জয়ন্তী অধিকারী

মায়াজম
2
উড়িষ্যার কথনকথা-ঝাড়ুদার রাজা,মা কালিজাই,উড়ন্তহাতি ইত্যাদি


লোককথা-রামকুমার মুখোপাধ্যায় ভারী সুন্দর নাম দিয়েছেন কথনকথা
তিনি বলেছেন "ভারতীয় কথনকথার কালসীমা ত্রিকালবিস্তৃত,চলাচল ত্রিলোকব্যপ্ত।কত না চরিত্র তাতে,দেবদেবী নারীপুরুষ থেকে অজস্র পশুপাখি,ভূতপ্রেত,দৈত্যদানব।কি বৈচিত্র্যময় তার পটভূমি- সমুদ্র,পাহাড়,তৃণভূমি,মরুপ্রান্তর,দ্বীপ,অরণ্য।ভারতীয় কথনকথা পাঠ যেন এই দেশকেই আবিষ্কার করা,সুদূর অতীত থেকে এই বর্ত্তমানেও।"
উড়িষ্যায় এই লোককথা বা কথনকথার কথকদের চমৎকার সব নামে ডাকা হয় । কথক নারী পুরুষ উভয়ই হতে পারেন। কথকদের অসাধারণ গল্প বলার ভঙ্গী ও কুশলতা, গল্প বলা ও শোনার পরম্পরা , ওড়িয়া ভাষা ও সংস্কৃতিকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে।। গ্রামের লোকেরা এই কথকদের ডাকেন ‘কথার সাগর’,”কথাপ্রাণ” ইত্যাদি মনোহর নামে। । ‘সারা’ সম্প্রদায়ে এদের অভিধা ‘কথাবিরমার’, কোরাপুট-কালাহান্দি অঞ্চলে বলা হয় ‘গীতকুদিয়া’ বা ‘দেবগুনিয়া’। অনেক অঞ্চলে জনপ্রিয় গায়কদেরও গল্প বলতে দেখা যায়। আদিবাসী এবং কৃষক সম্প্রদায়ের প্রায় সকলেই পুরুষানুক্রমে চলে আসছে এমন বহু গল্প বা লোককথা জানেন।
বেশীর ভাগ ওড়িয়া কথনকথা শুরু হয় এক রহস্যময় আবহের মধ্যে আর শেষ হয় জীবনের নিয়ম মেনে কখনো দুর্বৃত্তের দমন ও শিষ্টের পালন দিয়ে,কখনো চিরচেনা ‘তাহারা অবশেষে সুখে-শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল’ দিয়ে , কখনো নিষ্ঠুর বিচ্ছেদ বা মৃত্যু দিয়ে ।
উড়িষ্যার কথক গল্প শুরু করেন একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে , যার উত্তর তিনি নিজেই দেন, বিশিষ্ট স্বকীয় ভঙ্গীতে। তাঁর উদ্দেশ্য খুবই স্পষ্ট-প্রশ্ন ও উত্তরর টানাপোড়েনজালে ধরা পড়ে শ্রোতা যেন আসন ছেড়ে নড়তে না পারেন। । কিন্তু এই প্রশ্ন কখনো মূল গল্পের কাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক নাও রাখতে পারে
কখনো এর শুরুটা এমন-ছড়া কাটতে কাটতে–
‘সোজা কাটা হয়নি কাঠ
তেরসা করে কাটা।
জোড়া বলদ করল না চাষ
এক বলদের খাটা।’
কিংবা 
‘চলো, আজ তোমাদের একটা গল্প বলি–
কীসের গল্প?
বাঘের বা শেয়ালের গল্প।।’
আবার কখনো শুরুটা হয় ধাঁধা দিয়ে-পশ্চিম উড়িষ্যার বলাঙ্গির-কালাহান্দি অঞ্চলের একটি কাহিনীর মুখবন্ধ-
‘একটা গল্প বলি। একটা গল্প।
কিসের গল্প? এটা কুমোরের গল্প।
এক কুমোরের ছিল তিন ছেলে।
তার দুই ছেলে ছিল অন্ধ আর বাকি জন চাইতো না দেখতে।
অন্ধ একজন তিনটি পট।
তার দুটি গেলো ভেঙে আর একটি ধরার কেউ নেই।"
পরের পংক্তিটি সাংঘাতিক-
"তুমি পূব দিকে মুখ করে হু-হু করতে থাকো।"



উড়িষ্যার দীর্ঘ কথনকথাগুলির রচয়িতা ও শ্রোতা ছিলেন বিশেষত: কৃষক সম্প্রদায়। অনেকের মতে তার কারণ ছিল এইরকম-ধান বা অন্য শস্য মাড়াই করে কৃষকরা ক্ষেতেই জমা করে রাখতেন। রাতের দিকে চোরেরা আসত ওগুলো চুরি করতে। ক্ষেতে বসে চাষিরা যদি এই সব লম্বা লম্বা গল্পের আসরে জেগে থাকতেন, তবে চোর বুঝতে পারত ফসলের মালিক উপস্থিত ও সজাগ, চুরি করার সাহস হত না। স্বাভাবিক ভাবেই এই কাহিনীগুলি হত চিত্ররূপময় ও শ্রোতাকে দীর্ঘ রাত জাগিয়ে রাখার জন্য পর্যাপ্ত উত্তেজনায় ভরপুর।। তাছাড়া যারা পাহারা দেন তাঁদের মধ্যেও গল্প বলার রীতি ছিল। তীর্থযাত্রীরা তাঁদের দীর্ঘযাত্রার (অনেকসময়েই যা হত পদযাত্রা) ক্লান্তি ও একঘেয়েমি কাটানোর জন্য একে অন্যকে শোনাতেন এই সব লোককথা। কোন পর্ব বা উৎসব উপলক্ষে মন্দির প্রাঙ্গণে যখন জনসমাবেশ হত,সেখানেও পুরোহিত বা কথকঠাকুর শোনাতেন যুগযুগান্তর ধরে বহমান উড়িষ্যার প্রাচীন লোককথা।
উড়িষ্যা মন্দিরের রাজ্য,অনেক গল্পে ধরা আছে এইসব মন্দিরের অনামী শিল্পীদের জীবনের কথা।প্রাচীন যুগেওড়িয়া বণিকরা জাভা,সুমাত্রা,বালী ইত্যাদি দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করতেন।সমুদ্রযাত্রা,জলযান,বণিকদের পেশাগত জীবনের কাহিনী আছে অনেক লোককথায়।
তবে,দেশে দেশে যুগে যুগে যা হয়ে এসেছে,লোককথার সবচেয়ে পারদর্শিনী হন মা বা ঠাকুমারা।শিশুদের খাওয়ানো আর ঘুমপাড়ানোর সময় তাঁরা যেসব অপরূপ গল্প বলেন,তার কিছুটা শোনা,কিছুটা নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে রচনা। এই সব গল্প শুনে শুনে বাচ্চাদের একটা নিজস্ব কল্পজগত তৈরি হয়,মানসিক বিকাশ আর ভাবনাশক্তি ধীরে ধীরে বিকশিত হয়। মানবজীবনের নানা অনুভূতি ও বোধ্ ,দুঃখ,শোক , কান্না, ভয়,ভালোবাসা, সহমর্মিতা, সাহস আর মানবিকতার প্রথম পাঠ শেখায় এই গল্পগুলো।প্রতিবারই গল্প বলার সময় কথক কিছু সহযোজন করেন,কিছু বিযোজন করেন।মুখে মুখে চলে আসা এই গল্পগুলির কোন একজন বা দুজন রচয়িতা নেই,সকলেই এইসব আশ্চর্য কথিকার স্রষ্টা।
একটি বিস্ময় হল, এইসব উড়িষ্যার কৃষকরা বাস করেন গ্রামে, আর আদিবাসীরা পাহাড়ে ,অরণ্যে। সেখানে রাজারাণী, রাজকন্যা-রাজপুত্র-রাজপ্রাসাদ ,সওদাগর এসব কিছুই নেই। তাহলে কেন ওড়িয়া লোককথাগুলো রাজকীয় আড়ম্বরে অত্যুজ্জ্বল?!আসলে এইসব লোককথার পৃষ্ঠপট হল রাজা -রাণী, রাজকন্যা-রাজপুত্র-রাজপ্রাসাদের সঙ্গে অরণ্যের পাহাড়,নদী,পশু-পাখি-গাছ, , রাক্ষস-দেবতাদের সমাবেশে রচিত এক অনবদ্য রঙ্গমঞ্চ।
একজন সাধারণ মানুষ অনেক সময়েই জীবন নামের কঠিন প্রহেলিকার সামনে নতজানু হন, দুরূহ সব সমস্যা সমাধান করতে অক্ষম বোধ করেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হলে তার অস্তিত্ব বিন্দুর চেয়েও নগণ্য মনে হয় -এই সব মহাভয় থেকে উত্তরণের জন্য প্রায়শই তিনি অন্তহীন অপেক্ষা করেন এক কাল্পনিক সর্বশক্তিমান অরণ্যদেবের জন্য। এই গল্পগুলো ক্ষণিকের জন্য হলেও মানুষকে সেই শক্তিমানের স্পর্শ দেয়,অলীক রাজপুত্র ঘোড়ায় চড়ে ছুটে আসেন দুষ্টের দমন করতে। শ্রোতার মনে এই সব ইচ্ছাপূরণের গল্প চিরকালের জন্য গেঁথে যায়, বারবার একই গল্প শোনার পরেও চিরনতুন মনে হয়,কেননা, এই গল্প জীবন সমস্যার সমাধান দেয়,হলেই বা কল্পরাজ্যে ।

কিছু ওড়িয়া লোককথার নাম-রাজা যখন ঝাড়ুদার,ধর্মপদর আত্মবিসর্জন,কুঁড়ে মা কালিজাই,ব্রাহ্মণ,সুকেশিনী রাজকুমারী,চার উপদেশ ,রত্নাবতী,বনকন্যা দুইরাজপুত্র ইত্যাদি।সাধারণ মানুষ,রাজা রানী ও দেবতাদের সঙ্গেই ওড়িয়া লোককথায় উপস্থিত হয়েছে নানা জন্তুজানোয়াররা,যেমন হাতিরা যখন উড়তে পারত,রাজকুমারীর হস্তিস্বামী,মাছের হাসি,কানু আর মানু(গরুর নাম),যাদুর বলদ ইত্যাদি।
খুব সংক্ষেপে কয়েকটি গল্প বলি-
ধর্মপদ একটি কিশোর,তার জন্মের আগেই তার পিতা প্রখ্যাত স্থপতি বিশু মহারাণা চলে গিয়েছিলেন কোনারকের সূর্যমন্দির তৈরির কাজে।মায়ের স্নেহে লালিত ধর্মপদ যখন বারো বছরের হল,তখন সে বাবার সঙ্গে দেখা করতে বেরিয়ে পড়ল।দীর্ঘ পথ হেঁটে সে পৌঁছল বাবার কাছে,দুজনেরই আনন্দের অবধি রইল না।
কিছুক্ষণের মধ্যে ধর্মপদ জানতে পারল মন্দিরের প্রধান স্থপতি তার বাবা ও তাঁর বারোশো সহকর্মী রয়েছেন নিদারুণ উৎকণ্ঠায়,কারণ মন্দিরনির্মাণ প্রায় সম্পূর্ণ হলেও শীর্ষদেশে যে মুকুটমণিটি (কোথাও বলা হয়েছে সোনার কলস)বসানোর কথা ,তা বসানো যাচ্ছে না কোনমতেই।রাত ভোর হওয়ার আগেই এই কাজ টি সমাধা না হলে রাজা সকলের গর্দান নেবেন।ধর্মপদ মন্দিরের চারদিক ঘুরে ভাল করে স্থাপত্য কৌশল বুঝে নিল,তারপর উঠে গেল মন্দিরশীর্ষে।অক্লান্ত চেষ্টার ফলে মণিটি বসিয়ে কিশোর নেমে এল,পিতা আনন্দে তাকে জড়িয়ে ধরলেন।কিন্তু এই সুখ অতি অল্পক্ষণের ,অচিরেই ধর্মপদ পিতার সহকারীদের মলিন মুখ দেখে জানতে পারল,তাঁরা এতদিন ধরে যা করতে পারেন নি,এক অনভিজ্ঞ বালক অনায়াসে তা সুসম্পন্ন করেছে,এই খবর রাজার কানে পৌঁছলে প্রধান স্থপতি সহ সকলের প্রাণদণ্ড অবশ্যম্ভাবী।
ধর্মপদ আবার উঠে গেল মন্দিরচূড়ায় আর লাফিয়ে পড়ল নীচে,সূর্য অস্তাচলে গেল।
ঝাড়ুদার রাজার গল্প জগন্নাথ ভক্ত রাজা পুরুষোত্তমকে নিয়ে।রাজা মনে করতেন তাঁর রাজ্যপাটের প্রকৃত অধিকারী মহামহিম জগন্নাথদেব,তিনি সেবক মাত্র।প্রতিবছর রথযাত্রার দিন দিনি স্বর্ণমণ্ডিত ঝাড়ু দিয়ে জগন্নাথ ,সুভদ্রা ও বলরামের রথের পথ পরিষ্কার করতেন।
কাঞ্চী রাজ্যের রাজকন্যাকে দেখে রাজা মুগ্ধ হন, পাঠান।কিন্তু কন্যার পিতা রথযাত্রার দিন ভাবী জামাতার হাতে ঝাড়ু দেখে অত্যন্ত বিরক্ত হন ও বিবাহ বাতিল করে দেন,বলেন ,কোন "চন্ডালের" সঙ্গে তিনি কন্যার বিবাহ দেবেন না,।পুরুষোত্তম মনে করেন এ কেবল তাঁর অপমান নয়,স্বয়ং জগন্নাথদেবের অপমান।তিনি কাঞ্চী রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন,যুদ্ধে জগন্নাথ ও বলরাম তাঁর পক্ষাবলম্বন করেন।যুদ্ধ জয়ের পর পুরুষোত্তম কাঞ্চী রাজকন্যাকে বন্দী করে নিয়ে এসে তাঁর মন্ত্রীকে আদেশ দেন এই রাজ্যের কোন ঝাড়ুদারের সঙ্গে এই কন্যার বিবাহ দিতে।মন্ত্রী অবশ্য রাজকন্যাকে নিজের বাড়িতে লুকিয়ে রাখেন,রথযাত্রার দিন রাজা পুরুষোত্তম যখন পথ পরিষ্কার করছেন,তখন মন্ত্রী রাজকন্যাকে রাজার হাতে অর্পণ করে বলেন,মহারাজই তাঁর বিবেচনায় সর্বোত্তম ঝাড়ুদার.
মা কালিজাই- এর গল্প উড়িষ্যার সামুদ্রিক ঝড়ে এক বালিকার মৃত্যুর মর্মস্পর্শী কাহিনী। চিল্কার অনতিদূরে অবস্থিত বানপুরের এক দরিদ্র পরিবারের কন্যা ‘জাই’ । চিলকা হ্রদের মধ্যে অবস্থিত পারিকুদ গ্রামের এক যুবকের সঙ্গে ওই জাই এর বাল্যবিবাহ হয় । জাই বিবাহর পর বাপের বাড়ী আসে এবং যথাসময়ে তার বাবা জাইকে নিয়ে নৌকায় যাত্রা শুরু করে জাই-এর পতিগৃহের উদ্দেশ্যে । খুবই ছোট মেয়ে জাই কিছুই বুঝত না , বেচারি নৌকোয় কখন চাপেনি তবু সাহস করে বাবাকে আঁকড়ে ধরে নববধূ। হঠাৎ ভীষণ সামুদ্রিক ঝড় ওঠে ও ঝড়ের মাত্রা ক্রমে বাড়তে থাকে। জাই--এর বাবা মাঝিকে বলে, “ভল করি নাআ বা রে নাউরি ঝিওকু মাড়ুছি ডর” অর্থাৎ- ভালো করে নৌকা চালারে মাঝি , আমার মেয়ের ভয় করে । সেই সময় ঘূর্ণি ঝড়ের প্রকোপে নৌকো উলটে যায় এবং জাই চিলকাতে ডুবে যায় । মাঝি এবং জাই এর বাবা কোন মতে নৌকো ধরে ফেলে বেঁচে যায় কিন্তু জাইকে খুঁজে পাওয়া যায়না । 
কথিত আছে,এরপর থেকে ওই জায়গা দিয়ে নৌকো চালাতে মাঝিরা ভয় পেত কারণ প্রায়ই ওখানে নৌকো উলটে যেত এবং যাত্রীদের মৃত্যু ঘটত । ওখানে একটি ছোট্ট পাহাড় আছে,লোকে বলত সেখানে জাই এর অতৃপ্ত আত্মা ঘুরে বেড়ায় ও তার কান্না শোনা যায় । কোন লোক গেলে জীবন্ত ফেরে না সেখান থেকে । 


১৯৩০ এ ডঃ রাধা চরণ পাণ্ডা লিখিত “পারি-কুদের ইতিহাস” এ বর্ণিত আছে ; পারি-কুদের তখনকার রাজা জগন্নাথ মানসিং ওই পাহাড়ে র ওপর ১৭১৭ সালে জাইয়ের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এক মন্দির নির্মাণ করেন যার নাম “কলিজাই মন্দির” । এখানে “জাইকে” মা কালীর প্রতীক হিসেবে পূজো করা হয় । চিলকার প্রত্যেক মৎস্য জীবীরা কলিজাই এর পূজো করেন ।মকর সংক্রান্তিতে এই মন্দিরে মেলা বসে।
কলিজাই” এর এই প্রসিদ্ধ লোককথা উড়িষ্যার এক বিখ্যাত সাহিত্যিক পণ্ডিত গোদাবরিশ মিশ্র একটি সুন্দর কবিতায় লেখেন ।
জন্তুজানোয়ারদের নিয়ে রচিত লোককথাগুলিও কল্পনাশক্তি ও মানুষের ভালবাসার রসায়নে ভারী মনোগ্রাহী।হাতিরা যখন উড়তে পারত গল্পে জানা যায় তাদের চারটি ডানা ছিল এবং দেবতারাও তাদের পিঠে চড়ে যত্রতত্র যেতেন।কিন্তু বেচারা হাতিরা জানত না তাদের বিশাল শরীরের ওজন কতখানি।উড়তে উড়তে ক্লান্ত হয়ে তারা কখনো কোন বাড়ির চালে বসে পড়ত,কখনো অন্য ছোটখাটো জন্তুদের ওপর-তারপর কী হত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।ভগবান তখন হাতিদের এক বিশাল ভোজে নিমন্ত্রন করলেন।পেটভর্ত্তি নানা সুখাদ্য খেয়ে হাতিরা একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।তখন ভগবান তাদের ডানা কেটে দুটি ময়ূরের পিঠে ও দুটি কলাগাছের পাতা করে লাগিয়ে দিলেন।ঘুম ভেঙে হাতিরা ভীষণ রাগ করতে করতে বনে চলে গেল।
রাজকুমারীর হস্তিস্বামী গল্পটিতে কিন্তু হাতিস্বামীর ভূমিকা বিশেষ নাই।বনের সব পশুরা মিলে ঠিক করে সেই রাজ্যের অলোকসামান্যা সুন্দরী রাজকন্যার বিবাহ হোক একটি হাতির সঙ্গে।রাজকন্যা যে পুকুরে স্নান করতে আসতেন,সেখানে হাতিরা আগে ভাগে এসে শুঁড় ভাসিয়ে ডুবে থাকল,আর স্নান শেষে রাজকন্যাকে তুলে নিয়ে চলে গেল গভীর বনে। তারপর রাজকন্যার প্রেমিক এক রাজপুত্র বহু বাধাবিপত্তি পেরিয়ে রাজকন্যাকে উদ্ধার করে আনল।ফেরার পথে হাতির দল তাদের তাড়া করল,তখন রাজপুত্র এক সাপের দেয়া মণি মন্ত্রপূত করে মাটিতে রাখল, সেখানে তৈরী হল এক বিশাল নদী । হাতিরাও গাছের গুড়ি তুলে তুলে নদী পার হয়ে এলো। এবার রাজকুমার বাঘের দেয়া বাঁশের নলি মন্ত্রপূত করে মাটিতে রাখতেই তৈরি হয়ে গেল এক বিরাট বাঁশের দূর্গ। কিন্তু হাতিরাসেই দুর্গ ভেঙে ফেলল, আবার তাড়া করল। এবার রাজকুমার এক রাক্ষসের দেয়া হাড়টিকে মন্ত্রপূত করলো। প্রকাণ্ড এক আগুন ছড়িয়ে পড়লো বিশাল এলাকা নিয়ে। হাতিরা আগুনে ভয় পায়,তাই আর এগোতে পারল না।রাজপুত্র রাজকন্যাকে নিয়ে রাজ্যে ফিরে এসে তাকে বিয়ে করে সুখে থাকতে লাগল।
কিছু আনন্দের হাসি,কিছু চোখের জল,কিছু ঘুমপাড়ানি গান , কিছু প্রবাদ,কিছু প্রার্থনা, কিছু রাজারাজড়াদের কাহিনী,কিছু ধাঁধাঁ,কিছু সাধারণ মানুষের কথা জুড়ে জুড়ে এক একটি আশ্চর্য নকশী কাঁথার মত তৈরি হয়েছে উড়িষ্যার এইসব লোককথা। 
ভারী চমৎকার লাগে যখন হৃদয় বিগলিত করে গল্পের শেষ হয় একটি কবিতা দিয়ে,বাংলার একটি অতিপরিচিত কবিতার সঙ্গে যার সুন্দর সাযুজ্য-
‘ফুল গাছটা মুড়োলো, আমার গল্প ফুরলো/ হায় ফুল গাছ! কে তোমায় মুড়োলে?/ লাল পিঁপড়া আমায় কামড়ালো/ ওরে লাল পিঁপড়া, তুই আমায় কামড়া/ তবে আমার খোকন সোনাকে কেন?/ আমি মাটির নিচে থাকি আর কামড়াই/ যখনই কোন মিষ্টি-নরম মাংস পাই-----’
বাংলা ছড়াটি দেখুন-
"আমার কথাটি ফুরোলো/ নটে গাছটি মুড়োলো/ কেন রে নটে মুড়োলি?/ গরুতে কেন খায়?/কেন রে গরু খাস?/ রাখাল কেন চরায় না?কেন রে রাখাল চড়াস না/বৌ কেন ভাত দেয় না----"
শেষ করি ‘চার উপদেশ’ গল্পটি দিয়ে,এর কেন্দ্রীয় চরিত্র এক কুঁড়ে মানুষ,তাকে কিন্তু আমাদের মোটেই পছন্দ হয় না।
এক মহাত্মার দেওয়া চারটি উপদেশ মেনে অতি সামান্য অবস্থা থেকে সে বিরাট ধনী হয়।উপদেশগুলি হল -আয় করবে মেথরের মত, খাবে রাজারাজড়ার মত, সর্বদা-সর্বত্র বৌকে মিথ্যা বলবে আর আজীবন রাজার কাছে সত্য বলবে।’ 
কথক ঠাকুর গল্পটি শেষ করছেন এইভাবে-" আমি যখন তার কাছে গেলাম তখন সে কোন কথাই বলেনি আমার সাথে!!!"
উড়িষ্যার এইসব লোককথাকে অক্লান্ত পরিশ্রমে সংগ্রহ করে একত্রে প্রকাশ করা ও পুনর্জীবিত করে তোলার কৃতিত্ব Sri Gopal Chandra Praharaj, Dr. Kunja Behari Das, Sri Sridhara Das ,Dr Shanti Mohanty ইত্যাদি পণ্ডিতদের,তাঁদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি।
তথ্যসূত্র
Folk tales of Orissa-Shanti Mohanty,Sterling Publishers,
উড়িষ্যার লোককথা-দিদার মুহাম্মদ,Bangla Tribune,জুলাই,২০১৭।আন্তর্জাল 
Folk Tales of Orissa By Ganeswar Mishra-Vidyapuri Publication
ভারতজোড়া কথনকথা-সংকলন ও সম্পাদনা রামকুমার মুখোপাধ্যায়।মিত্র ও ঘোষ।


লেখক পরিচিতি-

শিক্ষা-বেথুন স্কুল,প্রেসিডেন্সী কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় রসায়নের ছাত্রী,কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন বিভাগে পি এইচ ডি করে বিবাহ ও চাকুরী সূত্রে দিল্লি আগমন।তিন দশকের ওপর দিল্লিবাসী।




পেশায় বৈজ্ঞানিক,কাজ করেছেন বিভিন্ন গবেষণা ও শিল্পসংস্থায়।বর্ত্তমানে একটি গবেষণা সংস্থায় মুখ্য আধিকারিক।বিশেষজ্ঞ হিসাবে  কয়েকটি সরকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত।

প্রথম ভালোবাসা -সাহিত্য।বিশ্বাস করেন, একমাত্র সাহিত্য পড়ার  জন্যই অমরত্ব তাচ্ছিল্য করা যায়।প্রবন্ধ,রম্যরচনা,গল্প ও কবিতা লিখেছেন।দিগঙ্গন,গুরুচন্ডালী,বর্ত্তমান,কথাসাহিত্য,সন্দেশ,সানন্দা,এই সময় ইত্যাদিতে লেখা প্রকাশিত হয়েছে।১৯৯০ সালে Childrens Book Trust আয়োজিত সর্বভারতীয় শিশুসাহিত্য রচনা প্রতিযোগিতায়  দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন।
দুই সন্তানের জননী,ভালবাসা-বই পড়া,আবৃত্তি,আড্ডা দেওয়া,বাগান করা।
    ল 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

  1. সংক্ষিপ্ত, কিন্তু সামগ্রিক আলোচনার লক্ষণ রয়েছে আলোচনাটিতে। পাঠককের জন্য শুধু তথ্য নয়, বিষয়টির প্রতি আগ্রহ তৈরি করার সনিষ্ঠ ও সফল প্রয়াস চোখে পড়লো। প্রত্যাশায় থাকবো অবিষ্যতে লেখক ওড়িয়া লোককথার আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে আমাদের নতুন লেখা উপহার দেবেন।

    উত্তরমুছুন
  2. কী ভালো লেখা! বিশেষ করে রাজার রাস্তা ঝাঁট দেবার গল্পটা। রেডিওতে একটা নাটক শুনেছিলাম এরকম, এক রাজা মন্দিরের চত্ত্বর ঝাড়ু দিতেন রোজ ভোরবেলা। এক ভোরে তিনি কৃষ্ণের নূপুর কুড়িয়ে পান। তারপর থেকে কপালে ওই নূপুর পরতেন। মুকুট আর পরতেন না। মানে কপালের উপরে মনে হয় নূপুর দু'খান কোনো কায়্দায় ঝোলাতেন, চুলে আর কানে হয়্তো দুই প্রান্ত আটকে দিতেন।
    আবার বলি, খুব ভালো লাগল লেখাটা, মুগ্ধ হয়ে বারে বারে পড়লাম। বিভিন্ন স্থানের লোককথায় কত মিল, ভাবলে অবাক হতে হয়।



    উত্তরমুছুন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন