লোকসাহিত্য
লোকসাহিত্য মৌখিক ধারার সাহিত্য যা অতীত ও বর্তমান কে আশ্রয় করে রচনা করা হয়। বিভিন্ন জায়গার লোকসাহিত্য আলাদা হয়, সেখানকার আচার বিচার ও জীবন প্রণালীর উপর ভিত্তি করে রচিত হয়। সাধারণত অক্ষর জ্ঞানহীন গ্রাম বাসীদের ভাবনা ও মানসিকতার উপর নির্ভর করে প্রচলিত ভাষাই প্রয়োগ হয়।পরিশালীত চিন্তার অভাব থাকলেও লোকসাহিত্যে শিল্প সৌন্দর্য রস ও আনন্দবোধের অভাব থাকে না। লোকসাহিত্য, লোকসংস্কৃতি ধারা বহন করে এবং নির্দিষ্ট জাতির জীবন শৈলী জানা যায়, তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একে “জনপদ হৃদয় কলবর” বলেছেন। লোকসাহিত্য কে আটটি ভাগে ভাগ করা যায় – লোকসংগীত গীতিকা, লোককাহিনী, লোকনাট্য, ছড়া, মন্ত্র ও প্রবাদ।
লোকসাহিত্যে লোকসঙ্গীতের এক বিশেষ স্থান আছে। লোকসঙ্গীত ঐতিহ্যগত ভাবে বিশেষ সম্প্রদায়ের বা গোষ্ঠির মধ্যে প্রচলিত গান, বিষয়, কাল ও উপলক্ষ্য ভেদে এ গান ছোটো বা বড় হয়। ব্রতগান, মেয়েলী গীত, জারী গান, গম্ভীরা গান, বাউল গান, কবি গান, হোলির গান ইত্যাদি।
লোক সঙ্গীতের গায়ক গায়িকারা পেশাদার ও অপেশাদার উভয়ই হতে পারে। পেশাদার কোনো গায়েন দল গঠন করে অর্থের বিনিময়ে গান গায়, কবিয়াল দলবল নিয়ে কবির লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করে। মেয়েলী গীত সাধারণত বিয়ে অনুষ্ঠানে বা বিভিন্ন ব্রতপালনে গাওয়া হয়, ক্ষেত খামারে, নদীর মাঝিরাও ভাটিয়ালী বা মাঝিগান গেয়ে থাকে। বাউল আধ্যাত্মিক গান গায়। বারোমাসি গান গ্রামাঞ্চলে বারোমাসে বিভিন্ন ব্রতপালনে গাওয়া হয়। সারিগান, হুমুর গান, হোলির গানে দেহজ কামনা বাসনা মান অভিমান মিলন বিরহ ইত্যাদি ব্যক্ত হয়। যেমন “বনে কানু বাঁশী বাজায় রে” বা “কি হেরিলাম যমুনায় আসিয়া গো সজনী”[ঘাটু গান], “শুন গো রাই বলি তোরে”[ঝুমুর], “সুন্দরী গো বাইরিয়া দেখ, শ্যামে বাঁশী বাজাইয়া যায় রে”[সারিগান] “নিধুবনে শ্যাম কিশোর সনে খেলবো হোলি আয়”[হোলির গান” ইত্যাদি। ধর্মসংস্কার আচার ব্যাবহার মূলক বিচিত্র লোকসংগীতে প্রচলিত আছে। যেমন কৃষকরা বৃষ্টির জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে, “আল্লাহ ম্যাঘ দে পানি দে, ছায়া দে রে তুই” গানে বৃষ্টির জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা হয়েছে, এমন আবেদন সরাদরি মেঘের কাছেও করা হয়েছে যেমন”মেঘ রাজারে তুইনি সুন্দর ভাই/ এক ঝাড়ি মেঘ দে ভিজ্যা ঘরে য়াই”। পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অঞ্চলের ভাদু টুসু ও জাওয়া গান বিভিন্ন ব্রতের সময় গাওয়া হয়। জাওয়া শস্য রোপণের সময় আর ভাদু শস্য তোলার সময়ের উৎসব। নারী সমাজে আরো অনেক ব্রত আছে, যেখানে সন্তান, সুখসমৃদ্ধি কামনা করে গান ও ছড়া বলা হয়। সে সব ব্রতে সন্তান, সম্পদ ও জগোতিক সুখ সমৃদ্ধি কামনা করে গান করা, ছড়া বলা ও আলপনা আঁকা হয়। কৃষির দেবতা শিব কে কেন্দ্র করে শিবের গাজন উৎসব পালন হয়, ঝড় বৃষ্টি ও বজ্রপাত থেকে ফসল রক্ষার জন্য ওঝা শ্রেণীর শিবালিরা শিঙ্গা বাজিয়ে ও মন্ত্র পড়ে মেঘ তাড়ায়। বর্তমানে এ জাতীয় গান প্রায় লুপ্ত প্রায়। গো সম্পদ রক্ষার উদ্দেশ্যে গোয়াইলার শিরনি ও গোরক্ষনাথের শিরনি আচার পালিত হয়। হিন্দু সমাজে দেব দেবীর উদ্দেশ্যে যেমন ব্রতের গান আছে তেমনি মুসলমান আছে পীর পীররানির উদ্দেশ্যে জাগ গান, এই জাগ গান সন্তান প্রাপ্তি রোগ ব্যাধি দূর করার জন্য গরু বাছুর রক্ষা করার জন্য গাওয়া হয়। গাজী পিরের উদ্দেশ্যে গান গাজী গান নামে পরিচিত। জারিগান বা শোক সংগীত মহরম উপলক্ষে গাওয়া হয়। নারীরা মহরম উপলক্ষে অন্তঃপুরে বসে যে মাতম করে এবং গীত গায় তাকে মর্সিয়া বলে। এতে পতিহারা সখিনার বিরহ যাতনা ও আর্তনাদ গীতের ভাষা ও সুরে প্রকাশ পায়।
কর্ম সংগীতের নামই প্রমাণ করে যে, শ্রম ও কর্মের সঙ্গে জড়িত লোকসংগীত, ক্ষেত নিড়ানো, ধান কাটা, ধান ভানা, ছাদ পেটানো, জাল বোনা, তাঁত বোনা, মাটি কাটা ইত্যাদি কাজে গাওয়া হয়।“আয় রে তরা ভুঁই নিড়াইতে যাই” , “আমরা ধান ভানিয়ে ঢেকিতে পার দিয়া ”।
পটুয়ারা কাগজ বা মাটির পাত্রে পট আঁকে এবং পটের চিত্র অনযায়ী গান করে অর্থ উপার্জন করে। তাদের পটের বিষয় বস্তু রাধকৃষ্ণ রামসীতা, বেহুলা-লখিন্দর, গাজীপীর ইত্যাদি, বেদেরাও সাপ ধরে, ওঝাগিরি করে গান করে জীবিকা চালায়। তাদের গান মূলত বেহুলা-লখিন্দর ও মনসা প্রসঙ্গ।
পুতুল নাচ দেখিয়ে ও গান গেয়ে অর্থ উপার্জন করে আর এক শ্রেণীর মানুষ, এরা রামায়ণ মহাভারত, রূপকথার উপর গান বেঁধে সরু সুতো দিয়ে পুতুলের হাত পা বেঁধে এক অদ্ভুত নিপুণ শৈলী তে পুতুল নাচ দেখায়। পুতুল নাচের জন্য বিভিন্ন ধরণের শিল্পী থাকে, সূত্রধর স্টার সাহায্যে পুতুলের অঙ্গভঙ্গি প্রকাশ করে, কথক সংলাপ বলে, গায়ক গান গায় এবং বাদক বাদ্য বাজায়। এসব কিছুই নেপথ্য থেকে করা হয়, যার জন্য বিশেষ ধরণের মঞ্চসজ্জার প্রয়োজন হয়।
ফেরিওয়ালারা ফেরি করতে করতে গান করে, আবার ফকির-বৈরাগীরা গান গেয়ে ভিক্ষা করে। বিবাহ অন্নপ্রাশনে খেমটাওয়ালারা নাচ গান করে দর্শকদের মনোরঞ্জন করে। এদের গান সাধারণত লঘু রসাত্মক ও অশ্লীল হয়ে থাকে। রাধাকৃষ্ণের লৌকিক প্রেম খেমটা গানের প্রধান বিষয়। চটকা, বোলান, লেটো, ইত্যাদি গানেও রঙ্গ-ব্যঙ্গ হাসি ঠাট্টা বিদ্রূপ অশ্লীলতা আছে। এছাড়া আলকাপ, কবির লড়াই, খেমটা, মেয়েলী গীত, সারি, ঘাটু ইত্যাদি গানও অংশত ব্যঙ্গ রসাত্মক।আসলে লোক-মনোরঞ্জনের এ ধরণের গানের উদ্দেশ্য।
কবিগানে পৌরাণিক ঐতিহাসিক সামাজিক ধর্মীয় অর্থনৈতিক ও শিক্ষা বিষয়ক কাহিনী বা সমস্যাদি স্থান পায়। দাঁড়া কবিগানে তাৎক্ষনিক-ভাবে প্রস্তাবিত বিষয় আলোচিত হয়। রাধাকৃষ্ণের প্রেমাখ্যান কে “সখি সংবাদ” এবং শ্যামার ভক্তিমূলক গামকে “ভবানী বিষয়” বলে। উনিশ শতকে কলকাতা শহরকে কেন্দ্র করে কবিগানের উৎপত্তি হয় পরে তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
সারিগানের সাথে নদী, নৌকা, মাঝি-মাল্লা, পারাপার ইত্যাদি বিষ্য জড়িত। নৌকা বাইচ উপলক্ষে গীত সঙ্গীত সমূহ সারিগানের প্রধান অংশ।, তবে সাধারণভাবে দাঁড় –গুণ টানা বা পাল তুলে নৌকা চালানোর সময়ও এ গান গাওয়া হয়।
কুমারী জীবন, বিবাহিত জীবন ও সংসার জীবনের ভাব নিয়ে মেয়েলি গীত রচিত হয়। বিয়ে উপলক্ষে রচিত মেয়েলি গীতের সংখ্যা বেশী। ম্যেলি গীত বাংলার প্রায় সব অঞ্চলেই প্রচলিত।
গীতিকারে পাত্র পাত্রীর নাম থাকেনা সাধারণত রূপকথার কাহিনী হয় তাতে মন্ত্রী পুত্র, রাজপুত্র, রাজকন্যা, রাক্ষস জাদুগর সওদাগর ধোপা মালিনীপীর পীরফকির ইত্যাদি নাম থাকে। কিন্তু কোনো ভউগলিক অস্তিত্ব থাকে না। গীতিকার প্রধান বিষয় নরনারীর প্রেম, প্রেমের প্রতিবন্ধকতা, বিত্তশালী ও অন্যান্য ক্ষমতাধর ব্যক্তির রূপতৃষ্ণা প্রণয়-বাসনা কামপ্রবৃত্তি ইত্যাদির কথা আছে।
লোককাহিনী পুরুষানুক্রমে মুখে মুখে প্রচলিত কল্পনা ভিত্তিক গল্প, স্বর্গ – মর্ত্য পাতাল দেব দৈত্য জীনপরী রাক্ষস খোক্কস রাজা প্রজা পীর ফকির গ্রামের বিভিন্ন শ্রেণী পশু পাখি নদী সাগর পাহাড় পর্বত চন্দ্র সূর্য দিন রাত্রি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে রচিত। বিষয় ও আঙ্গিক বিচারে লোককাহিনী গুলোকে বারোটি ভাগে ভাগ করা যায় – রূপকথা, ব্রতকথা, পুরাণকথা, রোমাঞ্চকথা, বীরকাহিনী, সন্তকাহিনী, পুরাকাহিনী,স্থানিক কাহিনী, পশু কাহিনী, নিতী কাহিনী, হাস্যরসাত্মক কাহিনী, ব্যাখ্যামূলক কাহিনী। বাংলা ভাষায় প্রায় সব শ্রেণীর লোককাহিনী রচিত হয়েছে। রোমাঞ্চ কাহিনীর উর্বর ভূমি হচ্ছে আরব পারস্য। আলিবাবা ও চালিশ চোর, হাতেম তাই, সিন্দবাদ, আলাউদ্দিনের আশ্চর্য প্রদীপ ইত্যাদি কাহিনী আরব্য-পারস্য থেকে আসা আরবি আলেফলায়লা-ওয়া-লায়লা গ্রন্থ এসব কাহিনীর উৎস । লোককাহিনী তে জাদুবিদ্যার উপর বেশী জোর দেওয়া হয়েছে। বাংলা লোককাহিনীতে সকল স্তরের মানবজীবন ও সমাজের অজস্র চবি আছে, সেসব বিশ্লেষণ করলে জাতির অনেক অজানা ইতিহাস বেরিয়ে আসে। বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, যৌতুক প্রথা, সবলের অত্যাচার, কৌলীন্য বিচার, গুরুভক্তি ইত্যাদির অসংখ্য চিত্র লোককাহিনীতে পাওয়া যায়। লোককাহিনী লোকসাহিত্যের একটি জনপ্রিয় শাখা ছিল, কিন্তু আধুনিক শিক্ষা ও নগরসভ্যতা বিস্তারের ফলে এর চর্চা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।
লোকনাট্য লোকসমাজে প্রচলিত ঐতিহাসিক ধর্মীয় ও লোককাহিনী ভিত্তিক নাট্যাভিনয়, আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে “ গ্রামীণ সমাজে জনসাধারণের জীবন অবলম্বন করে যে নাটকধরমী রচনা মুখে মুখে রচিত হয়ে মুখে মুখে প্রচারিত হয় তাই লোকনাট্য।লোকনাট্যের উপস্থাপনায় দুটি স্তর থাকে প্রস্তুতিপর্ব ও মূলপর্ব। প্রস্তুতিপর্বে মূল কাহিনীর পূর্বে প্রস্তাবনা, সমবেত যন্ত্রসঙ্গীত ও বন্দনা পরিবেশিত হয়, আর মূলপর্বে অভিনয় নৃত্য গীত, কথা ও সংলাপ ইত্যাদি পরিবেশিত হয়। লোকনাট্যে পৌরাণিক ঐতিহাসিক রাজনৈতিক ধর্মীয় ও লৌকিক বিষয় নিয়ে রচিত হয়।গ্রামের সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখ, আনন্দ বেদনা্, অত্যাচার পীড়ন, সংগ্রাম বিরোধ, প্রেম ভালোবাসা ইত্যাদি মিশ্রিত কাহিনী থেকে আনন্দলাভের পাশাপাশি সৎ অসৎ, ধরমা-ধর্ম, পাপপুণ্য ইত্যাদি সম্পর্কেও শিক্ষা লাভ করে।গীতাভিনয় সম্বলিত পালাগানকেও লোকনাট্যের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। যেমন গাজির পালা, বনবিবির পালা, জারিগান, ঘাটুগান, বর্ধমানের লোটোগান, উত্তরবঙ্গে প্রচলিত ভাসান যাত্রার বিষয় বেহুলা-লখিন্দরের জনপ্রিয় কাহিনী। কারবালায় বিষাদময় কাহিনী অবলম্বনে রচিত জারিগানও নাভ বাজনা অভিনয় সাথে পরিবেশিত হয় । পুতুলনাচ লোকনাট্যের একিটি জনপ্রিয় মাধ্যম।
ছড়া সাধারণত শিশুতোষ রচনা হিসাবে পরিচিত। অল্পবয়স্ক শিশুদের ভুলানো বা আনন্দ দেওয়ার জন্য মা দিদা ঠাকুমা যে ছড়া বলে সেসব ছেলে ভুলানো ছড়া। খেলা উপলক্ষে যে সব ছড়া বলা হয় সেসব খেলার ছড়া নামে পরিচিত। হাডূডূ কানামাছি ইত্যাদি খেলায় এইসব ছড়ার প্রচলন আছে। কোনো কোনো কাজে শ্রম লাঘব করা বা প্রেরণা দেওয়া, চিত্তবিনোদনের জন্য ছড়া রচিত হয়। সামাজিক ছড়া, গুলি রচিত হয় পিতা মাতা, পুত্র-কন্যা, ভাই-বোন, শ্বাশুড়ি-বধূ, ধোপা, নাপিত, তাঁতি, কামার, কুমার প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে। ঐতিহাসিক ছড়াও আছে যেমন “ছেলে ঘুমালো পাড়া জুডালো, বর্গী এলো দেশে” এতে বর্গী দ্বারা বাংলা আক্রমণের কথা আছে। বৃষ্টি আবাহনের জন্য “আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দিব মেপে” । বিভিন্ন মেয়েলী ব্রতে ছড়া সুর করে পড়া হয়। এছাড়া আছে বিভিন্ন মন্ত্র যেমন চোরবন্দী, সর্প বন্ধন, গৃহ বন্ধন, বিষঝাড়া, বশীকরণ মন্ত্র ইত্যাদি। ওঝা, বৈদ্য, কবিরাজ, পুরোহিত, সাধু সন্ন্যাসী, পীর ফকির, বেদে, ধাত্রী প্রভৃতি পেশাদার অপেশাদার ব্যক্তি মন্ত্রের প্রয়োগ করে থাকে। মধ্যযুগের কাব্য, ব্রতকথা লোকবিশ্বাস, লোকিক আচার-অনুষ্ঠান চিকিৎসা কৃষিকাজ ও অন্যান্য পেশায় জাদুমন্ত্রের প্রভাব আছে। আসামের কামাখ্যা ছিল মন্ত্রশিক্ষার কেন্দ্র। বাংলার লোককাহিনীতে কায়ার পরিবর্তন বা আত্মার রূপান্তর[transformation of soul] একটি উল্লেখযোগ্য মোটিভ।মন্ত্র আসলে অজ্ঞ ও অসহায় মানুষের সান্ত্বনা মাত্র, বিজ্ঞানের সঙ্গে এর কোনো যোগসূত্র নেই।
ধাঁধা একপ্রকার রহস্যপূর্ণ রচনা, ধন্দ শব্দ থেকে এর উৎপত্তি অর্থ সংশয়, দুরূহ সমস্যা ইত্যাদি আরেক নাম হেঁয়ালি এতে মূলত একটি জিজ্ঞাসা থাকে এবং উত্তরটাও এর মধ্যে থাকে। মূল বিষয় কে আড়াল করে শব্দের জাল বুনে তা রচনা করা হয়। ধাঁধা রচনায় বুদ্ধির সঙ্গে কল্পনার মিশ্রণ আছে। এইজন্য ধাঁধা বেশী বড় হয় না, গদ্যে ও পদ্যে লেখা হয়। ধাঁধা কে লোকসাহিত্যের প্রাচীনতম শাখার একটি বলা হয়। বাংলা ও ভারতের বিভিন্ন গোত্রের আদিবাসীরা বিয়ে, কৃষি কাজ , মৃতদেহ সৎকার ও ধর্মানুষ্ঠানে ধাঁধার ব্যবহার করে। যেমন চোটোনাগপুরের ওঁরাও উপজাতি বিয়ের অনুষ্ঠানে, মধ্যপ্রদেশের গড় উপজাতি মৃতের অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ায়, আসাম ও বাংলাদেশের নাগা, কুকি, গারো, কোচ ও মুরুং উপজাতির কৃষক রা ফসল পাকার সময় ধাঁধা বলে। মহাভারত, জাতক, নাথসাহিত্য, চণ্ডীমঙ্গল ইত্যাদিতে প্রচুর ধাঁধাঁর ব্যবহার আছে, বাংলায় ধাঁধাঁকে পৌরাণিক ঐতিহাসিক সামাজিক প্রকৃতি উদ্ভূত ইত্যাদি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এতে জাতির কল্পনাশক্তি, বুদ্ধিবৃত্তি বিষয়জ্ঞান, সৌন্দর্য চেতনা কৌতুক বোধ প্রকাশ পায়।ি একটি জাতি বা জনগোষ্ঠীর আত্মার মর্মস্থল থেকে ধাঁধাঁর উদ্ভব হয় বলে সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয়। “তলে মাটি উপরে মাটি/ মধ্যে সুন্দরঈ বেটি”[হলুদ], “ঘরের মধ্যে ঘর/ নাচে কন্যা বর”[ মশারি], ছোট ইটা ছেমরি/ নায়না ধোয়না এতই সুন্দরী[রসুন] ইত্যাদি ধাঁধা পারিবারিক জীবনের বিভিন্ন চিত্রকে ধারণ করে আছে।
লোকসাহিত্যের শাখাগুলির মধ্যে প্রবাদ অতীতের বিষয় হলেও সমকাল কে সবচেয়ে বেশি স্পর্শ করেছে। আধুনিক যুগে প্রায় সবধরনের রচনায় প্রবাদ ব্যবহার করা হয় কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাটক, সংবাদপত্র, বিজ্ঞাপন, বক্তৃতা দৈনন্দিন কথাবার্তা ইত্যাদিতে প্রবাদের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। লোকসাহিত্যের ধারায় প্রবাদ হলো ক্ষুদ্রতম রচনা, যে কোনো প্রবাদ মানুষের ব্যবহারিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থেকে জন্ম নেয়, “অতি সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট”, “চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে” , “জোর যার মুল্লুক তার”, “লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন” ইত্যাদি। অল্প কথায় এত বেশী অর্থ বহন ক্ষমতা প্রবাদ ছাড়া লোকসাহিত্যের অন্যকোনো শাখায় নেই, যে উক্তি লোকপরম্পরায় জনশ্রুতিকে নির্ভর করে চলে আসছে তাই প্রবাদ। দেশের প্রকৃতি পরিবেশ, পারিপার্শ্বিকতা প্রাণী সম্পদ, জাতীর জীবনের নানাধারা, তার ইতিহাস, সংস্কৃতি, ধর্ম সমাজিত্যাদি বিষয় নিয়ে প্রবাদ রচিত হয় প্রবাদ বহু প্রাচীন কাল থেকেই প্রচলিত আছে খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে মিশরের প্যাপিরাসের গল্পে প্রবাদ আছে, ভারতীয় বেদ, উপনিষদ এবং বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদে ও প্রবাদ আছে।
লোকসাহিত্য বিশেষ একটি যুগ কিংবা বিশিষ্ট একটি সমাজের চিত্র প্রকাশ পায় না এর মধ্যে একাধারে অতীত যুগের ঐতিহাসিক চিত্র যেমন প্রকাশ পায় তেমনি সমসাময়িক কালের চিত্রও প্রকাশ পায়, কিন্তু দুইই এখানে সমান অস্পষ্ট হয়ে পাশাপাশি অবস্থান করে, সেখানে কোনও ঐতিহাসিক দাবী থাকতে পারে না।
লেখক পরিচিতি
জন্ম ৪ঠা জুলাই, ১৯৬৬ পশ্চিমবঙ্গ এর নবদ্বীপ এ, পিতা চাকরী করতেন দামোদর ভ্যালী কর্পোরেশনে(D V C) তাই বাংলার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছেন, বিশেষ করে বর্ধমান, বাঁকুড়া, বীরভূম এই সব জায়গায়, তাই ওনার লেখায় ওই সব জায়গার কথা ভীষণ ভাবে প্রকাশ পায়, বিবাহ সুত্রে ভারতীয় বায়ুসেনার বিভিন্ন ইউনিটে ঘুরে বেড়িয়েছেন, ছোটো থেকেই লেখার উৎসাহ পান মায়ের কাছ থেকে, কবিতা, প্রবন্ধ, লেখেন, তাছাড়া গান, নাচ ও আবৃত্তি তেও তালিম নিয়েছেন, প্রথম বই, 'প্রচেষ্টা', বর্ধমানের ডুবুরী, শতাব্দী র সংবাদ পত্রিকা তে কবিতা প্রকাশ হয়েছে, দিল্লীর ' দিল্লী জংশন ' বই এ কবিতা প্রকাশ হয়েছে। বর্তমানে দিল্লীর বাসিন্দা।
সুচিন্তিত মতামত দিন