শ্রীময়ী চক্রবর্ত্তী

মায়াজম
0
                           দুই নারী


        " বন্ধুরা শান্ত হয়ে বসুন । একটুক্ষণের মধ্যে স্টেজে আসছেন আপনাদের জানে জিগর , দিলরুবা, রাত কি রানী মুম্বাই খ্যাত ড্যান্সার মিস পার্পেল পামেলা " শেষ কথাগুলো ঘোষক টেনে টেনে বলার সাথে সাথে চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো পুরো সামিয়ানা জুড়ে । মাঝবয়সীরা একটু নড়েচড়ে বসলো , পেছনে ছোকরার দল চেয়ারে উঠে দাঁড়াতে লাগলো টলমল পায়ে । হাততালি , সিটি আর চিৎকারে কান ফাটার জোগাড়।স্টেজ নীল আর বেগুনি আলোয়  কামনা মেদুর। দ্রিমি দ্রিমি ড্রামের বিটে আদিম কোন উপজাতির শিকারের ডাক। কালো রুপোলি স্বল্পবাস একটি যুবতী স্টেজে হিলহিলে গোখরো সাপের মতো, বিদ্যুতের শিখার মতো নাচের সন্মোহন ছড়াতে লাগলো । শরীর যেন তার মাখনে তৈরি । আলো আর উত্তেজক সুরে সে শরীর ভেঙ্গে পড়ছে উত্তাল সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো । স্টেজ জুড়ে একপাক ঘুরতেই আরো আটটি নর্তকী যোগ দিল পামেলার সাথে । পামেলার ট্রুপ " পারপেল লোলা গার্লস "। আধঘন্টা নাচের পর দশ মিনিটের বিরতি । একজন কৌতুক অভিনেতা হিন্দি বাংলা মিশিয়ে আদি রসাত্মক ভাঁড়ামি করতে লাগলো। দর্শক বেশীভাগ কোলিয়ারির শ্রমিক, খুচরো ব্যবসাদার, কিছু বড়লোকের নিস্কর্মা অপোগন্ড । তবে সবাই পুরুষ, কাঁচা মদের সাথে ঘাম , বিড়ি, সস্তার কড়া সেন্টের গন্ধ মিশে দম বন্ধ হয়ে আসে।
     পামেলা একঢোক পেপসি খেলো বোতল থেকে। এতে হুইস্কি মেশানো আছে , নার্ভ ঠান্ডা রাখতে এটুকু তার দরকার । কস্টিউম চেঞ্জ করতে গিয়ে পামেলা দেখলো গোলাপি মাসীর আটটা মিস্ড কল । এরকম তো হওয়ার কথা নয় , প্রবল দুশ্চিন্তায় মাসীকে কল করলো সে ...
" হ্যালো হ্যালো ! হ্যাঁ কি হয়েছে?
কি ? জোরে বল , টুকটুক কি খেয়ে ফেলেছে???
পয়সা কোথায় পেল ? .....
না না টুকটুক কে একা রেখে যেওনা । রিমাকে ডাকো । ওঃ রিমা প্রাইভেট পার্টিতে গেছে। আচ্ছা আমি রমেশ ডাক্তারকে বলছি আসতে , টুকটুক কে শান্ত রেখো আর তুমি কিন্ত্তু খোঁচাখুঁচি করো না । আমি আধঘন্টায় ফোন করছি। "
পামেলাকে ততক্ষণে ট্রুপের মেয়েরা ঘিরে ধরেছে । পাড়ার ডাক্তারবাবুকে ফোন করতে না করতে স্টেজ কল এসে গেলো। কোনরকমে শকিং পিঙ্ক ট্যাঙ্ক টপ আর মাইক্রো মিনি স্কার্টটা গলিয়ে স্টেজে পা দিলো লাস্যময়ী পার্পেল পামেলা । এখন একটা বলিউড নাম্বার " কাঁটা লগা..." । কিন্ত্তু নাচটা ঠিক জমছে না । নিস্প্রাণ রোবোটের মত হাত পা নাড়ছে প্রধানা নর্তকী । কোনরকমে নাচটা শেষ করেই মাসিকে ফোন করে ও । উফ্ ফোনটা যেন অনন্তকাল ধরে বাজছে....
" হ্যালো এখন কেমন আছে টুকটুক? হসপিটাল নিয়ে যেতে বলেছে । ডাক্তারবাবুকে সাথে যাবেন । না না ..... এতো ঠান্ডা ,  আ্যামবুলেন্স এ যাও । আমি রওনা হচ্ছি , আমি চলে আসবো । কি করে? ছাড়ো ! ডাক্তারবাবুকে দাও। 
হ্যাঁ ডাক্তারবাবু আমি তিন চার ঘন্টায় পৌঁছাবো । লাইফ লাইনে যাচ্ছেন ? আমি ডাইরেক্ট যাচ্ছি । টাকা পয়সার চিন্তা করবেন না । শুধু দেখবেন মেয়েটা যেন ..... । "দ্রুত ময়ুর পেখম লাগানো স্কার্টটা গলিয়ে নেয় পামেলা, উর্দ্ধাঙ্গে অতি ক্ষুদ্র ঘন নীল চুমকির ব্লাউজ । ম্যানেজার কানু আর ট্রুপের মেয়েদের হ্রস্ব কণ্ঠে কি সব বোঝায়। বিশেষ কিছু পরামর্শ দেয় প্রিয় শিষ্যা লাভলিনকে, তারপর আবার স্টেজে চরকির মতো পাক খেতে খেতে প্রবেশ করে সে । ময়ুর এর পেখমে যেন লাট্টু ঘুরছে একটা । হঠাৎই মাথা ঘুরে স্টেজের মাঝখানে আছড়ে পড়ে সে । সবাই ছুটে আসে , বড় সাদা আলো জ্বালিয়ে দেয়া হয়,কপাল ফেটে রক্তে মাখামাখি । একটা চাদরে অচৈতন্য পামেলাকে ঢেকে গাড়িতে তুলে দিল কানু, স্টেজে পড়ে রইল পেখমের স্কার্টটা ।দর্শক দুএক মুহূর্ত চুপ করে ছিল এখন তাদের চিৎকারে কান পাতা দায়।তাদের পয়সা ফেরত চাই । 
             কলকাতার পথে কুয়াশা চিরে ছুটে চলেছে তীব্র গতি এসইউভিটা । উঠে বসলো পার্পেল পামেলা ওরফে সরস্বতী কুণ্ডু । মেক আপ ম্যান রামলোচন বাবুর  কাছ থেকে জলের বোতলটা নিয়ে একটা কাপড় ভিজিয়ে মুছে নিল সারা মুখে মাখামাখি রক্ত আর মেকআপের সোনালী অভ্র । গাড়িতে রাখা জিন্স টপ আলগা গলিয়ে নিলো সে । গোলাপি মাসিকে ফোন করলো একটা, ওরা হাসপাতালে পৌঁছে গেছে নানারকম টেস্ট চলছে টুকটুকের । 
সন্তোষ বললো "  দিদি একটা অষুধের দোকানে একটু থামবো কপালে একটা ব্যান্ডেজ লাগিয়ে নেবে ।"
" দরকার নেই তুই গাড়ি চালানোয় মন দে" পামেলার গলায় কতৃত্বের সুর।
বড় অস্থির লাগছে তার, কতোক্ষণে মেয়ের কাছে পৌঁছবে সে.... কিছু করার নেই! কিচ্ছু না! ছোটবেলায় মায়ের কাছে শেখা হনুমান চালিশাটা অস্ফুট স্বরে গুনগুন করে আওড়াতে থাকে বিপন্ন নিরুপায় মা।
        ম্যানেজার কানুর সাথে কথা বলতে বলতে কয়লা মাফিয়া ভীমা চোখ দিয়ে আপাঙ্গ চেটে নেয় লাভলিনকে । তারপর  এসে  দাঁড়ায় স্টেজে, দর্শক মুহূর্তে শান্ত। জলদগম্ভীর স্বরে ভীমা উপস্থিত জনতাকে বলে " ভাইলোগ সব শান্ত হয়ে বস। পামেলাকে হসপিটালে নিয়ে যেতে হয়েছে সবার মত আমারও হেব্বি দুঃখ হচ্ছে । কিন্তু একটা মেয়েছেলে গেছে তো দুসরা মেয়েছেলে আছে । এবার আমরা লাভলিনের নাচ দেখবো। ভীমা পার্ট টাইম সমাজসেবী পাবলিক সামলানো তার বাঁ হাতের খেল।
          আবার মঞ্চে রঙিন আলোর খেলা , নাচ শুরু করলো লাভলিন। দক্ষতার অভাব চাপা পড়ছে অতি উত্তেজক প্রগলভতায় । বারবার জনতার দিকে চুম্বন ছুঁড়ে দেয় সে । প্রধানা নর্তকী হবার বাসনা তার বহুদিনের, এমন সুযোগ ছাড়তে রাজি নয় আমতার সুমা দাস। সে নাচতে নাচতে সামনের সারিতে বসা ভীমা সিং এর চোখে চোখ রেখে কচ করে চোখ মারলো। মূল্য যাই হোক নিজের দল সুমাকে গড়তেই হবে ।



শ্রীময়ী চক্রবর্ত্তী ( লেখক পরিচিতি)
কলকাতার নন্দিনী। আশুতোষ কলেজের প্রাক্তনী । ছোটবেলা থেকে কবিতা লেখার অভ্যাস থাকলেও অতি সম্প্রতি গল্পে হাতেখড়ি। সখ গান গাওয়া এবং রান্না করা

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)