সায়ন্ন্যা দাশদত্ত । - মায়াজম

Breaking

১৬ জুন, ২০১৮

সায়ন্ন্যা দাশদত্ত ।

                    গাছ হারিয়ে যায় 


Related image

****************
হাপু গানের দল ।

***************

ছোটবেলার একটা দুপুরের কথা মনে পড়ে ।আমাদের মামাবাড়ির তিনতলার বারান্দার নিচে ছোট্টমতো একখানা ডালভাতের নিরামিষ হোটেল চলত । এক বুড়ো ছিল মালিক ।বেলা তিনটে বাজলে একখানা কালো কুচকুচ বঁটি সামনে নিয়ে একটি কমবয়সী ছোকরা ঘ্যাঁস-ঘ্যাঁস করে নানানরকম সবজি কাটত বালতি ভরে । সবজির নেশায় এক আধটি নধর গরু দাঁড়িয়ে রইত সামনে । ভিন-ভিন মাছি ।আরো বিকেল বাড়লে টুকটাক লোকজন জড়ো হয়ে চায়ের ঠেক হতো একখানা ,খানিক দূরে ।বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেসব বিচিত্র মানুষজন ,ঠুনঠুন রিকশা ,সাইকেল অথবা দু একজন ফেরিওয়ালা দেখার মজাই ছিল অন্য । এক দুপুরে ,কি যেন কারণে খাওয়াদাওয়ায় দেরি হবে সেদিন ।মা ব্যস্ত ঘরের কাজে ।আরো যেন লোকজন এসেছে ।আমরা খুচরোখাচরা ছেলেপুলের দল বারান্দায় চিবুক ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছি চুপটি করে ।পথঘাট ফাঁকা ।লোকজন কম ।দু একটা ষাঁড় মহিষ গাছের নিচে ঘুমিয়ে রয়েছে চুপচাপ । 
হটাৎ একটা বিচিত্র গান চোখে পড়ল ।চোখে পড়ল বলার কারণ গানটি কেবল শোনার নয় ,দেখারও ততখানিই ! বিচিত্র এক কালো নোংরা মহিলা ।কাঁখে একটি শিশু ।কাঁধে একটি ঝোলা ।পায়ে চওড়া ঘুঙুর ,যদিও নোংরা এবং ছেঁড়াখোঁড়া । অদ্ভুতভাবে গান গাইছে চেঁচিয়ে ।তালে তালে ঘুঙুর নাড়ছে পায়ে ।আর সঙ্গের একটি ছেলে ,বছর বারো বয়স হবে হয়ত ।সে ওই গানের সাথে সাযুজ্য রেখে সপাং সপাং বেত মারছে পিঠে । ছেলেটির পরনে খাটো একটি ময়লামতো ধুতি । বাকি শরীর অনাবৃত । দু'পায়ে সরু করে আলতা পরা আছে । ছেলেটির বেত মারার কায়দাটি অদ্ভুত ।শরীরটা সামান্য নুইয়ে একটা অদ্ভুত কটকট শব্দ দিচ্ছে মুখে তারপর নৃশংস মার ।পিঠে সারসার দাগ ,কালশিটের মতো ।দেখলে কেমন গা শিরশির করে !
মুর্শিদাবাদ ,বর্ধমান ,বীরভূম ,মেদিনীপুর ,বাঁকুড়ার মফস্বল বা গ্রামাঞ্চলে এখনো দেখা মেলে এদের ।বাজিকর,বাইতি ,মাল ,পটুয়া সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের মধ্যেই এই গানের চল বেশি ।এরা কিয়দংশ যাযাবরের মতো জীবনযাপন করেন ।ভ্রাম্যমাণ সংসার ,সন্তান নিয়ে ঘুরে বেড়ান পথেঘাটে ।মূলত দুজন মিলে গানটি গাওয়া হয় ।সুরেলা যে ধরনের গানে আমরা অভ্যস্ত এই গান তার থেকে আলাদা ।খানিক বরং কর্কশ অপেক্ষাকৃত । অঞ্চল ভেদে হাপুগান হাবু বা হাফু বলেও পরিচিত । দীর্ঘ ছড়ার মতো এইগানে মাঝেমধ্যেই একরকম শীৎকার করার প্রচলন আছে । মূল গায়ক গানটি শুরু করেন বাদ্যযন্ত্র সহ এবং সঙ্গী বা সঙ্গিনী ধুয়ো ধরেন ।তার হাতে থাকে বেত অথবা পাঁচন লাঠি যা দিয়ে সে নিজেকে আঘাত করে গানের সাথে তাল রেখে । ক্রমাগত অদ্ভুত আওয়াজ করে মুখ থেকে এবং বগল বা পা ঠুকে অদ্ভুত শব্দ তৈরি করে।গানের শেষাংশে আঘাতের তীব্রতা বাড়ে ।মূলত শরীরের সেই অংশেই আঘাত করা হয় যেখানে মারলে জোরে শব্দ হয় এবং আঘাতগুলি দৃশ্যমান হয় ।গায়কের পিঠ এবং কোমরের ওপরের দিকের অংশে আঘাত লেগে লেগে চামড়া মোটা হয়ে যায় ,কালশিটে থাকে এবং 'স্কারিং 'হয়ে যায় । এই গানে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে মদিরা বা গোপীযন্ত্র ব্যবহৃত হয় । 'হা ' এবং 'পু 'শব্দদুটি বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয় গানে ,সম্ভবত সেখান থেকেই এই নামকরণ । 'হা ' অর্থাৎ হাহাকার অথবা অন্ন এবং 'পু ' অর্থে পূরণ সম্ভবত । মূলত অজয় ,দামোদর ইত্যাদি নদীর তীরবর্তী মানুষজন তাদের বসতজমি ,ঘর এবং আবাদ জমি হারিয়ে উৎখাত হয়ে যান বলেই ধারণা গবেষকদের ।এবং সেই দুঃখ বেদনার শৈল্পিক প্রকাশ হাপুগান । 
গবেষকদের মতে এই গান মানুষের হাহাকারের কথা বলে । সমাজের অপেক্ষাকৃত নিপীড়িত এবং গরীব অন্ত্যজ পিছিয়ে থাকা মানুষের দারিদ্র ,অন্নের জন্যে হাহাকারই এই গানে রূপক দ্বারা বর্ণিত হয় । আবার অনেকে মনে করেন সময়কালীন সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও হাপুগানের অন্যতম বিষয়বস্তু আসলে । হাপুগান আমরা ছড়ার ভঙ্গিতেও পাই ।একসময় হাপু গায়করা কবিরাজি নিদান ইত্যাদি দিতেন তেমন তথ্যপ্রমাণও মেলে । মফস্বল বা গ্রামের অলস দুপুরগুলিতে মেয়েদের শিশুদের মনোরঞ্জনের পাশাপাশি এরা ছোটখাটো টোটকা এবং গাছগাছড়া ইত্যাদির দ্বারা আয়ুর্বেদিক এবং কবিরাজি চিকিৎসাও করতেন । 
হাপু আতাপাতা লো 
হাপু সর্ষেপাতা লো 
হাপু আম খাবি জাম খাবি 
তেঁতুল খাবি লো 
তেঁতুল খেলে পেট গুলাবে ছেলে হবেনা 
হাপু কাকে খেলো লো 
হাপু ক্যা ঝাড়ুনি লো 
হাপু বেদের মাকে লো 
ই ডাঙাড়ে ওই ডাঙাড়ে শালিক বস্যেছেঁ
বেদের মা কে বিয়া করতে পালকি আস্যছ্যাঁ
হা ফুঃ কদম ফুঃ 
বুড়াতে বুড়িতে লড়াই লেগেছ্যাঁ
বুড়ার কপালে বুড়ি পাদ্যেঁ দিয়েছ্যাঁ
হা ফুঃ কদম ফুঃ !
হাই লো বামুন দিদি 
বাগদি ঠাকুরঝি 
আমি কেলে গয়লার ব্যাটার 
ঠিয়ে কখন হাঁস্যেছি 
হাঁস্যেছি বেশ করেছি 
তর বাপের কি 
যখন ছিলাম ছ'বছরের 
তখন উঠে নাই গা 
এখন আমি তেরো বছর হব ছেলের মা
মাছ ধরতে গিলাম আমি 
কুঁয়ে লুদির কুলে 
দেখি এক মিনসে 
রসির লাগর 
ভাঁড়া ফেলছে চারে 
জলে নেমে জাল ছাঁকি 
আর মিনসে থাকে চেয়ে 
ভাল কেনা তুই ঢ্যামনা মিনসে 
থানা কেনা চেয়ে 
তাকে চেয়ে উইচে যাব 
নইকো তেমন মেয়ে 
মাছ ধরছি চিংড়ি চাঁদা 
গচি মাগুর গাগর 
কার্তিক মাসে মাছের রসে 
বলব কি বুন
বলব কিলো 
আমার প্যাট হয়েঁছে ডাগর 
খোসার দুম খোলাক দুম 
কাঁথা চাপা দিঁয়ে মারব ঘুম !
উক্লীতে পাল্কী আঁকা 
বুলবুলিতে খায় 
ছেলের নামে বিচেন পড়ে 
নিজে ঘুম যায় !
ভারতে আর পাকিস্তানে লড়াই 
দেখ লেগেছে 
বোমা তৈরি করেছে 
সেই বোমা ছুটে এসে পাড়া গাঁয়ে পড়েছে 
ছেলেদের চোখে দেখ জয়বাংলা হয়েছে 
ডাক্তারখানা গিয়েছে 
গরমজলে তুলা দিয়ে 
শ্যাক করতে বলেছে !
জামাই এলো কামাই করে 
খেতে দিব কি 
হাত বাড়িয়ে দাও গামছা 
মুড়কি বেঁধে দি 
উড়কি ধানের মুড়কি দিব 
পাতে জল খেতে 
জষ্টিমাসে ছাতা দিব 
রোদে পথে যেতে !
ইলিক মিলিক শুলুকটি 
বড় শালুকের ফুল 
এমন ঘরে দিও না বিয়া 
ব্যাঙে টানে চুল 
ব্যাঙে করে ওডুর গাডুর 
কুচে করে হরি 
হাজার ট্যাকা দিয়ে পুকুর 
লোকের জ্বালায় মরি !
......আসলে বাকি সমস্ত লোকসংগীত এবং লোকাচারের মতোই হাপুগান মানুষের দৈনন্দিন সমাজের সময়ের কথাই বলে ।প্রেক্ষাপট যাইহোক কথাগুলি মানুষের কথা ।মাটির কাছাকাছি কিছু মানুষ যাদের হয়তো সমাজ সেভাবে কথা বলার সুযোগ করে দেয়না ।শিল্পের আঁচল ধরেই সেই অন্ত্যজ মানুষের সামান্যমতো জানলা ।সম্প্রতি আর হাপুগান চোখে পড়েনা বহুদিন ।সেই মামাবাড়ির দিনগুলি নেই ।নেই তেমন মফস্বল ।নেই সেই একান্নবর্তী পরিবারের জমজমাট দুপুর ।আমাদের ভাইবোনগুলিরও সাক্ষাৎ হয়না বহুকাল ।এইভাবেই আসর ভেঙ্গে যায় ।আমরা একাকী হাঁটতে শুরু করি ।কোন আটপৌরে মনখারাপের লোকালে চেপে পড়ি ।ভোঁ বাজে ।গাড়ি ছেড়ে দেয় ।কানে গোঁজা হেডফোন আর প্রচলিত প্রেমের গান থেকে দুপুর গড়িয়ে যায় ।চমক ভাঙ্গে সেই অদ্ভুত বগল বাজানো অথবা কর্কশ গানের সুরে ! অবাক হয়ে দেখি ছোটবেলার সেই হাপু ...সেই শতচ্ছিন্ন নোংরা কাপড় পরা গানের দল এখনো ঘুঙুর বাজিয়ে গান গাইছে লোকাল ট্রেনে ।বিনিময়ে ভিক্ষে পড়ছে কচিৎ এক অথবা দুটো টাকার । সবাই গা বাঁচিয়ে চলছে ।পাছে এদের ছোঁয়া লাগে গায়ে । আর দোসর ছেলেটি শপাং শপাং করে লাঠি ফেলছে কোমরে । পরনে বারমুডা ,ধুতি বা কাপড় নেই ।দাঁতে মশলার ছোপ । গায়কের হাতে চামড়ার কোন বাদ্য ।গানে চটুল বাক্যবাণ । কিছু লোক হাসছে ।আর কিছু চোখ সরিয়ে বিরক্ত মুখে বসে । দেখলে বোঝাই যায়না এ আমাদের মাটির গান ।আমাদের সংস্কৃতির শেকড় । 
এভাবেই কি গাছ হারিয়ে যায় ?এতখানিই বৃক্ষনিধন করা ? উত্তর নেই ।এখন বোধয় এমনই একটা দুঃসময় যেখানে নিজেকে আঘাতে রেখে উচ্চকিত গলায় জানিয়ে দিতে হয় ''আমরা ভালো নেই !'' হাপু গায়কের সেই দুর্দশাগ্রস্ত পিঠ আর কর্কশ গান যদি রাষ্ট্রের স্যাডিস্টিক নীরবতা ভেঙে ফেলে একদিন । আশা ,সরকারি প্রকল্পের আওতায় একদিন নিশ্চিত সুদিন দেখবেন হাপুগানের দল !
***************************************************
লেখক পরিচিতি
বিগত তিনবছর যাবৎ লেখালিখির সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত l ইতিমধ্যে সাপ্তাহিক বর্তমান,উত্তরবঙ্গ সংবাদ,আজকাল , নতুন কৃত্তিবাস ,কৃত্তিবাস ,মধ্যবর্তী ,শুধু বিঘে দুই ,দাঁড়াবার জায়গা , কবিতা আশ্রম ,মায়াজম ,ঋতবাক ও অন্যান্য অনেকগুলি লিটিলম্যাগাজিন এবং ওয়েবজিনে লিখেছেন l ২০১৭র বইমেলায় বইতরণী কর্তৃক প্রকাশিত 'আমার গল্প 'শীর্ষক অণুগল্পের সংকলনে লিখেছেন এবং প্রথম একক গদ্যের বই 'ধুলোবালির লেখা 'প্রকাশিত হয়েছে ২০১৮র বইমেলায় ।প্রকাশক ধানসিড়ি ।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র