ঝুমা চট্টোপাধ্যায় - মায়াজম

Breaking

১৬ জুন, ২০১৮

ঝুমা চট্টোপাধ্যায়

                                                         কালবিলাপ
Related image
................................................................................................................................................
লোক সাহিত্যের প্রথম শব্দটিই হল লোক। জনগণ। জন সাধারণ। আম আদমি। বাংলা গ্রামীণে ‘ নোক’ । শরৎচন্দ্রের উপন্যাস প্রবন্ধে ‘ষোলো আনা’ , রবীন্দ্র-বীক্ষণে ‘পনেরো আনা’। তামিল ভাষায় ‘পোতু’, চেক ভাষায় ‘জেরেনেক’, চীনা শব্দে ‘সানঞ্জি’ ইত্যাদি ইত্যাদি। গুহাবাসী নিয়ান্ডারথাল যখন দলবদ্ধ পশু শিকারের গুহাচিত্র অঙ্কন করছিল লোক সাহিত্যের শুরু বোধহয় সেই তখনই।

আদর্শ সভ্যতার মানদণ্ড কোনো কালেই নির্দিষ্ট হয় নি। কিন্তু যতদিন মানুষ উন্নতির শিখর ছেড়ে আরও ক্রমোন্নতির দিকে অনন্ত যাত্রায় দীর্ঘশ্বাস ছুটে যাবে ,ইতিহাসে পরতের পর পরত সভ্যতার পলি জমে নাভিমূল। সর্বাঙ্গে তলতলে মাটীর প্রলেপ পড়ে দেশ কাল সময়ে ঝিমিয়ে ওঠা হিউম্যান সাইকোলজি । শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি। সময়ের দীর্ঘ ব্যবধানে যার অস্তিত্ব এসে থিতিয়ে দাঁড়াবে ‘লোক সাহিত্য ‘ নামক সেই উপসংহারটিতে। এবং এইটিই সেই জায়গা যেখানে আজকের লোক জীবন কালকের (অতীত কালের) লোক সংস্কৃতি। লোক সাহিত্য সেই সংস্কৃতিরই বন কুসুমের আলোছায়া আধার। 

কিন্তু সব ছেড়ে খামোকা এই রুগ্ন শিল্পটিকে নিয়ে হঠাৎ মাথা ব্যথা কেন ? সাহিত্যটাহিত্য এমনিতেই বাতিলের জায়গায় চলে যাচ্ছে, সময় এখন ‘আমরা’ আর ;ওরা’কে নিয়ে তুমুল লড়াইয়ে...,বহতা জীবন ‘ শাড়িকে ফলসা কভি ম্যাচ কিয়া রে!, আনি মানি জানি না/ পরের ছেলে মানি না কিংবা আজ কি তাজা খবরের - ...

লোক সাহিত্য? সেটা আবার কি জিনিষ? খায় না গায়ে মাখে ?

এক দেশে এক রাজা ছিল। তার হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া, লোক লস্কর,সৈন্য সামন্ত। রানী সোনার খাটে শুয়ে রূপোর খাটে পা তুলে দিতেন। রাজ্যে চুরি নেই, ডাকাতি নেই। প্রজারা সুখে নিদ্রা যায় আর রাজার নামে ধন্য ধন্য করে। একদিন হল কি, রাজ্যে হঠাৎ শত্রু এসে হানা দিল। সৈন্য সামন্ত নিয়ে রাজা যুদ্ধ করলেন বটে কিন্তু শত্রুর কাছে একেবারে গোহারান হেরে গেলেন। রাজার সভাকবি এই যুদ্ধ, যুদ্ধের রীতি নীতি, প্রজাদের দুর্দশা সব কিছু কবিতার মত আকার দিয়ে লিপিবদ্ধ করে ফেললেন। কবি হাড়ি-পা। ইতিহাস বলছে এই কবির বর্ণনা পাঠ করলে সেকালের সাধারণ জন জীবনের কিছু কিছু জানতে পারা যায়। রাজা গোবিন্দচন্দ্রের সভাকবি ছিলেন ইনি। ডোম জাতীয় বৌদ্ধ যোগাচার্য্য। গোবিন্দচন্দ্র আনুমানিক ১০০৪ খৃঃ-এ বাংলাদেশে রাজত্ব করতেন। দাক্ষিণাত্যের চোল বংশীয় রাজা রাজেন্দ্র চোল যখন বাংলা জয় করে ফিরে যাচ্ছেন,বাংলার লোক জীবন ‘ হাড়িত ভাত নাহি নিতি আবেসি...’ । আজকের জন জীবন আগামীদিনের সাহিত্যের বিষয়। কালু-পা, কুক্কুরি-পা, ভুসুকু-পা,কানহ-পা লোক জীবনকে কি চোখে দেখতেন বা কেমন করে গল্পে কবিতায় উপজীব্য করতেন সেটা বড় কথা না। দুপুরবেলা মানুষ ডাল মেখে ভাত খাবে ,না , বিগ বাজারের ধামাকা অফার দেখবে এই সামাজিক পরিবর্তনটুকুই বহমান জীবনের সার। যেটা একমাত্র ধরা পড়ে লোক সাহিত্যে। এক অর্থে লোক সাহিত্য হল জীবন্ত ইতিহাস।
গান ও কথকতা ( পারমার্থিক ও অন্যান্য গান ,কবি গান{ শাক্ত ও বৈষ্ণব}, যাত্রা গান, কীর্তন গান,কথকতা ,উদ্ভট কবিতা , পল্লী অঞ্চলে ঠাকুমা দিদিমার মুখে মুখে প্রচলিত নানান কাল্পনিক লোক কাহিনী ইত্যাদি সবই লোক সাহিত্যেরই অন্তর্গত। বর কন্যার বিবাহ উপলক্ষে বাসর ঘরে গাওয়া গান, বিবাহের ছড়া ,‌ ছেলে ভুলোনো বা ঘুম পাড়ানী গান , মাঝ নদিতে ডিঙি বেয়ে গান গেয়ে যায় মাঝি – সেই উদাসী সুর ,লোক প্রচলিত কথা , উপকথা, মাঠ থেকে পাকা শস্য ঘরে তোলার সময় কৃষক বা কৃষক রমণী নানান সুরে নানান ছন্দে গান করেন, এগুলি সবই লোক সাহিত্যেরই শাখা । হিন্দুশাস্ত্রের মূল কথাগুলি সাধারণত ‘’কথক’’ নামক এক শ্রেণীর ব্রাহ্মণ ব্যাখ্যা ও পাঠের জন্য উচ্চ নীচ নির্বিশেষে সকলকেই প্রভাবিত করেছিলেন। এই ধরনের গান ও পাঠ তান্ত্রিক দেহতত্ব এবং বৈদান্তিক মায়াবাদের অপূর্ব সংমিশ্রণ। প্রাচীন বাংলা লোক কথা সাহিত্যে বাঙালী জন সাধারণের দান সামান্য নয়। এবং এই জন সাধারণের অধিকাংশই সমাজের নিম্ন স্তরের অশিক্ষিতরা । 
এবারে কিছু কবি পরিচয় দেওয়া যাক।কবি গানে , কবি অর্থাৎ প্রধান গায়ক মুখে মুখে গানের আসরে ছড়া বাঁধবে। পৌরাণিক নানান কূট প্রশ্নে দুই কবি গানের সুরে ও কথায় ‘পূর্ব পক্ষ’ ও ‘উত্তর পক্ষ’ একে অন্যকে পরাস্ত করবার চেষ্টায় শেষে গালাগালি পর্যন্ত করত। আনন্দময়ী ( ১৭০২ খ্রীঃ হরিলীলা গ্রন্থ প্রণেতা)—আলতার চিক পদে চাঁদের বাজার/হেরে সুর নারীগন কত বারে বার।/মাথা গলে করি উমা খেলিয়াছে ফুলে/সেউতি মল্লিকা যূথী চম্পক বকুলে(উমার বিবাহ)
গঙ্গামণি – জনক নন্দিনী সীতে হরিষে সাজায় রাণী/ শিরে শোভে সিঁথীপাত ...(সীতার বিবাহ)
কর্ত্তাভজা লাল শশী – মাতঙ্গ কত রঙ্গ বিহঙ্গ তরঙ্গ দেখি/রঙ্গে ভঙ্গে এই যে ভাঙা ডিঙে তরঙ্গে ডুবে আটকী
গোপাল উড়ে – কে করেছে এমন সর্বনাশ, /হল অরাজকে বাস।/আঁটকুড়ীর ছেলেদের জ্বালায় ,/ জ্বলি বারোমাস।/ ডাল ভেঙ্গেছে ...( ঝিঁঝিঁট আড়খেমটা , বিদ্যা সুন্দর)
কাঙ্গাল হরিনাথ – বাঁশের দোলাতে উঠে,/কেহে বটে, শ্মশান ঘাটে যাচ্ছ চলে/সঙ্গে সব কাঠের ভরা...
কৃষক রমণী কাবেল-কামিনী – আশমানে উঠেছে শ্যামার গায়ের আলো ফুটে/ তাই দেখতে সঙে সাঁঝের কালে লোক এল ...
পাগলা কানাই—এক বাপের দুই বেটা তাজা মরা কেহ নয়/ সকলেরই এক রক্ত এক ঘরে আশ্রয়।/ এক মায়ের দুধ খেয়ে এক দরিয়ায় যায়...
অজ্ঞাত পল্লীকবি – বঁধু তোমায় করব রাজা বসে তরুতলে/ চক্ষের জলে ধুয়ে পা মুছাব আঁচলে,/বনফুলের...
আলোয়ান –ননদিনী রসবিনোদিনী ও তোর কুবল সহিতাম নারী /ঘরের ঘরনী, জগত মোহিনী, প্রত্যুষে যমুনায় গেলি...
মির্জা হুসেন আলী—যারে শমন এবার ফিরি/এসো না মোর আঙ্গিনাতে দোহাই লাগে ত্রিপুরারি/ যদি কর জোর-জবরি(১৯শতাব্দীর গান)
মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র—অতি দুরারাধ্যা তারা ত্রিগুণা রজ্জুরূপিণী/ নাসরে নিঃশ্বাস পাশ...বন্দনে রয়েছে প্রাণী
ভারতচন্দ্র রায়, রামকৃষ্ণ রায়,দেওয়ান নন্দকুমার,রামনিধি গুপ্ত, দাশরথি রায়, কমলাকান্ত,রামপ্রসাদ,আজু গোঁসাই.........বিষয়গুলি হয়ত আরও সুন্দর করে গুছিয়ে বলা যেত কিন্তু চলমান সময় যখন যেটুকু এবং যেভাবে ধরা দেয়। 
পৃথিবীর অন্য সব দেশের লোক সাহিত্যের মত বাংলা লোক সাহিত্যও প্রাগৈতিহাসিক মানব গোষ্ঠী কর্তৃক সৃষ্ট, যখন তাদের অক্ষর জ্ঞান ছিল না,শব্দ জ্ঞান ছিল না অথচ মুখে মুখে নানান কল্প কাহিনী গল্প কথা নীতি কথা ইত্যাদির চল এক বহতা আঙ্গিক। তাই একক কোনও গোষ্ঠী বদ্ধ জীবন থেকে সৃষ্ট হলেও একটি নির্দিষ্ট ভৌগলিক প্রাকৃতিক স্বভাবজাত মিল সমস্ত জায়গার লোক সাহিত্যের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ঠিক যে বিশিষ্টতা , পৃথিবীর এক অঞ্চলের মানুষ জনের সঙ্গে আর এক অঞ্চলের মানুষদের অনেকানেক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও আবার কোথায় যেন একটা মিলও দেখতে পাওয়া যায়। এমন হওয়ার একটাই কারণ স্বভাবত লোক সাহিত্য হল মৌখিক সাহিত্য। এর ভাষা, স্টাইল , প্যাটার্ন ইত্যাদি যা কিছু গোষ্ঠী- অনুভূতি , গোষ্ঠী-সংস্কৃতি , গোষ্ঠী-প্রথা, নিয়ম কানুন মূল্যবোধ এসবের মধ্যেই , এসব কিছুকে জড়িয়ে মড়িয়ে। এবং মূল যে জিনিষটা, তা হল অতি সহজ সরল একটি বুদ্ধিময়তার বিচ্ছুরণ –লোক সাহিত্যের নান্দনিক সৌন্দর্য ঠিক এই জায়গাটাতেই। মুখে মুখে বয়ে চলা এক কাহিনী-কল্প। বাংলা লোককথা বাংলার জল হাওয়ার আবহমান স্রোত। দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ, চাওয়া- পাওয়া , বেঁচে থাকার নিষ্ঠুর দিকটি যদি কোনও গ্রাম্য বধূর কণ্ঠে গীত হয়, ‘বারোমাস্যা’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। উদয়াস্ত জলে জঙ্গলে নদী নালায় ডিঙ্গাখানি বেয়ে যায় মাঝি ,’ভাটিয়ালী’ শোনে নদী নদীর জল আকাশ বাতাস । দিনান্তের সূর্য , মাঠপারের ঘেঁটু ঝোপ ,ঘনায়মান নিবিড় সন্ধ্যার বুকে আঁকা হয় , ‘ভাওয়াইয়া’ । সুখ চাই অথচ সুখের দেখা নাই, তারে কোথায় পাই?- ‘বাউল’ বলে তোর মনের কথা উদাস মনেই রয়ে গেল ক্ষ্যাপা। তুই তার দেখা পেলি না! মুসলিম সংস্কৃতির প্রভাব বাংলা লোক সাহিত্যতে -কে যেন গো ডেকেছে আমায়..., পার্থিব যন্ত্রণার ঊর্ধ্বে উঠে সেই যন্ত্রণা ও দুঃখ নিয়ে তৈরি ‘জারিগান’, পবিত্র মহরমকে উদ্দেশ্য করে গাওয়া। পার্সি ভাষায় ‘জারি’র অর্থ ‘দুঃখ’।
বর্তমান প্রজন্ম বাংলা লোক সাহিত্যের লিখিত রূপ দেখতে পেয়েছে । এর গঠন ভঙ্গিমা , ভাষা বৈচিত্র্য , বিষয়ের রকমফের আমাদের কাছে অতি পরিচিত। জীবনের শুরুতেই শিশু পাঠ্যে আমরা লোক সাহিত্যের প্রাথমিক পরিচয় পেয়ে যাই। টুনটুনি আর রাজা ,ধূর্ত শেয়াল,বুদ্ধিমান কাক, অসুখী হংস – এদের সঙ্গে আমাদের কবেই ভাব হয়ে গেছে।গ্রামীণ সভ্যতায় সহজ অনাড়ম্বর জীবন যাত্রায় যে মিথ্যা ছলনা প্রবঞ্চনার স্থান ছিল না , এই গল্পগুলি শুধু যেন তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ । বুদ্ধি ও পরিশ্রমই যে সফল জীবনের চাবিকাঠি – বুদ্ধিমান কাকের কাজ টা মনে আছে ? সেই যে কাঠফাটা দুপুরের রোদে উড়তে উড়তে একটা কাক দেখতে পেল এক জায়গায় মাটির কলসির একদম নীচে সামান্য একটুখানি জল পড়ে। এদিকে তৃষ্ণায় তার গলা শুকিয়ে গেছে । কি উপায়? একটা একটা করে পাথরের ছোট ছোট টুকরো ঠোঁটে করে তুলে কলসির মধ্যে ফেলতে লাগল। কিছু পরে জল যখন ওপরে উঠে এল, কাক তা পান করল। এই নয় গল্পে যা বলা হচ্ছে তা সব সময় সত্যি, কিন্তু সত্যতা জিনিষটা যা নাকি ‘ইটারনাল’ , সেটা চিরকাল অবিকৃতই রয়ে যায়। কিন্তু এহ বাহ্য। এসব কল্প কাহিনী গুলো কিন্তু বহু বছর ধরে বংশ পরম্পরায় লোক মুখে ধারাবাহিক ভাবে চর্চিত,পঠিত,শ্রূত এবং অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি , যুগ যুগ ধরে এগুলো অবিকৃত। শিশুমনে এগুলোর বহু দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব। কথা হচ্ছে, এই গল্প এই সময়ে কতটা প্রাসঙ্গিক? যখন নাকি আমরা সময় এবং মানুষ , মানবিক মূল্যবোধ সবই হারাতে বসেছি, যেন তেন প্রকারেণ মানুষের কাঁধই ওপরে ওঠার সিঁড়ি ...কে হারিয়ে যাচ্ছে? আমি না আমরা ?অতীতের কত কিছুই কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। লোক কথার অতীত , অতীতের কথা , লোক ও লোকান্তর থেকে ছায়া ছায়া অশরীরীরা হাতছানি দিয়ে মিলিয়ে যায়। আমরা আমাদের অতীত কে ভুলেছি! ‘বাঙালি এক আত্মবিস্মৃত জাতি’ – মহাজনের এই উক্তি চিরকাল অমর রবে। 
‘’...... টুনটুনির কাণ্ড দেখে রাজা রেগে আগুন। তখুনি সেনাপতিকে হুকুম দিলেন এখুনি ঐ বজ্জাত পাখিটাকে বন্দি করো!
হুকুম পেয়ে সেনাপতি তাই করলে। টুনটুনি বন্দি হল। সোনার মোহর আবার রাজার টাঁকশালে ফিরে গেল। কিন্তু কি করে যেন সবার নজর এড়িয়ে টুনি আবার ফুড়ুৎ করে উড়ে পালাল। রাজার লোক আবার তাকে আনলে ধরে। রাজা বললেন , আন গরম জল! পাখিটাকে এবার গিলে খাব। জল এল। রাজা টুনিকে গিলে ফেললেন। কিন্তু পরক্ষণেই রাজার নাকের ফুটো দিয়ে টুনটুনি বাইরে বেরিয়ে উড়ে পালাল। রাজা বললেন , ধর ওটাকে! 
আবার জল দিয়ে রাজা পাখিকে গিলে ফেললেন। কিন্তু এবার একজন সৈন্য পাহাড়ায় দাঁড়িয়ে রইল। পাখি বেড়িয়ে এলেই এক কোপে তাকে কেটে ফেলা হবে। রাজার আদেশ। কিন্তু কি হল জান?যেই না রাজার নাকের ফুটো দিয়ে টুনটুনি বেরিয়ে পালাচ্ছে দেখে তাকে কাটতে গেছে, ভুল করে রাজার সেনা তরোয়ালের এক কোপে পাখির বদলে রাজার নাক কেটে ফেলল।
নাকের ব্যথায় রাজা তখন অস্থির। আর টুনটুনি? বাইরে বাগানে গাছের ডালে বসে দোল খাচ্ছে আর বলছে , নাক কাটা রাজা রে!
দেখতো কেমন সাজা রে! ‘’

প্রাচীন মিশর, ব্যবিলন,গ্রীস, রোম বাংলার শিল্পজাত দ্রব্যের আদর জানত। ঐতিহাসিক প্লিনী উল্লেখ করেছেন, ‘’রোমক ললনা প্রাচ্য সুচিক্কণ বস্ত্রের অন্তরাল
হইতে স্বীয় অঙ্গরাগ প্রকাশ করিতে ভালবাসেন’’। প্রকৃতি দেবীর কল্যাণে পল্লী বাংলায় অভাব খুব কম ছিল। এবং খুব আশ্চর্য হলেও সত্যি , রাজা রাজড়ার বিলাস ব্যসনের বাসনা চরিতার্থ করবার জন্য পল্লীতে পল্লীতে কুশলী শিল্পীদের আবির্ভাব। কথিত আছে, আওরঙ্গজেবের এক কন্যা উৎকৃষ্ট ‘আব্ রোয়ান’ বস্ত্র পরে পিতার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালে সম্রাট তাকে আবরুহীনা বলে ভৎর্সনা করেন। রাজকন্যা উত্তর করেছিলেন,’’তবু তো আমি সাতপুরু কাপড় পরে রয়েছি’’

এ ধরনের সূক্ষ্ম আব্ রোয়ান বাংলার তন্তুবায় সকল প্রস্তুত করত। ঢাকার ফুলতোলা জামদানী (তোড়াদার,বুটিদার,তেরছা,কারেলা,জল্বার,পান্না হাজার,দুবলি জাল), তুরন্দাম, নয়নসুখ,বদনখাস,কুমিস্,সব-নম,ঝুনা ইত্যাদি কার্পাস বস্ত্রের পুরো জগৎজোড়া চাহিদা ছিল। বিখ্যাত ঝুনা ছিল প্রায় মাকড়সার জালের মত সূক্ষ্ম। ছায়া বহুল গ্রাম্য পথের দুই পাশে কোথাও তন্তুবায়, কোথাও কামার বা কুমোর, কোথাও বা কাঁসারি বা স্বর্ণকার নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত। বিকেলে সমস্ত পথ আলোকিত করে গ্রাম্য বধূর জল আনতে যাওয়া... দুই হাতে তাদের বালা, কণ্ঠে চাঁদের মত হাঁসুলি।

একটা সময় প্রাচীন মুরুব্বিরা কাঠ চিনে নির্দেশ দিতেন কোন কাঠে উত্তম নৌকো প্রস্তুত করা যাবে। ক্ষুদ্রা, মধ্যমা, ভীমা,মন্থরা নদীতে চালাবার নৌকা। লো্লা, সত্বরা,জঙ্ঘলা,প্লাবিনী ইত্যাদি দশ প্রকার দীর্ঘা তরণী বৃহৎ নদী ও উপকূলে চালাবার জন্য নির্মিত হত। উর্দ্ধা , স্বর্ণমুখী , মধুকর সমুদ্রে চলাচল করত। চার মাস্তুলের জাহাজ সাদা , তিন মাস্তুলের গুলো লাল, দুই মাস্তুলের গুলো হলুদ এবং এক মাস্তুলের নৌকা গুলো নীল বর্ণে রঞ্জিত করা হত। দেশজ কাঠের এই সব নৌকোর অগ্রভাগ সিংহ , ব্যাঘ্র ,মকর বা হস্তী ইত্যাদির আকৃতি দেওয়ার রেওয়াজ ছিল।

উৎকৃষ্ট দেশজ শিল্পের নমুনা আরও অসংখ্য। সেকালের লোহার কাজ , কাঁসা পেতলের কাজ ,কাঠেরর কাজ , চামড়ার কাজ সবই বাংলায় হত। বাঙালি মুচির হাতের তৈরি ঘোড়ার সাজ ,যুদ্ধের উপকরণ চর্মের ঢাল ছিল সত্যি দেখার মত।

কথা হচ্ছে ,বঙ্গীয় সংস্কৃতি ও শিল্প নিদর্শনের নমুনা চিরকালই বাংলার বাইরেও কদর পেয়ে এসেছে । বর্ত্তমান যুগ হচ্ছে চিৎকার চেঁচামেচির যুগ। এতে অনেকের আপত্তি উঠবে। উঠুক। প্রত্যেকদিন বেঁচে থাকতে গেলে পরতের পর পরত ধুলো জমে। প্রত্যেকদিন সেই ধুলো পরিষ্কার করলে যা পড়ে থাকে , তাও ধুলো। মধুকর ডিঙা চড়ে সওদাগর বাণিজ্যে গেলেন সঙ্গে নুন মরিচ কাপাস বস্ত্র ময়ূরের পালক জামদানী উড়ানি। বিদেশে জিনিষপত্র কেনা বেচা হল। বৈদেশিক মুদ্রা হাতে এল। এবারে খুশি মনে সওদাগর গৃহে ফিরবেন । ফেরবার আগের রাতে নতুন পাতানো বিদেশী বন্ধুকে গল্প শোনাচ্ছেন – 
‘’ রাজার বাগানে এক গাছে এক টুনটুনির ছোট্ট বাসা । একদিন হয়েছে কি রাজার লোকেরা রাজকোষ থেকে মোহর এনে রোদ্দুরে শুকোতে দিয়েছে । শেষে একটি মোহর ঘরে তুলতে ভুলে গেছে । টুনটুনি ঠোঁটে করে সেই মোহর ......’’
হ্যাঁ , গল্প গান লোককথা এইভাবেই এক দেশ থেকে অন্য দেশে ডানা মেলে উড়ে যেত। তখন পৃথিবী অনেক নির্জন ছিল। একে অন্যকে দেবার মত মানুষের হাতে সময় ছিল। বানিজ্যকরণ বস্তুটাও ছিল উন্নতমানের শিল্প। শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির বানিজ্যকরণ। 
এখন চেঁচামেচিই সার ।
এবারে মোক্ষম কথাটি বলি। রায় বাহাদুর দীনেশ চন্দ্র সেন ( ১৮৬৬ – ১৯৩৯)
There are few people who haven’t been subjected to the command ,’’Tell me a story ‘’, and those who , on such occasions , find pleasure in trying to make other happy , to find something new to tell.
we need n’t enter the vexed question of the origin of folk tales. we may imagine that long before the introduction of the art of printing, primitive peoples sat by their blazing heaths reciting ... .but even in Greek tales we occasionaly come across the story of miraculous bird ‘tuntuni’, which had marvellous quality of ready wit.In many of the stories prevalent in different countries of Europe, we find animals supporting the leading characters.Western scholars are of opinion that these ‘‘strongly bear the impress of a remote Eastern originals’’. ( Folk = Literature Of Bengal )
...................................................................................................................................................................................................................................................................................................।।ঋণ স্বীকার
Folk Literature Of Bengal- Dinesh chondro Sen
Medival Bengal-Sukumar Sen
গৌড়ের ইতিহাস- রজনীকান্ত চক্রবর্তী
মধ্য-যুগের বাঙলা- কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়


লেখক পরিচিতি
ন্ম ও বেড়ে ওঠা পশ্চিমবঙ্গের শিল্প শহর দুর্গাপুরে। লেখালিখি করেন মূলত লিটল ম্যাগাজিনে। লেখালিখি করেন মূলত লিটল ম্যাগাজিনে।ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হচ্ছে কালিমাটি অনলাইনে তাঁর লেখা উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হচ্ছে


Show more reactions

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র