজনে। আমাদের দুটো বাড়িতেই দুজনে যেতাম সময় থাকলে। জেনেছি , ঠান্ডা থেকে তোর ভয় আছে। শীত তোর কাছে ভয়ঙ্কর। প্রেম করতাম দুজনে ঠিক। কিন্তু তোর ওই শীত শীত বাতিক ভালো লাগতো না । চট করে শাল টেনে নিতাম। ঝট করে চুল খুলে দিতাম তোর। আসলে আমি চাইতাম , অন্য মেয়েগুলোর মত পাখা মেলে উড়বি তুই। তা নয়, কেবল ঢাকা ঢুকি দিয়ে বুড়িদের মত কলেজে আসবি, ধীরে ধীরে কথা বলবি । ধুর।
কলেজের শেষ বছরে ডিপার্টমেন্ট থেকে প্ল্যান হলো সকলে মিলে মুকুটমনিপুর যাওয়া হবে। ক্লাসের সমবেত হৈ হৈ এর মাঝে আমি আড় চোখে তোর ফ্যাকাশে মুখ দেখে বেশ মজা পেলাম। যেতে ষোলো আনা ইচ্ছে, এদিকে ডিসেম্বরের ঠান্ডা। তুই কাতর মুখে আমাকে বললি
“ কি হবে রে রাহুল? আমি কি করে যাবো? “
--” যাবি না। সিম্পল। এত যখন ভয় তোর।”
---” এমন বলতে পারলি? আমি না গেলে তুই যাবি? তোর খারাপ লাগবে না?”
---” এই ঠান্ডা বাতিক থেকে সরে আয় তুই। পায়ে মোজা, গলায় মাফলার! কলকাতা কি সুইজারল্যান্ড?"
---”রাহুল । আমার ভীষণ শীত করে। বিশ্বাস কর। আমি যাবো না রে। তুইও যাস না।”
ভীষণ চেঁচিয়ে আমি বললাম
আমি তো যাবোই। তুই যাস বা না যাস।”
রুহি
আমি না হয় ভুল করেছিলাম। আমি না হয় তোকে বুঝতে পারিনি। তুই কেন ওমন বোকার মত রাজি হয়ে গেলি মুকুটমণিপুর যেতে ? তুই কেন গেলি ? না গেলে আজ জীবন কত অন্যরকম হত।
এমন করে তীব্র পাপ বোধের চিতার আগুনে রোজ পুড়ে যেত না আমার মমিতে শুয়ে থাকা ঠান্ডা শরীর।
সেদিন আকাশ জুড়ে মস্ত বড় পূর্ণিমার চাঁদ বন বাংলোর সামনের ঘাস জমিতে অলৌকিক জাফরী তৈরি করেছে। আমরা সবাই কাঠের বারান্দায় বসে উপভোগ করছি, পাতা খসার টুপ টাপ শব্দ, শিশির হিমে ভেজা বাতাস, সামনে আদিগন্ত শাল বন , অন্ধকার আর শীত মিলে ধীরে ধীরে নামছে মোহময় রাত।। চূড়ান্ত উপভোগের মাঝে শুধু তুই কেমন ভীত খরগোশের মত ঘরের দরজার সামনে চুপ করে বসে। হঠাৎ আমার মাথায় চাপলো দুষ্টু বুদ্ধি। এক টানে তোর হাত ধরে বারান্দা থেকে নেমে পড়লাম নীচের ভেজা ঘাসে। কাতর গলায় চেঁচাতে গিয়েও থমকে গেলি। তোর মুগ্ধ চোখের তারায় ফুটে উঠলো অগাধ বিস্ময়। রোগা ভোগা ছোট্ট পাখির মত তোর শরীরে হাজার সাবধান বাণীর কবচ ঝোলে, সেখানে হঠাৎ এত পরিষ্কার আকাশ, এমন কাছে ঝুলে থাকা চাঁদ , এমন আদিম বনানী- --আপনা থেকেই দুটো শরীর ঘন হয়ে এলো কাছে। অরণ্য আঁধার , প্রাচীর হয়ে তুলে দিল আড়াল, দু জোড়া শীতার্ত ঠোঁট উষ্ণতা খুঁজে নিলো আপন আনন্দে বিভোর হয়ে।
রুহি রে,
মানুষ জীবন নিতে পারে কিন্তু জীবন রক্ষা করতে পারে না। মৃত্যুর কাছে বিজ্ঞান কত অসহায়, দেখতে পেলাম তোর বিছানায় শুয়ে থাকার সময়।
ডাক্তার ,ওষুধ, ,অর্থ বৃষ্টির মত ঝরে পড়তে থাকতো নামী নার্সিংহোমের কেবিনে। তুই কেবল হলুদ পাতার মত শীর্ণ হতে হতে ম্লান হতে থাকলি।
ডাক্তার কাকুর তীব্র তিরস্কারের উত্তরে কাকিমা বললেন --” আমি বারণ করেছিলাম। ও শোনে নি।
আর আপনিও বলেছিলেন, যাবে যাক। কিন্তু ঠান্ডা যেন না লাগে। রাহুল তো ছিল সঙ্গে। নিশ্চিন্ত ছিলাম তাই।”
আচ্ছা রুহি! আমি যে হত্যাকারী একজন, আমার শাস্তি হবে না? দ্যাখ কেমন উত্তুরে হাওয়া দিচ্ছে, খুব ঠান্ডা পড়েছে আজ। লেপের তলায় ঘুমোচ্ছে সারা কলকাতা। শুধু শীত করছে না আমার। কেমন ভূতের মত দাঁড়িয়ে আছি ছাদে। ছাদ না কাঠগড়া?
“ ধর্মাবতার , আমাকে কেন বলা হয় নি, রুহির ফুসফুসে ফুটো আছে ? কি করে জানবো যে এমন ব্লাড গ্রুপ ওর, যা পাওয়া যায়না? কি করে জানবো যে, ওর শরীরে এমন একটা কিছু নেই যার ফলে অপারেশন হলে , ফিরে আসার চান্স খুব কম?
আমাকে বলা হয়েছিল --”
“ রাহুল। তোমার ভরসায় ওকে ছাড়লাম। দেখো, যেন ঠান্ডা না লাগে !” এই এক লাইন কি যথেষ্ট ছিল? বলুন ধর্মাবতার?
*
কত শীত পেরিয়ে এলাম । সেদিন ছিলাম কুড়ি। আজ বাহান্ন। বেঁচে থাকলে আজ তোকে আর ঠান্ডা লাগাতে দিতাম না রে সোনা। দু হাতে আগলে রেখে দিতাম। ওম দিতাম ভালোবাসার। তুই আমার সন্তানের মা হলেও তোকেই বেশি যত্ন করতাম। রুহি রে রুহি। প্রতিটি শীত আমাকে কাঙাল করে তোলে, প্রতিটি শীত আমাকে নতুন করে ভালোবাসতে শেখায়। হত্যাকারীর প্রায়শ্চিত্ত সেখানেই যখন সে নতুন জীবন দান করে। দরিদ্র শিশুদের মধ্যে হার্টে ছিদ্র নিয়ে যারা জন্মায় , চিকিৎসার খরচ তাদের কাছে দু স্বপ্নের মত। অর্থ তো অনেক আছে আমার। কেবল তুই থাকলি না। তাই এদের সঙ্গে আমি থাকি। এদের মুখে হাসি ফুটলে কিছুক্ষনের জন্য হলেও নিজের ঘাতক রূপ ভুলে থাকি ।
রুহি
খুব বেশিদিন নয় আর। পথের যে বাঁকে তুই দাঁড়িয়ে আছিস, কোনো এক শীতের সন্ধ্যায় আসবো সেখানে। ভয় নেই। তোর কমলা সাদা বুটির শাল খুলে নেব না কিছুতেই। কথা দিলাম।





                                                                                                           


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র