দেবশ্রী চক্রবর্তী

মায়াজম
0
              রাজস্থানী লোকসাহিত্য

লোকসাহিত্যকে যদি এক কথায় বর্ণনা করতে বলা হয়, তাহলে বোধয় রবীন্দ্রনাথের ভাষায় একে প্রকৃত অর্থে বর্ণনা সম্ভব। কবিগুরু একে ‘জনপদের হৃদয়-কলরব’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। কোন একটি বিশেষ অঞ্চলের সভ্যতা, সংস্কৃতি, মানুষের নিত্যদিনের আচার ব্যবহার সব কিছু এর মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। কোন এক প্রাচীন যুগ থেকে বর্তমান সভ্যতা পর্যন্ত কোন একটি বিশেষ অঞ্চলের সামগ্রিক সংস্কৃতি এক উচ্ছল নদীর ধারার মতন সেই অঞ্চলের পল্লিবাসীর স্মৃতি ও শ্রুতির ওপর নির্ভর করে লালিত হয়। হয় তো ব্যক্তি বিশেষে কোন একটি বিশেষ গান অথবা নাটক সৃষ্টি হলেও, তার সামগ্রিক লালন পালন নির্ভর করে সমষ্টিগত চর্চার ওপর।




লোকসাহিত্যকে একটি মহাসাগরের সাথে তুলনা করা ভালো। আলোচ্য প্রসঙ্গে আমি ভারতবর্ষের বিশেষ একটি অঞ্চলের লোক সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করবো। আর তা হল রাজস্থানী লোকসাহিত্য। একটি বিশেষ অঞ্চলকে বেছে নেবার একমাত্র কারণ এই স্বল্প পরিসরে এত দীর্ঘ একটি ধারার বিভিন্ন শাখা প্রশাখা নিয়ে আলোচনা সম্ভব না। রাজস্থানের লোক সাহিত্য সমৃদ্ধ, বৈচিত্রময় এবং প্রাণবন্ত সাহিত্য যা ভারতীয় লোকসাহিত্যকে অন্য একটি মাত্রা দান করেছে।
১০০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই সাহিত্য রচনা শুরু হয়েছে বলে অনুমান করা হয়। এই অঞ্চলের লোকশিল্পের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে, লোক গান বা লোকগীতি; গালাগাল; লোককাহিনী বা লোককথা; লোক নাট্য এবং হিতোপদেশ। রাজস্থানী লোক গান স্থানীয় সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে খুব জনপ্রিয়। এই গান গুলি মানুষের আবেগের স্বাভাবিক অভিব্যক্তি হিসাবে গণ্য করা হয়।এই গানগুলি ভালোভাবে শুনলে বোঝা যায় ধর্মীয় অনুষ্ঠান, উপাসনা, জাগরণ ইত্যাদি সম্পর্কিত গানগুলি ধর্মীয় গান এবং তা যেকোনো নির্দিষ্ট অনুষ্ঠান, ঘটনাবলী এবং মানুষের জীবনের অন্যান্য দিক থেকে পৃথক। লোকগাথা ছাড়াও রাজস্থানের অন্যান্য ধরনের সাহিত্যও আছে। আধুনিক রাজস্থানী সাহিত্য সুরজমিল মিসরানার কাজ শুরু করে। তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি হলো ভনসা ভাস্কর এবং ভিরা সৎসাই। কবি তার জীবদ্দশায় রাজপুত রাজবংশের এবং রাজপুতানা শাসিত রাজপুতদের রাজত্বকালে ভ্যান ভাস্করের বিবরণ তুলে ধরেছেন । ভাই সৎসাই শত শত দম্পতির একটি সংগ্রহ।
মধ্যযুগীয় রাজস্থানী সাহিত্যে বেশিরভাগই কবিতা এবং রাজস্থানের মহান রাজা ও যোদ্ধাদের উল্লেখ করে বীরত্বপূর্ণ কবিতা রচিত হয়েছিল । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার বলেছিলেন, বীরোচিত অনুভূতি যা রাজস্থানের প্রতিটি গান ও দোহারের মূল বৈশিষ্ট্য, এর দ্বারা সমগ্র দেশ গর্বিত এবং অনুপ্রাণিত।
প্রারম্ভিক রাজস্থানী সাহিত্য বেশিরভাগ চরানী বা ডিংগল নামে পরিচিত ছিল, যা গুজরাটের কাছাকাছি ছিল।




রাজস্থানী লোক সাহিত্যের বালাদারাঃ
বালাদার রাজস্থানী লোকসাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ন ধারা এবং তা বিভিন্ন ধারায় হয়। এই সাহিত্যের মধ্যে যেমন আমরা ঐতিহাসিক বীরগাথা খুঁজে পাই, তেমনি খুঁজে পাই পৌরাণিক দেবদেবী চরিত্র এবং নানারকম পৌরাণিক ঘটনা। উদাহরণস্বরূপ, পাবুই কা পোড়াকে একটি বীরত্বপূর্ণ গথা বা বল্লাদ বলা যায় । এটিকে বলা হয় ৫২ নম্বর এবং রাঠোর পূবুজির বীরত্বের বর্ণনা। ভূপরাও এই পোয়াডের গায়ক। এই গানের বিষয়বস্তুকে ব্যাখ্যা করার জন্য তারা একটি ফাঁদ বা একটি ছবি-পর্দায় রাখে।অন্যদিকে, বাগদাদকে একটি রোমান্টিক বল্লাদ বলা হয় এবং এই বল্লাদ ২৪ জন বাগদত্ত ভাইদের যুদ্ধের কথা। তারা বাঘ রাউলের ​​পুত্র ছিলেন। আবার অন্যদিকে আমবা রাশ, দৌরাপদ্দিন, নারসিজি রুহ মাওরোর রাজস্থানের কয়েকটি পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক বল্লাদ। এগুলি ছাড়াও নিবেদিত গাঁথাগুলি বিখ্যাত নাথ দর্শন দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং সিদ্ধ। এই ধারা গফচাঁদ ও ভারতীয়র জীবন ও কাজ বর্ণনা করে এবং তারা অত্যন্ত জনপ্রিয়। পূর্বেই বলেছি যে যেকোন লোক সাহিত্য সমষ্টিগত উদ্যোগ ছাড়া সম্ভব না। এবং সত্যিই তা অনেক কবিকে যুগ যুগ ধরে অনুপ্রাণিত করেছে।

দুবছর আগে মুম্বাই গেছিলাম , “সেখানে রেত- দ্যা সং অফ লাভ” নামের একটি থিয়েটার দেখেছিলাম । আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতন উপভোগ করেছিলাম নাটকটির প্রতিটি দৃশ্য, এই নাটকটির বিশেষত্ব হচ্ছে নাট্যকার শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথকে রাজস্থানী লোকনাট্যের গঠন শৈলীতে বিন্যাস করেছেন। গল্প মধ্যযুগের ইউরোপের বিশিষ্ট নাট্যকারের হলেও নাটকটি রাজস্থানী সঙ্গীত, আচার ব্যবহার, নৃত্য সবকিছুর দর্পণ হয়ে উঠেছিল। যুগ যুগ ধরে এইভাবেই লোকসাহিত্য প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিলিত ধারা হয়ে অনেক সময় অন্য এক রূপ ধারণ করে প্রবাহিত হয়েছে। রাজস্থানী লোকসাহিত্য নিয়ে এই ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা নিত্য চালিয়ে যাচ্ছেন দুজন স্বনামধন্য সাহিত্যিক বিজয়দান দীন ও গোবিন্দ আগ্রাওয়াল । তাদের মূল উদ্দেশ্য নিজস্ব শব্দভাণ্ডারের ছোঁয়াইয়, বিস্মৃতির সংক্ষিপ্ততার লক্ষ্যকে লক্ষ্য রেখে, সাধারণত প্রচলিত লোক শৈলীের মতো একটি বর্ণন বজায় রাখা। যেমন, বাটন রি ফুলবাড়ী, এক্ষেত্রে সাধারণত ভাষা প্রায়ই কৌতুকপূর্ণ হয়। গোবিন্দ আগারওয়ালের রাজস্থানী লোককাহিনী তাদের কার্যকারিতা ও স্বচ্ছতার কারণে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। লক্ষ্মীকুমারী কুন্দাওয়াতও লোক কট্টর বা লোকাল কণ্ঠ দিয়ে এই স্রোতে নিজের অবদান রেখে গেছেন।


রাজস্থানী লোক সাহিত্যে কে লোকনাথ রাজস্থান থেকে খালেদ, সোয়াং এবং লীলাতে বিস্তৃতভাবে শ্রেণীভুক্ত করা যায়। এক্ষেত্রে খালিদের সামাজিক, ঐতিহাসিক, ধর্মীয় বা ধর্মনিরপেক্ষ প্রজন্মের মধ্যে যেমন রয়েছে।তেমনি নৈপুণ্য এবং শৈলী অনুসারে, খ্যলগুলি রাজস্থানের বিভিন্ন অঞ্চলে জনপ্রিয়।অন্যদিকে, সুপরিচিত সোঙ্গাগুলি হল খালি ঝাৎতদ, টুনটুয়া তন্তকি, জামরা বিজ , বাহুরুপিয়া কি সাওয়ারি এবং অন্যান্য।পৌরানিক লীলা গুলির মধ্যে রাসলিলা, রামলীলা, রাশ ধারীলীলা, সানকাদিক লীলা এবং গাবরী কয়েকটি উদাহরণ। শিল্পকলার এই পর্যায়ের গবেষণায় শিবরাল সমর, মহেন্দ্র ভানওয়াত ও অন্যান্যরা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন।
লেখা শেষ করবো আমার একান্ত ব্যক্তিগত একটি অভিজ্ঞতা দিয়ে। কর্নেল জেমস টডের রাজস্থান বইটি যখন পড়া শুরু করি, লেখকের কয়েকটি কথা আমাকে অবাক করেছিল। তিনি লিখেছেন, যখন রাজস্থানের ইতিহাস লেখার দায়িত্ব তাকে দেওয়া হয়, তিনি স্থানীয় লোক গাথার ওপর নির্ভর করে এই ইতিহাস রচনা করে ছিলেন। দীর্ঘ দিন ধরে মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত লোক গান, নাটক, কবিতা এসবের আশয় তিনি নিয়েছেন। টড তার এই গ্রন্থে পদ্মিনী উপাখ্যানকে ইতিহাসের মর্যাদা দিয়েছেন। তার কথায়,কয়েক শত বছর ধরে সমগ্র রাজস্থেনের মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত এই গাথা। তাকে কল্পকাহিনী বলে উড়িয়ে দেওয়ার মতন স্পর্ধা তার নেই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)