কৃষ্ণা মিশ্র ভট্টাচার্য

মায়াজম
0
                                  বুZ

Related image

নেশা,পৃথিবীর আদিম প্রবণতা।কবে কখন কোথায়? কে /কারা প্রথম নেশাতুর ? অভিধান নেশাকে অনেক নামে ডেকেছে--- ভাল নেশা মন্দ নেশা ---- নেশার আমি নেশার তুমি --- আর কে না জানে এই আমি আর তুমি মিলেই জগৎ সংসার/ ঈশাবস্যং ইদং সর্বং--- স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেব ওগঞ্জিকা সেবনে তূরীয়ানন্দে বিভোর।মহিষাসুর মর্দিনী অসুরনিধন কালে মাধ্ধী রস পানে বল সঞ্চার করেছিলেন নাকি হত্যার পূর্বে নিজের বিবেক কে নিস্তেজ করেছিলেন? 

নীল রক্তের টানে ভেসে যায় জীবন—নীল স্বপ্নের নেশায় পানসে জীবনখুঁজে আ্যডভেনচার; নীল সাগরে স্বপ্নের নৌকোয়; পথের নেশায়, সৃষ্টির নেশায় আবিষ্কার করে নতুন দেশ, নতুন দিগন্ত। চলার নেশাতেই মানব সভ্যতার আজ এই বাড় বাড়ন্ত।
সিল্করুট, উত্তমাশা, আমেরিকা কিংবা চন্দ্রাভিযান---- নেশার ই তো ফসল। জীবন টাই তো নেশা--- নেশাই পাল,নেশাই নোঙর—নেশাই ঢেউ নৌকো নেশাই তলাতল পারাপারহীন দরিয়া।
শীত শীত ডেনটন- টেক্সাস—একদা অপেরা হাউস—রূপান্তরিত বুকশপ। প্রাক বড়দিনের বরফচাদর ম্যামথ কুহেলি---কবিতা র বই এ টানটান জরতী ---হাউল—গীনসবার্গ
‘ হু ডিসএপিয়ারড ইনটু দ্যা ভলক্যানোস ওব মেক্সিকো লিভিং বাহাইনড নাথিং বাট শেডোস --- 
এন্ড দ্যা লাভা এন্ড এশ ওব পোয়েট্রি স্ক্যাটার্ড ইন ফায়ারপ্লেস শিকাগো—; 
জরতীমোম সাদা মুখে যুবতী হাসি --- ‘ পোয়েট এলেন--- আমার ভালবাসা—
ভালবাসাই কি নেশা—এই দুই বিন্দুর মধ্যে কতখানি ফারাক-- ।ছোটবেলার স্মৃতির কুয়াশা সাঁতরে প্রভাতী গান আছড়ে পড়ে মাটির উঠোনে—
প্রভাত সময়ে শচীর আঙিনা মাঝে গৌরচাঁদ নাচিয়া বেড়ায়—‘
বৈরাগী দাদা এতো ভোরে গান গাও তোমার ঠান্ডা লাগে না
অঘ্রানের শীত ফালা ফালা হাসি একতারায়
গান যে আমার ভালবাসা দিদি—গৌর যে আমার নেশা—
ঠাকুর রামকৃষ্ণ গিরীশ ঘোষ কে বলছেন—‘ তুই মদের নেশা করেছিস অন্য নেশার সন্ধান পাসনি বলে যেদিন অন্য নেশার সন্ধান পাবি দেখবি এ নেশা তো কোন ছার----‘
সে নেশা ঐশ্বরীয় নেশা। সে ই অসামান্য নেশার টানে রাজপুত্র সিদ্ধার্থ ছেড়ে দিলেন রাজ সিংহাসন,ছেড়ে দিলেন সুন্দরী স্ত্রী শিশু পুত্র পরিবার পরিজন তুলে নিলেন কাষায় পরিধেয় ।এই নেশায় নদের নিমাই হলেন শ্রী চৈতন্য।এ নেশায় ব্রজের শ্রীমতি ঘরকে করলেন বাহির বাহির কে ঘর—
নেশাই বাঁচার রসদ।আবার হয়ত মরার---কর্ষিত জমির বুকে মঞ্জরিত বীজধান,গুহাচিত্র,কোন পাগলের একতারার গান সবই তো ছুঁয়ে যায় নেশালি নক্ষত্র আকাশ।
চিন্তামণির ভালবাসার নেশায় বিল্বমঙ্গল রজ্জুভ্রমে সাপের শরীর ধরে প্রেমিকার কাছে পৌঁছে যায়----
চিন্তামনি আর বিল্বমঙ্গলের জৈবিক প্রেম আজ চিরন্তন প্রেমের ইতিকথা।চন্ডিদাস আর রজকিনী রামীর ভালবাসার নেশা ছড়িয়ে আছে পদাবলীর পাতায়----
‘রজকিনী প্রেম নিকষিত হেম কাম গন্ধ নাহি তায়-----
পত্নী প্রেমে নেশাগ্রস্থ তুলসীদাস ঐশ্বরীয় প্রেমে রচনা করেন অসামান্য কাব্য গ্রন্থ রামচরিত মানস---
মারিজুয়ানা,হাসিস.ধেনো,আসব,তাড়ি মাদক,আফিং,সৈন্ধী,তালকী.সোমরস.দ্রাক্ষারস,কনিয়াক,শেরী,বিয়ার----
নেশায় বুঁদ শহর পার্ক কলেজ হোষ্টেল পাব ক্লাব শূড়িখানা রেঁস্তোরা বার –
প্যারীর শজালিজে ধরে হেঁটে চলেছি-দু ‍হাজার পনেরোর গ্লোবাল কুর্তি আমার শরীরে সারি সারি ছবির মুখ আমাকে নেশায় বুঁদ করে দিল-টুপি সামনে রেখে বসে আছেন শিল্পী— Vol au vent dela mer----সেইন নদীর অনাঘ্রাত বাতাসে নেশার বীজ চুম্বন আশ্লেষ—লা হাভানার ভিড় করা পাবে দেহাতী স্প্যানিশ সুরে বুঁদ হয়ে আছি-আমার প্রিয় লেখক আার্নে্ষ্ট হেমিংওয়ের বাষ্ট – স্পষ্ট দেখলাম হেমিংওয়ে আমার দিকে টলটলে মোহিতোর গ্লাস এগিয়ে দিচ্ছেন--- চোখ টিপে বলছেন টেক ইট—সিনোরা পিকে তো দেখো লা জবাব--- 
সাদা বাংলায় একটি প্রবাদ আছে—তাস দাবা পাশা তিন কর্ম নাশা।আমার বাবা দাবা খেলতে এতো ভালবাসতেন যে সেটা প্রায় নেশার পর্যায়েই পড়তো- রবিবার দিন বাবা সহকর্মী বন্ধুদের সাথে খেলতে খেলতে নাওয়া খাওয়া ভুলে যেতেন।আমিও খেলা শিখে বাবার সাথে খেলতে বসে বুঁদ হয়ে যেতাম---আর ঠাকুমা রেগে টান মেরে আমাকে উঠিয়ে দিয়ে বলতেন---মেয়েদের নেশা করতে নেই জানিস না?শতরঞ্চ কী খিলাড়ী তে আমরা দেখেছি দুই নেশাড়ু দাবাড়ু কীভাবে বুঁদ হয়েছিল—মহাভারতের ধর্মরাজ যুধিষ্ঠীর সর্বনাশা পাশা খেলায় মজে গিয়ে হারিয়েছিলেন রাজ্য,পত্নী,ভাই ,দাস,দাসী---।
কত বিচত্র এই নেশা---গ্যায়েটের ডঃ ফাউষ্ট জ্ঞানের নেশায় পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞানকে হাতের মুঠোয় পাবার নেশায় নিজের আত্মাকে শয়তানের হাতে বিক্রি করে দিয়েছিল।
আর আজ ও আমরা দেখছি সমগ্র বিশ্ব কে হাতের মুঠোয় পাবার নেশায় সাম্রাজ্যবাদ এবং আধিপত্যবাদের নিষ্ঠুর খেলা---পৃথিবীর সভ্যতার ইতিহাস ,অগ্রগতির ইতিহাসের পাতায় পাতায় মানুষের জয়যাত্রার পাশে পাশেএই আত্মম্ভরি ,আত্মঘাতী ধ্বংসের নেশা ও জড়িয়ে রয়েছে।পৃথিবী জোড়া ট্রানজিট ক্যাম্প/রিফ্যুজি ক্যাম্প কিছুসংখ্যক যুদ্ধকামী নেশাগ্রস্থ মানুষের উন্মাদ কামনার ফসল—আবার এর ঠিক বিপরীত বিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছেন ভালবাসা শান্তি সহমর্মিতার নেশায় আত্মভোলা স্বার্থহীন কিছু মানুষ যারা মৃত্যুঞ্জয়ী –যারা দেশকে মানুষকেভালবাসার নেশায় সুখ ছেড়ে দুঃখকে বরণ করে নেন।
এই দোলাচল এই নেশাই বারবার মানুষ কে হাতছানি দেয়—সাবধানী হিসেবী জমাখরচের হলদে ঘষটানো খাতার পাতা থেকে ছন্নছাড়া জীবনের আনন্দের নেশায় ঘরছাড়া করে ----বুঁদ করে ---


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)