জয়া চৌধুরী

মায়াজম
0
আদর্শ – সেকাল একাল


রামায়ণ নিয়ে কিছু বলি তেমন গাঢ় জ্ঞান আমার নেই। তবু পৌরাণিক কোন চরিত্রকে নতুন আলোয় পুনর্দর্শন করার অনুরোধ যখন সম্পাদক করলেন মনে পড়ল সুমিত্রার কথা। বাল্মীকি রামায়ণের সবচেয়ে কম আলোচিত একটি চরিত্র।
কিন্তু এখানে আমি ঠিক সুমিত্রা সম্পর্কেও লিখতে পারছি না। কারণ ...ঐ যে আগেই বললাম সীমিত জ্ঞান। আমি ভাবছি অন্য কথা। ভারতীয় সভ্যতায় নারীর সব ভূমিকার মধ্যে “মা” বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব পেয়েছে বরাবরই। এখানে দেখবার এই যে পুরুষ সম্পর্কে তেমন কোনো সম্পর্ক নির্ভর ধারণার অবকাশ হয় না। কারণ ‘পুরুষ’ ভাবনাটি জলের মতই তরল। তাকে যে কোনো পাত্রে রাখলে তেমন ভেবে ফেলা যায়। মানে পুরুষ “বাবা” হিসাবেই আদর্শ কিংবা জ্যেঠু, পিসেমশাই, নাতি বা পুত্র কোনো সম্পর্কেই পুরুষকে ভাবা হয় নি আজ পর্যন্ত। ধারণায় সে ‘মুক্ত’ । বরং বলা যেতে পারে মানুষ হিসাবে কিছুটা হলেও একটা ভাবমূর্তি তৈরী করা বেশি জনপ্রিয়। সেটি হল পুরুষ তাকেই বলা যায় যে ‘বীর”। মনে রাখতে হবে বীরত্বের সংজ্ঞাও খুব পালটে যায় দেশে দেশে। কোথাও গাড়ি থেকে পুরুষ আগে নেমে তারপর নারীকে নামার জন্য সাহায্যের হাত বাড়ালে সেটি শিভ্যালরির উদাহরণ হয় আবার কোথাও জোর করে নারীকে তুলে এনে বিয়ে করাকেও পৌরুষের সার্থক উদাহরণ ভাবে। রূপকথাতেও রাজপুত্র ময়ূরপঙ্খী নাওতে চড়িয়ে রাজকন্যাকে নিয়ে যায় গল্পের শেষে। কিন্তু সবগুলি ক্ষেত্রেই বিষয়টি পুরুষটির “মানব” সত্ত্বার সঙ্গে জড়িত, তার বৈবাহিক সম্পর্ক সত্ত্বার সঙ্গে নয়।
রাজা দশরথ ছিলেন অমিতাচারী। তার হারেমে তিনশো উনষাট উপপত্নী ছিল বলে জানা যায়। পত্নী ও উপপত্নীর মধ্যে ফারাক স্রেফ ক্ষমতার বিলি বন্টনেই। বন্ধ দরজার ভেতরে বিছানায় দুজনের ভূমিকাই রাজার আদেশ পালন কর্ত্রী রূপেই তার চেয়ে এক সেন্টিমিটার বেশিও নয়। অতএব রাজা দশরথের সাড়ে তিনশোর শয্যাসঙ্গিনীর মধ্যে কৌশল্যা, কৈকেয়ী ও সুমিত্রার মূল ক্ষমতার কাছে চলে আসার পেছনে সাড়ে তিনশো কারণ থাকতেই পারে তবে তাতে সম্মানের ফারাক পড়ে না। তাই দেশে দেশে রামায়ণের নানান ব্যাখ্যায় একটি দৃষ্টিকোণেই এই তিন নারীর সার্থকতা খুঁজেছে মানুষ। সেটি হল- তাঁরা কতখানি “মা” হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। ভারতীয় সভ্যতায় নারীর চরম আদর্শ ‘সীতা” র কথা এ লেখায় আলোচনা করছি না। কেননা সীতার মত নানা রূপে পরিপূর্ণ নারীর আলোচনার পক্ষে জায়গাটি অপরিসর এবং আমার জ্ঞানও সীমিত।
এইখানেই চলে আসবে রামায়ণের আর একটি অনালোচিত চরিত্র ’শান্তা’। এই শান্তা চরিত্রটি রাজা দশরথের চরিত্রের সেই দিকটি উন্মোচিত করবে যেখান থেকে ভারতবর্ষে কিভাবে ‘কন্যা’ রা অকামনা যোগ্য হয়ে থেকেছে বরাবর তার একটি ধ্রুপদী উদাহরণ। দশরথ ও তার প্রথম স্ত্রী কৌশল্যার প্রথম সন্তান একজন কন্যা- শান্তা। মহামহিম ভারতীয় ভাবধারায় কন্যারা সবসময়েই অবাঞ্ছিত কিংবা কম বাঞ্ছিত, এক্ষেত্রেও সেটিই দেখি। দশরথের পুত্র না হওয়াতে তিনি দুঃখে কাতর হন। তারপর একে একে বিয়ে করেন কৈকেয়ী ও সুমিত্রাকে। এবং তার পরেও আরও অসংখ্য নারীকে নেন শয্যায়। কিন্তু নাঃ পুত্র জন্মায় না। তাই কন্যার প্রতি অনাদরও বজায় থাকে। একুশ শতকের ভারতেও এর চেয়ে বেশি কিছুই বদলায় নি সেকথা পাঠক মানবেন নিশ্চয়ই।
দশরথ তার জন্মের আট মিনিট পরে বাবা মা দুজনকেই হারান এবং প্রতিপালিত হন মুনি মরুদন্ডের কাছে। শাস্ত্র ও শস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে দক্ষিণ কোশলের রাজার কন্যা কৌশল্যাকে বিয়ে করেন। যার ফলশ্রুতি কন্যা শান্তা। এই শাস্ত্র পারদর্শী অশেষ গুণবতী শান্তা রাজগৃহে বড় হন কিন্তু রাজা তখনও পুত্র কামনায় উন্মাদ। তাই যখন তিনি শোনেন ঋষি বিভান্ডকের পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গের পুত্রেষ্টি যজ্ঞ সম্পর্কে জ্ঞানের কথা তখন মরীয়া হয়ে যান তাকে অযোধ্যায় আনার জন্য। কিন্তু ঋষ্যশৃঙ্গ তো মানুষ হয়েছিলেন নির্জনে নারী সঙ্গ বর্জিত হয়ে। একমাত্র নারীর আকর্ষণেই তিনি অযোধ্যায় আসতে রাজি হবেন। অতএব দশরথ কন্যা শান্তাকেই এ কাজে ব্যবহার করলেন। তাকে আদেশ করলেন ঋষ্যশৃঙ্গর মন জয় করে তাকে অযোধ্যায় নিয়ে আসতে। কৌশল্যার সঙ্গে ঠিক এ সময় থেকেই সম্পর্কে অবনতি ঘটে দশরথের। তিনি পরোয়া করেন না। স্বাভাবিক! ক্ষমতাবানেরা ক্ষমতাহীনদের পরোয়া করবেনই বা কেন! নির্দ্বিধায় রাজকন্যা শান্তা বাবার আদেশে রাজবিলাস ত্যাগ করে গরীব মুনি ঋষ্যশৃঙ্গের সঙ্গে থাকতে শুরু করে দেয়। ঋষ্যশৃঙ্গ কোনো অর্থেই শান্তার যোগ্য ছিলেন না। কিন্তু মেয়েকে স্বার্থের যূপকাষ্ঠে বলি দিয়ে দশরথ পুত্রলাভ করেন।
কাজেই ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় সাহিত্য রামায়ণের অন্ততঃ শুরু দিকের পাতায় এভাবেই নারীর প্রতি অনাদর ও অবমাননা বর্ণনা দেখি। কাজেই কোন নারী চরিত্র যদি মহান হিসাবে স্থান পায়ই তার একমাত্র ভূমিকা হতে পারে তার ‘মাতৃরূপ’। সুমিত্রার মহনীয়তা যে তার মাতৃরূপেই বর্ণিত হবে এতে আর আশ্চর্য কী! তুলসীদাসও তাঁর বর্ণনায় সুমিত্রা কে আদর্শ ‘মা’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন যিনি গর্ভজাত সন্তানের চেয়েও অধিক স্নেহ করেছেন অপরের সন্তান ‘রাম’ কে। সে ছায়া আমি শরৎচন্দ্রের নিষ্কৃতিতেও দেখেছি কিংবা এরকম অজস্র সাহিত্যে। শরীরজাত হলেই সে সবচেয়ে আপন হবে একথা সাধারণ মায়েরা ভাবেন কিন্তু সত্যি বলতে কী ভালবাসায় স্বার্থপরতা থাকে না এমন ভাবলে সুমিত্রার এই স্নেহকে প্রণাম না জানিয়ে পারা যায় না। আর সত্যিই তো তাই । মহাভারতে দেখুন গান্ধারীর কাছে দুর্যোধন আশীর্বাদ চাইতে এলেন, প্রাণের প্রিয় সন্তানকেও মা বলতে পারলেন না “তোমার জয় হোক”, বললেন- ধর্মের জয় হোক। গান্ধারী এখানেই অনন্যা, অতুলনীয়া। কিন্তু সত্যিই কী গান্ধারী তাঁর মাতৃসত্তাকে অতিক্রম করতে পারলেন শেষ অবধি? নাঃ। তিনি কিন্তু কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষে শ্রীকৃষ্ণকে সেই শোকেই অভিশাপ দিয়েছিলেন- তুমি তোমার পুত্র প্রপৌত্র সহ বংশ বিনাশ দেখবে। কাজেই সার্থক ‘মা’ হবার সংজ্ঞার নানান দিক দেখতে পাই।
রামায়ণ লেখা হয়েছিল মহাভারতেরও আগে। তার ভেতরকার চরিত্রগুলিও নির্মিত হয়েছিল একমাত্রিক ও প্রায় আধিদৈবিক চরম দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে। কাজেই সুমিত্রার কাছে লক্ষণ ও শত্রুঘ্নর চেয়ে রাম বেশি প্রিয় ছিল এতে অবাক হতে পারি না। অথবা রাম ও ভরত দুজনেই সুমিত্রার ন্যাওটা ছিলেন, ঘুমের সময়েও তারা নিজের জন্মদাত্রী মা নন, সৎ মা সুমিত্রার কাছেই শুতে পছন্দ করতেন। কিংবা বনবাসে যাবার সময় লক্ষণ যখন মায়ের অনুমতি নিতে এলেন তখনও সুমিত্রা সবচেয়ে আগে গর্ভস্থ সন্তান অতি বাধ্য লক্ষণকেই বকলেন কেন ঐ সামান্য সময়ের জন্য হলেও রামের সঙ্গ ছেড়ে অন্দরমহলে এল? কিংবা বললেন- লক্ষণের দুর্ভাগ্য যে রাম অযোধ্যা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, আবার লক্ষণের সৌভাগ্য যে রাম লক্ষণকেই বলেছেন তার সঙ্গে বনবাসে যেতে। অতএব লক্ষণকে কখনই দাদাকে ছেড়ে থাকতে হবে না। লক্ষণ যে বিবাহিত, তার যুবতী স্ত্রী মান্ডবীও যে স্বামীসঙ্গ বিচ্ছিন্ন থাকবে এটা কোন বিষয়ই নয় শাশুড়ি সুমিত্রার কাছে। যদিও সুমিত্রা কাশীরাজের কন্যা এবং অত্যন্ত শাস্ত্র বিশারদ ছিলেন। বলা হয় দশরথের অন্দরমহলে সবচেয়ে পড়ুয়া জ্ঞানী ছিলেন সুমিত্রাই। সেই সুমিত্রাও পুরুষতন্ত্রের মনোমত কাজ করলেন। বিনা কারণে অথবা একটি অন্যায় আবদার মেটানোর জন্য নিজের সন্তান বিচ্ছিন্ন থাকা বা সন্তানের স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছিন্ন থাকাটাও কোন বড় ব্যাপার মনে হলো না ওঁর কাছে। ‘নিঃস্বার্থ’ শব্দটির কৌলীন্য এখানে ব্যবহার করা হল দশরথের অন্যায় আচরণের ফল স্বরূপ যে যে ঘটনাগুলি ঘটছিল অযোধ্যার অন্দরমহলে, তাকেই যাথার্থ্যতা দিতে।
রামায়ণের কাল থেকে অনেক অনেক হাজার বছর পরে বাস্তবে যখন সারদা মায়ের কথা পড়ি বরং আদর্শ ‘মা’ কীরকম হবেন সে বিষয়ে যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা পাই। যেখানে মা মুসলমানের ছেলে ডাকাত আমজাদ কিংবা রামকৃষ্ণ মিশনের প্রথম সচিব স্বামী সারদানন্দ ওরফে মায়ের শরতের মধ্যে কোনো ফারাক করেন না। কিংবা সাধু ছেলের জন্য জয়রামবাটির গ্রামে রাত থাকতে জেগে দুধ সংগ্রহ করতে যান মা যাতে ছেলের পেটে ভাল কিছু পড়ে। কেননা তাদের যে কঠিন সাধনা করতে হবে। আবার সেখানেই সারাদিন রাত গৃহী ভক্তদের সমাগমে খেটে ক্লান্ত মা নিঃশব্দে শুধু সেবাই করে গেছেন। কত রাত বয়স্ক অসুস্থ বৃদ্ধা ভক্ত রাতে মায়ের বাড়িতে থেকেছেন। হয়ত কাঁথা ভিজিয়ে ফেলেছেন মলমূত্রে। নিজেই অসুস্থ মা কেউ জাগার আগেই চুপি চুপি সব কেচে ধুয়ে সেই লজ্জায় জড়োসড়ো ভক্তকে খাবার বেঁধে রওনা করে দিয়েছেন। যাতে তার সাধুছেলেরা পরদিন জেগে এসব দেখে তাদের বকাবকি না করে। তিনি সাধুরও মা ছিলেন গৃহীরও মা। এরকম আরো বহু কাজের ভেতরে আদর্শ মাতৃরূপ দেখতে পাই।

রামায়ণে রামচন্দ্র তার বাবা দশরথের দ্বিতীয় রানী কৈকেয়ীকে এক স্খলিত সময়ে দেওয়া প্রতিজ্ঞাটি পালন করবার জন্য বনবাসে গিয়েছিলেন। কোন মহৎ সাধনার উদ্দেশ্যে যান নি। কাজেই রাজপ্রাসাদের রাজনীতিতে সেইসব ‘রানী’রা কে কতখানি আদর্শ ‘মা’ ‘পত্নী’ ‘কন্যা’ বলা হবে, তা নিয়ে আধুনিক সময়ে প্রশ্ন উঠেই যায়।













____________ __________________________________________

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)