অন্য আলো
১
মা:
“রুবাই একটু শুনে যা। ঘরে এসে বোস।”
‘হ্যাঁ বলো।”
খাটে বসে চারপাশটা দেখে রুবাই, সকালের দিকে এই ঘরে আসা হয় না। মাএর ঘরটা কত বছর ধরে একই রকম, সাদা দেওয়াল, একধারে সরু খাট পরিষ্কার টানটান চাদরে মোড়া, একটা বেতের চেয়ার, কোনের শোকেসে কিছু বইপত্র সেলাইএর জিনিস, দেওয়ালে টিভি আর বাবার ছবি বাঁধানো তাতে ফুলের মালা, দক্ষিণে বারান্দা, এপাশে মাএর ঠাকুরের আসন, মাটিতে বসতে পারে না বলে মা তাক করে নিয়েছে, নিজেও টুলে বসে পুজো করছে। চেয়ে চেয়ে দেখে চোখে জল আসে রুবাইএর, কি সুন্দর চেহারা ছিলো মা এর, এখন রোগা দড়ি, বয়স আর অসুখের ছাপ সারা শরীরে, তিনটে কেমোর পরে চুল সবই উঠে গেছিলো এখন ছোট ছোট সাদা কালো চুল বেরিয়েছে।
“নে প্রসাদ নে।”
হাতের বাটি থেকে আপেলের টুকরো, বাতাসা মুখে ফেলে রুবাই।
“বলো কি বলবে।”
“রুবাই তোর বাবা যখন চলে গেলো তুই মাত্র সাত বছরের তখন, আমিও অল্প শিক্ষিত আঠাশের গৃহবধূ কিছু জানি না বুঝি না, যেন অকূল সমুদ্রে পড়লাম,খালি এই বাড়িটা ছিলো, একতলাটা তো চিরকালই দোকানঘর ভাড়া দেওয়া,দোতলায় তোর কাকা কাকিমা তখন রুমু হয়েছে সবে ঝুমু হয়নি, আর তিনতলায় এই তিন চারটে ঘর নিয়ে আমি তুই আর তোর বাবার ছবি। দোকানের সামান্য ভাড়া সম্বল দু এক মাস পরেই চোখে অন্ধকার দেখলাম।”
“এইসব তো জানি মা, এসব কেন বলছো?”
“কারণ আছে রে, অত বিপদেও কিন্তু আমি ভেঙে পড়িনি, সেলাই করে কিছু রোজগারের চেষ্টা, দেখলাম তাতে কুলোচ্ছে না। তুই অত বড় স্কুলে পড়তিস, সেই সব খরচ, স্কুল বাস, নিজেদের খাওয়া, তারপর কম্পিউটার শিখলাম, তখন খুব চাহিদা ছিলো, সেই থেকেই এই ছোট অফিসে অপারেটরের চাকরি। বাসে যেতাম, সামান্য টিফিন করতাম, বছরে দু তিনটের বেশি শাড়ি কিনতাম না, শুধু ভগবানকে ডাকতাম আমার রুবাইকে মানুষ করতে পারলেই সব পাওয়া হবে আমার। তোর খরচে কার্পণ্য করিনি কখনও।”
“আচ্ছা মা কি শুরু করলে বলোতো, এই বাড়ির প্রতিটি মানুষ জানে তোমার সেই স্ট্রাগলের কথা, কি কষ্ট করেছো তুমি, কেউ পাশে ছিল না, কাকাইরাও উদাসীন থাকতো পাছে আমাদের দায়িত্ব নিতে হয়।”
“এইসব করেছিলাম শুধু তোর মুখের দিকে চেয়ে, এত বড় অসুখ হোল আমার সব সময়ে ঠাকুরকে ডেকেছি, যদি তুলে নেন আমাকে বেশ তো, আজ রুবাই বৌমা, সোনাইকে নিয়ে সুখের সংসারে আর আমার কিছু চাই না।”
“তুমি ভালো হয়ে গেছো মা, সম্পূর্ণ সুস্থ বছরে একবার চেক আপ করলেই হবে।”
“কষ্ট তো অসুখে পাইনি অত আমি, আজ যা পেলাম, বৌমা সকালে এসে আমাকে সব বলেছে, তুই কি পাগলামি শুরু করেছিস, এইসব কি চিন্তা ধারা, এই জন্যই কি এত কষ্ট করে তোকে মানুষ করেছিলাম।”
২
দীপা:
প্রেসেন্টেশন বানানো শেষ। মুম্বাই থেকে ভাইস প্রেসিডেন্ট এসেছেন, এখন দীপাঞ্জনার বসের সাথে কথায় ব্যস্ত। বারোটায় সবার সাথে মিট। দীপা ছাড়াও অমিতাভ আর রনির প্রেসেন্টেশন দেবার কথা,কিন্তু সেই সকাল থেকে মাথাটা টিপটিপ করছে। ফোন তুলে এককাপ কফি চেয়ে ব্যাগ খুলে ব্যাথার ট্যাবলেট মুখে দিলো ও। কাল থেকে খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে আছে, রাতে যখন সোমাভ কথাটা বললো, চমকে উঠেছিলো, বুঝিয়ে বললো অনেক কিন্তু সোমাভ খুব জেদি জানে দীপা, উপায় না দেখে আজ সকালে অফিস বেরোনার আগে শাশুড়িকে গিয়ে সব বলেছে।
“কি বলছো বৌমা, রুবাই এমন বলেছে, কি অদ্ভুত এমন কেউ করে নাকি, তুমি চিন্তা কোর না, আমি রুবাইকে বুঝিয়ে বলছি, একি পাগলামি, না না এমন করলে সবাই কি বলবে।”
যতই মা বুঝিয়ে বলুক, রুবাই কি কারুর কথা শুনবে! আহ তেতো কফিটা আর ওষুধ একসাথে বোধহয় কাজ করছে মাথাটা হাল্কা লাগে দীপার। উচ্চবিত্ত পরিবারের আদুরে মেয়ে হলেও ছোটবেলা থেকেই দীপা পরিশ্রমী। পড়াশোনা কেরিয়ার এই নিয়েই ভাবনাচিন্তা ছিলো। অর্থনীতিতে স্নাতক হবার পরে এমবিএ ক্লাসে আলাপ সোমাভর সাথে। প্রথম দর্শনেই ভালো লাগা। রুবাই এর ভদ্রতা, সৌজন্য বোধ, সারল্য ওকে আলাদা রেখেছিলো অন্যদের থেকে সবসময়। অর্থনৈতিক ভাবে সাধারণ অবস্থার হলেও দীপার বাড়িতেও কেউ এই পছন্দ নিয়ে আপত্তি তোলে নি। বরং ওর বাবা বলেছিলেন তোর পছন্দের তারিফ না করে পারছিনা। আট বছরের বিবাহিত জীবনে ছোটখাটো মতান্তর হলেও ওদের মনান্তর কখনও হয়নি বরং ভালোবাসা আর বোঝাপড়া বেড়েছে।
কাজের ব্যাপারে দীপা খুব সিরিয়াস, এই রিজিয়নে দীপা প্রায় দু নম্বর এখন, সহকর্মী দের অনেক পিছনে ফেলে, ওর কাজের ফোকাস মারাত্মক, টিম ম্যানেজমেন্টও ঈর্ষনীয়, যদিও বাড়ি এবং অফিস দু দিক ম্যানেজ করা কখনও কখনও সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় বিশেষ করে মাএর অসুখের পরের থেকে। আয়া কাজের লোকেরা কোনদিন এল না হয়তো, ছোট্ট সোনাই আর তার পড়াশোনা, অসুস্থ মা, এবং বাড়ির কাজ দীপাকে নাজেহাল করে ছাড়ে, যদিও সোমাভ খুব সাহায্য করে কিন্তু মার্কেটিং এ থাকার জন্য ওর খুব ট্যুর থাকে, মাসে অনেকদিনই বাড়িতে থাকে না,কিন্তু যাইহোক করে ম্যানেজ তো হচ্ছে, তাবলে সোমাভ এমন একটা চিন্তা করবে মন থেকে মানতে পারছে না দীপা।
ফোন বাজছে, বসের নম্বর, “দীপা ক্যান উই স্টার্ট দ সেসন নাও?”
৩
রুবাই:
“মা, দীপা, সোনাই তোমরা সবাই আমার কথা শোনো, মন দিয়ে, আগের থেকে মাথায় পুরনো চিন্তা রেখো না। হ্যাঁ তোমরা ঠিকই শুনেছো, আমি কাজ ছেড়ে দিয়েছি, মাস খানেক নোটিস পিরিয়ডে আছি। না কাজের কোন অসুবিধা হচ্ছিলো না, আরও দায়িত্ব বাড়ছিলো, তাহলে আমার মাসে কুড়ি দিনই প্রায় বাইরে থাকতে হবে।
আমি জানি প্রায় দশ এগারো ঘন্টা প্রচন্ড পরিশ্রম করে এসেও দীপা ঠিক ম্যানেজ করবে, মা তুমি শরীর খারাপ নিয়েও বাড়ির কাজ করবে, সোনাইএর পড়াশোনা পুরোটাই টিচারের ওপরে থাকবে, ফাঁকা সময়ে সোনাই টিভিতে কার্টুন দেখবে, খেলতে যাবে না কারণ নিয়ে যাবার কেউ নেই।
তোমরা সবাই বলবে এর জন্য কাজ ছেড়ে দেবার কিছু নেই, পুরুষ মানুষ কাজ ছেড়ে বাড়ির কাজ করলে লোকে ছিছি করবে, দীপা অফিসে কি বলবে ওর বর বেকার, মা তুমি এত কষ্ট করে আমাকে পড়িয়েছো তোমারই বা কেমন লাগবে। একমাত্র সোনাই বোধহয় খুশি হবে যদিও ওর টিভি দেখা কমে যাবে।
কিন্তু তোমরা বলো কি করলে ভালো হবে, মা আমি তোমাকে একটু সময় দিতে চাই, হাতেহাতে একটু কাজ করতে চাই, অসুস্থ শরীরে শেষ বয়সে তোমার পাশে থাকতে চাই মা। আমি দীপাকে অনেক বড় দেখতে চাই, ও কর্মক্ষেত্রে এই বয়সেই খুব সফল, ওরও ঘরে একটু সাপোর্ট দরকার। সোনাইকে ক্যারাটে, সাঁতারে ভর্তি করবো, ওকে পড়াবো, তোমাকে বলি মা, আমাদের দ্বিতীয় বাচ্চারও প্ল্যান আছে, তাকেও মানুষ করতে হবে। এখন প্রশ্ন উঠবে আমাকেই কেন স্যাক্রিফাইস করতে হবে দীপা কেন চাকরি ছাড়বে না, তার প্রধান কারণ দীপা আমার থেকে চাকরি ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে, ওর ভবিষ্যৎ বেশি উজ্জ্বল।
আমি বাড়িতেই একটা ফিনান্সিয়াল কন্সাল্ট্যান্সি শুরু করছি, মূলত অনলাইনে কাজ অর্ককে মনে আছে তো, ওর সাথে, রোজগার প্রথম দিকে সামান্যই থাকবে আমি ঘন্টা চারেক সময় দেবো দুপুরের দিকে। এবার তোমরা বলো।”
“রুবাই তুই চাকরি ছেড়ে দিলে সংসারে টাকা পয়সার অসুবিধাও তো হবে তাই না?”
দীপা মাকে থামিয়ে দেয়।
“না মা সেটা হয়তো তেমন সমস্যা হবে না, আমার কিছুটা মাইনে বেড়েছে, কত সংসারে তো স্বামীর একার রোজগারেই চলে, আমাদের সেভিংস কিছুটা কমবে হয়তো।”
“দীপা তুমি কি এতে খুশি হবে, স্বামীকে হাতখরচ দিতে, সংসার খরচ একা দিতে?”
“মা প্রথমে আমিও আপনার মতই আপত্তি জানিয়েছিলাম ভালো লাগেনি, কারণ বহু বছরের সামাজিক রীতিনীতি মনে দৃঢ় থাকে তো। কিন্তু রুবাই বোঝালো কত মেয়েরাও তো চাকরি কেরিয়ার ছেড়ে দেয় কই তখন তো কেউ কিছু বলে না। মা আসলে প্রত্যেক মানুষের তার নিজের জীবন নিজের মত করে চলার স্বাধীনতা থাকা দরকার। আমরা তো কেউ রুবাইকে জোর করিনি, ও যদি একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে চায় বেশ তো, আমি ওর পাশে আছি মা।”
“মা তুমি একা একটা লড়াই করেছিলে তোমার পাশে কেউ ছিল না, আজ কিন্তু আমরা চারজন সবাই সবার পাশে থাকবো,খুব শিগগির পাঁচজন হবার ইচ্ছে আছে। দেখি না কিছুদিন, আমার কনসালট্যান্সি যদি ভালো চলে লোকজনও রাখতে পারি। কাকাইদের নিচের ঘরটা খালি হবে, দরকার হলে ওখানে আমার নতুন অফিস করবো। আমি অফিস থেকে বেশ কিছু থোক টাকা পাবো, সবটাই জমিয়ে দেবো, যা সুদ পাবো আমার নিজের খরচ বাদ দিয়েও সংসারে কিছু দিতে পারবো, কনসালট্যান্সি থেকে প্রথমেই বেশি কিছু আশা করছি না।”
“মা সংসার খরচ নিয়ে কিছু ভাববেন না, আমার টাকা রুবাইয়ের টাকা আলাদা নয় যদিও আপনি কারোর ওপরে নির্ভরশীল নন তবুও বলি নির্দ্বিধায় থাকবেন যেমন ছিলেন।”
“মা সকালে তোমাকে সামনের পার্কে মর্ণিং ওয়াকে নিয়ে যাবো, সোনাইকে ক্যারাটে আর সাঁতারে। সন্ধ্যেবেলা তুমি টিভি দেখো আমি সোনাইকে পড়াবো। দীপা ছুটির দিনে রান্না করতে পারে বাকি দিন কল্পনাদি রান্নার কাজে কামাই করলে আমি রান্না করবো। কনসালট্যান্সিও হয়তো মন্দ চলবেনা। দেখি না কি হয়।”
“মা আপনি জেনে নিন অনেকে আপনাকে অনেক কথা শোনাবে হয়তো, কিন্তু আপনার ছেলের জন্য আমার খুব গর্ব হয়, ও খুব অন্যরকম তাই তো আমার ওকে ভালো লেগেছিলো।”
“দীপা, আমার তোমাকে নিয়েই চিন্তা ছিলো মা। তুমি যদি মেনে নাও আমার কোন অসুবিধে নেই। রুবাই কিছুটা ওর বাবার মত, পরিবারই ওর কাছে সব কিছু, অন্যরকম ভাবনা তো চিরদিনই কিছু মানুষ ভেবে এসেছে, দেখা যাক কেমন হয়। আশীর্বাদ করি তোমাদের বন্ধন, বোঝাপড়া চিরদিন এমনই থাকুক।
সুচিন্তিত মতামত দিন