ঝুমা গঙ্গোপাধ্যায়

মায়াজম
4

                বাউল/ফকিরি, কিছু কথা 




লোকসাহিত্যের ধারাকে নদীর সঙ্গে তুলনা করলে দেখতে পাই তাতে কতো শাখা, উপশাখা। আবার কতো খাল, বিল, জলধারা এসে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। লোকসাহিত্যের বহুমুখী ধারার অন্যতম হলো বাউল ও ফকিরি গান। বাউলগানের সীমানা নির্ধারণ করা সহজসাধ্য নয়। তবে কয়েকটি অঞ্চলকে চিহ্নিত করতে পারি -- বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, নদীয়া ও বাঁকুড়ার কিছু অঞ্চল বাউলদের আবাস। বর্তমান কালের নদীয়া, মুর্শিদাবাদ/কুষ্টিয়া, যশোরে বাউল-ফকির পরম্পরা আজও বর্তমান। নদীয়া ও মুর্শিদাবাদের কিছু অংশে আজও এই ভাবধারার সাম্যে উজ্জীবিত । এখানেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সাধক বাউল ও ফকির রয়েছেন। বহু বিখ্যাত গীতিকার এই অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেছেন। তবে ফকিররা পেশাদারি গানে এলেও তাঁরা নিজ ডেরাতেই অবস্থান করে ধ্যানে মগ্ন থাকেন।
বাউলের সাথে শান্তিনিকেতনের মেলবন্ধন ঘটান বোধহয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁরই প্রবল উৎসাহে গড়ে ওঠে পৌষমেলা ও বাউলগানের সগর্ব উপস্থিতি। বহু বাউলকে এই মেলা স্বীকৃতি দান করেছিল। তবে বাউলগানের ধারা যেভাবে বিশ্বমানে স্বীকৃতি লাভ করেছে, ফকিরগান সে জায়গায় যেতে পারেনি। বাউলদের তুলনায় ফকিরদের অবস্থাও খারাপ। শরিয়ত মানে না বলে ফকিরদের নিপীড়িত হতে হয়। ফকিরি আসলে একটি সাধনপন্থা যেখানে ধ্যান, জপতপ, জিকিরের কাজ বেশি। বাউলদের আবার সুরের সাধনা। অনাড়ম্বর ফকিরি আজও উপেক্ষিত। তবে কোথাও কোথাও দুই যেন মিলেমিশে একাকার। বাউলগান আমাদের লোকসাহিত্যের সম্পদ। এ সম্পদের এতো বড়ো ভাণ্ডার চারিদিকে ছড়িয়ে আছে যে তার সংঘবদ্ধ রূপ আমরা পাই না। লালন, পাঞ্জু শাহ, হাসন রজা, আর্জান শাহ এসব বিখ্যাত মানুষদের গান সংকলিত অবস্থায় পেলেও বহু বিখ্যাত বাউলগীতি অগ্রন্থিত রয়ে গেছে। কয়েকজন বিখ্যাত মানুষের গান নীচে দেওয়া হলো...
শোষিত মানুষের প্রতিবাদ পাই লালনশিষ্য দুদ্দু শাহ-র গানে,
এ দেশে জাত বাখানো সৈয়দ কাজী দেখিরে ভাই
যেমন বঙ্গদেশে ব্রাহ্মণ সবাই
ব্রাহ্মণের দেখাদেখি
কাজী খোদকার পদবী রাখি.......
আবার হরিপদ গোঁসাই-এর গানে পাই অন্তর্নিহিত অর্থ,
যাস নারে তুই হুরার পুকুর পার।
সেই পুকুরের জলের পারে
মাছরাঙায় মানুষ মারে
দেখলে জীবের জ্ঞান থাকে না আর।
সর্বধর্মসম্মিলন দেখি আশানন্দন চট্টরাজের গানে,
আমি মরছি খুঁজে সেই দোকানের
সহজ ঠিকানা--
যেথা আল্লা-হরি-রাম-কালী-গড
এক থালাতে খায় খানা।
কোনো এক অজ্ঞাত বাউলকর্তা দরদ দিয়ে গেয়ে ওঠেন---
প‍র বিনা জগতে কে আপন
পরের জন্য যার প্রাণ কাঁদে
সেই তো জানে পরের মন।
মুহম্মদ শাহ-র অপূর্ব ফকিরগান--
মুখে কেবল আল্লাহ বলা হয়
আল্লাহ কোথা আমি কেবা হল না তার পরিচয়---
আপন কাছে না দেখিয়া দেখে বেড়ায় জগৎময়।
আমরা যতই বা যেভাবেই বাউল বা ফকিরি গানের বিষয় নিয়ে চর্চা করি, এই গানগুলির রচয়িতারা বিদ্বজ্জন নন। তাই তাঁরা ধারাবাহিক সাহিত্য রচনার অন্তর্ভুক্তি লাভ করেননি। যদিও তাঁরা একত্রিত হন গানের ভাবের আড়ালে তাঁদের প্রতিবাদী চেতনা ও মানবধর্ম সমন্বয়কে তুলে ধরতে। তাঁদের লোকায়ত ভাবনাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এইসব গানগুলিতে। এখান থেকেই আমরা তাঁদের জনজীবন, রীতিনীতি, আচরণবাদের সম্যক পরিচয় লাভ করি। কিন্তু ফকিরি গানে সেই অস্ফুট, গোপন জগৎ সম্পর্কে আমরা সামান্যই জানতে পেরেছি। সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে পেছনে ফেলে এইসব গান এগিয়ে গেছে মানবতার সেই খনির সন্ধানে। বাউলমনের সেই গোপন ডেরাকে তাঁরা হাজির করতে চেয়েছেন সঙ্গীতের মূর্ছনায়।
“সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে---
লালন কয়, জাতির কী রূপ, দেখলাম না এই নজরে।।
কেউ মালা কেউ তসবীহ্ গলে
তাই তো রে জাত ভিন্ন বলে
যাওয়া কিম্বা আসার বেলায়
জাতের চিহ্ন রয় পড়ে...”
ভদ্র শিক্ষিত মার্জিত রুচিবোধের তথাকথিত সাহিত্যধারা যেখানে এগোতে পারেনি, লোকসাহিত্যের এক ক্ষীণধারায় আজও সেই মানবতার কথাই প্রতিফলিত। নিম্নবর্গীয় হিন্দু অথবা মুসলিমরা তাঁদের নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন এই সমস্ত গান যা লোকসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। তথাকথিত শিক্ষিত জ্ঞানীগুণী জনের রচনা না হলেও এতে লুকিয়ে আছে জীবনের গভীর দর্শন ও চেতনা। উচ্চ-নীচ জাতিভেদের ঊর্ধ্বে গিয়ে তাঁরা যে জীবনবোধের পরিচয় দিয়েছেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়।



লেখক পরিচিতি
পেশা- শিক্ষকতা।ভালোবাসি পড়তে ও লিখতে।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

4মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

  1. চমৎকার লিখেছ ঝুমা। খুব সুন্দর !

    উত্তরমুছুন
  2. বেশ সুন্দর উপস্থাপন ঝুমা । ভালো লাগলো মনোরম এই রচনা @ রাজেন্দ্র

    উত্তরমুছুন
  3. অল্প পরিসরে বেশ ভাল হয়েছে। তবে কিছু কথা এই লেখা প্রসঙ্গে বলতেই হয়। বাউল এক সাধন মার্গ। এই মার্গের মূল কথা মানুষ রতনের মাঝে পরম ঈশ্বরের খোঁজ। তাই আমরা বাউল গানের মধ্যে দেখি একটা মানুষ রতনের জন্য আকুলতা। বাউল গান প্রধানত দেহতত্ত্বের গান। পাশাপাশি ফকিরী গানেও দেখি মানুষ রতনের মাঝে পরম করুণাময়ের খোঁজ। তাই আজ বাউল ফকির সমার্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। আর সুরের মধ্যেও প্রভেদ দেখা যায় না। প্রতিবাদী চেতনায় নেই কোনো পার্থক্য। শুধু যে পার্থক্য চোখে পড়ে তা হলো সামাজিক অবস্থান। বাউল যেমন সমাজে স্বীকৃতি পেয়েছে কিন্তু ফকিরের আজও সামাজিক স্বীকৃতি নেই। তারা আজও সামাজিক উৎপীড়নের স্বীকার হয়েই চলেছে। এ বড়ো লজ্জার। বাউল ফকিরের গানে মানুষ রতনের বন্দনা আমাদের প্রানিত করে কিন্তু আমরা কবে ফকিরের উপর যে অত্যাচার মাঝে মাঝে নেমে আসে তার বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদ গড়ে তুলবো?


    উত্তরমুছুন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন