‘ইতু’
আমাদের পাড়ার শেষপ্রান্তে অনেকটা জায়গা জুড়ে গাদাগাদা আম কাঠাল লিচু পেয়ারা কুলগাছে ঘেরা একটা টালির বাড়ি ছিল। কোনো সীমানা না থাকায় আমরা যখন তখন ঢুকে পরতাম। ভিতরের দিকে বিশাল উঠোন। তার ঠিক মাঝখানে ছিল মাটির ঠাকুর ঘর। গায়ে নানারকম নকশা আঁকা। সেই ঘরে যেসব ঠাকুর থাকতো তাদের বেশীরভাগই আমরা চিনতাম না। বড়দের কাছে শুনেছিলাম ওরা এদেশীয় আর আমরা বাঙাল তাই ঠাকুর আলাদা। এই ব্যাপারটা আমাদের মনে রহস্য তৈরি করেছিল। মাঝে মাঝেই হানা দিতাম। প্রায় সারা বছরই নানা পূজোপালা হতো ওই বাড়িতে। আমরা শুধু লক্ষীর ব্রতর কথাই জানতাম। ওই বাড়ির ঠাকুমা পিসিরা কতরকমের যে ব্রত করতো দেখে অবাক হতাম। মনসা, ঘেঁটু, টুসু, ভাদু এমন আরো অনেক। ওরা নাকি সব আঞ্চলিক দেবদেবী। সারা গ্রাম বাংলা জুড়ে এদের খুব সমাদর। এদের নিয়ে যে ব্রতকথা বা লোকাচার সেগুলো খুবই আকর্সনীয় ছিল।
এক ছুটির রবিবারে খেলতে খেলতে আমরা ও বাড়িতে গেলাম। দেখি অনেক মেয়ে বউ গোল হয়ে বসে আছে আর একজন গল্প বলছে। আমরাও বসে পড়লাম। সেটা ছিল ইতুর ব্রতকথা। আজও সেই গল্প আমাকে টানে।
আজকাল প্রযুক্তির যুগ। সেইসব ব্রত, লোকাচার আধুনিকতার হিড়িকে মুখ লুকিয়েছে। ফ্লাট কালচারে পাড়ার সেই বাড়িটিও হারিয়ে গেছে । কিন্তু কাজের খাতিরে গ্রাম বাংলায় ঘুরতে ঘুরতে দেখেছি সব কিছু হারিয়ে যায় নি একেবারে। আজও গ্রামের মহিলারা নিজেদের সংসারের কল্যাণের কথা ভেবে উপোষ করে, পূজো দেয়, নানান ব্রত পালন করে।
ইতু ব্রতর গল্পের প্রতি ছোটবেলার সেই আকর্ষন থেকে আমি তার ইতিহাস ভুগোল খুঁজতে শুরু করি। দারুণ মজার তথ্য পেলাম। কন্যা সন্তানের প্রতি অবহেলা, তাদের পরিত্যাগ করার দৃষ্টান্ত ‘ইতু’ পূজোর ব্রতকথার প্রচলিত লোক কাহিনীতেও আছে।
‘ইতু’ আসলে সূর্যের পূজো। সূর্যের এক নাম মিত্রা, তা থেকে মিতু বা ইতু। আবার রবিবার দিনটি সূর্যকে উৎসর্গ করা দিন। কার্তিক মাসের শেষ দিন থেকে শুরু হয়ে অগ্রহায়ণ মাসের প্রতি রবিবার ইতু পূজোর ব্রত পালন করা হত।
আরো জানলাম এটি আসলে স্ত্রীআচার। শীতকালীন রবিশষ্যের বীজ বপন করার আগে বাড়ির মেয়েরা সূর্যদেব কে সন্তুষ্ট করতে এই ব্রত করে।। বিবাহিত অবিবাহিত সব মেয়েরাই এই ব্রত পালন করে। ব্রতের দিনে তারা তেল হলুদ ছাড়া সম্পুর্ণ নিরামিষ খাবার খায়। আরো একটি ব্যাপার হল এই পূজোর প্রসাদ কেবলমাত্র মেয়েদের মধ্যেই বিতরণ করা হয়।
ইতু পূজোর আচার বেশ লম্বা। কার্তিক সংক্রান্তিতে কাকভোরে উঠে বাড়ির উঠোন নিকিয়ে চুকিয়ে তকতকে করে রাঙামাটির গোলা দিয়ে মেড়ুলির সজ্জা বানাও। তার চারপাশে দুধসাদা বাহারি আলপনা, শঙ্খলতা খুন্তিলতা চালতেলতার, আর লক্ষ্মীর পা। ফুলকারি নক্সাও করতে পারো। হেমন্তের শিশিরভেজা তুলসিতলায় পাতা হবে ইতুর আটন। একটা নতুন মাটির সরা বা মালসায় একতাল গোবর মেশানো মাটি। তার ওপর সিঁদুর দিয়ে পুতুল আঁকা ইতুর ঘট। ঘটের কানায় জড়িয়ে দাও কলমি আর শুশুনির শাক। ধান, কচু, মান আর হলুদগাছ রাখো। চারপাশের তাজা মাটিতে পাঁচরকমের কলাই ছড়িয়ে দাও।
আর লাগে বট গাছের ছোট ছোট পাঁচটা ডাল। এছাড়া অন্যসব পূজোর মতো ফুল, দূর্বা, বেলপাতা, সিঁদুর, তেল, হরিতকী, ধূপ-ধুনা,প্রদীপ তো থাকবেই। আয়োজন সম্পন্ন হয়।
‘ইতু’পূজোর অন্যতম বৈশিষ্ঠ হল পিঠে। নানারকমের পিঠেপুলি তৈরি করে ফলমূল দিয়ে নৈবেদ্য সাজাতে হয়। এটি হল ইতুর সাধ। আয়োজন শেষে পুজো। তারপর সবাই মিলে ব্রতকথা শুনে সেদিনের মতো ব্রত সমাপন কর। তারপর শুধু ঘট জলে বিসর্জন দিয়ে এসে প্রসাদ খাও। আবার পরের রবিবার নতুন ঘট পেতে নতুন করে সব আয়োজন করতে হবে। ততদিনে মাটির সরায় পোতা বীজ অঙ্কুর হয়ে বেরোবে। সব রবিবার গুলোতে একইভাবে পূজো তারপর ব্রতকথা শুনতে হাবে। অগ্রহায়ণ মাসের শেষ রবিবার ব্রত পালনের শেষ দিন। মাটির সরায় যে সব বীজ পোতা হয়েছিল সেগুলি থেকে যদি ঠিকমতো চারা বেরোয় তাহলে বুঝবে ব্রত পালন সফল হয়েছে। আবার পরের বছরের জন্য ‘ইতু’ কে নেমন্তন্ন করে এই বছরের মতো ব্রত শেষ কর।
এবার আমার অতিপ্রিয় ইতু ব্রতকথার লোককাহিনী।
অষ্টচাল অষ্টদূর্বা কলস পাত্রে থুয়ে
ইতুর কথা শুন সবে মনপ্রাণ দিয়ে।।
ইতু দিলেন বর
পুত্র পৌত্র ধনধান্যে বাড়ুক তাদের ঘর।।
এক গ্রামে খুব গরীব এক ব্রাহ্মন ছিল। তার দুই মেয়ে উমনো আর ঝুমনো। ভিক্ষে করেই তাদের দিন কাটতো। ব্রাহ্মনের একদিন সাধ হল পিঠে খাবে। বহুকষ্টে অল্প পরিমাণ সামগ্রী জোগাড় করে ব্রাহ্মনীকে বলল সব পিঠে যেন তাকেই দেওয়া হয়। ব্রাহ্মনী পিঠে ভাজে। তেলে একটা করে পিঠে পরে আর তার শব্দ শুনে ব্রাহ্মন গামছায় একটা করে গিঁট দেয়। রাতে খাবার সময় একটা করে পিঠে খায় আর একটা করে গিঁট খোলে। একসময় পিঠে শেষ হয়, কিন্তু গামছায় তখনো দুটো গিঁট থেকে যায়। ব্রাহ্মনের রাগ হয়। ভয়ে ব্রাহ্মনী স্বীকার করে একটা করে পিঠে মেয়েদের দিয়েছে। পিঠে খাওয়ার অপরাধে ব্রাহ্মন মেয়েদের পিসির বাড়িতে রেখে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। পরদিন ভোরে দুই মেয়েকে নিয়ে বেড়িয়ে পরে। বহু ক্রোশ পায়ে হেঁটে খিদে তেষ্টায় মেয়েরা জঙ্গলের মধ্যে একটা গাছের কোটোরে ঘুমিয়ে পড়লে ব্রাহ্মন তাদের ফেলে বাড়ি ফিরে যায়। দু-বোনের যখন ঘুম ভাঙে তখন অনেক রাত। বাবাকে দেখতে না পেয়ে তারা ভাবে বাবাকে কোনো জন্ত খেয়ে নিয়েছে। ভয়ে ভয়ে রাতটা কোনোরকমে কাটিয়ে পরদিন সকালে হাঁটতে হাঁটতে তারা এক গ্রামে পৌঁছোয়। সেখানে তখন মেয়ে বউরা ইতু পুজো করছিল। দুই বোনের কথা শুনে তারা ওদেরও পুজো করার পরামর্শ দেয়। উমনো ঝুমনো তাদের কথামতো পুকুরে স্নান করে ইতু পুজো করে। ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করে তাদের অভাব যেন দূর হয়ে যায়। বাবা-মায়ের সব ইচ্ছা যেন পূর্ণ হয়। একমাস ওই গ্রামে থেকে তারা ‘ইতু’র ব্রত পালন করে। তারপর পূজোর ঘট হাতে দুই বোন বাড়িতে ফিরে আসে। ততদিনে তাদের অবস্থা কিছুটা ভালো হয়েছে। ব্রাহ্মনী মেয়েদের দেখে আনন্দে কেঁদে ফেলে। মাকে তারা ইতু পূজোর কথা বলে। তার মেয়েদের প্রার্থনায় সুদিনের মুখ দেখা দিয়েছে জেনে ব্রাহ্মন তার ভুল বুঝতে পারে। তারপর থেকে ব্রাহ্মনীও ইতু পুজোর ব্রত পালন করতে শুরু করে। কিছুদিনের মধ্যেই তার ছেলে হয়। তাদের সংসার সুখ সমৃদ্ধিতে ভরে যায়। উমনির বিয়ে হয় এক রাজকুমারের সঙ্গে। আর ঝুমনির মন্ত্রীপুত্রের সঙ্গে।
ভালো করে পড়লে এই লোককাহিনী থেকে প্রাচীন ইতিহাসের অনেক বিলুপ্তপ্রায় প্রথার সন্ধান পাওয়া যাবে। যেমন দড়িতে গিঁট মেরে মনে রাখার প্রথা প্রাচীন গ্রন্থিলিপিকে স্মরণ করায়। পেরু, পলেনেশিয়া, এমনকি প্রাচীন চীনেও এই লিপির প্রচলন ছিল। এর নাম কুইপান বা কুইপু লিপি। ব্রতের গল্পটিতে ইন্দো-ইউরোপীয় লোকগল্পের মোটিফগুলিও দারুনভাবে রয়েছে। বিশেষ করে পঞ্চতন্ত্রের গল্পগুলোতে। যেমন - মেয়েদের বনবাসে পাঠানো, দুর্ভাগ্য জয় করে বাড়িতে পুনরায় ফিরে আসা, গাছের কোটোরে আশ্রয় নেওয়া ইত্যাদি।
লোকাচার আমাদের সংস্কৃতি। হারিয়ে গেলে আমাদেরই ক্ষতি। আমাদের পরবর্তি প্রজন্ম আমাদের শিকড় থেকে আলগা হয়ে পড়বে। চলুন সবাই মিলে সেই সব পূজো, ব্রত লোকাচার এবং তার সঙ্গে জড়িত লোককথাগুলির পুনরুদ্ধারে লেগে পড়ি।
--
লেখক পরিচিতিঃ ২০১৪ থেকে লেখালিখি শুরু। প্রধানত ব্লগজিনেই লিখে থাকি। বিভিন্ন লিটিল ম্যগেও লেখালিখি করি। মূলত কবিতা, অনুগল্প, প্রবন্ধ লিখে থাকি।
সুচিন্তিত মতামত দিন