মৃত মালভূমি
রেপকেস হলে ত কথাই নেই! এছাড়া অন্যান্য মার্ডার কিম্বা আত্মহত্যার ঘটনার রিপোর্ট পেলেই মেজবাবু বিরাজ পট্টনায়েক তারমারফৎ অমনি খুঁটিয়ে খোঁজ নিতে শুরু করেন, “মেল হ্যায় ইয়া, ফিমেল? উমর---?’
আজ খুব ভোরভোর খবর এল, দুমকাটিলা থানার দু’কিলোমিটার উত্তরে টিলার নীচে একটি ডেডবডি পড়ে আছে। সম্ভবত রেপকেস। মেজবাবু উর্দিতে জিপ টানতে টানতে বললেন, “স্যার সোচিয়ে, ইয়ে ম্যাটার হামকোহি হ্যাণ্ডেল করনা পড়েগা! ইসসে আপ টিপাইটিলা কি পলিটিক্সকে ওপর নজর ডালিয়ে।”
বড়বাবু হেসে ফেললেন, “ইট্স অ্যা ভেরি ব্যাড অ্যাডিকশান মিঃ পট্টনায়েক!”
বড়বাবুর হাসির সাথে আরো কিছুটা হাসি মিশিয়ে ব্যাপারটা তরল করে মিঃ পট্টনায়েক বললেন, ---‘‘হ্যাবিট হো গ্যায়া সাহাব!”
বছর ছাব্বিশের এক মহিলা। চীৎ হয়ে পড়ে আছে গড়িয়ে পড়া পাথরের পাশে। আশেপাশের মহল্লা থেকে জড়ো হয়েছে বেশকিছু কুলিকামিন, হাফমুসাফির মানুষ। পট্টনায়েকের সর্বকাজের, এমনকি বিরাম বিনোদনেরও সহায়ক কালুডোম। সে নায়েকের ইশারামতো উপস্থিত উৎসাহীদের দিকে চোখ ঘুরিয়ে, গ্লাভস, টর্চলাইট সহ অন্যান্য অনুষঙ্গ হাতের কাছে রেডি করে নিল।
--“আপলোগ থোড়া তফাৎ যাইয়ে।” মেজবাবুর কথামতো উৎসাহী জনতা দূরে সরে গেল। কালু একে একে লাশটির বিভিন্ন অঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ চিহ্নগুলি সার্চ করতে লাগল। বুকের কাপড় সরাতেই পট্টনায়েকের স্নায়ুবেয়ে অদ্ভুত এক বিজুরিশিখার শিহরণ খেলে গেল। ইতিপূর্বের অভিজ্ঞতা যা বলছে, আজ তারও চেয়ে সূক্ষ্ম অথচ সাপের মাথার মণির চেয়েও মোহনীয় ছিল এই অনুভব! ঢেউখ্যালা বক্ষযুগল,অথচ উঁইঢিবির মতো উঁচু! মণিবৃত্তের চারপাশে বিন্দু বিন্দু কাঁটার আলকুশি, শীত শীতল শিশিরের স্পর্শে মৃত্যুজনিত ক্লান্তিটাও এখানে অনেকটাই ফিকে!
--“থোড়া ইন্তেজার কিয়ে,ম্যায় আভি আরাহাহুঁ!” কড়ে আঙুলের ইঙ্গিত করে পাশের উঁচু পাথরের আড়ালে কিছুক্ষণের জন্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন পট্টনায়েক। লোকগুলো আবার শুকনো কচ্ছপের মতো শুঁড় বার করে ঝুঁকে পড়ল মৃতদেহের ওপর। পট্টনায়েক যতক্ষণে ফিরে এলেন, ততক্ষণে কালুয়া ডেডবডিটা কালো প্লাস্টিকে আগামাথা মুড়ে ফেলেছে।
কোয়ার্টারে পট্টনায়েকের ঘরে আজকাল আলোই জ্বলতে দ্যাখা যায় না। দিনের বেলাতেও তাই, একই উন্মনা ভাব! এখন একটু যদি সময় পেইয়েছেন, অমনি চলে যান টিপাইটিলার উত্তরে। সবাই বলাবলি করেন, “নায়েকবাবুর হাতেই এবার টিপাইটিলা শান্ত হবে!” যেদিন চাপ কম থাকে, কাজের ফাঁকে একছুট্টে চলে যান কুলিকামিনদের মহল্লায়। ফিরতিপথে পাথরের ওপর শুয়ে শুয়ে সূর্যাস্ত দ্যাখেন। সন্ধ্যা হলেই আস্তে আস্তে জুড়িয়ে যেতে থাকে প্রিয় মালভূমি। তখন ভীষণরকম আরাম অনুভূত হয়, এর ওপরে নিজেকে বিছিয়ে দিলে! ওপরে অনন্তপ্রসারী আকাশ,আর নীচে গড়িয়েপড়া শান্তসমাহিত একের পর এক পাথুরে ঢেউ! যেন কোথাও মৃত্যু নেই, মানুষের ঘরবসতিতে অশান্তিও নেই,--এমনকি পূতিগন্ধপ্রিয় প্রাণীদেরও দ্যাখা নেই! কেবল অগনিত তারাদের সাথে পাল্লা দিয়ে থরে থরে ছড়িয়ে থাকে ফুল আর ফুল! কিছুসময়ের জন্যে হলেও পরাগের গন্ধে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে পট্টনায়েক। এরপর নিজের অজান্তেই গড়িয়ে পড়া মৃত পাথরের বুকে ফুটে ওঠা নানারঙের নামহারা ফুল তুলে, হাতের তালুতে চটকে, পিষে, তার গন্ধ শোকেন। আবার কোনকোনদিন রাতের অন্ধকারে ফাঁকা কোয়ার্টারে গুলিখাওয়া কাকের মতো খ্যাকখ্যাক করে ওঠেন তিনি। এছাড়া সকাল হতে না হতেই অধস্তন কর্মচারীদের সাথে দুর্ব্যবহার, হাতাহাতি,এমনকি গোবেচারা গাড়ির চালক ঝরিলালের গালেও সাঁটিয়ে চড় কষে দিতেও দু’বার ভাবতে হচ্ছে না তাঁর! অনেকেই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন, তাঁর খামখেয়ালি আচরণের জন্যে!
--“সাহেব কিছুদিনের জন্যে ছুটি কাটিয়ে আসুন। ভাবিসাহেবারও ভালো লাগবে।” আই-সি ওমপ্রকাশ সিংজী একপ্রকার জোর করেই পট্টনায়েককে ছুটিতে পাঠালেন। লং লিভে নরম খাটবিছানার আয়েশ পেয়েও কিছুতেই যেন মস্তি পেলেন না পট্টনায়েক। নিজের বিবাহিত স্ত্রীও যে এতোখানি আড়ষ্ট, এর আগে অনুভব করেন নি তিনি। শুধুমাত্র ওর বিবশ রণক্লান্ত ঠোঁট দুটোর ওপর বারদুয়েক চুমু খেয়ে বলে উঠেছিলেন, “সরি ডারলিং! আর কখোই তোমাকে কষ্ট দেব না!” কোনোরকম পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই পট্টনায়েক স্ত্রী মধুপাকে সাথে নিয়ে, আবার কোয়ার্টারেই ফিরে এলেন।
আপাতত টিপাইটিলা এলাকা অনেকটাই শান্ত। ঝরিলাল জিপেকরে সাহেব বিবিকে পাহাড় ঘুরিয়ে খুশ করতে থাকে। কালুডোম লক্ষ্য করে, “বহুতদিন বাদে দারুণ ফুরফুরে মুডে আছেন মেজবাবু।”
--“আচ্ছা আমাদের যদি এই টিলার ওপরেই এখখানি ঘর হতো?”
মধুপা মুগ্ধতা জড়িয়ে বলে, “খুব ভালো হতো! তাহলে আর খুনজখম হতো না! টিলার ওপর থেকেই তুমি সমানে নজর রাখতে পারতে।”
--“জান, এই পাথরে আমি অদ্ভুত এক গন্ধ পাই!”
--“য্যামন--?”
পট্টনায়েক মধুপার নাভির গর্তে নাক ডুবিয়ে দিয়ে জোরে জোরে খানিকটা শ্বাস নেন। পরক্ষণেই হতাশা উড়িয়ে বলেন, “এই মাটির নীচে একসময় চাপচাপ আগুনের চিরাংগি ছিল!”
--“আজ নেই?”
--“আছে। অন্য জায়গায়!” বলতে বলতে একটি দেশলাই কাঠি ফস্ করে জ্বেলেই নীচে কুলিকামিনের পাতার ঘরগুলিকে উদ্দেশ্য করে ছুঁড়ে মারলেন। পেছন থেকে কালুয়ার সবিনয় স্বর ভেসে আসে, “সাহাব! খুব শিশির পড়ছে। ঘরে চলুন।”
এখন প্রায়শই সন্ধ্যাবেলা পালা করে মদমাংসের সাথে হাসি ঠাট্টা তামাশা উড়তে লাগল। আজ পার্টি ছিল পট্টনায়েকের কোয়ার্টারে। পেয়ারের ভাবিজি এসেছেন বলে কথা! বিশেষকরে ওঁর রান্নার তারিফ বিহার থেকে ছোটনাগপুর--সর্বত্র পাহাড়ি পরাগের মতো এখন হাওয়ায় ভাসছে। পট্টনায়েক আগ বাড়িয়েই আজ এলাহি আয়োজন করলেন। বড়োসাহেব সিংজী এসেছেন, আরো চারজন কনস্টেবল সহ গাড়ির ড্রাইভার ঝরিলাল এসেছে। কালু,অর্থাৎ কালিয়া ডোম,-- তাকেও পার্টিতে আমন্ত্রণ জানিয়ে ভরপেট্টা খাইয়ে দিলেন।
তখন কাকভোর। হঠাৎ ফোন, “সাহাব ভাবিজান ঠিক আছে ত? টিলার পাশে আসুন। এখানে একটি লাশ পড়ে আছে!”
--“সরি! রং নাম্বার!” ফোনটা রেখে ফাঁকা বিছানার এপাশ ওপাশ আরো খানিকটা আলস্য ঝেড়ে ফেলতে সময় নিলেন পট্টনায়েক।
আবার ফোন বেজে উঠল, “হ্যাঁ বলছি। আমি যাচ্ছি না। বড়বাবুকে কল দিন।”
--“আই-সি বলছি। আই অ্যাম ওমপ্রকাশ সিংজী। সি ইজ ফিমেল।---আসুন। এটা আপনাকেই সনাক্ত করতে হবে!” বলেই ফোনটা কেটে দিলেন। কণ্ঠস্বরে যতটুকু বোঝা গেল উদ্বেগ জড়ানো; আজ আর সামান্যতমও রসিকতার মিশেল ছিল না।
পট্টনায়েক প্রতিদিনের মতো উর্দি পড়ে জিপে অপেক্ষা করতে লাগলেন। তখনো কালুয়া বার হয় নি। ঝরিলাল গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে, গলা বাড়িয়ে দুএকবার ধমক দিল। তাও এল না। এরপর মেজবাবু ডাকলেন, “কালুয়াআআআ---!”
কালুয়া প্লাস্টিক, টর্চ, দড়ি গোটাতে গোটাতে সবে গাড়িবারান্দায় পা দিয়েছে, অমনি পট্টনায়েকের রিভলবার থেকে একটা গুলি ছুটে এসে ওর বুকের বাঁ দিকাটা ফুটো করে দিল!
সুচিন্তিত মতামত দিন