সরিৎ চট্টোপাধ্যায়

মায়াজম
1
                          মুসাফি

 

সৈকত ওর আই-এম-আই গ্যালিলের টেলিস্কোপিক সাইটে একটা মাথা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল। ফরসা, গালে সদ্য গজানো দাড়ি। বয়েস কত আর হবে, বড়জোর উনিশ। এই তিনশো মিটার দূরত্ব থেকে অন্ধকারেও লক্ষ্যভেদ করা ওর কাছে হাটতলা বাজারে আধপচা গেঁড়ি গুগলি কেনার থেকেও সহজ।

পুরুলিয়ার বাগমুন্ডির ছেলে সৈকত। অযোধ্যা পাহাড়ে শেষবার বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে গেছিল, সেই যেবার বিজেপি জিতে সরকার গড়ল। তারপর এই ফৌজের চাকরিতে আজ তিনবছর হয়ে গেল। নাইনথ্ বিহার রেজিমেন্টের সদস্য হিসেবে কাশ্মির সেক্টরে এসেছে মোট ছ'মাস। শার্পশুটার হিসেবে বেশ নাম করেছে এই ক'দিনেই।
আশফাক হামির অনন্তনাগের ছেলে। বাবা পেহলগাঁওতে অমরনাথ যাত্রীদের জন্য ছড়িদারের কাজ করে। এগারো ক্লাস অবধি পড়েছিল আসফাক, তারপর ইস্কুলটাই জ্বালিয়ে দিল উগ্রপন্থীরা। 
ষোড়শী রাকেয়াকে ভালোবাসত আশফাক। কিন্তু হাসপাতালে ওর পেলেট গান-এর ছররার আঘাতে বীভৎস মুখটা দেখে পালিয়ে এসেছিল ও। পালিয়ে এসেছিল এক অদম্য রাগ নিয়ে। চারমাস পর বর্ডার পেরিয়ে ওপারে যায়, শুরু হয় ট্রেনিং।

এখন, বুরহান ওয়ানির ফ্যান ও। বিশেষ করে গতবছর কোকরনাগে বুরহানের শহিদ হওয়ার ভিডিওটা দেখার পর আক্রোশে ফেটে পড়েছিল ও। ইনডকট্রিনেশানের পর মেজর কুরেশি বলেছিল, ঠন্ড্ রখ্ পুত্তর, মৌকা মিলেগা! খুদা কসম, জল্দ্ হি মিলেগা!
হ্যাঁ, খিলাফত কায়েম করতেই চায় সে আজ।

অন্ধকার। সমুদ্রতট থেকে প্রায় ন'হাজার ফুট উঁচুতে, দূরে ওই ফিদাইনদের তাঁবু। ক্ষীণ কেরোসিন লম্ফের কাঁপা কাঁপা আলো। ক্যাপ্টেন সতীশ কুমারের নিশ্বাসের শব্দ কানে আসছিল সৈকতের। ওর বউটা অসুস্থ, বেশ কিছুদিন হলো জ্বর ছাড়ছে না।

লাইন অফ কন্ট্রোল পার হয়ে ওরা চাকোঠি আর পাট্টান গ্রামের মাঝখান দিয়ে যাবে। রাত তিনটেয় শুরু করবে ওরা। দেড়ঘন্টার পথ। এখন রাত এগারোটা। পি-ও-কে'র এই ক্যাম্পটা ওদের শেষ নিরাপদ আস্তানা। ওরা ছ'জন। অলস হাতে রেডিওটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল মীর। মীর আইএএস হতে চাইত। আজকাল বিশেষ কথা বলে না, শুধু ওর চোখগুলো ধিকিধিকি জ্বলে। আর একমনে গান শোনে, পুরনো দিনের গান।

চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ বিগ এফএম শ্রীনগর শুনতে পেল ওরা। আর জে তৌসিফ তখন শ্রীনগরের লেক সিটি প্লাজার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরের ভেতর থেকে বলছে, অব দোস্তোঁ, দিল থামকে বৈঠিয়ে! পেশ-এ-খিদমত হ্যায় উন্নিসসো চৌঅন কি বেমিসাল ফিল্ম, 'ট্যাক্সি ড্রাইভার' সে ইয়ে বে-ইন্তহাঁ হসিন নগমা। সংগীতকার, এস ডি বর্মন; আলেখ, সাহির লুধিয়ানভি ...
অন্ধকার ভেদ করে প্রয়াত শিল্পীর গলায় গানটা এতদূরেও ভেসে আসছিল ...
জায়েঁ তো জায়েঁ কহাঁ
সমঝেগা, কৌন ইহাঁ
দর্দ ভরে, দিল কি জুবাঁ
জায়েঁ তো জায়েঁ কহাঁ ....

আশফাক রেডিওটার আরও একটু কাছে সরে এল। না, রাকেয়াকে বলা হয়নি। বলা হয়নি অনেককিছুই। ওদিকে লণ্ঠনের আলোয় মীর নিজের হাঁটুদুটো জড়িয়ে বসে তন্ময় হয়ে শুনে চলেছে ...
উনকা ভি গম্ হ্যায়, অপনা ভি গম্ হ্যায়
অব দিল কে বচনে কি, উম্মিদ কম হ্যায়
এক কস্তি, স' তুফান
জায়েঁ তো জায়েঁ কহাঁ ....

দাঁতে দাঁত চেপে ক্যাপ্টেন সতীশ বলে উঠল, নাও! ফায়ার!
ছ'টা রাইফেল একসঙ্গে গর্জে উঠল, নির্ভুল লক্ষ্যে। যখন ওরা ক্যাম্পে ঢুকল তখনও একজন জীবিত। আশফাক। রক্তাক্ত হাতে রাইফেলটা তোলার ওর অক্ষম চেষ্টা সৈকতের এক গুলিতেই শেষ হয়ে গেল।

মৃতদেহের মাথাটা চুলের মুঠি ধরে টেনে কোমর থেকে ছুরিটা বের করল সতীশ কুমার। আশফাকের মুখের ওপর একদলা থুতু ফেলে বলল, সালে মুসল্লি! তুম সালে কুত্তে ইয়হি ভাষা সমঝোগে!
সৈকত আর থাকতে না পেরে ওর ছুরিশুদ্ধু হাতটা চেপে ধরল। বলল, জানে দিজিয়ে স্যর! কুছ তো ফরক হোনা চাহিয়ে উন মে ঔর হম মে!

ওরা ফিরছিল। এগারো কিলোমিটার পথ নিঃশব্দে পেরিয়ে আসছিল ওরা, ফিরছিল সেই ভূক্ষণ্ডে, যেটাকে ওরা দেশ বলে জানে। 
অথচ, ওদের কানের ভেতর সেই গানের রেশ বোধহয় তখনও থামেনি। সতীশ দৌড়তে দৌড়তেই সৈকতকে জিজ্ঞাসা করল, আওয়াজ বড়া জানা পহচানা সা লগ রহা থা ইয়ার। কৌন থা? হেমন্ত্ কুমার?

এই প্রথম মানুষের প্রাণ নিজের হাতে নেওয়া! এখনও শরীরটা কেমন যেন আনচান করছিল সৈকতের। সতীশের আকস্মিক প্রশ্নে তাই একটু সময় নিল ও উত্তরটা দিতে।
তারপর বলল, থা এক মুসলমান স্যর। নাম থা, তলত মেহমুদ।

চমকে ওর দিকে তাকাল সতীশ। অন্ধকারেও যেন দেখতে পেল, ক্যামোফ্লেজ উর্দির বুকের ওপর সেলাই করে নাম লেখা, সৈকত আখতারুজ্জামান সরকার। 
থমকে গেল সতীশ। কোনরকমে শুধু ও বলল, স্যরি দোস্ত। ভুল হো গয়া, মাফ কর দেনা ইয়ার!

আবার ওরা দৌড়চ্ছে। পাশাপাশি। 
আর ভোরের সূর্যের পূর্বরাগ তখন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে জন্নত-এ-হিন্দের বুকে।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

  1. পরিবেশনে স্মার্টনেস আছে। গল্পটি অত্যন্ত সাদামাটা।

    উত্তরমুছুন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন