এক টুকরো লোক সাহিত্য প্রেক্ষিত বাংলাদেশঃ
সাধারণ থেকে অতি সাধারণ মানুষদের যাপিত জীবনের হাসি কান্না, স্বপ্ন দেখা, স্বপ্ন ভাঙার বেদনা, আনন্দ স্ফূর্তি ব্যর্থতাকে গল্প, কবিতা, সুরে বেঁধে সহজ সরলভাবে প্রকাশ করাকে লোকসাহিত্য বলা চলে। যেমন বর্ষার জল প্লাবিত মাঠে অনাবিল আনন্দে গজিয়ে ওঠে থোকা থোকা শণগাছ কিম্বা নালিঘাস আর কাশগুচ্ছ। যেমন নতুন জলের আবাহনে লকলকিয়ে ছুটে বেড়ায় হেলেঞ্চা আর কলমি শাকের দল। ঠিক তেমনি করেই লোকসাহিত্যের উৎসরণ ঘটে সহজ সরল মানুষদের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ, উৎসাহ, ভালোলাগা, মন্দলাগা থেকে। মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ওঠে আসে কথা। তাতে সহজিয়া সুর বসিয়ে মাটি মন মানুষরা ছড়িয়ে দেয় গাঁয়ের ধূলো মাখা পথ প্রান্তর বেয়ে দূর থেকে আরো দূর দূরান্তে।
সুর, শব্দ, ছন্দ, তাল, বিস্ময়, বেদনা, প্রেম, বিরহ, ত্যাগ, কৃতজ্ঞতা আর কৃতঘ্নতা মানুষের আদিমতম গুণাগুণ। তেমনি বিসর্জন, সমর্পণ, হিংসা, ঈর্ষা, অসূয়া, হত্যা, লোভ, লাভ, লিপ্সা আর বিশ্বাসের পাশাপাশি অবিশ্বাস মানুষকে তাড়িত করে ফিরছে সৃষ্টির আদিপর্ব থেকে। মানুষের জীবনে এগুলোই হচ্ছে মূল অনুভূতি শক্তি। পৃথিবীর কোনো মানুষই এই শক্তি থেকে ব্যতিক্রম নয়। প্রতিটি মানুষের আবর্তন বিবর্তন, আগমন, প্রত্যাগমনে ফিরে আসে এই অনুভূতিরই অনুরণন। আর যে কোনো ঘটনার আবেগ তাদের ফিরিয়ে আনে এই মূলশক্তিগুলোর কাছে। ঠিক এ কারণেই নৃতাত্ত্বিকরা খুঁজে ফিরছে পুরনোকে। খুঁজে পাওয়া একটি মাটির বাসন কোসন, এক টুকরো জীর্ণ বল্কল, ক্ষয়ে যাওয়া ধাতু চিহ্ন, একটি ভাঙ্গা নোখ তাই বর্তমান মানুষকে মনে করিয়ে দেয়, এখানে জীবন ছিল। ছিল যাপনও। ছিল কর্ম, ঘর্ম, আহার, সম্ভোগ, জন্ম মৃত্যুর সাথে গীতি, কথা, গান, ছড়া, যাত্রাপালা, ধাঁধাঁ, দোঁহার, পদ প্রবচন, কিসসা আর কাহিনীর সন্তরণ।
আজকের বাঙ্গালী পেছন পানে হাঁটলে অর্জিত ঐতিহ্যে গর্বিত হয়ে উঠবে সুনিশ্চিত। প্রাচীন বাংলার লোকসাহিত্য এক বিস্তৃত সংস্কৃতিতে ভরপুর ছিল। শিল্প সাহিত্য, কাব্য ছড়া, গান চর্চাকারীকে বলা হত সিদ্ধাচার্য। এদের কেউ কেউ ছিলেন পূর্ববঙ্গের, কেউ বা উত্তরবঙ্গ বা রাঢ় , কেউ বিহার, উড়িষ্যা, অসম কামরূপের অধিবাসী বৌদ্ধ, ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, ক্ষত্রিয়, বণিক আর অন্ত্যজ শ্রেণীর। দীনেশচন্দ্র সেন ১৯১১ সালে তার বই, “The History of Bengali language and Literature” বাংলা সাহিত্যের আদি পর্বে বৌদ্ধ প্রভাবের কথা বলেছেন।
কিন্তু মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পূর্বে ব্রাহ্মণ্যবাদের অতি আতিশয্যে বৌদ্ধ-পণ্ডিতরা প্রাচীন বাংলা ছেড়ে পালিয়ে গেছিলেন নেপাল, ভুটান, তিব্বত। সাথে নিয়ে গেছিলেন সিদ্ধাচার্যদের রচিত পুঁথিপত্র। এই পুঁথিপত্রের অমূল্য ভাণ্ডারে বাঙ্গালী সিদ্ধাচার্য এবং বাংলাভাষা নিয়ে চর্চিত অন্যান্য সিদ্ধাচার্যদের রচিত পদাবলীও ছিল। অর্থাৎ সেই সুদূরকাল থেকে বাঙ্গালী ছিল ছন্দরসিক, সুর পাগল, কবি মানসের আউল মনা বাউল গায়ক ।
বাংলাভাষার লোকসাহিত্যের ইতিহাসে এ কথার জোরালো সমর্থন রয়েছে।
গবেষক ও পণ্ডিত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং প্রবোধ বাগচীর মতে, এই সময়টা ছিল খৃস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ সময় ব্যেপে। আবার জ্ঞানতাপস পণ্ডিত ডক্টর মুহাম্মাদ শহিদুল্লাহ এবং লেখক গবেষক রাহুল সাংকৃত্যায়ন আরো দুশ বছর পিছিয়ে দিয়ে বলেছেন, অষ্টম শতাব্দী থেকেই প্রমাণ মেলে বাঙ্গালী সিদ্ধাচার্যরা ছিলেন কাব্য গীত রচনা শৈলীতে অত্যন্ত পটু এবং কাজটা তারা ভালোবেসে মন থেকেই করতেন ।
এ বিষয়ে বহু পরীক্ষা নিরীক্ষা গবেষণা, যুক্তি তর্কের অবসানে অবশেষে বাঙ্গালির গীতিপ্রিয়তার সপক্ষে যা পাওয়া গেছে, তাহলো, চর্যাপদ। চর্যাপদের রচয়িতারাই ছিলেন, সিদ্ধাচার্য। এদের মধ্যে অনেক বাঙ্গালী সিদ্ধাচার্য ছিলেন বলে জানা যায়। তবে বাংলা ভাষার প্রথম কবি সিদ্ধাচার্য লুইপাদ। পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে , অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের সাহায্যে লুইপাদ “অভিসময়বিহং” নামে একখানি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। সময়ের হিসেবে লুইপাদ তাই চর্যাপদ রচনার প্রথম দিকের কবি। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে ইনি একজন আদি সিদ্ধাচার্য। চর্যাপদের প্রথম পদটি তিনিই রচনা করেন। লুইপাদ ছাড়া আরো যে সকল বাঙ্গালী ছিলেন যারা তাদের যাপিত জীবনের সুখদুঃখ, অভাব অনটনের নানা কথা নানা পদ বিভিন্ন রচনার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন।
তেমনই একজন বাঙ্গালী সিদ্ধাচার্য তার পদ রচনায় নিত্যদিনের অভাব অনটনের সাথে দীর্ঘনিশ্বাস জুড়ে রচনা করেছিলেন, “টালত মোর ঘর, নাহি পড়বেশী। হাড়ীত ভাত নাহি, নিতি আবেশী।।” অর্থাৎ টিলার উপরে আমার ঘর, আমার নাই কোনো প্রতিবেশী।। হাঁড়িতে আমার ভাত নাই, আমি নিত্য উপোষ থাকি।।
কি জীবন্ত দুটি পদ ! হাজার বছর পেরিয়ে গেলেও এই পদ দুটির মর্ম আমাদের কাছে একটুখানিও ম্লান এবং ক্ষুণ্ণ হয় নি। আমরা কি জানিনা আমাদের জীবনে, সুদিনের বন্ধু যারা, যারা সুখের পায়রা তারা দুর্দিনে আর বন্ধু থাকে না। সরে সরে থাকে, উড়ে চলে যায় দূরে। এই ভাবসংকোচনের কি বিরাট বিশাল সম্প্রসারণ? কি ব্যাপক অভিঘাত! ব্যক্তিগত জীবন থেকে সমাজ, দেশ এমনকি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও আমরা দেখি, আজ যে বন্ধু, কাল সে শত্রু হয়ে যাচ্ছে কারণ “হাড়ীত ভাত নাহি” তাই আমরা “নিতি আবেশী।।”
এই প্রসঙ্গটি টেনে আনার কারণ এটি জানানো যে, শিল্প সাহিত্যের জগতে বহু প্রাচীনকাল থেকেই বাঙ্গালীর সহজ সাবলীল অংশগ্রহণ ছিল। ছিল গভীর, চটুল, ব্যাঙ্গ, ধর্মদর্শন, সাধন, ধাঁধাঁ, প্রবচনের রসাস্বাদনে বাঙ্গালীর জন্মগত পারঙ্গমতা। পরবর্তীকালে হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়ের কবি, বাউল, সুফিরা এই চর্যাপদের পদগুলিকে উদাহরণ করে যুগে যুগে রচনা করে চলেছে বৈষ্ণব পদাবলী, বাউল গান, সুফি মুর্শিদী, নাথাপন্থী গান, দেহোযোগী বা শাক্তপদাবলি ।
বাংলার লোকসাহিত্যের ভাণ্ডারে রয়েছে লোককথা, ব্রতকথা, রূপকথা, কিসসা, কিংবদন্তি, বচন প্রচলন, লোকপুরাণের বিপুল বিশাল ভান্ডার।
ব্যক্তিগতভাবে আমি দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার জলমগ্ন এক অঞ্চলের মানুষ । খুব মনে আছে শৈশবে স্বচক্ষে দেখা চিত্রাবলী। বর্ষার থই থই জলের উপর কচুরিপানার ধাপে লাউ, কুমড়োর চাষ করছে যে হিন্দু মুসলিম সমবেত নারীরা তারা গল্প করছে, মনসাদেবী, গুনাই বিবি থেকে রূপবান, কাঞ্চনমালা, গুনাইবিবি, বেদের মেয়ে বা যাত্রাপালার এক পয়সার সিঁদুর, নবাব সিরাজদ্দোউলা, আলেয়া, গৌর নিতাই, রাধা কৃষ্ণ, সখিনার প্রেম, সোজনা বাদিয়ার ঘাট, নকশীকাঁথার মাঠ নিয়ে। এদেরই কেউ একজন হয়ত হাতের কাঁচি দুলিয়ে সহজিয়া সুরে গেয়ে উঠল, দাঁড়া রে নিমাই, অমনি অন্যেরা গেয়ে ওঠে, দাঁড়া রে দাঁড়ারে নিমাই, দাঁড়া বাছা, দেখিবো তোর মায়ে। কিম্বা গুনাবিবির গান, দাদা আর যাবো না হাই ইশকুলে পড়িতে অথবা কৃষ্ণ প্রেমিকা রাধার গান, তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে--
মনসা পুজোয় মন্দিরের বারান্দা থেকে ভেসে আসে ভাসানের পাঠ, “ভাসিতে ভাসিতে ভুরা গেলো নন্দীপুর। আপুয়া ডোমের ঘাটে ঠেকে গিয়া ভুরা।। বসিয়াছে আপু ডোম টুঙ্গি ঘরখানে। ভুরাখানি দেখি বেটা মনে অনুমানে।।”
কবি জসীমউদ্দীনের নকশীকাঁথার মাঠ কাব্যগ্রন্থে বৃষ্টির জন্যে গ্রামের মেয়েদের আকুল প্রার্থনা পদ রচনা করেছেন। যুগ যুগ ধরে তীব্র খরায় ত্যক্ত বাঙ্গালীদের মধ্যে সংস্কৃতির প্রচলন রয়েছে। কবি তাই তুলে এনেছেন তার অমর কাব্যগ্রন্থে, “কালা মেঘা নামো নামো, ফুলতোলা মেঘ নামো ধুলট মেঘা, তুলট মেঘা, তোমরা সবে ঘামো, কানা মেঘা টলমল, বারো মেঘার ভাই, আরো ফুটিক ডলক দিলে চিনার ভাত খাই।”
সুন্দরবন ঘিরে রয়েছে অদ্ভুত লোককাহিনী । দক্ষিণবাংলার হিন্দু মুসলিম সকলেই বনবিবির কাহিনী জানে এবং সশ্রদ্ধচিত্তে মান্য করে চলে। বনবিবি হচ্ছে হিন্দুদের বনদুর্গা আর মুসলিমদের বনবিবি। বাঘের হাত থেকে বনবিবিই রক্ষা করে সুন্দরবন এলাকার মানুষদের। ক্ষীর আর শিরনি দিয়ে বনবিবির পূজো করে হিন্দু মুসলিম জনজাতি । বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরাসহ এই অঞ্চলের সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য বনবিবির পুজা হয় খুলনার দাকোপ উপজেলার বানিশান্তা ইউনিয়নের সুন্দরবন সংলগ্ন ঢংমারি গ্রামে। একটি মাত্র খাল সুন্দরবন আর ঢংমারির মধ্যে বয়ে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যেই বাঘ চলে আসে সাঁতরে। মানুষরাও খাল পেরিয়ে বনে যায় মধু, মোম, কাঠ সংগ্রহে। তখন বনবিবিই একমাত্র রক্ষাকারী। আর বনের বাঘের, নদীর হাঙ্গর, কুমিরে কাঙ্গটের হাত থেকে রক্ষা পেতেই এই পুজাআচ্চা। বনবিবির পুজা দক্ষিণ বাংলার আবহমান লোক সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। পুজা ছাড়াও প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় বনবিবির পাঁচালি, যাত্রা, গান। হিন্দু মুসলিম সকলের বিশ্বাস, বিপদে বনবিবি মাকে ডাকলেই তিনি সাথেসাথে হাজির হয়ে যান, “আঠারো ভাটির মাঝে আমি সবার মা।। মা বলি ডাকিলে কারো বিপদ থাকে না।।”
এছাড়াও রয়েছে ওলাবিবি, সাতবিবি, নয়বিবি পালাসহ মানিক পীর, সত্য পীর , গাজী পীরের পালা পাঁচালী, অষ্টক নাচ ও গান । আর আছে ঋতুভিত্তিক নানা উৎসব।
মানুষের ইচ্ছা প্রকাশের আদি প্রবৃত্তি প্রকাশিত হয় শিল্প সাহিত্য, সঙ্গীত, ভাস্কর্য, কথা কাব্য, পালা পাঁচালী, গল্প, কিসসা, ছড়া, পদ, এমনকি খাদ্য উপকরণ, রান্না ইত্যাদিতে। দক্ষিণ বাংলা জল বাহিত ভাটি অঞ্চল । স্বাধীনতার আগে এখানকার অধিকাংশ মানুষের ঘর ছিল মাটির। বেড়া ছিল বাঁশের ,কাঠের, কাছনি। গোলপাতার ছাউনি। জলে ছিল অফুরন্ত মাছ। কালিন্দী, কপোতাক্ষ, বেতনা, যমুনা, শিবসা, পশুর মিষ্টি পানির নদীর সাথে এখানে মিশেছে বঙ্গোপসাগরের নোনা জল। নারকেল বীথির ছায়ায় ঘেরা এখানকার মানুষদের খাদ্যে নারকেল বা নারকেলে দুধ থাকে অবধারিত। নদীতে হয় নৌকা বাইচ। মেলায় আসে কাঠের বাসন কোসন। অবস্থাপন্ন ঘরে দেখা যেত কিছু পেতলকাঁসার থালা বাসন, কলস , জগ, চাল ছাঁকলি।
বাগেরহাটের সাতগম্বুজ, খান জাহান আলি পীর নিয়ে রয়েছে নানা লোককথা। খান জাহান আলি পীরের দরগায় হিন্দু মুসলিম অনেকেই মানত পূরণের অছিলায় যায়। সেখানকার পুকুরে সাদা পাহাড় আর কালা পাহাড় নামে দুটি কুমির আছে। লোক পরম্পরায় কাহিনী জানা যায় যে এই কুমির দুটি আসলে কুমির নয়। পীর সাহেব দুটি পরিকে মতান্তরে জিনকে কুমির রূপে বন্দি করে রেখেছেন এই পুকুরে। এছাড়া রয়েছে পুরনো স্থাপত্যে মন্দির, মঠ। যা প্রমাণ করে মুসলিমরা পূর্ববঙ্গে আসার আগে এখানকার মানুষদের আদি ইতিহাস।
ঐতিহ্য পরম্পরাগত, ধারাবাহিক এবং সময় পরিক্রমণের ক্ষতে নানারূপধারী। আজকের যন্ত্রনির্ভর সবজান্তা যুগেও এই সমস্ত লোককাহিনী , লোকসংস্কৃতি হারিয়ে যায় নি। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ঘুরে আসছে আর মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে জেনে নিচ্ছে লোকসংস্কৃতির এই আদিরূপকে । সাথে সাথেই জানিয়ে দিচ্ছে দেশ এবং বিদেশের অন্য বন্ধুদের।
আর এভাবেই বাংলার লোক সাহিত্য ছড়িয়ে পড়ছে।
সুচিন্তিত মতামত দিন