আজব নেশার সাতকাহন
কালীপুজোর পরের দিন। সকাল থেকে যোগীমামাকে দেখা যাচ্ছে না। দাদু খোঁজ করছে, বাপন মামা খোঁজ করছে। এমনকি শীলামাসিও ছড়িয়ে থাকা জ্বলা তুবড়ির খোল, পোড়া চরকি, ফুলঝুরির তার এসব কুড়িয়ে এক জায়গায় জড়ো করতে করতে ছাত থেকে ঝুঁকে আমার উদ্দেশে হাঁক পাড়ে, এই বুড়োন, তুই যোগীদাকে দেখেছিস? সেই ছোটো বেলা থেকেই দেখছি যোগীমামাকে ছাড়া যেন দাদুর বাড়ির কোনো কাজই সুসম্পন্ন হয় না। সে শীলা মাসির বিয়েই হোক, কী বাপন মামার পৈতে। বাড়ির পাতকুয়োতে পড়ে যাওয়া বালতি তোলাই হোক অথবা পাগলাতলা মন্দিরের কালীপুজো। আমি দাদুর বাড়ির পাঁচিল ঘেরা উঠোন পেরিয়ে রাস্তার ওপারের বাগানে ঢুকে দেখি একটা বেঁটে কাঁঠাল গাছে হেলান দিয়ে মাটিতে বসে আছে যোগীমামা। সামনে দুপা ছড়ানো। মাথা ঘাড় থেকে ঝুলে রয়েছে চওড়া বুকের পরে। কাঠালপাতার ফাঁক দিয়ে সকালবেলার আলো এসে পড়েছে ওর একমাথা এলোমেলো চুলে। আমি হাঁটু মুড়ে বসে, ওর কাঁধে হাত রেখে ডাকি, যোগীমামা, কী হয়েছে?
--এখনো ধুমকি কাটে নি রে! চোখটা সামান্য খুলে যোগীমামা বলে। গলার স্বরে মনে হচ্ছে যেন কত দূর থেকে কথাগুলো ভেসে এল।
-- তুমি কি কাল বেশি মাল টেনেছিলে? কই, দেখে তো মনে হচ্ছিল না। যেভাবে স্টেডি হাতে অতগুলোকে নামালে!
যোগীমামা বিশেষ মদ-টদ খায় বলে কখনো শুনিনি। অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়া, সাহসী, অবিবাহিত যোগীমামাকে তো সেই ছোটোবেলা থেকেই দেখছি। মেদিনীপুর না বাঁকুড়া থেকে এসে কবে যে এই বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল আমি নিজেও ঠিক করে জানি না। শুধু এটুকুই জানি যে দাদুই যোগীমামাকে নিজের ছেলের মতো মানুষ করেছিল। অথচ সেই দাদুই আবার প্রতিবছর কালীপুজোর দিন সন্ধ্যায় যোগীমামার জন্য একটা ওল্ড মঙ্ক রামের পাঁইট কিনে আনাতেন পুজোর জিনিস পত্রের সঙ্গে। পুজোর দিন সন্ধ্যায় যোগীমামা কখনো জলে মিশিয়ে সেই রামটুকু খেত কখনো বা পড়েই থাকতো। কিন্তু কাল যদি পুরোটা খেয়েও থাকে তার নেশা তো আজ সকাল পর্যন্ত থাকার কথা নয়!
-- ঐ নামানোরই তো নেশা, বুঝলি। ঐ রক্তেরই তো নেশা। কী গন্ধ মাইরি! কী রঙ! ঐ ফিনকি দিয়ে বেরোনো, ঐ গড়িয়ে যাওয়া...। কথাগুলো বলতে বলতে যোগীমামার লাল চোখদুটো যেন বুজে আসে। মাথা আবার ঝুলে পড়ে বুকের পরে। যোগীমামাকে দেখে মনে হয় ঠিক যেন বাংলা খেয়ে আউট হয়ে যাওয়া কোনো পাকা নেশাড়ু।
দাদুদের পাগলাতলার কালীমন্দিরে যত পাঁঠা বলি, গ্রামের মানুষদের বছরভরের যত মানসিক, সব কাল রাতভর বলি দিয়েছে এই যোগীমামা। এক এক কোপে নামিয়েছে একএকটা পশুর গলা। বেশ ক'বছর ধরেই দিচ্ছে। আর দিতে দিতে যোগীমামার কাছে আজ এ এমন এক নেশা পরের দিন সকালেও যার ঘোর কাটে না।
ঘোর অবশ্য আমাদের স্কুলের বোঁদেদারও কাটত না। বোঁদে দাম। তারকমোহন বিদ্যামন্দিরে আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি, তিন বছর ফেল করে আঠারো-উনিশ বছরের বোঁদেদা তখনও নাইনে। সবার হেলাফেলার পাত্র।
একদিন পিটি ক্লাসের শেষে, এই তোর সঙ্গে কথা আছে, বলে আমার হাত ধরে স্কুলের উত্তরদিকের পাঁচিল ঘেষা পেয়ারা আর কলকে গাছ ঢাকা গলিতে টেনে নিয়ে গিয়ে বলেছিল, একটা জিনিস দেখবি?
কী? বলতেই নিজের প্যান্টের বোতাম খুলে বোঁদেদা একটানে বের করে ফেলেছিল নিজের কালো বড় ঝুলে থাকা ইঁদুরের মতো নুংকুটা। আমাকে বলল, এবার তোরটা দেখা দেখি কত বড়।
আমার মুখে জড়ো হওয়া বিস্ময় আর অস্বস্তি লক্ষ করে নিজেই আমার হাফ প্যান্টের বোতাম খুলে বের করে এনেছিল হতবম্ব হয়ে যাওয়া, ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা আমার লাজুক কিশোর নুংকুটা। একঝলক তাকিয়েই হেসে, অবজ্ঞার স্বরে বলল, ধুস! আমার থেকে অনেক ছোট। এমনিতে তো বেশ লম্বা চওড়া হয়ে গেছিস, নুংকুটা এখনও তেমন বড় হয়নি দেখছি। তবে তোদের ক্লাশের ফার্স্ট বয় সেকেন্ড বয়, ওই যে পারিজাত আর শঙ্কু, ওদেরটা কিন্তু তোর থেকেও ছোটো। জানিস, নাইন টেনের সব ছেলেদের থেকেই আমারটা বড়!
মেরেকেটে পাঁচ ফুট উচ্চতার, কালো, গাট্টাগোট্টা বোঁদেদাকে আমি বলে ফেললাম, জানি তো।
নিজের প্যান্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, জানিস? কী করে? কে বলল?
স্কুলের সবাই তো জানে।
বোঁদেদা গর্বের হাসি হেসে বলেছিল, হ্যাঁরে। এই জন্যই তো সবারটা চেক করি। আরে বাবা, যতই পড়াশোনায় বা খেলাধুলায় ওস্তাদ হও কিংবা কার্তিকের মতো চেহারা, এই ব্যাপারে বোঁদেকে কেউ এখনো হারাতে পারেনি। আমারটাই সব থেকে বড় বুঝলি! এই একটা বিষয়ে আমিই ফার্স্ট। জানিস তো এক এক সময় রাস্তায় কোনো ছেলেকে মাস্তানি করতে দেখলেই ইচ্ছে করে মেপে দেখি আমার থেকে বড় নাকি। এমনকি স্যারেদেরগুলোও দেখতে ইচ্ছে করে। স্যারদেরও নির্ঘাৎ হারিয়ে দেব। তোর কি মনে হয় সুবীর স্যারেরটা আমার থেকেও বড় হবে? সুবীর স্যার ছিলেন আমাদের পিটির সুপুরুষ স্যার।
এখন বুঝতে পারি এটা আসলে ছিল বোঁদেদার এক নেশা। আমার পাড়ার বন্ধু প্রসাদ এজন্যই খুব খার খেতো বোঁদেদার ওপরে। রাগ করে বলতো, অন্যের মেসিন মাপতে মাপতে দেখবি ঢ্যামনাটার নিজের মেশিনে একদিন মর্চে পড়ে যাবে! যত ফালতু নেশা শালা!
প্রসাদ পাল। ওদের মূর্তি তৈরির পারিবারিক ব্যাবসা। খুব সুন্দর গানও গাইতে পারতো প্রসাদ। দেখতেও ছিল সুদর্শন। সেই প্রসাদের নেশা ছিল গোপন স্পর্শে। চড়কের মেলাই হোক বা রথের, পুজো প্যান্ডেলে অঞ্জলি দেওয়ার ভিড়ই হোক বা ভিড় ট্রেনে বাসে প্রসাদ সবসময় গোপনে মেয়েদের স্পর্শ করার সুযোগ খুঁজতো। ও বলতো, শালা, তোরা বুঝবি না। এই লুকিয়ে ছোঁয়ার কী যে নেশা! এর উত্তেজনাই আলাদা। প্রেম করে বা পটিয়ে ছোঁয়াছুঁয়ি কিংবা পয়সা খরচা করে সোনাগাছিতে ছুঁয়ে এ মজা জীবনে পাবি না। একদিন ছোঁয়ার মত ছুঁতে পারলে জানিস, শালা দিনভর তার খোঁয়াড়িই কাটে না।
নেশা মানেই যেন নিষিদ্ধ কোনো কিছুকে ছোঁওয়ার উত্তেজনা। নেশা মানে নষ্ট অভ্যাস। নেশা নচ্ছারের লক্ষণ। নেশা শব্দটার সঙ্গেই যেন জড়িয়ে আছে এক নেতিবাচকতা। সখ বললে কিন্তু তেমন মনে হয় না। সখ যেন নেশার মতো মন্দ নয়। দোষের নয়। রোজ একটা করে সিনেমা দেখলেই লোকে বলবে সিনেমার নেশা কিন্তু সকাল সন্ধ্যা খেয়াল শুনলে বলবে, আহা, শাস্ত্রীয় সংগীতের সখ। অতিরিক্ত আড্ডা প্রীতি হলে সেটা নেশা কিন্তু আলোচনা বা তর্কে প্রীতি হলে সখ। দিনরাত প্রবন্ধের বই মুখের সামনে নিয়ে বসে থাকুন সে হবে বেশ সম্ভ্রান্ত এক সখ, কিন্তু দিনরাত নভেল পড়লেই হয়ে যাবে নেশার ব্যাপার। নেশা নষ্টামী ও ন্যাক্কারজনক হলেও সখের সাথে যেন জড়িয়ে আছে শৌখিনতা ও সাধ।
তবে নেশা ও সখের মধ্যের সীমারেখাটা যে সবসময় খুব পরিস্কার ও স্পষ্ট তা মোটেই নয়। মাঝেমধ্যেই এদের মাঝখানের সূক্ষ্ম সীমানার ওপরে কুয়াশা জমে তাকে ঝাপসা করে তোলে। সখ ও নেশার পার্থক্য যায় গুলিয়ে।
যেমন এখন নেশার সাতকাহন লিখতে বসে বুঝতে পারছি না আমাদের সময় থেকে শুনে আসা চা পান নস্যি সিগারেট মদ গাঁজা চরস তাস পাশা থেকে আজকের দিনের সিসা লাউঞ্জ, ইয়াবা, ফেনসিডিল পর্যন্ত নেশা কে না হয় নির্দ্বিধায় নেশা বলে চিনে নেওয়া যায়, কিন্তু কী বলব আমাদের ছেলেবেলায় দেখা বীণা দাশগুপ্ত বা অলোকের ঘটনাকে? কিংবা আজকের দিনের মৃদুলা বা বিশ্বনাথের মতো মানুষদের অভ্যাসগুলোকে!
কে নাম দিয়েছিল আজ আর মনে নেই, তবে আমাদের পাড়ার চিত্ত জেঠুর অবিবাহিতা মধ্য বয়স্কা বোনটিকে সবাই আড়ালে বীণা দাশগুপ্ত বলেই ডাকত। তার আসল নাম যে মঞ্জু আমরা তা ভুলেই গিয়েছিলাম। সেই মঞ্জুপিসি সাত সকালেই দুভুরু এঁকে, চোখে টানা কাজল দিয়ে, লালটুকটুকে লিপস্টিক পরে মাথায় ইয়া বড় একটা খোঁপা বেঁধে সেজে গুজে সেই যে হরিনঘাটার দুধের গুমটির উদ্দেশে বেরোতেন, তারপর থেকে সারাদিনই তাকে দেখা যেত তেমনি চড়া সাজে। চব্বিশ ঘন্টা, তিরিশদিন, বারো মাস। আর তিনি খুব সাধারণ কথাও বলতেন খুব সুর করে, উচ্চস্বরে, যাত্রার ঢঙে। সেকারণেই বোধহয় তার নাম হয়েছিল বীণা দাশগুপ্ত, সে সময়ের নামকরা যাত্রা শিল্পীর নামে। আর ছিল অলোক। সতীন সেন নগরে থাকতো। রাত ঘন হলেই সে বেরোতো অন্যের ঘরে উঁকি দিতে। যুবতী মেয়ে আছে বা নতুন বিয়ে হয়েছে এমন বাড়ির একতলায় গরমের দিনেও রাতে জানলা খুলে রাখার উপায় ছিল না অলোকের দৌরাত্ম্যে। এই যে আমার তরুণ বয়সে দেখা মঞ্জু পিসির অতিরিক্ত সাজের প্রতি বা অন্যের শয়নকক্ষের প্রতি অলোকের অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ একেও কি নেশাই বলব! কিংবা কী বলব আজকের দিনের মৃদুলা বসু অথবা বিশ্বনাথ সানকির স্বভাবকে! মৃদুলা আছেন আমার ফেসবুকের বন্ধু তালিকায়। মৃদুলা সুশ্রী, মধ্যবয়স্কা, অবস্থাপন্ন এবং বিবাহবিচ্ছিন্ন। মধ্যরাতে তিনি তৎপর হয়ে ওঠেন ফেসবুকের ইনবক্সে। ফেসবুকে আপাত সুখী দম্পতির ফটো দেখলেই তার ভেতরে তীব্র ইচ্ছে জেগে ওঠে ঐ স্বামীটিকে বন্ধু বানিয়ে তার সঙ্গে ফ্লার্ট করার। তারপর কিছুদিন বাদে পুরুষটির সঙ্গে প্রেমালাপের স্ক্রীনশট তার স্ত্রীর মেসেঞ্জারে পাঠিয়ে দিয়ে মৃদুলা পান এক স্বর্গীয় তৃপ্তি। আর বিশ্বনাথের ইচ্ছা কবি হওয়ার। সারাদিন ঘাড় গোঁজ করে সে শব্দের সঙ্গে শব্দ সাজাচ্ছে। অন্যের লেখা থেকে টুকে রাখছে ভালোলাগা পংক্তি। পছন্দের শব্দবন্ধ। তারপর জোড়াতাপ্পি দিয়ে খাড়া করছে একএকটি কবিতা। পোস্ট করছে ফেসবুকে, পাঠাচ্ছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে। মানুষকে ইনবক্সে বারবার অনুরোধ করছে তার লেখার নিচে মন্তব্য করতে, লাইক দিতে। তার কবিতা ছাপলে সে কত কপি কিনে নেবে জানিয়ে পত্রিকার সম্পাদকদের প্রলোভন দেখাচ্ছে। যে করেই হোক সে নিজের নাম দেখতে চায় ছাপার অক্ষরে। যেভাবেই হোক ফেসবুকে পোস্ট করা তার কবিতার নীচে সে দেখতে চায় লাইক ও মন্তব্যের বন্যা।
খবরের কাগজে বা টিভিতে নেশামুক্তির নানান উপায়, ওষুধ কিংবা দেশজুড়ে গজিয়ে ওঠা পেশাদার সেন্টারের নানান বিজ্ঞাপন দেখতে পাই। কিন্তু সেখানে কি চিকিৎসা হয় যোগীমামা, বোঁদেদা বা প্রসাদের মতো অমন সব সৃষ্টিছাড়া নেশাড়ুদের! কোন ওষুধে কমবে মঞ্জু পিসির অতিরিক্ত প্রসাধনের, মৃদুলার অন্যের দাম্পত্য ধ্বংসের, অলোকের লুকিয়ে দেখার কিংবা বিশ্বনাথের যেনতেনপ্রকারেণ কবি বনার নেশা! এসব আজব নেশার পেছনের মনস্তত্বই বা কী! জানি না। তবে এমন নেশা থেকে প্রায়শই যে তাদের মুক্তিও ঘটে যায় এটা দেখেছি।
সেই কালীপুজোর পরের দিন বিকেলে দাদুর বাড়ির ছাতে উঠতে গিয়ে থমকে গিয়েছিলাম। চিলেকোঠা থেকে কানে এসেছিল শীলামাসি আর যোগীমামার চাপা স্বর।
-- না, তুমি সামনের বছর থেকে আর কিছুতেই বলি দিতে পারবে না। শীলামাসি যেন ফোঁপাচ্ছিল।
-- কেন, তাতে তোমার কী? আমাকে তো বলি দিয়েই বিয়ের পিঁড়িতে উঠেছিলে, সে বেলায়? যোগীমামা বলছিল। উঁকি দিয়ে দেখলাম যোগীমামা দুহাত দিয়ে শীলামাসিকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে রেখেছে।
-- বাজে কথা বলবে না। আজ আমার মাথায় হাত রেখে তুমি দিব্যি করো এবার বিয়ে করে সংসারী হবে। আর এসব অকারণ রক্তের নেশায়...
আর শুনিনি। নিঃশব্দে নেমে এসেছিলাম সিঁড়ি দিয়ে। সকালে দেখা ঐ লালচোখ, এলোমেলো চুলের যোগীমামা যেন অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল আমার কাছে। মনে আছে তার কমাস বাদেই যোগীমামা বিয়ে করেছিল। সে বছর কালীপুজোয় যোগীমামা নতুন বউ নিয়ে বারাসাতে চলে গিয়েছিল সারারাত ধরে ঠাকুর দেখতে।
আমরা যেবছর মাধ্যমিক দিই, বোঁদেদা সেবছর কোনোমতে ক্লাস টেনে উঠলেও টেস্টে আটকে গিয়েছিল। হঠাৎ একদিন দুপুরে স্কুলে দোতলার ল্যাবরটারিতে আগুন লেগে ভয়ংকর হয়ে উঠলে বোঁদেদা নিজের প্রাণ সংকট করে আতংকিত সমস্ত নাইনের ছাত্রদের নিরাপদে নিচে নিয়ে এসেছিল। শুধু তাই নয় আমাদের যে বিজ্ঞান শিক্ষক, যিনি তখন একটা দুর্ঘটনার পর ডান পায়ে প্লাস্টার নিয়ে ক্লাচের সাহায্যে স্কুলে আসতেন, সেই রহজদ্দি স্যারকে পর্যন্ত পাঁজাকোলে করে ধোঁয়ায় ভরে যাওয়া ল্যাবরেটারি থেকে উঠিয়ে একতলায় নিয়ে এসেছিল। সেবছর স্কুলে বাৎসরিক অনুষ্ঠানে সবার সামনে মঞ্চে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল বোঁদেদাকে। বছর বছর ফেল করা, মাত্র পাঁচ ফুট উচ্চতার বোঁদেদাকে। সবার প্রশংসায় ভাসতে ভাসতে বোঁদেদার উচ্চতাই যেন বেড়ে গিয়েছিল। সে ঘটনার পর আশ্চর্যজনক ভাবে আর কেউ কখনো বোঁদেদাকে অন্য পুরুষের নুংকুর মাপ নিয়ে কথা বলতে শোনেনি।
যেমন আমাদের পাড়ার প্রসাদের কাছে এখন তার ঐ তরুণ বয়সের গোপন ছোঁয়ার নেশার কথা বললে ভারি লজ্জা পায়। প্রসাদ এখন একজন মৃৎশিল্পী। ছাত থেকে ঝুলে থাকা সিএফএল আলোর নিচে দাঁড়িয়ে সে একমনে কাঠামোতে খড় বাঁধে, তারপর মাটি চাপায়, রঙ করে। একটু একটু করে ফুটিয়ে তোলে নানান সাইজের দেবীর অবয়ব। সেদিন শীতের সন্ধ্যায় অনেকদিন বাদে তিন সন্তানের পিতা প্রসাদের কাছে গিয়েছিলাম আড্ডা মারব বলে। প্রসঙ্গক্রমে ওর সেই নেশার কথা তুলতেই ও যেন একটু থমকে গেল। তারপর পরম মমতায়, যত্নে নিজের ভিজে আঙুলগুলো দিয়ে সামনের প্রতিমার কুচকূম্ভে মাটির প্রলেপ দিতে দিতে লাজুক হাসলো। বললো, না রে, অল্প বয়স ছিল তো বুঝি নি। এখন তেমনি ভালোলাগায় ছুঁই শুধু প্রতিমার দেহগুলো। চোখের সামনে দেহগুলো যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে একটু একটু করে। তারপর যখন জীবনের সব স্পর্শের স্মৃতিকে একাগ্র করে চোখ আঁকি মনে হয় দেবী প্রতিমা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন। এর থেকে তৃপ্তি, এর থেকে উত্তেজনা বোধহয় আর কিছুতে নেই রে! তারপর মৃদু স্বরে গুনগুন করে উঠল, "...কিছু পলাশের নেশা, কিছু বা চাঁপায় মেশা, তাই দিয়ে মনে মনে রচি মম ফাল্গুনি। একটুকু ছোঁয়া লাগে..."
সুচিন্তিত মতামত দিন