ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

মায়াজম
0
       তৃতীয় লিঙ্গ আর নতুন কি! 
Related image
থাসরিৎসাগরে আছে মহাদেব নাকি বলপূর্বক অগ্নিদেব কে নিজের বীর্য গ্রহণে বাধ্য করছিলেন । সেই বীর্য অগ্নির উদরে প্রচণ্ড জ্বলন সৃষ্টি করে । মহাদেবের উপদেশে তা তিনি একদল ঋষিপত্নীর উপর উগরে দেন । ঋষিপত্নীগণ আবার সেই বীর্য গঙ্গা নদীতে ফেলে আসেন । গঙ্গার তীরে পড়ে কার্তিকেয়ের জন্ম হল। মহাভারতে অগ্নি একজন কৃত্তিকার হাতে নিজের বীর্য দান করেন। আর সেই কৃত্তিকা একটি হ্রদে মহাদেবের বীর্য নিক্ষেপ করেন যা থেকে কার্তিকের জন্ম হয়। পুরাণকথায় পাই এক পর্বতের উপর অগ্নির রেতঃপাতের কথা । অতএব মদ্যা কথা হল কার্তিক দুই পুরুষ শিব ও অগ্নির সন্তান।কেমন করে ? তা ব্যাখ্যা করবে বিজ্ঞান।

আমাদের দেশে একাধিক দেবদেবীকে তৃতীয়-লিঙ্গ বা সমকামীদের রক্ষাকর্তা মনে করা হয়। এই সব দেবদেবীদের পৌরাণিক কাহিনি বা তাঁদের পূজার রীতিনীতিগুলি এই ধারণার উৎস। দুটি কাঠের টুকরোকে নারী মূর্তি মনে করে পরস্পরের সঙ্গে ঘষা হয়। এই দুটি টুকরোর নামকরণ করা হয় অধরারণি ও উতরারণি। এটি একটি আধ্যাত্মিক নারী সমকামী মিলনের পরিচায়ক।

কৃষ্ণের পুত্র অভিশপ্ত শাম্বও খোজা পুরুষ, রূপান্তরকামী ও সমকামোদ্দীপনার পৃষ্ঠপোষক। শাম্ব নারীর বস্ত্র পরিধান করে মানুষকে উপহাস করতেন এবং বিপথে চালনা করতেন। নারীর বেশ ধারণ করে তিনি সহজেই নারীদের সঙ্গে মিশতে পারতেন এবং তাঁদের সম্ভোগ করতেন। মৌষলপুরাণ গ্রন্থে দেখা যায়, শাম্ব একবার নারীর বেশ ধারণ করে কয়েকজন ঋষিকে নিজের গর্ভধারণ নিয়ে প্রশ্ন করেন। ঋষিরা তাঁকে অভিশাপ দেন যে, পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও তিনি লৌহ মুষল প্রসব করবেন।
হিন্দু দেবতা আয়াপ্পার জন্ম সংক্রান্ত পৌরাণিক কাহিনীটির মধ্যেও অ-বিষমকামী যৌনপ্রবৃত্তির আভাস পাওয়া যায়।শিবের ঔরসে মোহিনীরূপী বিষ্ণুর গর্ভে আয়াপ্পার জন্ম হয়। বিষ্ণু লজ্জায় তাঁকে পরিত্যাগ করেন। পট্টনায়ক লিখেছেন, শিবের ঔরসে মোহিনীর গর্ভে আয়াপ্পার জন্ম হয়নি। মোহিনীকে আলিঙ্গন করার সময় শিবের বীর্যপাত হয় এবং সেই বীর্য থেকেই আয়াপ্পার জন্ম হয়েছিল। এই কাহিনী অনুসারে, আয়াপ্পা হলেন অযোনিজাত (অর্থাৎযোনি থেকে যাঁর জন্ম হয়নি) এবং হরিহরপুত্র (অর্থাৎ,বিষ্ণু ও শিবের পুত্র)। বড়ো হয়ে আয়াপ্পা একজন মহান যোদ্ধা হয়েছিলেন।
হিন্দুধর্মে ও ভারতীয় পুরাণে একাধিক দেবদেবীকে বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন রূপে পুরুষ ও নারী উভয় সত্ত্বা ধারণ করতে দেখা যায়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে আবার একজন দেবতা ও একজন দেবী একই সময়ে একই মূর্তিতে একাধারে পুরুষ ও নারী রূপে প্রকাশিত হন। এই রকম একটি মূর্তি হল অর্ধনারীশ্বর। ইনি শিব ও তাঁর পত্নী পার্বতীর সম্মিলিত রূপ।অর্ধনারীশ্বর নামটির অর্থ "প্রভু, যাঁর অর্ধাংশ নারী' । শিবের এই মূর্তিটি "দ্বৈতসত্ত্বার ঊর্ধ্বে স্থিত সামগ্রিকতা' র প্রতীক। এই মূর্তি নশ্বর জীব ও অমর দেবদেবীদের এবং পুরুষ ও নারীসত্ত্বার যোগসূত্র।অ্যালাই ড্যানিলোর মতে, "উভলিঙ্গ, সমকামী ও রূপান্তরকামীতার একটি প্রতীকী মূল্য রয়েছে এবং এঁদের সম্মানীয় সত্ত্বা অর্ধনারীশ্বর মূর্তি মনে করা হয়।আরেকটি অনুরূপ মূর্তি হল লক্ষ্মী-নারায়ণ। এই মূর্তিটি সৌন্দর্য ও সম্পদের দেবী লক্ষ্মী ও তাঁর স্বামী বিষ্ণুর যুগল উভলিঙ্গ মূর্তি।
পুরাণকথায় দেবতা নন এমন চরিত্রদেরও লিঙ্গ পরিবর্তন করতে বা বিপরীত লিঙ্গের পোশাক পরিধান করতে দেখা যায়। এমনই এক চরিত্র হলেন মহাভারত মহাকাব্যের শিখণ্ডী। শিখণ্ডী বালিকা রূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল ‘শিখণ্ডিনী’। পূর্বজন্মে শিখণ্ডিনী ছিলেন অম্বা নামে এক নারী। ভীষ্ম তাঁকে বিবাহের অযোগ্য বিবেচনা করেছিলেন। অপমানিত হয়ে অম্বা কঠোর তপস্যা করেন এবং দেবতাদের থেকে এই বর প্রাপ্ত হন যে তিনি ভীষ্মের মৃত্যুর কারণ হবেন। পরজন্মে অম্বা শিখণ্ডিনী রূপে জন্মগ্রহণ করেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় ভীষ্ম শিখণ্ডী রূপে পুনর্জন্ম গ্রহণকারী অম্বাকে চিনতে পারেন এবং ‘এক নারী’র সঙ্গে যুদ্ধ করতে অস্বীকার করেন। এরপর অর্জুন প্রায় অপরাজেয় ভীষ্মকে পরাজিত করার জন্য শিখণ্ডীর পিছনে লুকিয়ে ভীষ্মকে পরাজিত করেন। যবদ্বীপীয় উপকথা অনুসারে, শ্রীখণ্ডী (যবদ্বীপীয় উপকথায় শিখণ্ডীর এই নামটিই প্রচলিত) কখনই পুরুষে পরিণত হননি। বরং তিনি ছিলেন পুরুষতুল্য এক নারী এবং অর্জুনের পত্নী। মৃত্যুর পর শিখণ্ডীর পুরুষত্ব সেই যক্ষের কাছে ফিরে যায়।
অর্জুন নিজেই লিঙ্গ পার্থক্যের একটি উদাহরণ। উর্বশী নামে এক অপ্সরা অর্জুনকে প্রেম নিবেদন করলে, অর্জুন তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন। তখন উর্বশীর অভিশাপে অর্জুন এক "ক্লীব' বা তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিতে পরিণত হয়। কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন যে, পাণ্ডবদের বর্ষব্যাপী অজ্ঞাতবাসের ক্ষেত্রে এই অভিশাপ ফলপ্রসূ হবে। অর্জুন বৃহন্নলা নাম গ্রহণ করেন এবং নারীর পোশাক পরিধান করেন।
আরেকটি উপাখ্যান হল ইলার কাহিনী। এই কাহিনীটি একাধিক হিন্দু ধর্মগ্রন্থে পাওয়া যায়। ইলা ছিলেন এক রাজা। তিনি শিব ও পার্বতীর অভিশাপে এক মাস পুরুষ রূপে এবং পরবর্তী এক মাস নারী রূপে দেহধারণ করতেন। লিঙ্গ পরিবর্তনের পর ইলা তাঁর পূর্বতন লিঙ্গের কথা বিস্মৃত হতেন। এই রকম একটি পর্যায়ে ইলা গ্রহদেবতা বুধকে বিবাহ করেন। বুধ ইলার পরিবর্তনশীলতার কথা জানতেন। কিন্তু তিনি ‘পুরুষরূপী’ ইলাকে তা জানালেন না। ইলাও তাঁর নারী রূপের কথা বিস্মৃত হলেন। ইলা যখন স্ত্রী রূপে থাকতেন, তখনই বুধ ও ইলা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে একত্রে বাস করতেন। রামায়ণ অনুসারে, ইলা বুধের এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। যদিও মহাভারত অনুসারে, ইলাকেই সেই পুত্রের মাতা ও পিতা বলা হয়েছে। পুত্রের জন্মের পর ইলার অভিশাপের মেয়াদ শেষ হয়। তখন ইলা পাকাপাকিভাবে পুরুষে পরিণত হন। এরপর ইলা তাঁর স্ত্রীর কাছে ফিরে যান এবং তাঁর একাধিক সন্তানের জন্ম হয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)