শৌনক দত্ত

মায়াজম
0
                               লস্ট ফেদার

জীবন আর পথের বড় মিল।পথের মতো জীবনেও পিছনে ফেলে আসতে হয় চেনা অচেনা মানুষ।শেষ রাত্তিরে ফুঁ দিয়ে জীবন উড়িয়েছি পাঁচ আঙ্গুলে করুন দহন সারা সন্ধেবেলা,এখন দুপুর দুটো।কয়েক মাইল শূন্যতার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে আমার মাঝবয়সী ভুল।এই স্বপ্নের সাথে সেই স্বপ্নের মিল নেই! জীবনের কথা ভাবতে ভাবতে পৌঁছালাম চুংথাং।এখানেই লাচেন চু এবং লাচুং চু হাত ধরাধরি করে তিস্তা হয়ে গেছে।ভাল লাগছেনা আমার, এভাবে কত আর পিছু টান?পাহাড়ে অন্ধকার নামছে।আমি হারিয়ে যাচ্ছি।ডুবে যাচ্ছি।
সন্মোহন কে মনে পড়ে।যদিও আজ এইখানে এসে তাকে মনে করার কোন মানে হয় না!একটা লোহার ব্রিজ পেরিয়ে লাচুং ঢুকছি আমি।আমার আস্তানার প্রধান দরজায় ঝুলছে বিরাট বড় সুদৃশ্য কারুময় পিতলের কড়া।আজকাল সোনা আর পিতলের তফাৎ বোঝা বেশ কঠিন।বিশেষ করে আমার মতো মানুষের জন্য সোনানা পিতল সনাক্ত করা বেশ শক্ত কাজ।মানুষের উপর থেকে বিশ্বাস হারাতে নেই, বোঝার পর থেকে আমি তাইতো পিতলকেও সোনা ভেবে বিশ্বাস করি হরদম।আমি ঘুমুবো। একটি শব্দকে বুকে ধরে খুব ঘুমুবো, রাত্রি হলো। রাতভর দু’চোখের পাতা এক করতে পারলাম না।কিছুটা জিরো পয়েন্ট যাওয়ার উত্তেজনায়,কিছুটা ভোরে যদি ঘুম না ভাঙ্গে সেই টেনশনে।টেনশন আমাকে কখনোই ছুঁতে পারেনি,মেঘলার বিয়েতে সন্মোহনের চাউনি যেভাবে ছুঁয়েছিলো সেভাবে কেউ কখনো দৃষ্টিতে ফালাফালা করেনি আমায়।যেন বহু দূর থেকে ভেসে আসছে শব্দ স্বর-তোমার চোখের কাছে আমার কনক ঋণ!আমার জন্মদাত্রী মা আমাকে অনাথ আশ্রমে রেখে গেছিলো শুনেছি।তার পরিচয় জানার ইচ্ছে করেনি কখনো জন্ম আমার কাছে ঋণী থাকলো নাকি আমি জন্মের কাছে?আজ ভাবতে ভাল লাগে আমার যদি কোন সন্তান হতো তাকে আমি কখনো অনাথ আশ্রম দিয়ে আসতাম না।কিন্তু আমি কোন সন্তান জন্ম দিতে পারিনি।সেই না পারাটা আজ আর সত্যিই কোন অর্থ বহন করে না।লাচুং নদীর পাশে বসে এবং শুয়ে প্রকৃতির সাথে নিজেকে মিশিয়ে দিতে দিতেই মনে হলো নারী মানেই তিস্তা কিংবা ঐ দূরের পাহাড়।সন্মোহন আজ নিশ্চয় খুব ভাল আছে।ছোটবেলা থেকেই আমি ডাইরী লেখি,ম্যাডাম দরথী আমার জন্মদিনে তালা দেয়া একটা ডাইরী উপহার দিয়ে বলেছিলেন-‘রোজকার কথা এখানে লিখে রাখবে,নিজেকে কখনো একা লাগবে না।’আমি যে আদতে একা সেটা আমি সেদিনই বুঝেছিলাম।তার পরের বছর আমার জন্মদিন বদলে গেলো,আমাকে দত্তক নেয়া মা বাবার সাথে আমি নতুন করে শুরু করলাম।আমার নতুন নাম হলো,পদবী পেলাম।নতুন সব কিছুর মাঝে থেকে গেলো শুধু পুরোনো ডাইরী।লাচুং থেকে বেরিয়ে রাস্তা ক্রমশ পাথুরে,বোল্ডারময়।কাছে এবং দূরে বিভিন্ন আকারের পাহাড়ের রঙ ধূসর থেকে বাদামী হয়ে ক্রমশ কালো।অন্যান্য পাহাড়ী পথের মতোই এঁকেবেঁকে কেবল উঠতে থাকি আমি।কিন্তু এই পথ রুক্ষ।পথের দুপাশে রডোডেনড্রন গাছের চিহ্ন আছে বটে,কিন্তু ফুলের কোন অস্তিত্বই নেই।অন্য যেকোন সময় হলে আমি সব লিখে রাখতাম ডাইরীর পাতায় আজ আর কিচ্ছু লিখছি না আমি।পাহাড়ী এই পথের মতো জীবনটাও যে এমন রুক্ষ হতে পারে কয়েকমাস আগেও কেউ বললে আমি হয়ত বিশ্বাস করতাম না।সন্মোহনেরও যে আমায় ভাল লেগে ছিলো তা বুঝতে আমার সময় লাগলো সাতদিন।সেদিন বাইরে উঁচু নিচু রোদ,মেঘলার নম্বরটা ভেসে উঠলো মোবাইলে।সমতল বিকালে মেঘলার সাথে আমার বাড়ী এলো সন্মোহন সঙ্গে তার মা বাবা আর বোন।আমি ইয়ুমথাং এর দিকে যাচ্ছি,রাস্তার ধারে বরফ পড়ে আছে।দূরে পাহাড়ের গা থেকে ঝুলে পড়ছে বরফায়িত ঝরনা।চোখে পড়লো পাহাড়ের পায়ের কাছ দিয়ে বয়ে চলা কিপ ছঅ নদী।তার পান্নাসবুজ জলের বুকে সাদা বরফের চাদর।আমি ভূগোলের ছাত্রী,ভ্রমণ আমার খুব পছন্দ।দেখা অদেখার চাদর সরিয়ে সন্মোহনদের ব্যবসায়ী পরিবার, বিয়ের প্রস্তাব মেনে নিলেন আমার মা বাবা।বিয়ের প্রস্তুতি শুরু হলো।সেই প্রথম আমরা মিট করলাম কফিশপে।মনে পড়ে আমি সেইদিন অনেকটা আগেই পৌঁছে গেছিলাম।অনেক কটা মিনিট পরে সন্মোহন এসেছিলো,তার হাতে মোড়কে মোড়া উপহার।কফি অর্ডার করে পাশে এসে বসলো সন্মোহন।আমি তখন মোড়ক খুলে ডুবে গেছি কবিতায়।নতুন কবি,আগে কখনো পড়া হয়নি,অথচ কি সাবলীল,সহজ কথায় ছড়িয়ে দিচ্ছেন বোধের জাদু যেমন করে গ্রাস করছে আমাকে সন্মোহন!দুপাশে পাহাড়,পাহাড়ের গায়ে ঝুলে থাকা মনোরম ঝরনা আর ছোট বড় অজস্র বোল্ডার।ইয়ুমথাং ঢুকে দুচোখ ভরে গেলে লাচুং চু-র শুকনো নদীখাতে সারিবদ্ধভাবে সাজানো বাহারী রঙের প্রেয়ার ফ্ল্যাগে।সন্মোহনের সাথে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণে বিয়েটা হয়ে গেলো,চোখে রঙীন স্বপ্ন গ্রাম্য আকাশের মত,প্রাচীন ঠান্ডায় জমে থাকা হাত শীত থেকে বসন্তের দিকে যেতে যেতে দাড়ি কমা ছড়াচ্ছে।একদিন খেলনা পুতুলের বিয়ে দিতে গিয়ে যেমন সংসার পাততাম বন্ধুদের সাথে তেমনি আজ সংসার পেতে বসেছি,তবে এ খেলা নয়।প্রতিটি নারীর স্বপ্ন জুড়ে থাকে নিজের সংসার সেই পুতুল খেলার দিন থেকে যার শুরু।আমিও স্বপ্ন দেখেছি এতদিন নিজের ঘর,নিজের মানুষ,নিজের একটি নিটোল সংসারের।দূরে পাহাড়ের বুকে তুষারের আস্তরণ।এখান থেকে পাওহুনরি এবং শুনদু শেনপা পাহাড়ের চূড়া দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিলো দূষনহীন ঘন নীল আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে মহাপৃথিবীর লক্ষ বছরের বোবা অহংকার যেন পাহাড়ের চূড়ায় সেজে থাকা বরফের আলপনা।নারী জন্মে নারীর বোধ হয় কিছুই নিজের হয়না,এমনকি ভাবনাও না।মনে পড়ে,হানিমুনে আমরা সমুদ্রে গেছিলাম,সেই প্রথম আমার সমুদ্র দর্শন,সমুদ্রকে এর আগে বহুবার মনে মনে ছুঁয়েছি,সেদিন বুঝিনি পুরুষমানুষ আদতে সমুদ্র,তাতে যত খুশি ভাসো,সাঁতার কাটো কিন্তু ডুবতে পারবে না তার গহীনে, পারে সে ফেরাবেই।আমার ডাইরীর পাতা খুব দ্রুত ফাঁকা হচ্ছিলো।কুড়িদিন ডাইরীর পাতায় কিচ্ছু লেখা হয়নি।হানিমুনের প্রথমদিন কাটলো পলকে,মনে পড়ে কুড়িদিন পরে ডাইরীর পাতায় শুধু লিখেছিলাম,একটি নিঃশ্বাস ঘন পৃথিবীতে আমি বার বার যাই, বার বার শুধু হারিয়ে যাই!ইয়ুমথাং থেকে কিছু দূরেই ইউমেসেমডং।আমি এখানে এসে দাঁড়িয়েছি।চারপাশ অ্যাজালিয়া ফুলের গাছে ভর্তি।জায়গাটা জুড়ে তার সুবাস ঘিরে আছে।পাশেই চিনা সীমান্ত।ব্যবসায়ীক স্বার্থে আমি আর সন্মোহন পরিবার ছেড়ে অন্য শহরে থাকি।সময় নিরন্তর হাঁটে,সন্মোহনের খুব ইচ্ছে আমি চাকরী করি,তাই একটা চাকরী করছি,যদিও আমি সংসারটাই করতে চেয়েছি কিন্তু নারী তো তাই আশা বেঁধে রাখি যদি এটা করলে সুখ ফেরে,চাকরী করলে যদি সন্তান নেবার যোগ্য হতে পারি।সন্মোহন কে সুখী করতে পারি না,যতবার তার কাছে মা হবার প্রস্তাব রেখেছি এখন নয় বলে সে ফিরিয়ে দিয়েছে।মাসের পর মাস আমার সেলারি তার হাতে দিয়ে আমি নিস্ব থেকেছি এমন কি আমায় একা রেখে সে যখন অন্য শহরে ফিরে গেছে তখনো।আমার ডাইরীর পাতা ভরে উঠছে চাকরী,অত্যাচার আর অবজ্ঞার শব্দ স্বরে।আয়নায় মুখোশের নীচের মুখ ভেসে ওঠছে রোজ।ডাইরীর পাতায় তবু স্বপ্ন বুনেবুনে ভালবাসা লিখে রাখি।সন্মোহনের বাবা মা আর বোন কাচের চুড়ির মতো ভাঙছে শ্রদ্ধা।সন্মোহনও মদের নেশায় চুর হয়ে ছুঁড়ে মারছে ফুলদানী।কবিতা বলা মুখে উচ্চারণ করছে গালিগালাজ।আমি আয়নার সামনে দাঁড়াতে ভয় পাই,নিজেকে দেখতে ভয় পাই।সন্মোহনের কি মিথ্যে মনে হয় আগুনকে সাক্ষী রেখে বলা মন্ত্রের সব অর্থ?নাকি আমিই সেই নারী যে আদতে প্রাচীন বিশ্বাস আঁকড়ে বেঁচে আছি?আর দু কিলোমিটার এগিয়ে গেলেই জিরো পয়েন্ট।ইউমেসেমডং এই শেষ বসতি।আর্মি এরিয়ার সুন্দর করে সাজানো পাথরের ঘরগুলো ছেড়ে এগিয়ে যেতে যেতে চোখে পড়লো বরফজমা নদী।পাহাড়ের চূড়ার দিকে তাকিয়ে অনুভব করলাম পুরনো কফির মগ,মৃত অর্কিড,সাহসী সড়ক পথ, যেখানে ঠাঁই নেই দাঁড়িয়ে থাকার,সেখানে নিঃসঙ্গ নগ্ন বনানী!
আমার সকল দুঃখ উড়ছে উড়ে যাচ্ছে,সংসার থেকে গ্রীবার দিকে,সব স্বপ্নই একদিন নীরবের জল,সব নারী জলের মত জমে থাকা কাদা!বরফের নিচে এক কাঁদো কাঁদো নদী।আমাকে খুব বোকা মনে হচ্ছে।দরথী ম্যাডামের কথা বলেছিলাম তিনি ডিভোর্স নিয়েছিলেন,মেঘলাও তো একাই থাকে।আমিও হয়ত পারতাম ডিভোর্স নিয়ে নিতে।কিন্তু আমি সংসার করতে চেয়েছিলাম।ভালবাসা নিজের স্বপ্নের কাছে বড়,সমাধান নয় জানি তবুও এই ডাইরীর পাতাই কাল সংবাদ হবে।পথ থেমে আছে, শূন্য আর শূন্যের মাঝে হলুদ সংবাদ ধারন করেছে গোঁজামিলের অধর।হেঁটে হেঁটে আমার ক্লান্তি আসে, নতুন বৃক্ষের নিচে কয়েকটি এটোঁ স্বপ্ন কুকুর হয়ে পথ দেখায়......

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)