তুষ্টি ভট্টাচার্য

মায়াজম
0
              নেশা নেশা, আগুন আগুন 
Related image

ছেলেটা ঠোঁট ছুঁচলো করে একের পর এক নিঁখুত রিং ছেড়ে যাচ্ছে। আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি রিং গুলোর দিকে, যতক্ষণ না ওরা মিলিয়ে যাচ্ছে। রিং ছাড়তে তো অনেককেই দেখেছি, কিন্তু এর মত এমন নিঁখুত, আর প্রত্যেকটাই নিটোল রিং ছাড়তে কাউকে দেখিনি। রিং ছাড়ার কি কোন কম্পিটিশন হয়? যদি হয়, এ ছেলে নিশ্চই চ্যাম্পিয়ন সেখানকার। এই হল আসল রিং মাস্টার তাহলে! ওর পাশে আরেকটা ছেলে আর মেয়ে বসে আছে। এবার বোধহয় পাশের ছেলেটার পালা। এ দেখি খুব সিরিয়াস মুখ করে সোজা হয়ে বসল। এক গাল ধোঁয়া নিয়ে গাল ফুলিয়ে এক আঙুল দিয়ে টুকটুক করে টোকা দিচ্ছে নিজের গালে আলতো করে… ছোট ছোট বৃত্ত বেরিয়ে আসছে একে একে। খুব হাল্কা, তুলোর মত স্বভাব এগুলোর। সহজেই মিলিয়ে যাবে বলে যেন তৈরি হয়েছে। আগের ছেলেটির রিং গুলোর দিকে চোখ রাখা যাচ্ছিল, ফলো করা যাচ্ছিল, আর এছেলেটির রিং গুলো যেন মনোযোগের পরীক্ষা নিচ্ছে। চোখ সরালেই পালিয়ে যাবে। মেয়েটি এতক্ষণ পর্যন্ত চুপচাপ দেখে যাচ্ছিল। এরপর ওর পালা এল। এক মুখ ধোঁয়া নিয়ে প্রথমেই খাবি খেল। আরেকবার সুযোগ নিল। এবারে প্রথম দু একটার পরে ফিক করে হেসে ফেলল। আর তারপর হেসে গড়িয়ে পড়ল পাশের ছেলেটির গায়ে। 
সেদিন ছিল হ্যাপি আওয়ার। বাই ওয়ান, গেট ওয়ান ফ্রি। ছেলেটার বোধহয় সেদিন বিয়ার খাওয়ার খুব ইচ্ছে হয়েছিল। এক লিটার অর্ডার দিতে সঙ্গে আর এক লিটার ফ্রি পেল। ওর সঙ্গে গার্ল ফ্রেন্ড বা বউ ছিল। সে মেয়েটিও সঙ্গ দিচ্ছিল টুকটুক করে। মাঝপথে ওয়েটার এসে হুক্কা নেবেন কিনা জিজ্ঞেস করাতে ছেলে তো এক পায়ে রাজী। কিন্তু এখানেও সেই এক কলকের সঙ্গে আরেকটা কলকে ফ্রি। মেয়েটি তো হাত তুলে দিয়েছিল অনেকক্ষণ আগে। ছেলে বিয়ার খেয়ে হুঁকো টেনেই চলছিল সমানে। সে কী যে সে টান! একটা শেষ হল আরেকটা টিকে বসিয়ে দিয়ে গেল তামাকের। বুকে লাগছিল নিশ্চই, মনে হচ্ছিল এই বুঝি হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে। আমি  বারণ করার কে? যদি অপমান করে! চুপ করেই ছিলাম। তারপর দেখি ম্যানেজার গোছের কেউ ছেলেকে বোঝাল। বলল, এভাবে খাবেন না স্যার! দুদিন বুকে ব্যথা থাকবে। কাশির দমকে রাতে ঘুমোতে পারবেন না। অগত্যা রণে ভঙ্গ দিল তারা।
কলেজ থেকে একটু দূরে গঙ্গার ধারে চারটে ছেলে সিগারেট টানছে। তীব্র কটু গন্ধে মালুম হচ্ছে নেহাতই মামুলী সিগারেট নয়। এই দিনের আলোতেও সিগারেটের আগুন ভাঁটার মত জ্বলছে। একটা ছেলে কেশে উঠল একটু। পরক্ষণেই দমকে দমকে কাশি আসতে থাকল তার, পাশের ছেলেগুলো ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে আচে ওর দিকে। কেউ কিছু বলছে না, একজনের ঠোঁট নড়ে উঠল, কিন্তু শব্দ ফুটল না। সিগারেট শেষ হয়ে গেছে ওদের। ওরা তেমনি অনড়, অটল হয়ে স্থির বসে আছে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে। সম্ভবত আধঘন্টা পরে ওরা উঠল ওখান থেকে। লাল খর চার জোড়া চোখের পলক পড়ছে না আপাতত। এগোচ্ছে কলেজের দিকেই। অথচ মনে হচ্ছে গন্তব্য কয়েকশ মাইল দূরে। জানি না, ওরা শেষ পর্যন্ত কলেজে পৌঁছতে পেরেছিল কিনা, ক্লাস করেছিল কিনা। আরেকদিন সোশালে উঠতি নামকরা এক অল্প বয়সী গায়িকাকে ওরা এনেছিল। গান শুরু করার আগে ছোট ছোট কল্কে নিয়ে ওরা বসেছিল গায়িকার সঙ্গে মজলিশে। গায়িকাও প্রায় তাদের বয়সী। থার্ড ইয়ারের ছাত্রী। কল্কেতে টান না দিলে সে গাইতে পারে না, শুনেছিলাম। পুরো ছিলিম শেষ হবার পর গায়িকা স্টেজে উঠেছিল, আর গেয়েওছিল বেদম হয়ে। তাও আবার রবীন্দ্রসঙ্গীত। হাল্কা বিটে ফেলে গাওয়া, ঝঙ্কার বিট নয় যদিও। পুরো মাঠ কাঁপছিল তার গানের সুরে, ছেলেমেয়েরাও, এমনকী স্যার, ম্যাডামরাও ধন্য ধন্য করেছিলেন। সত্যিই বড় মিঠে গলা আর গায়কী তার। 
দোলের দিন প্রতি বছরই ওদের বাড়ির ছাদে প্যান্ডেল বেঁধে মোচ্ছব হয়। সকাল থেকে এক প্রস্থ রঙটঙ মেখে বেলা গড়ালে সবাই আসতে থাকে সেখানে। রঙ, আবীর তো আছেই, মদ্যপানেরও অঢেল ব্যবস্থা। মাংস রান্না হচ্ছে ততক্ষণে, তার আগে ফ্রাই ট্রাই দিয়ে বসেছে আসর। খানিক বাদে কাঁচা, কষা মাংসও নিয়ে আসবে এক বাটি, কেউ না কেউ। সারা বাড়ি রঙিন, দেওয়াল, মেঝে ময় রঙের আস্তরণ। মালকিন সেই রঙ তুলবে সাতদিন ধরে। আপাতত ভদকার জলরঙ লাল, নীল, সবুজ, ম্যাজেন্টা হয়ে যাচ্ছে। দাঁত বের করে হাসছে ওই যে লোকটা, তাকে দেখে মনে হচ্ছে রক্ত খেয়েছে বুঝি! নেশা চড়ছে যত, হল্লা বাড়ছে। কে যে কাকে কী বলছে, আর কী নিয়ে এত হাসাহাসি, ঠাহর হচ্ছে না সাদা চোখে। ভেজা গায়ে রঙ শুকোচ্ছে, গলা ধরে আসছে। কারুর মাথা টিপটিপ করছে, বলছে, এ বছরই লাস্ট। সামনের বার থেকে আর রঙ খেলব না। বয়স বাড়ছে, আর সহ্য হয় না। শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। ক্রমশ নেশার রঙ রঙিন ভদকা আর হুইস্কির রঙের থেকেও তীব্র হয়ে উঠেছে। দুটি মেয়ে এক গেলাসের ইয়ার, প্রায়ই বসে ওরা। ওদের নেশার তীব্রতা বোঝা যায় না তেমন। দিব্যি আড্ডা দিচ্ছে ঠ্যাঙ ছড়িয়ে। সিগারেট জ্বলছে তো জ্বলছেই। এখানে অবশ্য শুধুই তামাক পাতা। আর একটি মেয়ে মদে জল ঠেকায় না। রেগুলার না হলেও, যখনি পানে বসে জল বিনা। তা সে আজও জল বিনা চলতে চলতে লাগামছাড়া তৃষ্ণার্ত হয়ে গেছে এই দুপুরে। পুরুষ মানুষ তো জামা খুলে ফেলতেই পারে লোক সমাজে। গেঞ্জি আছে একটা অবশ্য। সেই সাদা গেঞ্জি রুঙিন হয়ে ভিজে ঝুলে আছে তার গায়ে। ফলে তার স্তন বৃন্ত দুটি উদোম হয়ে পড়েছে। তাতে আর দোষ কী তেমন? পুরুষই তো। মহিলা হলে নাহয় আব্রুর প্রসঙ্গ। সেই মেয়েটি নেশায় আর রঙে এবার যদি কামতাড়িত হয়ে ওঠে সেই পুরুষ শরীর দেখে, খুবই লজ্জার বিষয় হবে জানি। আর বিষয়টা ঠিক তেমনই গড়াল। বন্ধুবান্ধবদের উপস্থিতি ভুলে সেই মেয়ে সেই পুরুষের বৃন্তে কামড় বসিয়ে দিল হঠাতই! হতবাক সবাই। তারপর হাহাহিহি…নেশা ঝরে গেল আবারও। ভাত, মাংস কে খাবে এখন? খেল কেউ কেউ, কেউ ছড়িয়ে ফেলল, কাউকে আবার ভাতের থালায় মুখ থুবড়ে পড়ে যেতে দেখলাম। তবে সেযাত্রা এমন এক ডালপ্রেমীকে প্রত্যক্ষ করা গেল, যার কোন তুলনা বোধহয় কোথাও নেই। প্রথম পাতেই ভাতের সঙ্গে ভাজা এল, তারপর মুগ ডাল। রাঁধুনি ডালটা অবশ্য ভালই রেঁধেছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু সেই লোকটি এক গ্রাস ভাত তুলছে ডাল মেখে, আর তারিফ করে চলেছে ডালের। আবার দেব? ঘাড় নাড়ল। এভাবে ডালের ওপর ডাল, ডালের পুকুর হয়ে দাঁড়াল তার পাতটি। তপসে ফ্রাই পড়ে রইল, খাসীর মাংস পড়ে রইল। লোকটি এক নাগারে সেই মুগ ডালের সমুদ্রে সাঁতার কেটে চলল। এক সময় প্রায় ডুবেই যাচ্ছিল। তখন তাকে পাঁজাকোলা করে কেউ তুলে দিল খাওয়া থেকে। আহারে! খেতেও দিল না বেচারিকে! এমনকি তাকে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছিল কেউ, যাওয়ার পথেও চিৎকার করে ডালের স্বাদের সুখ্যাতি শুনিয়ে গেল পাড়াপড়শিকে। এমন ডালপ্রেমী আর কেউ দেখেছে বলে আমার জানা নেই। সেদিন রাতেও ছিল আসর। রঙ ছাড়াই রঙিন আসর অবশ্য। এক শা জোয়ান, জিনস স্নিকার্সে মুখ ছোটাচ্ছিল। শব্দ ফাটছিল ফটাস ফটাস, দুম দুম। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুলছিল সে কথারই তালে তালে। হঠাতই শব্দ হল আর এক। ধড়াম্‌ শব্দে সে ছেলে তখন মাটিতে ধরাশায়ী। তাকেও তুলে কেউ নিয়ে গেল, তারই বাইকের পেছনে তাকে বসিয়ে বাড়ি দিয়ে আসা হল। এরকম ভাবেই একদিন বাড়ি ফেরার সময়ে বাইক নিয়ে আছাড় খেয়েছিল সে, মাথা ফেটেছিল ভাল রকমই। প্রাণে বেঁচে গেছিল অলৌকিক ভাবে। যদিও তার যুক্তি ছিল অন্য একটি বাইক নাকি ওকে পেছন থেকে মেরে দিয়েছিল। আর সেই দুটো মেয়ে, যারা এক গেলাসের ইয়ার, তারা সব শেষে রসগোল্লাড় চাট দিয়ে খেতে বসেছে। শেষ পাতের মিষ্টির মত, শেষ গ্লাসে মিষ্টি ওদের চাইই চাই। এবার এক অভিজাত মদখোরের কথা বলি। দামী বার-এ বসে পাঁচ-ছ খান খাওয়ার পরে তার যখন মৌজ আসে, বিল মেটানোর আগে সে খালি গ্লাস হাতে উঠে দাঁড়ায়। আর গ্লাসটাকে আলতো করে হাওয়ায় ভাসিয়ে দেয়। রোজ রোজ মেঝেতে পড়ে গ্লাসের ভাঙচুর হওয়া দেখতে তার কী আরাম হয়, আমরা কেউ জানি না যদিও। হ্যাঁ, নির্দ্বিধায় এই গ্লাস ভাঙার দরুণ ক্ষতিপূরণও সে দিয়ে আসে বার-এ। একবার বোধহয় বারের মালিক খানিক আপত্তি জানিয়েছিল, তার ফলে সামনে রাখা এক পাঁজা প্লেট সে ছুঁড়ে দিয়েছিল ফুটপাথে। আর এর জন্যও যা পয়সা লাগবে নিয়ে নিতে বলেছিল। তর্ক বাড়ালে সে নাকি আরও ভাঙবে। ম্যানেজার তখন আর তাকে ঘাঁটায়নি, বাঁধা খদ্দের হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে। ফলে ওই একটি গ্লাস ভাঙা তার রুটিন ছিল, এখনো আছে। 
গঙ্গোত্রীর দিকে যেতে, বাসে একটি কলেজ পড়ুয়ার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সেই বয়সী ছেলের মত নয় সে, আত্মমগ্ন হয়ে একা বসেছিল, তার বাবা মা ছিল সামনের সিটে। আর জানলার ধারে বসে ওই প্রায় কিশোর, প্রায় যুবা একের পর এক সিগারেট খেয়ে চলছিল। এমন বয়সীদের চেন স্মোকার হতে দেখলে খুব দৃষ্টিকটু লাগে। গম্ভীর সেই ছেলের থেকে পরে জেনেছিলাম, ড্রাগের নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে এক বছর নষ্ট করেছে সে। রিহ্যাব থেকে ঘুরে এসে, সে আবার পড়াশুনোয় মন দিয়েছে। আর আশ্রয় করেছে সিগারেটকে। কত তরুণ যে মরে গেল এই ড্রাগের পাল্লায়। এক চেনা জলজ্যান্ত ছেলে দুর্গাপুরে পড়তে গিয়ে মদে সেডেটিভ দিয়ে খেত হামেশাই। পরে ড্রাগের আশ্রয় নিয়েছিল। সেও মরেছে অকালে। একদিন সকালে দরজা ভেঙে তার বডি বের করতে হয়েছে। নেশা তো নেশাই নয় শুধু। আগুনই। পুড়িয়ে মারে। যে কোন নেশাই বর্জন করার প্রয়োজন আজ। এর কুফল নিয়ে বলতে গেলে ইতিহাস লিখতে হয়। জানেনও কমবেশি প্রায় সকলেই। তবুও এই পানমশলা, মদ, গাঁজা, চরস, ড্রাগের পাল্লায় পড়ে সর্বনাশের আগুনে পুড়ছে মানুষ। যতক্ষণ না আমোদের, রিল্যাক্সের পর্যায় থেকে বেরিয়ে এই নেশা আমাদের গিলে খাবে, ততক্ষণ যেন আমাদের শান্তি নেই! মরতে হলে আর সর্বসান্ত হয়ে যাওয়ার দিকে কেন যাব? এর চেয়ে বোধহয় আত্মহত্যা ভাল! এই বিলাপ ছাড়া আমার আর সত্যিই কিছু লেখার নেই আপাতত। কত ঘর, কত সংসার তছনছ করে দিল এই নেশা, তবুও সেই গতরখাকির মৃত্যু নেই আজও।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)