জয়তী অধিকারী

মায়াজম
0
                     ডেস্টিনেশন...
তৃতীয়বার তপোবন অভিযানে চলেছে ঋদ্ধ। তবে এবারে আর বন্ধুদের সাথে নয়, আগের বারের মত একাও নয়। এবারে আটজনের গ্রুপ নিয়ে সে চলেছে দস্তুরমত গ্রুপ-লিডার হিসেবে। যদিও এতজনের দায়িত্ব দিয়ে তাকে পাঠানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও ছিল না অসীমদা’র। নেহাত অপারগ হয়েই মত দিয়েছে।
“ডেস্টিনেশন স্নো-পীক” শুধুমাত্র একটা ট্রেক-অ্যান্ড-ট্র্যাভেল সংস্থাই নয়। কয়েকজন পাহাড়-পাগল মানুষের স্বপ্ন বলা যায়। অসীম রায় আর তার চার বন্ধুর একটাই চাওয়া... নবীন চোখে তুষার-শৃঙ্গের ছাপ এঁকে দেওয়া। বর্তমান প্রজন্মকে দেখে তাদের গা শিউড়ে ওঠে। বিশাল অঙ্কের মাইনের চাকরী, দামী ফ্ল্যাট, ঝাঁ চকচকে গাড়ি আর শপিং-মলের ফুডকোর্টে গিয়ে হ্যাংআউট...এর বাইরে তাদের তাকানোর সময় কোথায়! একটা দিন আসবে যখন এরা প্রকৃতির মর্ম বুঝবে, কিন্তু ততদিনে হাই কোলেস্টেরল আর ইউরিক অ্যাসিডের দাপটে সোজা হয়ে দাঁড়াতে গেলেও হয়ত পয়সা দিয়ে অ্যাটেন্ডেন্ট রাখতে হবে। কোনভাবে যদি তরুণ প্রজন্মকে পাহাড়ের নেশাটা একবার ধরিয়ে দেওয়া যায়!
-“অসীম, আসব?” দীপকদার গলা শুনে ঘোর কাটে অসীমের।
-“এসো দাদা, বসো”
-“না রে, তোর বৌদি আসলে খুব চিন্তা করছে। বুঝতেই তো পারছিস! ঋদ্ধ তো ছেলেমানুষ। তাকে এত বড় একটা দায়িত্ব দিয়ে পাঠালি...”
-“কি করব বলো দাদা, হঠাৎ করে অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গিয়ে আমি যে বিছানায় পড়ে গেলাম গো! বাকীরা কেউ ছুটিও পেল না দু’দিনের নোটিশে। আর ঋদ্ধটাও এত জেদ করল...”
-“দেখ, আর কি বলব! ছেলেটার মাথায় কোথা থেকে যে এই নেশা চাপল! আমি তো ওকে ওই দার্জিলিং আর পুরী ছাড়া কোথাও নিয়েও যাইনি ছোটবেলা থেকে। কলেজে পড়ার সময় থেকে কি যে ট্রেকিং-এর নেশা চাপল মাথায়! গত বছর তো কালিন্দী পাস থেকে মরতে মরতে বেঁচে ফিরেছে”।
অসীম কি বলবে ভেবে পেল না। চিন্তা যে তারও হচ্ছে না তা নয়। ঋদ্ধ মাত্র পঁচিশ বছর বয়সেই সব পাহাড় যেন গুলে খেয়ে নিয়েছে। 
-“ভেবো না দাদা। বৌদিকে বলো ওর কোন অসুবিধা হবে না। আমার চেনা সব গাইড আর পোর্টারদের সাথেই ও গেছে”।
-“দেখ, কোন খবর তো দিতে চায় না পাহাড়ে গেলে। যদি তুই খবর পাস আমায় জানাস তাহলে”।
-“জানাব দাদা”
ঋদ্ধর বাবা বেরিয়ে যেতেই অসীম ফোনে ধরার চেষ্টা করল একজন টিম-মেম্বারকে। কিন্তু ফোন অউট-অফ্‌-রীচ।

ঋদ্ধ খুব এক্সাইটেড। গোমুখ আর তপোবন ঘুরে যদি বাসুকীতালটাও ঘুরে আসা যেত! দলের আটজনের মধ্যে সোম আর তুলিকাও খুব এক্সাইটেড। আসলে ঋদ্ধর পাহাড়প্রীতি ওদেরও এতটাই ছুঁয়ে গেছে যে ওর প্রতি দুজনেরইএকটু আলাদা সমীহ জন্মেছে। সারাদিন চলার পথে ঋদ্ধর কাছে শুনছে গোমুখ-তপোবনের গল্প, ঋদ্ধর ইশারায় চিনে নিচ্ছে মাউন্ট শিভলিং, থেলু, মেরু আর ভাগীরথী সিস্টার্সকে। যত শুনছে ঋদ্ধর জ্ঞান দেখে মোহিত হয়ে পড়ছে। তুলিকা তো ঋদ্ধর পিছুই ছাড়ছে না। সকালে টেন্ট থেকে বেরিয়ে টয়লেট যাওয়ার সময় ঋদ্ধ যখন হাত উঁচু করে টিস্যু পেপার দেখাল, তখন লজ্জা পেয়ে অন্যদিকে চলে গেল। মেয়েটার পাহাড়ের প্রতি আগ্রহ দেখে ঋদ্ধরও বেশ ভাল লাগছে। আসলে পাড়ায় থেকেও কখনও সেভাবে কারুর সাথে মেশাই হয়নি তার। অসীমদাদের এই সংস্থায় যোগ দিয়ে তাও কয়েকজনকে চিনছে। পাহাড়ী-স্বপ্ন কখন যেন তারও চোখের পাতায় বসত করতে শুরু করেছে।
-“ঋদ্ধ, আমরা কি আজ তপোবনেই থাকব?” প্রবল ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে তুলিকার দাদা বলল। পাহাড়ে আসতে তারও ভাল লাগে ঠিকই, কিন্তু যতদূর গাড়ি যায়, ততদূর। বোনের পাগলামীর জন্য আজ তাকেও নিজের বিছানার ওম ছেড়ে এই বরফের রাজ্যে হি হি করে কাঁপতে হচ্ছে আর হেঁটে মরতে হচ্ছে।
-“হ্যাঁ প্রসূনদা। আজকেরটা এখানেই থাকি আমরা। সারাদিন যে যার মত করে আশেপাশে ঘুরে আর বিশ্রাম নিয়ে কাল ভাবছি বাসুকীতালের দিকে যাব। অবশ্য যদি সবাই যেতে চায়... তো”।
ঋদ্ধর কথা শেষ হতে না হতেই আটজনের মধ্যে কার্যত দুটো ভাগ হয়ে গেল। ঋদ্ধর দু’পাশে তুলিকা আর সোম ছাড়া বাকী সবাই বসে পড়ল। 
-“আমরা আর কোথাও যাচ্ছি না। তোরা ঘুরে আয়। তারপর একসাথেই ফেরা যাবে”...বিভিন্ন সময়ে কিছু না কিছু নিয়ে মতবিরোধ হতে থাকলেও এই ব্যাপারে সকলেই একজোট হয়ে যাওয়ায় ঋদ্ধ বেশ মজা পেল।
-“না না, সকলে গেলে যাওয়া যেত। থাক, দরকার নেই...”
-“আমরা যাব” তুলিকার গলা শুনে ঋদ্ধ আর প্রসূন একসাথেই তার দিকে তাকালো।
-“বাড়াবাড়ি করিস না বোনু। মা কিন্তু বারবার বলে দিয়েছে আমি যা বলব সেটা শুনে চলতে”
-“মা, বাবা আর তোর কথা শুনেই তো নিজের সব শখ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে বিয়ে করতে রাজী হয়ে গেলাম। আর কি চাস?”
এতজনের সামনে তুলিকার কথার কোন উত্তর দিতে না পেরে প্রসূন চুপ করে টেন্টে ঢুকে গেল।
ঋদ্ধ এতক্ষণ চুপ করেই ছিল। পরিস্থিতি বিরূপ দেখে সে তুলিকাকে বোঝাতে গেল, কিন্তু মাস্টার্স কমপ্লিট করা মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে আর কিছুই বলে উঠতে পারল না।

ডিনারের পর সবাই আগুন জ্বেলে বসে গল্পগুজব করার মাঝেই প্রসূন এসে রিদ্ধকে একপাশে ডেকে নিয়ে গেল।
-“ঋদ্ধ, তোকে আমি ছোটবেলা থেকে চিনি। আমি জানি তোর ওপর ভরসা করা যায়। তুলির মতের বিরুদ্ধেই বাবা-মা ওর বিয়ে ঠিক করেছে। আসলে ছেলেটাও ভাল তো...তাই। ওর এই ট্রেকিং-এর শখটা তুই পূরণ করে দিবি?”
ঋদ্ধ কি বলবে ভেবে পেল না। অসীমদা জানতে পারলে খুব রাগ করবে। তুলিকাও তাকে টুকটাক অনেক গল্পই করেছে। আধুনিকতার ধ্বজা ওড়ানো বাঙালীদের মধ্যে থেকে প্রাচীন ধ্যান-ধারণাটা হয়ত কোনদিনই যাবে না। শুধু মেয়ে বলেই আরও পড়াশোনা করে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার ইচ্ছেরও যে কোন দাম নেই, সেটা ভেবেই খুব কষ্ট হল ঋদ্ধর।

তুলিকা, সোম আর ঋদ্ধ পরদিন ভোর পাঁচটায় বেরিয়ে পড়ল নন্দনবনের উদ্দেশ্যে। ৫-৬ ঘন্টা জোরে হাঁটলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে সেখানে। তুলিকাকে শুধু একটাই অনুরোধ করেছিল ঋদ্ধ... “আমরা কিন্তু ওখানে বেশীক্ষণ থাকব না। আধঘন্টা থেকেই আমরা ফিরব”। তুলিকার চোখে কি একটা ঝিলিক দিয়ে গেল। মেয়েদের ব্যাপারে অনভিজ্ঞ ঋদ্ধ অত গভীরে যাওয়ার চেষ্টাও করল না। পাহাড়ের চূড়ায় জমে থাকা বরফ ছুঁয়ে আসা হাওয়ার দাপট থেকে বাঁচতে ওদের গাইড করে নিয়ে এগিয়ে চলতে থাকল সে।
কিছুক্ষণ চলার পরে সোম একটু পিছিয়ে পড়েছে দেখে ঋদ্ধ দাঁড়াতেই তুলিকা এসে তার হাতটা ধরল। অবাক হয়ে তার দিকে তাকাতে তুলিকা কেমন একটা ধরা গলায় বলে উঠল, “আমাকে বিয়ে করবে ঋদ্ধ?”
-“মানে?!” কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তুলিকার দিকে তাকিয়ে ঋদ্ধর মনে হল তার জানা সব শব্দের ভান্ডার হঠাৎ করে যেন শূন্য হয়ে গেছে। 
-“এসো না, আমরা এই পাহাড়কে সাক্ষী রেখে আজ এখানে এক নতুন অঙ্গীকার করি, একসাথে চলার”, তুলিকার গলায় এক অদ্ভুত আকুতি। ঋদ্ধর সব কেমন যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। সে তো কোনদিনই কোন মেয়ের সাথে প্রেম করার কথা ভাবেইনি। আর আজ তুলিকার মত একজন শিক্ষিত-মার্জিত মেয়ে তাকে প্রপোজ করছে! সেই মুহূর্তে ঋদ্ধর মনে হল হয়ত তুলিকার সাথেই সে সারাটা জীবন আনন্দে কাটাতে পারবে! কিন্তু না, ঋদ্ধ জানে তুলিকার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, আজ সে যা বলছে তাতে তার পরিবারের সম্মানহানি হবে। তাছাড়া ঋদ্ধর জীবনের লক্ষ্য তো সংসার করা নয়। 
সে একটু গম্ভীরভাবে তুলিকার হাতটা ছাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আমাকে তুমি কতটুকু চেনো? আমার বিভিন্ন জায়গায় অনেক প্রেমিকা আছে। আমি কোন একজনের সাথে বেশীদিন থাকতে পারি না। তুমি কিছু মনে কোর না”।
তুলিকার বিস্ফারিত দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে ঋদ্ধ অনুভব করল, সে হঠাৎ করে তুলিকার চোখে যেন অনেকটা নীচে নেমে গেল। কিন্তু সারা হিমালয় জুড়ে তার প্রেমিকারা সারাবছর তার অপেক্ষায় থাকে, এটা তো সে ভুল বলেনি। এই বরফে মোড়া পাহাড়গুলোর নেশা যে তার শিরা থেকে ধমনীতে ছুটে বেড়াচ্ছে! তুলিকা কেন, হয়ত তার বাবা-মাও কোনদিন তা বুঝবে না।
গ্লেসিয়ারে ভেসে থাকা বরফের টুকরোগুলোয় সূর্যের আলো পড়ে ঝিকিয়ে উঠছে…নতুন প্রেমিকার লাজুক চাউনি অনুভব করছে ঋদ্ধ…তার সারা গায়ে যে শিহরণ খেলে যাচ্ছে, সেই অনুভূতিটুকু একান্ত তারই। নেশাগ্রস্তের মত সেদিকে এগিয়ে চলল ঋদ্ধ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)