ফাল্গুনী ঘোষ

মায়াজম
0

                       অলক্ষ্মী_বিদায়



ক্ষ্মী কথাটির মধ্যেই যেন বেশ একটু নরম, পোলেব,মোলায়েম, স্নিগ্ধ হাবভাব আছে। আরামপ্রিয়, দুধেভাতে, শান্তশিষ্ট বাঙালির তাই লক্ষ্মী প্রিয় হওয়াই স্বাভাবিক। ঘরের ‘মা’, ‘মেয়ে’, ‘বউ’কে সে লক্ষ্মীলাভে কল্পনা করেছে। কিন্তু ইতিবাচক দিকের অন্যপিঠে ‘অলক্ষ্মী’ না থাকলে ‘লক্ষ্মী’ এতটা মূল্যবান হয়ে উঠতেন কিনা ভাবার বিষয়। ঠিক যেমন ‘কালো’, ‘অন্ধকার’- সাদা আর আলোকে মূল্য ধরে দেয়। তেমনই লক্ষ্মীর পাশাপাশি অলক্ষ্মীও আম বাঙালির মনে জাঁকিয়ে বসলেন তাঁর নেতিবাচক রূপ নিয়ে। কালী পুজো বা দীপান্বিতার দিন সমগ্র বাংলাদেশে অনেক বাড়িতেই ‘অলক্ষ্মী বিদায়’ হয়। পুজো বলে না কারণ পুজোর মধ্যে সম্মান, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা দেখানোর ব্যাপার থাকে। কিন্তু ‘অলক্ষ্মী’কে কেই বা ভালোবাসবে! 
এখন মনে উঁকিঝুঁকি দেওয়া সব থেকে বড় প্রশ্ন হল আদৌ কি অলক্ষ্মী কোনও দেবী? না কি আমাদের মনগড়া ভয় ‘অলক্ষ্মী’র রূপ ধরেছে! এটা কি শাস্ত্রীয় ব্রত না কি ষষ্ঠীর মতো মূলত অনার্য ব্রত, যেখানে শাস্ত্র ঢুঁ মেরেছে। অলক্ষ্মীর জন্ম সংক্রান্ত একাধিক শাস্ত্রীয় বিধানে দেখা যায়, প্রজাপতি ব্রহ্মার মুখ থেকে ‘লক্ষ্মী’ আর পৃষ্ঠদেশ থেকে ‘অলক্ষ্মী’ জন্ম নিয়েছেন। অন্য একটি উপাখ্যানে সমুদ্র মন্থনের সময় উভয়েরই জন্ম। তবে অলক্ষ্মী(জ্যেষ্ঠা)লক্ষ্মী (শ্রী)র জ্যেষ্ঠা। বাসুকি নাগের মুখনিঃসৃত কালকূট বিষ থেকে জেগে ওঠার কারণে মনে বিষের ভাঁড় নিয়ে যে ঘরে অলক্ষ্মী পা দেয়, সেখানে ছড়িয়ে পড়ে ভাইয়ে ভাইয়ে, পরিবারের লোকেদের মধ্যে ঈর্ষা ও দ্বন্দ্বের কটূতা। কুলবিনাশ হয়। কল্কিপুরাণ ও মহাভারত কথিত দৈত্য কলির দ্বিতীয় স্ত্রী এই ‘অলক্ষ্মী’ শাস্ত্রে সে কারণে দুর্ভাগ্যের দেবী বলেই পরিচিতা হলেন। 
বাস্তব জীবনে আমরা ডানপিটে, গৃহকর্মে অনিপুণা, স্বভাবে অগোছালো কুরূপা মেয়েদের অলক্ষ্মী মনে করি। শাস্ত্রেও তাঁর বর্ণনায় ‘গোরু খেদানো, হরিণের মতো পদবিশিষ্ট, বৃষের মতো দন্তযুক্তা’ বলা হয়েছে। শুকনো দেহ, তোবড়ানো গাল, পুরু ঠোঁটবিশিষ্ট কুচকুচে কালো রঙের এই দেবীর বাহন গাধা বা কাক। হাতে থাকে কুলো বা ঝাঁটা। অন্যদিকে আবার দশমহাবিদ্যা’র অন্যতম বিধবা, দারিদ্র্য, বিষণ্ণতা ও দুঃখকষ্টের দেবীমূর্তি ধূমাবতীর সাথে মারী, দুঃখের দেবী নিঋতি এবং মন্দভাগ্য ও দারিদ্র্যের দেবী অলক্ষ্মীর মিল পাওয়া যায়। শক্তিসংগম তন্ত্র গ্রন্থের কাহিনী অনুযায়ী, সতী দক্ষের যজ্ঞকুণ্ডে আত্মবলিদানের উদ্দেশ্যে ঝাঁপ দিলে সতীর পোড়া দেহের কালো ধোঁয়া থেকে ধূমাবতী উত্থিতা হন। কেন বিধবা—তার ব্যাখ্যায় পাওয়া যায়—একসময় সতী শিবের কাছে অন্ন প্রার্থনা করলে শিব তা দিতে অক্ষম হন। তখন রাগে সতী শিবকেই কড়মড়িয়ে চিবিয়ে খান। এই জটিল অবস্থা থেকে শিব নিষ্কৃতি চাইলে শিবকে উগড়ে দেন। শিবের তালাক আর অভিশাপে সতী হয়ে যান শিবের বিধবা। ‘স্বামীখাকি’ গালাগালির উৎপত্তি সম্ভবত এখান থেকেই! 
তবে ধূমাবতী ও অলক্ষ্মীর মিল উভয়ের হাতেই ঝাঁটা, কাকের সঙ্গে যোগসাজসটা উপরি পাওনা। মনে করার কারণও আছে—সারদাতিলক তন্ত্র গ্রন্থের টীকাকার লক্ষণ দেসিকা ধূমাবতীকে দেবী জ্যেষ্ঠার অপর রূপ বলে উল্লেখ করেছেন। দেবী জ্যেষ্ঠা হলেন লক্ষ্মী বা শ্রী’র বিপরীত শক্তি অর্থাৎ কিনা সেই ‘অলক্ষ্মী’। রাত্রির অন্ধকারে ঘরের বাইরে কুলোর বাতাস দিয়ে ও ছাই উড়িয়ে বিদায় হন অলক্ষ্মী। আসলে কাক পুড়িয়ে শত্রুর ঘরে ছড়িয়ে দিয়ে শত্রুকে নিকেশ করতে হয়- ধূমাবতীর এই পুজো পদ্ধতি থেকেই ধোঁয়া ও ছাই ওড়ানোর ব্যাপারটি প্রচলিত। তাছাড়া শাস্ত্রোক্ত ধূমাবতীও তো ধোঁয়া নির্গত না হলে তুষ্ট হন না। শত্রুবিনাশই এই দেবীকে তুষ্ট করার একমাত্র উদ্দেশ্য। যাতে অশান্তি, ঝামেলার উৎপাতে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে হাহাকার না নেমে আসে তাই ‘এসো মা লক্ষ্মী, বস ঘরে’— অলক্ষ্মী বিদায়! 
সমগ্র ভারতবর্ষের হিন্দু সংস্কৃতির কথা হালকা করে ছেড়ে রাখলেও বাঙালির পুজো পার্বণে যে লোকাচার আর শাস্ত্রচর্চায়ের মেলবন্ধন ঘটেছে প্রতিনিয়ত সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। হয়ত ‘অদৃষ্টেরে হাস্যমুখে করব মোরা পরিহাস’ বলার মতো ধক বাঙালির ছিল না। সুতরাং লক্ষ্মীর বিপরীতে অলক্ষ্মী। লক্ষ্মী যে কৃষিউৎসব। আদিম প্রবৃত্তি। তাহলে শাস্ত্রের লক্ষ্মীর আবির্ভাবের আগে কোন লক্ষ্মীর পুজো হত? বাংলার নিজস্ব ব্রতগুলিতে ডুব দিলে দেখা যায় ‘গারসি’ ব্রতের নাম। লোকমুখে ‘গারুসংক্রান্তির ব্রত’ নামেও পরিচিত। মূলত হেমন্তে ধানের শিষে দুধ সঞ্চয়নমূলক একটি অনুষ্ঠান। পাশাপাশি মশা মাছি, রোগ জীবাণুকে খেদিয়ে হেমন্তের রুক্ষতায় প্রাণসঞ্চারের আশাও যেন লুকিয়ে থাকে। আশ্বিন সংক্রান্তির সকাল থেকে শুরু হয়ে একমাস চলে ব্রতের রেশ। খেসারির ডালের সাথে পাঁচরকম সবজি মিশিয়ে রাঁধা হয় গারুর ডাল। ব্রতের দিন স্নানের আগে কাটা সবজি টুকরোগুলি দাঁত দিয়ে কেটে পিছনের দিকে না তাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে বলা হয়—
“বুরা গিয়া ভালা আ
অলক্ষ্মীকে তাড়াইয়া লক্ষ্মী আ
যা যা মশা মাছি উইড়া যা 
আমগো বাড়িত্যে অমুকের বাড়ি জ্যা।“


এছাড়াও ফসল যাতে ভালো হয় তার জন্য কাঁচা হলুদ, শুন্দি বেঁটে সরষের তেল দিয়ে ধান গাছে মাখিয়ে দেওয়া হয়। ব্রতের অঙ্গ হিসেবে সন্ধ্যে হলেই পোকামাকড় আকৃষ্ট করার জন্য ঘরের বারদরজায় জ্বলে ওঠে আকাশবাতি। আশ্বিন সংক্রান্তি থেকে একমাস ব্যাপী ‘আকাশপ্রদীপ’ দেওয়ার উৎসটা বোধহয় এখানেই। 
এই লোকাচার সম্পূর্ণ ভাবেই জনজীবনের কথা ভেবে। শাস্ত্রের লক্ষ্মী এখানে নাক গলাতে পারেননি। কারণ কৃষিপ্রধান দেশে এটি সম্পূর্ণরূপে একটি শস্যকেন্দ্রিক অনুষ্ঠান। গ্রামে ঘরে এখনও মুঠি আনা, তিন খণ্ড লক্ষ্মীর পুজো হয়ে আসছে। আর সর্বসাধারণের জন্য রইল আর্য শাস্ত্র ও অনার্য লোকাচারের মেলবন্ধনের কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো। শস্যকেন্দ্রিক লক্ষ্মীর অনার্য অংশটি লক্ষ্মী অলক্ষ্মী পুজোর অলক্ষ্মী অংশে জায়গা করে নিল। অবনঠাকুর এই ‘অলক্ষ্মী’কেই বলেছেন অনার্য বা অন্যব্রতদের লক্ষ্মী বা শস্যদেবতা। (বাংলার ব্রত) 
“পাড়াগাঁয়ে মেয়েরা অলক্ষ্মী বিদায় নিজেরা করে না; পূজারিকে দিয়ে এ কাজ সারা হয়। এই অলক্ষ্মীই হলেন অন্যব্রতদের লক্ষ্মী বা শস্যদেবতা। শাস্ত্র নিজেদের মা লক্ষ্মীকে এই প্রাচীনা লক্ষ্মীর স্থানে বসিয়ে অলক্ষ্মী নাম দিয়ে কুরূপা- কুৎসিত বলে একে ছেঁড়া চুল ও ঘরের আবর্জনার সঙ্গে বিদায় দিতে চাইলেন। মেয়েরাও ব্রহ্মকোপের ভয়ে অলক্ষ্মীর পুজোর জায়গা বাইরেই করলেন এবং যথাবিধি পূজা করা বা না-করার দায় দোষ সমস্তই পূজারিকে নিতে হল এবং তখনকার হিন্দু পরিবারে ব্রাহ্মধর্মের শালগ্রাম ফেলার মতো তখনও একটু যে গোলযোগ না হল তা নয়। মেয়েরা পূজারির কথা শুনে প্রাচীনা লক্ষ্মীকে বেশি রকম অপমান করতে ইতস্তত করলেন। এখন অলক্ষ্মীই বলি আর যাই বলি, একসময়ে তিনি তো লক্ষ্মী বলেই চলেছিলেন, কাজেই তাঁর কতকটা সম্মান ধূর্ত পূজারি বজায় রেখে মেয়েদের মন রাখলেন; নিজেরও মনে অলক্ষ্মীর কোপের ভয় না-হচ্ছিল তা নয়; ঘরের বাইরে হলেও মা লক্ষ্মীর আগে অলক্ষ্মীর পূজা হবে, স্থির হল।“ 
সবথেকে মজার কথা হল গ্রাম বাংলার তিনখন্ড লক্ষ্মীর পিটুলি দিয়ে তৈরি সবুজ, হলুদ, লাল এই তিন রঙের পুতুল আর অলক্ষ্মী বিদায়ের মেয়েদের মাথার খানিকটা ছেঁড়া চুল—এই আদি লক্ষণগুলি পৃথিবীর অন্য প্রান্তে মেক্সিকোর পুরাণ গাথায় খুঁজে পাওয়া যায় মেয়েদের কেশের মতো গোছা আর লম্বা শস্যের কামনায়—
“The women of the village wore their hair unbound and shook and tossed it, so that by sympathetic magic the maize might take the hint and grow correspondingly long” ( Myths of Mexico and Peru)
আর তিন দেবী মেক্সিকানদের শস্যের রক্ষা করে—অপক্ব, অর্ধপক্ব, পরিপূর্ণ পক্ব অবস্থায় সবুজ, হলুদ ও লালের প্রতীকে। তবে পুরুত ঠাকুররা নিজেদের প্রয়োজনে ব্রতকথা আর মন্ত্রকে এমন পরিবর্তন করলেন যে তা দেখে বোঝবার উপায় রইল না এটা আসলে তিন ধাপে অফলন্ত, ফলন্ত এবং সুপক্ব শস্যের উৎসব। 
সব মিলিয়ে মনে কিলবিলে প্রশ্ন কালীপুজোর রাতটিকেই বা কেন বেছে নেওয়া হল এই লক্ষ্মী-অলক্ষ্মী পুজোর জন্য, অলক্ষ্মী বিদায়ের দিন হিসেবে! আশ্বিনের পর কার্ত্তিক অগ্রহায়ণে পাকা ধানের সুবাসে গ্রাম ঘরের আনাচ কোনাচ ভরে উঠবে, বহু ব্রীহি ছড়িয়ে মানুষ ভরন্ত হয়ে উঠবে, এই আশায় মন দোদুল। আশ্বিনের পরে কার্তিকের অমাবস্যার ক্ষণটিকেই তো বেছে নিতে হবে আপদ বালাই দূর করার জন্য- অন্ধকার সরিয়ে আলো জ্বালা এও তো মনের অন্ধকার দূর করার প্রতীক। মনের মধ্যেই সু-কু’র অবিরত দ্বন্দ্ব। লক্ষ্মী-অলক্ষ্মীর অদৃশ্য দড়ি টানাটানি। সুখ সৌভাগ্যের আলোর তলায় যেন ঈর্ষা আর অহং ছায়া ফেলতে না পারে সেই কামনায় দুধে ভাতের বাঙালি মনে প্রাণে মা-বউ-মেয়ের রূপে লক্ষ্মী নাম জপে অলক্ষ্মীকে বিদায় করে।





লেখক পরিচিতি
প্রবন্ধ বা নিবন্ধ লেখার আগ্রহ এবং উৎসাহ অনেক দিনের। কথক প্রকাশন থেকে দুবছর আগে বেরিয়েছে প্রবন্ধের বই 'প্রবন্ধে চেতনা ও চিন্তাচর্চা'। গত একবছর ধরে অন্য ধারার লেখালিখির সুত্রপাতও ঘটেছে। পেশায় শিক্ষিকা ফাল্গুনী ঘোষ, বাংলার লোকসংস্কৃতির প্রতি বিশেষ আগ্রহী। শাস্ত্রের অলক্ষ্মী বা জেষ্ঠ্যা বাংলার কোন কোন লোকাচারের মধ্যে মিশে গেলেন এবং কিভাবে দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের সাথে সংযোগসূত্র গাঁথা হল 'অলক্ষ্মী বিদায়' তারই ছোটোখাটো ইতিহাস বলা চলে।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)