---
নেশা শুনলেই মাথায় ঘন্টা বাজায় " নেশুড়ে" শব্দটি। ঠিক যেমন " ফাঁসি"র সঙ্গে "ফাঁসুড়ে" কথাটি!। মানে প্রায়
একই , নেশা করেছ কি মরেছ। সত্যিই কি তাই? একটু ভেবে দেখা যাক। নেশা কারে কয়? সাধারণ ভাবে যে কোনো বিষয়, বস্তু, খাদ্য, পানীয় এবং আবশ্যিক ভাবে একটি বিশেষ মানুষের প্রতি অপর ব্যক্তির অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণের ভর কেন্দ্র যা থেকে মুক্তি পাওয়া যথেষ্ট কঠিন, তাই নেশা। মূল কথা আসক্তি, তবে আমরা নেশাকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সদর্থকের বদলে নঞর্থক ভাবেই দেখা হয়। সমাজ কল্যাণ, দেশাত্মবোধ বা দৈনন্দিন জীবনে সৃষ্টি বা কৃষ্টি মূলক কাজের নেশা কিন্তু প্রোডাকটিভ।তাতে কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু কোনো সুন্দরী মহিলাকে দেখে, বাঃ ! বলে মুগ্ধ হয়ে তাকে "আমার জীবনে চাইই" ভেবে "আই লাভ ইউ ক ক ক কিরন" বলে ডর ফিল্মের শাহরুখ খানের মতো আচরণ করলে তাকে তক্ষুণি অবসেসড লাভার হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া হয় , নেশার তিক্ততম বহিঃপ্রকাশ। তোকে ভালবেসেছিলাম সুন্দরী, তুই আমাকে ছেড়ে ও পাড়ার বাবলুকে বিয়ে করছিস? দাঁড়া, মজা দেখাচ্ছি। অ্যাসিড মেরে এমন বদন বিগড়ে দিলাম, যে আমাকে পুলিশ হাজতে যেতে হোলো, প্রতিশোধ পরায়নতায় আমাকে সাইকিয়াট্রিক ট্রিটমেন্ট করাতে হবে। কারণ ওই একই--- possessive behaviourial disorder. আসক্তির বিপরীত নমুনা
নেশার সঙ্গে পরিচিতি আমাদের সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য, পুরাণকথা--- সর্বত্র। বলতে গেলে যাপনচিত্রে চর্চার মানচিত্রের রূপকথা --নেশা, নতুন কিছু নয়। কিন্তু কোনো অজানা কারণে নেশাক্রান্ত বললেই ঢুলুঢুলু চোখের মদে চূর চেহারা চোখে ভাসে। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে আঙুরের ফলন হয়। তাই গ্রীকো- রোমান পৌরাণিক চরিত্রেরা দ্রাক্ষাসব , মানে আঙুর গ্যাঁজানো ওয়াইন পান করে । ফ্রেঞ্চ ওয়াইন,রাশিয়ান ভদকা , জার্মানির বিয়ার, স্কটল্যান্ডের সিঙ্গল মল্ট হুইস্কি, সে ব্ল্যাক বা রেড লেবেল যাই হোক না কেন ! পৃথিবীখ্যাত। আমাদের পুরাণগাথায় দেব দেবীদের সোমলতা থেকে সোমরস বা দ্রাক্ষাসব কিংবা মধু, যব চূর্ণ ও আখের রসের ফেনার মিশ্রণে গ্যাঁজানো মাধ্বী পান ও দেব সভায় অপসরা- ঊরবশী প্রভৃতি। নৃত্য গীত পটীয়সী দের দর্শন করে এনজয় করার বহু কাহিনী প্রচারিত ও প্রচলিত। এইসময় দেবলোকের পার্টি টাইম -- সুরা ও সাকী সহযোগে দারুণ এনজয়েবল হোতো , বলাই বাহুল্য।
প্রাচীন কালের মানুষ প্রাকৃতিক ওষধি ও গাছ গাছালির সঙ্গে নানা প্রাকৃতিক নির্যাস মিশিয়ে যে পানীয় তৈরি করত
তাতে সাময়িক ভাবে শারীরিক আরাম হত ও কিছুটা এনার্জি লেভেল বেড়ে যেত, রাতে ঘুম ভালো হওয়া - একটা বাড়তি সুবিধে ,কিছুটা বেশি পরিমাণে পান করে হয়ত পরিবেশ ভুলে তূরীয় আনন্দেও স্বর্গে বাস করার মতো অনুভূতির বোধ হত। সবই অনুমান নির্ভর। তবে অতিরিক্ত মাদক সেবনে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড ভুলে যাওয়ার ইতিহাসের বোধহয় সেখানেই সূত্রপাত।
আচ্ছা একটা কথা আমার বোধগম্য হয় না , সেই কোন সুদূর অতীতে , মানে যখন ইতিহাস, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে মানুষ বিশেষ জটিলতায় আটকে পড়ে নি , তখনও নেশা করে সাময়িকভাবে ভাবে পরিস্থিতির থেকে রিলিফ পেতে চাইত? মাদকের এমন পাওয়ার গেম খেলার ক্ষমতা আছে ? তবে বৈদিক যুগের যা তথ্য তাতে অধিকাংশ সময়েই দ্রাক্ষাসব বা মাধ্বী প্রধানত পূজার্চনা বা হোম যজ্ঞে ব্যবহার হত। সোমরসও সামাজিক অনুষ্ঠান উপলক্ষে পান করতেন আমন্ত্রিতরা। আসলে প্রাকৃতিক উপাদানের নিজস্ব কিছু ওষধি গুনও ছিল, যা সময় বিশেষে চর্মরোগ বা শল্যাদি মানে সোজা কথায় অপারেশনের সময় অ্যানাসথেশিয়া হিসেবে কাজ করে এমন জড়িবুটির নিষিক্ত নির্যাস রোগীর শরীরে লেপন করা হোতো। তাতে রোগ নিরাময় , যন্ত্রণার উপশমের কিছু তথ্য আমরা বৌদ্ধ চিকিৎসা শাস্ত্রে পেয়েছি। রামায়ণ , মহাভারতে তো এমন উদাহরণ অজস্র। মজার ব্যাপার হলো এই ঔষধির মধ্যে কয়েকটির component কিন্তু নেশা উদ্রেককারী, যেমন আফিম এবং ভাঙ। নটরাজ শিবকে ভাঙ , ধুতুরা, সিদ্ধি দিয়ে পূজো করলেই আশুতোষ পরম তুষ্ট। শিবরাত্রির সময় সিদ্ধি আর ধুতুরা (ধুতরো) পাতার দাম আকাশছোঁয়া। দোলের (হোলি) বা বিজয়া দশমীতে সিদ্ধি বা ভাঙের ঠান্ডাই ঢকঢক গলাধঃকরণ করে " জয় জয় শিব শঙ্কর" কিংবা "রঙ্গ বরসে ভিগে চুনরিয়া" করতে ইচ্ছে করে না বা এমন করেন নি কেউ যদি বলেন এটা কিন্তু বিশ্বাস করতে রাজি নই। তখন নেশাতুর গোলাপী চশমায় "দারা পুত্র পরিবার, তুমি কার ? কে তোমার?
এতক্ষণ আমরা নেশার আউট লাইনেই ঘুরছিলাম।এবার একটু অন্দরে যাওয়া যাক। মানুষ কেন নেশা করে ? এর উত্তর বেশ কঠিন। কেউ সোশাল ড্রিঙ্কার, কেউ বন্ধু বান্ধবের পাল্লায় পড়ে নিজেকে smart প্রমাণ করার চেষ্টায় নেশার কবলে পড়ে তলিয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে কোনো টেনশন বা পারিবারিক অশান্তির থেকে মানসিক ভাবে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টায় কেউ নেশাকে বন্ধু করে । এমনকি খুব প্রিয় জনের মৃত্যু বিচ্ছেদ সহ্য করতে না পেরে অনেকে নেশায় বুঁদ হয়ে যায় । নেশা। হল মস্তিষ্কের অ-সন্তুলিত অবস্থা, যে ক্ষেত্রে হরমোনের ক্ষরণের পরিমাপের নিষ্কাশন অনুঘটকের কাজ করে। সাধারনতঃ Dopamine এবং Seratonine Hormone মস্তিষ্কের আনুপাতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। "Dopamine injection " or in any liquid form শরীরের এনার্জি লেভেল বাড়িয়ে দেয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা মূলক খেলার আগে ডোপ টেস্টে মূত্র পরীক্ষায় ধরা পড়ে অনেক বিশ্ব বিখ্যাত খেলোয়াড় কে শাস্তিমূলক ভাবে সাসপেন্ড করা হয়েছে । Benjamin Sinclare Johnson (Ben Johnson ) কানাডার খ্যাতনামা দৌড়বাজ
(Sprinter) , যার ঝুলিতে পর পর 1987 , 1988 সালের 2 টি অলিম্পিক ব্রোঞ্জ ও সামার অলিম্পিকের 1টি রূপোর মেডেল
ডোপ টেস্টে fail করলেন । প্রশ্ন তুলেছিলেন কার্ল লিউয়িস।
Ben Johnson নিয়মিত ভাবে "Furazabol anabolic steroid " নিতেন। "This steroid can be used as medicinal purpose. But Ben Johnson found to take Orstanzanol which was a banned item for the athlets".Ben Johnson কে অলিম্পিক গেমসে সাসপেনশনের সঙ্গে তার পদক তিনটিও কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, বিখ্যাত এথলিটের জীবনে সব থেকে কলঙ্কিত অধ্যায়। তার পরেও তিনি কোর্ট অর্ডারে তর্ক তুলেছিলেন, তার অজান্তেই বিয়ারের সঙ্গে কেউ এই ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিল। আঙুল তুলেছিলেন তার কোচের দিকেও মাদক বা ড্রাগ --- intoxication , addiction --একই চালচিত্রের দুই দিক। নিয়মিত ব্যবহার বা সেবনে আকর্ষণ আরও তীব্র হয়, শারীরিক ও মানসিক নির্ভরতা তৈরি হয়। মস্তিষ্কের প্রতিবন্ধকতা (antibody) সৃষ্টি হয়, স্বাভাবিক চিন্তা ভাবনা করার ক্ষমতা কমে যেতে থাকে। প্রাকৃতিক নেশার জিনিস আফিম, চরস , গাঁজা----এরা শুকনো জিনিস । অন্যদিকে তাড়ি, পচাই, এবং last but not the least হাঁড়িয়া আর মহুয়া রস। শেষের দুটি আইটেম একেবারে রামবাণ। বাহা (বসন্ত) উৎসব আর মারাং বুরু ( পাহাড়ের দেবতা) র পূজায় সাঁওতালি নাচে শুধু এই দুটি লিকুইডের জন্য শহুরে বাবু বিবিরাও কম fascinated নন!
এবারে আসি রাসায়নিক মাদকের কথকতায়। এই দলে হেরোইন, পেথিডিন, L.S.D (Lysergic acid diethylamide)
মারিজুয়ানা, কোকেন, হ্যাশিশ বা weed cannabis , শাদা বাঙলায় "ঘাস" , আগুন ধরিয়ে ধোঁয়া শুঁকলে মনে হবে একেবারে স্বর্গে বাস করছি। হ্যলুসিনেশন বা দৃষ্টি বিভ্রান্তি মানে যা আছে তা দেখতে পাচ্ছি না, যা নেই সেটাই আমার তাৎক্ষণিক সত্যি। গত শতকের ষাটের দশকে আমেরিকার "Flower Children Hippies " রা এক নতুন দর্শন নিয়ে এসেছিল। গতানুগতিক ধারাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আধ্যাত্মিকতা ও মুক্ত জীবনের আশায় "হিপি" গোষ্ঠীর জীবনে গভীর ভাবে মারিজুয়ানা, চরস, ঢুকে গিয়েছিল। নতুন কিছু খোঁজার চেষ্টায় নেশার আবেশে পলায়নী মানসিকতা। এইবার নেশাকে নিয়ে আসি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে। পান, কাঁচা তামাক পাতা, খৈনি, সিগারেট, দোক্তা, জর্দা, গুটখা, কাঁচা সুপুরি, পান মশালা, এমনকি চা , কফি। কোনটা নেশার আর কোনটা যে নয় ভাবতে গেলে ঠগ বাছতে শহর উজাড় হয়ে যাবে। আমি দিনে 10/12কাপ চা/ কফি খেতাম(মানে পান করতাম আর কি!) কিছু দিন আগে ভেবেছিলাম সন্ন্যাস নেবো। তাই ছেড়ে দিলাম নেশার বস্তু। বাপরে উইথড্রয়াল সিনড্রোমে এত ছটফটানি বেড়ে গেল যে প্রাণ যাওয়ার উপক্রম। তবে নেশার কাছে হার মানি নি। এক কাপ মর্নিং টি এখন নিজের জন্য বরাদ্দ। আফিমের নেশা ছিল আমার দিদিশাশুড়ির। 4 সন্তান নিয়ে 18 বছর বয়সে বিধবা হন। আমার বিয়ের পরে দেখেছি , তিনি সন্ধ্যার হলেই এক দলা আফিম আর এক কাঁসার গেলাস ভর্তি ফেনা ওঠা দুধ ( মানে ওটাই তাঁর রাতের খাদ্য ও পানীয়) খেয়ে গুনগুনিয়ে হরিনাম করতে করতে ঘুমিয়ে যেতেন। গেরস্থ মধ্যবিত্ত পরিবারে এই নিয়ে কোনো নিন্দা মন্দ শুনি নি
আরেকটা ঘটনা মনে পড়ে। উত্তর কলকাতায় আমার বাপের বাড়ির পাড়ায় বর্ষাকালে নাবাল জমি জলে ডুবে থাকত। কালো জোব্বায় মিজান মিঞা আদাড় বাদাড় থেকে সাপ ধরতেন। বিষধর সাপের ছোবলে তার নীল হয়ে যাওয়া শরীরে ঘোলাটে রঙের চ্যাপ্টা বিষপাথর ঘষে দিতেন বিবি মদিনা। গ্যাঁজলা ওঠা শরীর ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াতেন মিঞা। এনামেলের শানকিতে টপাটপ খুচরো পয়সা পড়ত। শুনেছিলাম মিজান নাকি সাপের বিষের নেশা করেন। এটা কি করে সম্ভব হয় আজও আমার যুক্তি বুদ্ধি
দিয়ে বুঝে উঠতে পারি না ।
" Some mental assylums have become the den of all sorts of addictive drugs, which are prescribed only by the doctors for medical purpose , like morphine, methadone (which are pain killers), benadryl cough syrup etc." এই আমাদের বর্তমান অবস্থা। স্টেশন ,বাস টার্মিনাল গুলো রাতের আঁধারে ফুটপাথ বাসিন্দাদের মধ্যে অনেক শৈশব-কৈশোর ডেনড্রাইট, ফিনাইলে নিজেদের জড়িয়ে নিয়ে আরও অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে। আফিম থেকে ঘরোয়া পদ্ধতিতে কোকেন তৈরি করে , বাজার গরম করে রেখেছে ড্রাগ পেডলাররা। আফগানিস্তানের (জালালাবাদ বর্ডার), মায়নামার থেকে সমুদ্র পথে ব্যাংকক পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে হৈ হৈ করে করে বিক্রি হয় " পপি সীডস"। ইন্টারপোলের নারকোটিকস বিভাগ জানে না , তা কিন্তু নয়। ভারতে মোঘল শাসন কালে মাদকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রনে ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে , শাসন ব্যবস্থায় অধিকার কায়েম রাখার জন্য বনিক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাবু, মুৎসুদদি, তেজারতি কারবারি, ছোট ভূ- স্বামী, এমন কি চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের জন্য ও নারকোটিকস রেগুলেশন অ্যাকট অনেক পরিমানে শিথিল করে দিল। শুধু তাই নয় বিভিন্ন শহরে, বন্দরে চিটেগুড় ও চিনির বর্জ্য দিয়ে শস্তার অ্যালকোহল তৈরি, বাজারিকরণ, নির্দিষ্ট এজেন্সির মাধ্যমে সেগুলি বিক্রি করার জন্য সোল ডিসট্রিবিউটর, অসংখ্য লোকাল ডিলারের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করত " Ferru & co."
হায় রে নেশা ! সর্বনাশা! চূড়ান্ত আসক্তি থেকেই তো জুয়াড়ি রা জুয়া খেলে। এককালে" তাস - পাশা - কর্ম নাশা' গেরস্থ ঘরে পাবলিকের নজর বাঁচিয়ে খেলতে হত। 70 এর দশকে দিব্যেন্দু বড়ুয়া প্রমাণ করলেন -" দাবা" বুদ্ধিমানের খেলা। তাই এখন ঘরে ঘরে বিশ্বনাথন আনন্দ তৈরি করার পালা । যুধিষ্ঠিরের পাশা খেলার নেশা ছিল , অথচ তিনি পাশার চাল বুঝতে পারতেন না। সেই সুবর্ণ সুযোগ টি নিয়ে শকুনি যুধিষ্ঠিরকে কিস্তি মাত করে দ্রৌপদী সহ পঞ্চভ্রাতা এবং মধ্যবয়সিনী মাতা কুন্তীকে তিন দানে পথের ভিখারি করে ছেড়ে দিলেন ।
কি করে অস্বীকার করি প্রতি শনিবার পকেট উজাড় করা রেসের মাঠের সেই রেসুড়ে কে? যে সর্বস্বান্ত হয় কেবলমাত্র একটি জ্যাকপটের আশায়? না খেয়ে শুঁটকে জিরো সাইজের "এনোরেকসিক" মেয়েটি বা ডিপ্রেশনে খাই খাই করে
বেদম ওজনদার "বুলিমিয়া" আক্রান্ত গৃহবধূটি, এইট প্যাক অ্যাব বানানোর কঠিন যুদ্ধে জিমে ঘাম ঝরানো , ঘন ঘন এনার্জি ড্রিঙ্কসে চুমুক দেওয়া পাড়ার মুখ চেনা ছেলেটা---- সবটাই তো অ্যাডিকশন! সূক্ষ্ম বিভাজন রেখাটা কখন হারিয়ে যায় বোঝা যায় না। তখন "বাতিক"(mania) ও নেশার ঘরে ধাক্কা দিয়ে ঢুকে পড়ে।
অ্যাডিকশন কখনও ম্যানিয়া আবার কখনও OCD(Obssessive Compulsive Disorder), যেখানে কোনো বিশেষ অতি তীব্র আকর্ষণে ব্যক্তি মানুষের সাধারন কাজ বা চাহিদা ক্রমান্বয়ে একই বিষয়ের পারম্পর্যে আটকে যায়। কেউ একঘেয়েমি কাটাতে সমানে শপিং করে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের লিমিট শেষ করছে, কেউ সারাদিন অনর্গল আন্তর্জালে সময় কাটাচ্ছে। নিয়মিত ইউ টিউবে নীল ছবির দর্শকের অভাব নেই, ছোট বাচ্চা থেকে মাঝবয়সি অনেকেই ভিডিও গেম খেলোয়াড়। key button টিপেটিপে আঙুল ব্যথা, চোখের বারোটা বাজতে চলেছে, তবু-------ঐ যে নেশা! টিঙ করে অ্যানড্রয়েড ফোনে ঘন্টা বাজল, এক দৌড়ে স্ক্রিন চেক করে দেখতে থাকো তোমার কোন পোস্টে কটা লাইক পড়ল! চকচকে চোখের তারায় সে কি উল্লাস! এ এখন আম বাত হয়ে গেছে। কানে ইয়ার ফোন গুঁজে গান শুনতে শুনতে রাস্তা বা রেললাইন পার হতে গিয়ে থ্যাঁতলানো লাশ হয়ে দুনিয়া ছাড়া হতে আর কতটুকুই বা সময় লাগে? কেউ সাবধান হওয়ার চেষ্টা করে কি?্সাধারণ অভ্যেসে মৃত্যুই চরম নিয়তি হয়ে যায়।
ছোটোখাটো বাতিক বরং less harmful বলা যায়। মাসের বাজার প্রচুর পরিমাণে কিনে জমিয়ে হোর্ডিং করে রেখে পরম নিশ্চিন্ত মনে বসে থাকেন যিনি, তিনি প্রায় সারা বছরের জিনিষ জমা করে ফেলেছেন; তাকে বোঝায় কে? শুচিবায়ু গ্রসত পাড়ার কাকিমা টি সারাদিনে 6/7 বার চৌবাচচার জলে স্নান করেন, কাচা কাপড় জামা বার বার ঘষে ঘষে আরও পরিস্কার করতে গিয়ে প্রায় ছিঁড়েই ফেলছেন, তার কিন্তু বুকে সর্দি বসে প্রায় নিউমোনিয়া হওয়ায় উপক্রম। এহেন মানুষকে কে সামলাবে? কোন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ? মনে পড়ে আমাদের পাড়ায় থাকতেন নরেন্দ্র নাথ লাহিড়ী স্যার। ইনডিয়ান সট্যাটিসটিকাল ইনস্টিটিউট এর অ্যাকচুয়ারির প্রফেসর। তিনি রোজ ভোরবেলায় ব্রিজের নিচের এঁদো জলাজমি টপাটপ করে লম্বা লম্বা পা ফেলে নিরুদ্বেগে পার হতে পারতেন পায়ের দিকে না তাকিয়েও সম্পূর্ণ হাওয়ায় সট্যাটিসটিকস স্টেপস সলভ করে যেতেন। এখন 90 বছর বয়সে বিশেষ নড়াচড়া করতে পারেন না। কিন্তু একতলার ঝুল বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসেও হাওয়ায় অঙ্ক কষা বন্ধ হয় নি । বুলুর বড়ো কাকার অভ্যাস ছিল কাজ করার সময় মাথায় পেন্সিলের শীষ ঠোকা।মিউনিসিপ্যালিটির ক্যাশে বসতেন--- যত না লিখতেন, তার দ্বিগুণ কপিং পেন্সিল মাথায় ঠুকে চুল তো উঠে গিয়েইছিল। উপরন্তু মাথার ঠিক মাঝখানে চকচকে টাকের মধ্যে পাকাপাকিভাবে বেগুনি রঙ হয়ে গিয়েছিল, কপিং পেন্সিলের অবদান। ল্যান্ড ফোন ও দূরদর্শনে নেশাতুর রা একটু অন্য রকম। তারা মোবাইলে বিশেষ ভরসা না করে কলকাতা থেকে কোয়েমবাটুর বা হাওড়া থেকে আইসল্যান্ড সর্বত্র ল্যান্ড লাইনে কল করে সবার খবরাখবর নিচ্ছেন, কারণ কেউ সুন্দর করে বুঝিয়েছে ল্যান্ড লাইনে কথা বললে মোবাইলের থেকে সস্তা হয়। যুক্তি দেবেন? পাগল নাকি? শুনবে কে? এদের অনেকেই সন্ধ্যা 6 থেকে রাত 11 টা পর্যন্ত জোরালো আওয়াজে কুসুম দোলা কিংবা ফাগুন বৌ দেখেন।
তার মধ্যেই সংসারের উনকোটি কাজ সামলে নিচ্ছেন। কিন্তু টেলিভিশনের আওয়াজ মিউট করা চলবে না । এই সদভ্যাস
ছাড়াবে ? কার এত সাহস? ডাক্তার? পাগল না কি? তার আর অন্য কোনো কাজ নেই? পাবলিক ডিমান্ড বলে কথা ।
"নেশা এক আদত হ্যায়, ইয়ে কভি ছোড়তা হি নহী, যিতনে
ভী কোশিশ কিঁউ না করো, ইনসান আপনি আদতোঁ সে
মজবুর হ্যায় " ------
অভ্যাস প্রসঙ্গে বলেছিলেন প্রফেসর গঙ্গা প্রসাদ বিমল। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও কিন্তু কথাটা প্রযোজ্য। সাহিত্যিকও তো মানুষ! শোনা যায় শেকসপিয়র বাগানে বেশ কিছুক্ষণ টানা পায়চারি না করতে পারলে কলমে হাতও লাগাতে না
আলেকজান্ডার ডুমা গল্প ও উপন্যাসের জন্য ব্যবহার করতেন নীল রঙের কাগজ, গোলাপী কাগজে প্রবন্ধ, হলুদ কাগজে কবিতা। বালজাক রাত জেগে লিখতেন, কড়া কফি তাঁর সৃষ্টির stimulus হিসেবে কাজ করত।
" Magnum Opus" , "La Comedia Of Humany " র ঔপন্যাসিক নাকি কফির পাউচ নিয়েই বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যেতেন, যাতে নেশায় ভাঁটা না পড়ে। ভলটেয়ার 40 কাপ কফি পান করতেন , তিতকুটে কফিতে স্যামোভার সর্বদাই ভরা। আমেরিকান কবি অ্যামি নোয়েলের 10,000 সিগারেটের কারটন জমা করা থাকত টেবিলের এক পাশে। লেখায় বুঁদ
কবির আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা না পেলে নাকি কাব্যে গতি আসত না।
ছোটোবেলায় যখন বাঙলা গল্পের বই ই ছিল বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম, তখন যে চরিত্রে রা আমাদের ভীষণ পরিচিত বা প্রিয়, তাদের কিছু পছন্দের জিনিস বা অভ্যাস আমাদেরও খুব কাছের হয়ে গিয়েছিল। নীহাররঞ্জন গুপ্তের রহস্য সন্ধানী কিরীটি রায় বর্মা চুরুট আর সিগারের ধোঁয়া তার বুদ্ধিকে আরও শানিত করত। ব্যোমকেশের ও সিগারেটে টান না দিলে
চিন্তা খোলতাই হত না। শরদিন্দু বনদোপাধ্যায়, ব্যোমকেশের অমর স্রষ্টা, খেতেন সিগারেট। তাঁর "মাকড়সার রস" কাহিনীর কেন্দ্রীয় চরিত্র নন্দ দুলাল বাবু "বিষাক্ত ট্যারানটুলার"রসের নেশা করতেন এক অভিনব পদ্ধতি তে। প্রেমেন্দ্র মিত্রের 78 নম্বর বনমালি নস্কর লেনের ঘনাদার হাভানা চুরুটের টিনের কৌটোটি হাতে না পেলে আড্ডার মুড ই হোতো না। চাটুজ্জে
দের রোয়াকে বিকেলের আডডাতে মুড়ির সঙ্গে তেলে ভাজা বা কাটলেট না পেলে যে নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদা কোনো মতেই " ডি লা গ্রান্ড মেফিসটোফিলিস" বলে চেঁচাতে পারতেন না। সত্যজিতের ফেলুদা চারমিনার সিগারেটে টান না দিলে মগজাসত্রে শান্ত দিতে পারতেন না। ফেলুদা অজস্র বই পড়েন আর দৈনিক শারীরিক কসরত করে বডি ফিট রাখেন।
শরৎ চন্দ্রের দেবদাস ব্যর্থ প্রেমে মাতাল ,।ত্রৈলোক্যনাথের লুল্লু ভূত চন্ডুর নেশা করে, বংকিম চন্দ্রের কমলাকান্ত আফিমের আসক্ত। নেশা করে প্রসন্ন গোয়ালিনীর সঙ্গে একান্ত তার মানস সংলাপ। মুক্তারামের তক্তারামে শুয়ে শিব্রামের অসাধারণ কথাটি মনে পড়ে যায়---- "নেশা করতে হয় তো রাবড়ির নেশাই খাসা। আমার পেশা কলম পেষা। নেশার কোনো নেশাই নেই "।
সুচিন্তিত মতামত দিন