সহেলী রায় - মায়াজম

Breaking

২০ জানু, ২০১৮

সহেলী রায়

                  মহাশূন্যে, মহাকাশে




মি উইলিয়ামের আড়বাঁশি হতে চাই। উইলির ওষ্ঠদেশ আমায় ছুঁয়ে ওর নাভি থেকে উঠে আসা সমস্ত নিশ্বাস ভরে দেবে আমার মধ্যে। আমি বিদেশী সুরে দুলে উঠব ওর শরীর বেয়ে। আমার দেশের বাদ্যযন্ত্র, সাগরপারের সুর। মিলে সুর মেরা তুমহারা। এসব আমি ভাবতেই পারি। আমি এখন দুই বেণী, দ্বাদশ শ্রেণী। ঠিক ধরেছ, জয় গোঁসাই আমার প্রিয় কবি। 

দিবিয়া, কি করচিস র‍্যা? 

উফ সুনীল! ওকে দেখলেই আমার গা গুলোয়। আমার নামটাও ঠিকঠাক উচ্চারণ করতে পারে না। আমার সামনে এলেই ব্যাঁকা কার্তিক হয়ে পোজ মারে। 

তোর কি? যা করছি, করছি। আমার নাম দিব্যা।

দুটো লিখাপড়্যা শিখ্যা কি দিমাক রে বাবা। দিবিয়া ভারতী তুই। তুর বাপ তুকে লায়িকা বানাবে বলে নাম রাখছে। 
অনেকেই বলে এই কথা। আমার বাপ নাকি দিব্যা ভারতী না কোন নায়িকার সিনেমা দেখে আমার নাম রেখেছে। বেশ করেছে। আমি দিব্যা ভারতী না হই, দিব্যা মুর্মু বটে। আমার বাপ আমায় লিখাপড়া শিখাইছে। আমি মাধ্যমিকে জিলায় প্রথম হয়েছি। প্রথম তফসিলী উপজাতি মেয়ে। আমায় টিভিতে দিখাইছে। আমি তোদের মত হো, মুন্ডা, বাংলা মিশিয়ে কথা বলি না। আমি অলচিকিতে লিখিনা। রবি ঠাকুর, জয় ঠাকুরের পুজো করি। আমার মারাংবুরু ওরা। তুরা হিংসে করিস। 
তুই ইখান থেকে যাবি নাকি বাপকে ডাকি
আজকাল আমি উইলিয়ামের কথা ভাবার সময় ছেদ পড়লেই কালনাগিনীর মত হিস হিস করি। খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার আমার জগত নয়। আমার মাথার প্রতিটি কোষ অনেক দূর ডানা মেলেছে। শাখা-প্রশাখা নিয়ে ছড়িয়ে গেছি পৃথিবীর সাত ভাগ জল আর তিন ভাগ স্থলে। আমার ভাবনার তল আমার বাপও খুঁজে পায় না। মা মরা তিন ভাইবোনের মধ্যে আমিই বড়। বাপ গ্রামের মিশনারী স্কুলের পিওন। আমরা ওখানেই পড়ি। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে বাপ শুধু আমাদের মন ভরে দেখে। গ্রামের মধ্যে আমাদের বাড়িটুকু অন্যরকম আলোয় ঘেরা। বাপ আমায় দেখে শুধু, জেলার মুখ উজ্জ্বল করা, আমি। 
আর ইউ ম্যাড? মিউজিক ইস মাই প্যাশন। মিউজিক কান্ট প্রোভাইড মি ব্রেড এন বাটার বাট ইট স্যাটিফাইস মাই মাইন্ড। 
আজকাল স্কুল ছুটির পরেও উইলিয়ামের সাথে বসে থাকি। জানতে চেয়েছিলাম হে সুরপ্রেমিক, কেন তুমি শুধু সুর বাজাও না? আমার মিশনারী স্কুলে প্রচুর বিদেশী অনুমোদন আসে। বিদেশীরা আসেন দেখতে তাঁদের অনুদান ঠিকঠাক ব্যবহার হচ্ছে কি না। উইলিয়াম কেলি তাঁদেরই দলের। এর আগে আমি শুধু হাভাতের মত গিলেছি ওদের চেহারা পোশাকের বাহ্যিক রূপ। এবছর কেলি যেদিন প্রথম এল, আমার সদ্য পড়া গ্রীক মাইথোলজির বর্ণিত গ্রীক পুরুষকে দেখলাম যেন। মনে হল স্বয়ং যীশু দাঁড়িয়ে আছেন, ভগবান কৃষ্ণ বা হজরত মহম্মদও হতে পারেন। হতে পারেন আমার অদেখা মারাংবুরুর গৈরিক সংস্করণ। মাধ্যমিকে প্রথম হবার সুবাদে আমায় নিয়ে স্কুলে এখন মাতামাতি। উইলি আলাদা করে কথা বলে আমার সাথে, আমি কি হতে চাই, জানতে চায়। উইলি আমার দিক নির্ধারণ করে দেয়। আমায় শপথ করায় যেন আমি ওর দেখানো পথেই চলি। আমার সাফল্যই নাকি ওর স্বপ্ন। উইলির ছায়ামানুষ হয়ে যাই ওর অজান্তে। অবশ্য আমার কিছু যায় আসে না। আমি একদিন অযোধ্যা পাহাড় ডিঙোবো, আমিই ত সেই মেয়ে যে সমস্ত ট্রাইবাল মিথ ভেঙে সাত সমুদ্র পার হব, জ্ঞান বিজ্ঞানের মুকুট পরে দাঁড়াব উইলির পাশে। চেঁচিয়ে বলব আমি, ‘দিব্যা মুর্মু’। 
দিব্যা একবার আসবেক ঘরে? 
বাপও আমার সাথে সম্ভ্রমের সুরে কথা বলে, আমি বাপই বলি, ‘বাবা’ ডাকে পর লাগে।
বলো 
আজ আমার ঢের খুশির দিন বটে। 
আমি চমকে উঠলাম। আজ একবার প্রিন্সিপাল রুমে সিস্টার নির্মলা, উইলি আর বাপকে দেখেছি বন্ধ দরজার পেছনে। তবে কি উইলি আমায় তার দেশে নিয়ে যেতে চায়? হে মারাংবুরু, আমার ভাবনা সত্যি কর। 
কি হল? বল?
পুরুলিয়া কলেজের অধ্যাপক দীনবন্ধু কিস্কুবাবু তাঁর ছেলার জন্য বিয়ার প্রস্তাব এনেছেন। ছেলাও তফসিলী কোটায় সরকারি চাকরি করেন। উনারা তুমায় পড়াবেকও। সিস্টার আর উইলিয়াম সাহেবও খুব খুশি। সাহেব আরও কিছুদিন থাকবেক শুধু তুমার বিয়া দেখবেক বলি। আমাদের বিয়া লিয়ে কি যেন তথ্য বানিয়ে ছাড়বেক ইন্টারনেটে। তুমার বিয়া সারা পৃথিবী দেখবেক দিব্যা। 
বাপ খুশিতে এলিয়ে পড়ছে। শুনতে পেলাম সুনীল হাসছে খ্যাঁক খ্যাঁক করে। আমার ভীষণ গা গুলোচ্ছে। উইলির স্বপ্ন দিব্যা মুর্মুর কাঁধে বন্দুক রেখে সত্যিকারের ঈশ্বর হওয়া। বাপ শুধু আমার পড়াশোনার ইচ্ছেটুকুতেই আগুন দিয়েছিল। এছাড়া আর কোন দয়া নেই তাঁর। মিশনারীতে ফ্রিতেই পড়েছি আমি। আমার অধ্যবসায়ের দায়ভার শুধু আমার। কাউকে দেব না ভাগ। আমি, আমি, আমি। আজ সবাই মিলে তছনছ করে দিচ্ছে আমিকে। উইলিয়াম ইশ্বর হতে চায়, সিস্টার জেলায় প্রথম হয়ে আরও অনুদান পেতে চায়, বাপ চায় হাড় জুড়োতে। দিব্যা মুর্মুর কি হবে? কোটা? কোটায় বেঁধে ফেলবে জীবন। 
ওয়ানা গো উইথ মি অ্যাট মাই প্লেস?
বিধ্বস্ত আমাকে ঘিরেছে সিস্টার, উইলি, সনাতন- আমার বাপ। ভোরবেলা পালাতে গিয়ে ধরা পড়েছি স্টেশন মাস্টারের হাতে। বাপ কেঁদেই চলেছে অবিরাম। উইলি বহুবার জানতে চেয়েছে কেন এমন করলাম? উত্তর দিইনি। তাকিয়ে আছি একদৃষ্টে। আমার মিথ্যে ঈশ্বরকে দেখছি মন ভরে। একি প্রশ্ন করলে আমায় ঈশ্বর? বুঝতে পেরেছ আমি কি চাই? দেরিতে হলেও বুঝেছ তো? আমার চোখের আগুন নেমে আসছে গাল বেয়ে চিবুকে। 
নো, আমি তোমার সাথে যেতে চাই না। আমার লাইফের ডিসিশন শুধু আমি নেব। 
বাপ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে, যেন কিছুই বোঝেনি।। উইলি এই প্রথম মাথা নীচু করল। হয়ত ভগবান সাজার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার। সিস্টারের দুই ভুরুর মাঝে ডজনখানেক জিজ্ঞাসা চিহ্ন। 
সুনীল আজ ছোটবেলার মত মারাংবুরুর পুজো খেলবি। অযোধ্যা পাহাড়ে উঠব আমি, দেখতো খুঁজে পাস কিনা? সুনীলের মত ঘাড় উঁচু করে খুঁজছে ট্রাইবাল কোটা, মিলিয়ে যাচ্ছি মহাকাশে। 


                                                                            -সমাপ্ত-


লেখক পরিচিতি-
আমি সহেলী রায়, দুর্গাপুরনিবাসী, একটি বেসরকারি স্কুলে কর্মরতা। কবিতার হাত ধরে প্রথম সাহিত্যজগতে এলেও এখন মুক্তগদ্য, অণুগল্প, বড়্গল্পেই বেশি স্বচ্ছল। সুরজিৎ ও বন্ধুরা কবিতাক্লাবের সক্রিয় সদস্য। রেওয়া ও নবাঙ্কুর পত্রিকা থেকে সাহিত্যকর্মের জন্য পুরস্কৃত। এ পর্যন্ত কলকাতা ও আশপাশ জেলা, উত্তরবঙ্গ, বাংলাদেশ, বেঙ্গালুরু, ইউএসএ মিলিয়ে প্রায় একশোটি লিটল ম্যাগ ও বইএ লেখা প্রকাশ এর মধ্যে পত্রভারতী প্রকাশনার বইও আছে। বর্ধমান পুলিশ থেকে পুরস্কৃত সমাজসচেতনমূলক সাহিত্য লিখে।

২টি মন্তব্য:

Featured post

সোনালী মিত্র