কর্ণ শীল

মায়াজম
2
                একচক্রার পরিব্রাজক


                -------------



                                     ★

বীরভূমের একচক্র গ্রাম। লালমাটির পথ। উঁচুনীচু পথ ধরে এগিয়ে চলেছেন এক সুঠামদেহী সন্ন্যাসী। গৈরিক বস্ত্র। তিনি কোথা থেকে এসেছেন কেউ জানে না। তাঁর দিব্যদেহ দেখে চাষীরা চাষ ফেলে, তন্তুবায় তাঁত ফেলে তাকিয়ে থাকে।

   একচক্র গ্রামের ইতিহাস বর্ণাঢ্য ও সুপ্রাচীন। কথিত আছে বক নামে এক ভয়ানক রাক্ষস ত্রেতায় এ গ্রামে বসবাস করতো। তার খোরাক ছিল প্রতিদিন একটি করে জীবন্ত মানুষ। তাকে বধ করার জন্য কুন্তী তাঁর পুত্র ভীমসেনকে নির্দেশ দেন এবং একই সময়ে আদিদেব শিবের কাছে অর্জুন লাভ করেন এক মহাস্ত্র। সেও বকরাক্ষসের নিধনের জন্যই। কিন্তু সে অস্ত্র অকুস্থলে পৌঁছনোর আগেই ভীমসেনের হাতে বকরাক্ষস নিহত হন এবং সে দিব্যাস্ত্রটি একচক্র গ্রামেই কোথাও প্রোথিত হয়ে থাকে।

   সন্ন্যাসী বিভিন্ন পথ ঘুরে গ্রামের এক প্রান্তে হাড়াই পণ্ডিতের ঘরে আতিথ্য গ্রহণ করলেন। কৃষ্ণভক্ত হাড়াই সন্ন্যাসীর পাদ্যার্ঘ্য দিলেন। আচমনের জল দিলেন। ফলমূলাদি -আতপ চাল-বাতাসা দিয়ে ফলাহারের যথাবিহিত ব্যবস্থা করলেন।

   রাত্রিবাসের শেষে সকাল হলে হাড়াই হাত জোর করে দাঁড়ালেন সন্ন্যাসীর সামনে।

-প্রভু, আশীর্বাদ করুন যেন কৃষ্ণনামে মতি থাকে। শ্রীহরি বন্দনায় যেন দারপুত্র নিয়ে শান্তিতে বসবাস করতে পারি।

     সন্ন্যাসী কিছু একটা বলার জন্য অনেকক্ষণ থেকেই উসখুস করছিলেন। তাঁর চিত্তচাঞ্চল্য হাড়াইয়ের চোখ এড়ালো না। তিনি নরম গলায় বললেন,

-নাথ, হৃদয় ব্যকুল দেখি যেন। আমার আতিথ্যে কি কোনও ত্রুটি হয়েছে? তবে আমাকে আদেশ করুন, শিরোধার্য হোক আমার।

   সন্ন্যাসী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন,

-হাড়াই, তুমি শাস্ত্রজ্ঞানে মহাপণ্ডিত, কৃষ্ণপ্রেমে শ্রেষ্ঠ সাধক। তোমার অজানা কিছুই নয়। তাই তোমাকে বলতে কোনও লজ্জা দেখিনা। আমি দরিদ্র, বৃদ্ধ সন্ন্যাসী। শত তীর্থ পরিভ্রমণ করতে ইচ্ছুক। কিন্তু আমার পাথেয় অল্প, ততোধিক ক্ষীয়মাণ দেহের শক্তি। তাই দেশভ্রমণের সঙ্গী হিসেবে তোমার পুত্রটি আমায় দান করো। 

   রৌদ্রে চিরে বজ্রপাত হলো যেন। পণ্ডিতের মুহুর্তের মধ্যে মনে হলো গাছ, ছায়া, রোদ, জল, সমগ্র চরাচর কালিমালিপ্ত। মৃত্যুর চেয়েও তীব্র এক যন্ত্রণাবোধ তাঁর সমস্ত স্নায়ুতন্ত্রকে অসাড় করে দিল। তিনি এ ছেলেটিকে নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। চাষে যান না, যজ্ঞে জান না, পূজার ফুল তোলেন গৃহের অঙ্গন থেকে।  অনতিদূরে নদীর ঘাট, সেখানেও জাননা তর্পণে,  বাড়ির পাশের ছোট্ট পুকুুরে ঐহিক বন্দনা, সূর্যপ্রণাম সারেন। পাছে নিত্যানন্দ তাঁকে ছেড়ে পালিয়ে যান। আর্তস্বরে কেঁদে উঠে বললেন,

-প্রভু, এ কি বললেন? এ কেমন ধর্মসংকটে শ্রীহরি আমাকে ফেললেন। আমার প্রাণ চেয়ে নিলেন না কেন তিনি? পুত্রদান আর মৃত্যু আমার কাছে সমার্থক। অথচ সন্ন্যাসীকে কথা দিয়েছি, তা ফিরিয়ে নিলে সবংশে অখণ্ড নরকে পতিত হবো...ঠাকুর, আপনি ব্রাহ্মণীর কাছে তাকে চেয়ে নিন। আমি পারব না। বাকি শ্রীহরির ইচ্ছা।

   নিত্যানন্দমাতা পদ্মাবতী কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। ভগ্নহৃদয় স্বামীর কাছে এসে দাঁড়ালেন। বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে বললেন,

-এ পূর্বনির্ধারিত স্বামী। স্বয়ং শ্রীহরি এর নিয়ামক। দশরথ যেমন তাড়কা বধের সময় রামচন্দ্রকে তুলে দিয়েছিলেন বিশ্বামিত্রের হাতে, তেমনই আপনিও করুন পণ্ডিত। পালনহার তাঁর রক্ষা করবেন। বিদায় দিন তাকে।

     ঝাপসা হয়ে এলো ব্রাহ্মণের দুই চোখ। প্রবল ক্রন্দনের বাষ্পে ফুলে ফুলে উঠতে লাগলো বুকের পাঁজর। আলোকিত প্রভাতে কালিমা লেপে দিয়ে সন্ন্যাসীর সঙ্গে চললেন দিব্যাঙ্গ নিত্যানন্দ।

  "কোটি চন্দ্র জিনিঞা বদন মনোহর।
জগত -জীবন হাস্য সুন্দর অধর।।
মুকুতা জিনিঞা প্রভুর দশনের জ্যোতি।
আয়ত অরুণ দুই লোচন -সুভাঁতি।।
আজানু -লম্বিত ভুজ, সুপীবর বক্ষ।
চলিতে কমলবত পদযুগ দক্ষ।। "

   ক্রমে একচক্র গ্রামে সীমা অতিক্রম করে গেলেন সন্ন্যাসী এবং নিত্যানন্দ। যুবক দেখলেন, সন্ন্যাসী দেখনেই বৃদ্ধ, আদতে তিনি পূর্ণযুবার চেয়েও বেশি দ্রুত। বলশালী। ক্ষিপ্রতার সঙ্গে তিনি পার হয়ে যাচ্ছেন ক্রোশ, যোজন। তাঁর সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠছেন নিত্যানন্দ। 

   সন্ন্যাসীর সঙ্গে পরিব্রজনে নিত্যানন্দ গয়া, কাশী ঘুরে উপস্থিত হলেন প্রয়াগ তীর্থে। বড় মনোহর রৈবতক পর্বত। পাহাড়ি  প্রপাতগুলি পর্বতগৃহের আঙিনায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গবিভঙ্গে ছুঁয়ে যায় শত শত ফুলের পাপড়ি। মৃদু হাওয়ায়  উড়ন্ত পাখির পালক খসে পড়ে সরোবরের জলে একটুকরো আষাঢ় মেঘের মত। সোনা, হীরে, মরকত, বৈদূর্য্য পোখরাজ,  চুনী,  লোহা,  তামা,  স্ফটিক, -সহস্র খনিজের দেশ প্রয়াগ।  এক সময় রৈবতক পর্বতে বৃষ্ণিবংশীয় নৃপতি উগ্রসেন প্রমোদভবন নির্মাণ করেছিলেন। 

   সন্ন্যাসী বললেন,

-নিত্যানন্দ, এই জায়গাটি ভালো করে দেখে রাখো। এ মহা পুণ্যস্থান।

    নিত্যানন্দ আপ্লুত হয়ে বললেন,

-জানি, প্রভু এখানেই পার্থ ও পার্থসারথি মিলিত হয়েছিলেন।

    সন্ন্যাসীর কন্ঠস্বর গাঢ় হয়ে এলো। গদগদ কন্ঠে তিনি বললেন,


-তখন বর্ষাউৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে প্রয়াগে। দ্বারকানাথ রাজকীয় সম্বর্ধনা লাভের পর অর্জুনের আগমন সংবাদ পেয়ে এলেন প্রয়াগে।  বাসবনন্দন আর মাধবের আগমনে পূর্ণ হলো বর্ষামিলনমেলা। পানপাত্রের ঝংকারে ঝংকারে নুপুরনিক্কণ আর স্বর্ণবলয়ের রিনিরিনি সঙ্গতে মনোহর গিরিপাদদেশে অকালবসন্তের আগমন হলো যেন। পশু, পাখি, সমগ্র যদুকূল, বৃষ্ণিবংশীয় রাজকুলবীর তথা পুুরাঙ্গনাগণ মগ্ন হলেন। অক্ষিকটাক্ষিনী, পক্কবিম্বোধরা নারীগন পানাহারে মত্ত হয়ে স্খলিতঅঞ্চলে, কুন্দসন্নিভ দন্তরুচির ছটায় আষাঢ়ের স্নিগ্ধগন্ধা মেঘে চালনা করলেন ক্ষণপ্রভার ক্ষুরধার অসি।

সাদা, হলুদ,  লাল, নীল,  কালো,কপিশাদি সহস্রবর্ণের বস্ত্রে দিগন্ত  উদ্ভাসিত... উচ্ছসিত। কৃষ্ণ- বিজয় যুগলমূর্তির চারিদিকে পরমানন্দে নৃত্য করতে লাগলেন উগ্রসেন,  বসুদেব,  অক্রুর,  হলধর,  কামদেব,  সাত্যকি, প্রদ্যুম্ন, শাম্ব, চারুভদ্র প্রমুখ আত্মীয়মিত্রগণ।পুরন্দরলোকের ঊর্বশী মেনকা রম্ভা প্রমুখ চতুঃযষ্টিকলানিপুণা নৃত্যঙ্গনাগণ ঈর্ষাণ্বিতা দৃষ্টিতে দেখতে  লাগলেন দৈবকী, রোহিণী, ঝিল্লি, উপঝিল্লি, ভদ্রা, শচী, রতি, বাণপুত্রী, ঊষা প্রমুখের রত্নভূষার লাস্যববিনন্দিত নৃত্যকলা।

    নিত্যানন্দ করজোরে বিগলিত হৃদয়ে শুনতে লাগলেন সেই মহামিলন গাথা। সন্ন্যাসী দূরে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন। দুটি একটি দীপ জ্বলে উঠলো শহরের পড়ন্ত গোধূলির শেষে। ভিজে ভিজে হাওয়ায় রোমাঞ্চ উপস্থিত হলো সন্ন্যাসীর বুকে। কাঁপা কাঁপা গলায় তিনি বললেন,

-নিত্যানন্দ, তোমার জীবনেও যে এমন এক মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হয়েছে। অনতিবিলম্বে তুমি মিলিত হতে চলেছ এক যুগপুরুষের সাথে। তাঁর কীর্তি বর্ণনা করতে গিয়ে আলংকারিক অলংকার হারান, ভাষ্যকার ভাষা। তোমাকে যে তাঁর তেজ সহ্য করার যোগ্য হয়ে উঠতে হবে। 

   শিহরিত হলেন নিত্যানন্দ। একচক্র গ্রামের পিতার আরাধনার মালাতলাটি মনে পড়ে গেল তাঁর। নিয়মিত সেখানে দাঁড়িয়েই পিতা অষ্টোত্তর শতনাম জপ করেন।

     সন্ধ্যাকাল। পদ্মাবতী সামান্য কিছু ফলাহারের সামগ্রী প্রস্তুত করেছেন। নিত্যানন্দ প্রদীপের আলোকে মহাভারত পাঠে নিমগ্ন।

  এমন সময় উঠোনের দিকে একটি পতনের শব্দ শোনা গেল।সঙ্গে উচ্চস্বরে কান্না।

   নিত্যানন্দ ছুটে গেলেন সেদিকে। সন্ধ্যামালতীর ঝোপে অসংখ্য জোনাকি উড়ে বেড়াচ্ছে। আরাধনা গৃহ থেকে ভেসে আসা মৃদু ধূপগন্ধ বাতাসে মিশে আছে। 

  হাড়াই পণ্ডিত মাটিতে পড়ে আছেন। কিন্তু তিনি সংজ্ঞা হারাননি। আকাশের দিকে হাত তুলে উচ্চস্বরে কাঁদছেন বৃদ্ধ  ব্রাহ্মণ। নিত্যানন্দ তাঁকে জড়িয়ে ধরে তুললেন।  তাতে আরও বেশি করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। পুত্র আকুল হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,

-বাবা, কি হয়েছে? এমন করছ কেন?

    দুচোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে এসে বুক ভাসিয়ে দিল। বাষ্পরুদ্ধ গলায় বৃদ্ধ বললেন,

-নিতাই রে, এই এতদিনে প্রভু এসেছিলেন। ওই..ওইখানটিতে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। আহা..আহা..রূপ গো প্রভু! ও কি রূপ! আমাকে অন্ধ করে দে নিতাই, ও মনোহরকে দেখার পর আমি আর কিছু দেখতে চাইনা।

-বাবা, তুমি শান্ত হও, উচাটন হয়োনা। পুণ্য থাকলে প্রভু আবার দেখা দেবেন..

    হাঁপাতে হাঁপাতে বৃদ্ধ বললেন,

-না নিতাই, যতটুকু পুণ্য অর্জন করেছিলাম, তার ফলেই প্রভুর ঝলক দেখেছিলাম। এ জন্মের সঞ্চিত পুণ্যে তা আর সম্ভব নয়। তুই কথা দে, আমার ইপ্সিত দর্শন তুই পূর্ণ করবি। কথা দে বাবা...কথা দে।

    

সন্ন্যাসী সব শুনে স্তব্ধ বিস্ময়ে নিত্যানন্দের মুখের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন। অম্বাদেবীর মন্দিরে নবদম্পতির দল প্রদীপ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। দূর থেকে তার আলো দিগন্তের দেহে ফুটে উঠেছে আলোর অজস্র ফুলের মত। কালো পাথরে তৈরি তীর্থঙ্কর নেমিনাথের বিরাট মূর্তির নীচে দুজন দাঁড়িয়ে রইলেন। এক অপার্থিব জ্যোৎস্না ছেয়ে আছে চরাচরে। তার আলো চাঁদের নয়। নয় নক্ষত্রলোকের বহ্নিমান স্ফূরণ। এ যেন সৃষ্টির আদি থেকে বিশ্বের সকল পাণ্ডিত্য, পূণ্য, পবিত্রতার আকর হয়ে আলোকিত করছে চরাচর।

   সন্ন্যাসীর কন্ঠ মেদুর হয়ে এলো।

-তোমার পিতা ব্যাসদেবের সমান জ্ঞানী ও পুন্যবান। যে পুণ্যার্হ স্বপ্ন তিনি দেখেছেন তার পথেই তোমাকে হাঁটতে হবে নিত্যানন্দ।

-সে পথ কি মহাত্মা?

-শত দেশ, পুণ্যভূমি তোমাকে পদব্রজে চলতে হবে ব্রাহ্মণ। সকল তীর্থের পবিত্র ধুলো গায়ে মেখে অবশেষে পৌঁছতে হবে পরম বোধির ক্ষেত্রে। ভগবানের যে রূপ তোমার পিতা দর্শনরূপে ধন্য হয়েছেন, তাঁর লীলাভূমিতে, তাঁর লীলাকর্মের সঙ্গী হতে হবে। আমার পথ তোমার সঙ্গে এই পর্যন্তই পরিব্রাজক। এবার তুমি একা এগিয়ে যাও। তোমার সুমহান পথে, তুমি একা।

নিত্যানন্দ ঋষিকে প্রণাম করলেন। তিনি আশীর্বাদ করে বললেন,

-তবে মনে রেখ, ঈশ্বরপ্রাপ্তির চেয়ে বড় হলো ঈশ্বরে মতি বজায় রাখা। ভ্রষ্ট হয়োনা।

   রৈবতক পাহাড়ের পাঁচটি চূড়া বেয়ে এক অনাবিল গন্ধ ভেসে এলো। 

     
দামোদর কুণ্ডের সোপান বেয়ে সারি সারি দীপমালা নেমে গেল জলের দিকে। হুলুধ্বনি হলো কোথাও। নিত্যানন্দ দেখলেন রহস্যময় সন্ন্যাসী অদৃশ্য হয়েছেন।

    শ্রীহরির নাম করে নিত্যানন্দ এগিয়ে চললেন। 

                     
                                        ★

মথুরা, দ্বারাবতী, বৌদ্ধ -কাশীপুর, নরনারায়ণাশ্রম, রঙ্গনাথ, সেতুবন্ধ, মলয়, গোমতী, গণ্ডকী, সরযূ, কাবেরী, অযোধ্যা, দণ্ডকারণ্য, ত্রিমল্ল, বেঙ্কটনাথ, সপ্তগোদাবরী, কন্যকানগরী, রেবা, ---একের পর এক তীর্থ, একের পর এক নদী, পর্বত, বন, উপবন নিত্যানন্দের কাছে নব নব রূপে ধরা দিল। ঐহিক চিন্তায় প্রতিফলন ঘটলো দৈনিক নিত্তনৈমিত্তিক জীবনের প্রতিচ্ছবির। উত্তরোত্তর সম্যক জ্ঞান, অভিজ্ঞতার আলোকে নিত্যানন্দ হয়ে উঠলেন আলোকিত।

    অবেশেষে নিত্যানন্দ পৌঁছলেন নর্মদা উপত্যকায়। মাহিষ্মতী সাম্রাজ্য। 

অবন্তী রাজ্যের মধ্যে মহাবিন্ধ্য পর্বত। তার উত্তরাংশের পরিচয় অবন্তী, দক্ষিণাংশের পরিচয়, মাহিষ্মতী। 

মনোরম নর্মদা উপত্যকাকে প্রহরীর মত ঘিরে রেখেছে উত্তরে বিন্ধ্য এবং দক্ষিণে সাতপুরা পর্বতমালা। বিন্ধ্যাচলে সন্ধ্যা নামে নর্মদার আকাশে অস্তরাগের মত। সাতপুরার পর্বতপ্রাকারে নীলচে পৃথগন্ন জোনাকির দল সন্ধ্যাপ্রদীপ হাতে অশরীরী বধূদের চিলমনের আড়ালে ঝলসে ওঠে বুন্দেলখন্ডের মহলের আলিশায়।

বনপথে হঠাৎ হঠাৎ পথের বাঁকে চমকে ওঠা ঘাই , চৌশিঙ্গা হরিণ, গাউর ছুটে মিলিয়ে যায় ঝরে পড়া শুকনো পাতার স্তূপ পার হয়ে।

  মেলঘাট বনাঞ্চলে ক্ষীণ চাঁদের আলোয় টিক গাছের ছায়ায় বসে হয়তো কোন বাঘ আফসোসে মাথা নাড়ে, রাতপাখিকে পরী ভেবে।

  নির্লোভ হাওয়ার মত, স্থিতধী সময়ের মত,আবেগী রাত্রির মত,উন্মুক্ত দিনের মত নিত্যানন্দ চলেছেন।

রাত্রির অন্তিম প্রহরে তিনি পৌঁছলেন এক রাত্রিবাসের সামনে। খোলা দরজা। দীপমালা রাত্রিশেষের চাঁদের মতই ক্ষয়িষ্ণু। এক দ্বাররক্ষী তাঁকে দেখে এগিয়ে এলো। বিরাটদেহী নিত্যানন্দের রজতগিরিতুল্য রূপ দেখে দ্বাররক্ষী সসম্ভ্রমে তাঁকে অভিবাদন করলো,

-আপনার পরিচয়?

    নিত্যানন্দ উত্তর দিলেন,

-আমি পরিব্রাজক। পথশ্রমে ক্লান্ত। আশ্রয়, খাদ্য আর পানীয় চাই।

       দ্বাররক্ষী তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো। হাতের আলোকবর্তিকার আলোয় অস্পষ্ট পথ। দুপাশে সারি সারি ঘর।সমগ্র ভবনটি নিদ্রায় আচ্ছন্ন। জাগরুক কোনও স্পন্দন বোঝা যায়না। অলিন্দের শেষ প্রান্তে একটি ছোট ঘরে।প্রদীপটি একটি কুলুঙ্গির মধ্যে রেখে দ্বাররক্ষী প্রশ্ন করলো,

-আর্য, রাত্রির প্রায় অন্তিম প্রহর। কোনো আহার্য চাই কি?

   নিত্যানন্দ সবেগে মাথা নাড়লেন।

-নাহ্, এত রাত্রে আর খাব না কিছু। তুমি একটু মাধ্বীর ব্যবস্থা করো। সঙ্গে কিছু মৎসাণ্ড।


        -আচ্ছা, আমি ব্যবস্থা করছি।

কিছু সময় পরে একটি অবগুন্ঠিতা নারীমূর্তি দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। মধুর স্বরে নিত্যানন্দ বললেন,

-তুমি কে নারী?

     নর্মদা নদীর প্রবাহের মত তার হাসি। এক রাশ পদ্মকোরক ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে। মাধ্বীর পাত্র, অনুপান নিত্যানন্দের সামনে রেখে সে বললো,

-আমি নর্মদা। 

গোহপতানি কইলেন আপনার স্নান হয়নি। ডুব দেবেন?

     নিত্যানন্দের অধর স্ফূরিত হলো, 

-তুমি বারাঙ্গনা? 

    ছ্যাঁকা খাওয়া সাপের মতো ফুঁসে উঠলো নারী। তীব্র দৃষ্টিতে নিত্যানন্দের দিকে তাকিয়ে সে বললো,

-হ্যাঁ, আমি শুদ্ধিকরণ মন্ত্র।

     ঘরের কুলুঙ্গিতে দীপের উজ্জ্বল আলো। সেই আলোকশিখার দিকে আঙুল দেখিয়ে মেয়েটি বললো,

-অগ্নি তো পাবক। চতুর্বেদের জাতক। পঞ্চভূতের অন্যতম। মহাদেবের তৃতীয় নয়ন। সেও নারীর সৌন্দর্যে, কলানৈপুণ্যের পদাশ্রিত।  


   নিত্যানন্দের কৌতুহল জাগলো। আসমুদ্রহিমাচল ভ্রমণ করে তাঁর বিশ্বাস জন্মেছিল, তিনি সর্বজ্ঞ হয়েছেন এবং আবহাওয়া, ভূ -বিদ্যা, মনুষ্য চরিত্র সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞান সম্পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু মাহিষ্মতীর ক্ষুদ্র রাত্রিবাসে এক অনামী নারীর সামনে তাঁর জিজ্ঞাসা জাগলো। তবে কি তাঁর শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়নি? এখনও কি বাবার দেখা দেবমূর্তির মানব রূপের সামনে দাঁড়াবার যোগ্যতা তাঁর হয়নি? মেয়েটিকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন,

-ব্যাখ্যা করো নারী।

      মাথা থেকে ঘোমটা খুললো মেয়েটি। শরতের মেঘ যেমনছসব বর্ষা ঝরিয়ে ম্লান সাদা হয়ে আসে, তবুও রয়ে যায় অত্যল্প কালিমার রেশ, তেমনই রঙ যেন মেয়েটির গায়ের। চাপা চিবুক। খাঁজকাটা চিবুকের তিলটি যেন লবঙ্গের ফুল। দুটি উজ্জ্বল কালো চোখে যেন সাক্ষাৎ বাগদেবীর অধর।

  শালগ্রাম শিলায় ব্রাহ্মণের তর্পণের জল পতনের মত তার গলার স্বর।

-ত্রেতাযুগ মাহিষ্মতীর রাজা ছিলেন একজন নিষাদ। তাঁর নাম নীল। তিনি ছিলেন অগ্নির উপাসক। অগ্নি তাঁর কুলদেবতা হয়ে রক্ষা করত সমগ্র নর্মদা উপত্যকা। রাজকন্যা অঞ্জনলীনা ছিলেন অসামান্যা সুন্দরী। রাজা রাজকার্যে ব্যস্ত থাকতেন। আর অদূরে অবন্তী, উজ্জয়িনীর বিশাল সাম্রাজ্য। ইন্দ্রপ্রস্থের পরাক্রমশালী রাজা যে কোনও সময় অশ্বমেধ যজ্ঞ শুরু করতে পারেন। যদিও বিন্ধ্য, আরাবল্লী, সাতপুরা পর্বতের কেন্দ্রস্থলে  অবস্থিত মাহিষ্মতী তিনদিক পূর্ব, উত্তর পূর্ব ও উত্তর তিনদিক থেকেই সুরক্ষিত, তবুও রাজা নীল সর্বদা তটস্থ বহিঃশত্রুর আক্রমণের ভয়ে। ক্ষুদ্র রাজ্য, ততোধিক ক্ষুদ্র তার ঐশ্বর্য, সৈন্যবল। কার্তবীর্যার্জুন, মুচকুন্দের সময়ের সেই গরিমা আজ আর নেই। পিতামহ ভীষ্মের দেওয়া কৌরব রথী সম্মান বা পদটুকুই এই রাজ্যের প্রধান পরিচয়। 

   অগ্নির উপাসনা, অর্চনা, রক্ষণাবেক্ষণ, যথাবিধি পূজন নির্বাহ করতেন রাজকুমারী অঞ্জনলীনা। বড় আশ্চর্য সে পূজা। শত বিপ্রের মন্ত্রোচ্চারণ, আবাহনে অগ্নি জাগ্রত হতেন না, যতক্ষণ না পর্যন্ত অঞ্জনলীনা তাঁর ঠোঁট দিয়ে আলতো স্পর্শ করতেন যজ্ঞের অরণিতে।

  তখন গ্রীষ্মকাল। দাক্ষিণাত্য মালভূমির এ অঞ্চল লাভাগঠিত। দ্বিপ্রহরের প্রখর সূর্য প্রাসাদশীর্ষের স্বর্ণ ত্রিশূলে পড়ে ঝিকিয়ে উঠছে অগ্নিগর্ভ বিদ্যুতের মত।নিঃঝুম দুপুরে শুধু শোনা যায় নগরীর পূর্বপ্রান্ত দিয়ে প্রবাহিত রেবার জলের শব্দ আর ভাসমান নিঃসঙ্গ পাহাড়ি ঈগলের ডাক। এমন সময় অঞ্জনলীনা শুনতে পেলেন উপাসনা স্থল থেকে ভেসে আসছে এক সুমধুর অথচ গম্ভীর মন্ত্রোচ্চারণ। শিহরিত হলেন তিনি। রাজপুরোহিত বা অন্য কোনও ব্রাহ্মণের উচ্চারণ নয় এ।

     ধীরে ধীরে উপাসনাগৃহে প্রবেশ করলেন তিনি। যজ্ঞভূমে জ্বলছে নিষ্কম্প এক শিখা। তাতে আন্দোলন নেই। নেই কালো ধোঁয়া। শুধু এক অমর্ত্য সুরভি ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে।

  আগুনের সামনে বসে আছে এক তপ্তকাঞ্চনবর্ণ যুবক। পিঙ্গল কেশরাশি বিরাট কাঁধের ওপর এসে পড়েছে। স্বর্ণোপবীত পরিধান করে তিনি জপ করছেন অগ্নিমন্ত্র। 


"ওঁ মহাজ্বালায় বিদ্যহে অহমগ্নি মধ্যায় ধীমহি।
অহম্ অগ্নিহ্ প্রচোদয়াৎ।।"

   এ কি! এ কি মন্ত্র বলছে ও? "আমি স্বয়ং মহাতপা অগ্নি, নিজ বন্দনা করি। স্ব আলোক আলোকিত হয়ে আমি নিজ মানসলোক নির্মল করে তুলি। "

অঞ্জনলীনা চিৎকার করে উঠলেন, 

-কে তুমি? এ সব কি বলছ? মহা সর্বনাশ হয়ে যাবে।

    স্মিতহাস্যে ব্রাহ্মণ উঠে দাঁড়ালেন। রক্তাম্বর। কপালে অর্ধসূর্য। অঞ্জনলীনার সামনে এসে দাঁড়ালেন উজ্জ্বল পুরুষ। দুচোখে চোখ রেখে বললেন,

-পঞ্চতত্ত্ব সকলের মধ্যেই বিদ্যমান হে কুমারী। বহুদেব বন্দনার মাধ্যমে পরোক্ষে মানুষ নিজেরই ইষ্টলাভের আয়োজন করে। এতে অন্যায় দেখিনা।অগ্নিবন্দনার মাধ্যমে পূজারি আলোকিত অন্তর্লোকের বন্দনা করে। তুমি ভয় পেয়োনা।

    রক্তিম চোখ। উগ্র ক্ষাত্রতেজ সর্বাঙ্গে। ব্রাহ্মণ বলে মানতে মন চায়না অঞ্জনলীনার। তবুও মন্ত্রাদির এমন মনোজ্ঞ এবং যুক্তিনির্ভর ব্যাখ্যা ব্রাহ্মণ ছাড়া কার পক্ষে সম্ভব?

     বিপ্রকে প্রণাম করে অঞ্জনলীনা হোমাগ্নির সামনে উপবিষ্ট হলেন। পুনরায় মন্ত্রোচ্চারণে ব্রতী হলেন বিপ্র। আবিষ্ট মনে রাজকন্যা বসে রইলেন তদগতচিত্তে। একবারও মনে এলো না কে এই অপরিচিত? কি করে গভীর পরিখা, স্কন্ধাবার,সতর্ক প্রহরা ভেদ করে অর্ধযোজন গভীর এই গর্ভগৃহে সে পৌঁছলো? পূজা সমাপন হলে রাজকন্যা বিপ্রকে প্রণাম করে বললেন,

-কি নাম তোমার যুবা ব্রাহ্মণ?

-আমি জাতবেদ।

-কি দক্ষিণা দেব তোমায়?

-রোজ যা দাও কুমারী, তাই দেবে।

  বিস্মিত রাজকন্যা বললেন,

-রোজ? আমাদের তো আগে দেখা হয়নি।

      অট্টহাস্যে ফেটে পড়লেন জাতবেদ।

-হয় কুমারী, নিয়ত, প্রত্যহ, অহোরাত্র ...প্রতি হোমের কালে হয়। তোমার ঠোঁটের স্পর্শে প্রতিদিন আমি জেগে উঠি যে, ভুলে গেলে?

     অঞ্জনলীনা শিহরিত হলেন। মৃণালকন্টকের মতো শিহরণ জেগে উঠলো তাঁর সারা দেহে,

-তুমি অগ্নি? চতুর্বেদের জন্মদাতা, ধর্মসমূহের সত্যতা? 

     
জাতবেদ মৃদু হাসলেন। তৎক্ষণাৎ অঞ্জনলীনা তাঁর সামনে হাঁটু মুড়ে বসলেন। অস্ফুট স্বরে বললেন,

-তোমাকে কি দক্ষিণা দিই ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ?

     জাতবেদ কুমারীকে তুলে ধরলেন। দু হাতে সুন্দর মুখটি ধরে সামনে নিয়ে এলেন। ঘন ঘন শ্বাস পড়তে লাগলো অঞ্জনলীনার। নরম ঠোঁটদুটিতে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলেন তিনি। দেব -মানবের প্রেমের আরেকটি অধ্যায় রচিত হলো। "

   মেয়েটি থামলো। 

নিত্যানন্দের আয়ত চোখের দৃষ্টি পড়লো তার ওপর।

-তোমার গল্প আমি শুনলাম মেয়ে। তবে এ কথা তো প্রতীকী। এতে বোঝানো হয়েছে, অগ্নি একাধারে সর্বঘ্ন আবার সর্বংসহা। দহনেও তিনি শ্রেষ্ঠ। শ্রেষ্ঠ মননেও।

-এই কথাই আপনাকে আমি বলছি, পরিব্রাজক। আপনি আকারে ক্ষত্রিয়, পানাহারে শাক্ত, বেশভূষায় বৈষ্ণব আবার কামসংযমে বৌদ্ধ। একই অঙ্গে এত বৈষম্য যে ভালো নয়। একটি শ্রেষ্ঠত্ব অন্যটিকে ম্লান করে দেয়। যেমন একই ময়ানে থাকতে পারেনা দুটি তরবারি।শতদেশ পরিব্রাজনে আপনি ক্লান্ত। এই রাত্রিবাসে কিছুদিন অবস্থান করে সঠিক, পানীয়, আহার্য আর কামক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পূর্ণ হউন। কারণ মানবজাতি যখন বনবাসী বা গুহাবাসী ছিল, তখনও এই তিনটিই ছিল তার প্রথম ও প্রধান প্রয়োজন। এই ত্রিরত্ন ভিন্ন
ভ্রমণের প্রকৃত অর্থ লাভ হয়না। 

     নিত্যানন্দ মৃদু হেসে মেয়েটিকে বললেন,

-আপনি বিদুষী অথবা দেবী। সাধারণ রতিসঙ্গীনি নন। বোধ করি আমার পরীক্ষা নিতেই এসেছেন। তথাস্তু, এর উত্তর আমি দেবো। শুনুন, ...

পুরাকালে ইন্দ্রদেব ঋষি গৌতমের স্ত্রী অহল্যাকে প্রেম নিবেদন করেছিলেন জানি। সোমদেবের স্ত্রী রোহিণীর প্রেমে জর্জর হয়েছিলেন স্বয়ং দেবর্ষি অগস্ত্য। মরুৎকন্যা মমতা ছিলেন ঔতাথ্যের স্ত্রী। তাঁর গর্ভে দেবগুরু বৃহস্পতির ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন ভরদ্বাজ। 

বৃহস্পতির স্ত্রী যখন দেবতাদের উদ্দেশ্যে নৈবেদ্য অর্পণ করছিলেন চন্দ্রদেব তাঁকে প্রেম নিবেদন করেন এবং তার ফলে বুধ জন্মগ্রহণ করেন। পরাশর -কালী (অগ্নি বা মতান্তরে বরুণের দৌহিত্রী), বশিষ্ঠ -অক্ষমালা, যযাতি -অপ্সরা বিশ্বাচী ...সবই জানি, কিন্তু যে মানবেশ্বরের সঙ্গী হওয়ার কথা ঋষি বলে গেছেন আমাকে, তিনি হবেন সকল কাম -ক্রোধের উর্ধ্বে। আর আমার তাঁর যুগল ক্রিয়া ছাড়া আমরা কেউই সম্পূর্ণ নই।

    অপরিচিতা বিস্মিত হলো। 

-এমন পুরুষ জগতে বিদ্যমান?

-বিদ্যমান নন। তবে পারিপার্শ্বিকতা ও সৎসঙ্গে তাঁর মধ্যে গ্রথিত মহাসাধনার স্ফূরণ ঘটবে এবং সূচনা হবে নব্য ক্রান্তির।

     নারী ঠোঁট কামড়ে কিছু ভাবলো। তারপর উত্তেজিত স্বরে বললো,

-তিনি নিশ্চয়ই গৌড় বাংলায় প্রকট হয়েছেন। আমি নিশ্চিত।

    নিত্যানন্দ পানাহার ফেলে উঠে দাঁড়ালেন।দ্রুতপদে এগিয়ে এসে নর্মদার দু কাঁধ চেপে ধরলেন। গলার শিরা ফুলে উঠলো। গাঢ় তীব্র কন্ঠে তিনি হিসহিস করে উঠলেন,

-বলো, তুমি কি শুনেছ তাঁর সম্বন্ধে? এখনই, এই মুহুর্তে বলো।

    নর্মদা নিত্যানন্দের হাত দুটি ছাড়িয়ে নিলেন জোর করে। তারপর তীব্র কন্ঠে বললেন,

-রাধা হারানোর মত উচাটন দেখি পথিক। বলছি, খামচাও কেন?

    নিত্যানন্দ লজ্জিত হলেন। নর্মদার সামনে থেকে সরে গিয়ে বিছানার ওপর বসলেন।তারপর হাতজোড় করে বললেন,

-আমাকে ক্ষমা করো নারী। মন বড় উচাটন হয়েছিল। আর এমন হবেনা। বলো।, তুমি কি জানো।

    ক্ষুদ্র বাতায়ন। মৃদু মৃদু বাতাস ভেসে আসছে নর্মদার জলে কম্পন জাগিয়ে। শেষরাত্রির তারারা এক এক করে মিলিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমে। পূর্বাকাশে ডিমের কুসুমের মত লালচে হলুদ ছোপ লাগতে শুরু করেছে। নর্মদার কথে যেন সেই তারার দেশ থেকে নর্মদার জল ছুঁয়েই ভেসে এলো। 

    

     -বছর খানেক আগে এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ এসেছিলেন রাত্রিবাসে এই আপনার মতই। তিনদিন চার রাত্রি ছিলেন এখানে। খাদ্য জল কিচ্ছু গ্রহণ করেননি। শুধু অস্থিরভাবে পায়চারি করতেন আর বিড়বিড় করে কি যেন বলতেন। গহপতানি একদিন এর কারণ জিজ্ঞাসা করায় তিনি অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হন এবং উন্মাদের মত চিৎকার করতে করতে আবাসন ত্যাগ করে চলে যান।

      নিত্যানন্দ বললেন,

-এই ঘটনার সঙ্গে আমার লক্ষ্যের সাযুজ্য বুঝতে পারলাম না। 

     -সেই ব্রাহ্মণ কি বলতে বলতে গিয়েছিলেন জানেন?

-বলুন ...

-"এ হতে পারে না, ওই সপ্তদশবর্ষীয় বালকের কাছে কৃষ্ণভক্তির তর্কে আমি হার মানতে পারিনা। এই কৃষ্ণপ্রেমই তার কাল হবে, যে পরম প্রেমধনের গর্বে সে গরীয়ান, তাই তার পতনের কারণ হয়ে দাঁড়াবে..."

    নিত্যানন্দ আবার উত্তেজিত হয়ে উঠলেন,

-সে ব্রাহ্মণ কোন দেশের কথা বলেছিলেন? কোথায় আছে সেই নওলকিশোর?

-তা তো জানা নাই, তবে গৌড়বঙ্গের নাম উল্লেখ করেছিলেন, বলেছিলেন জাহ্নবীর কথা।

-জাহ্নবী! সে তো জহ্নুমুনির নাম থেকে ভাগীরথীর ওই নাম। তবে কি নবদ্বীপ?ন্যায়রত্ন রঘুনাথ  শিরোমণির স্পর্শধন্য নবদ্বীপ? আমি যাব, আমাকে যে যেতেই হবে। তোমাকে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই নর্মদা ..

   নিত্যানন্দ দেখলেন নর্মদা নেই। শূন্য কক্ষ। কুলুঙ্গীর প্রদীপটি নেই। সেটি অলিন্দের শেষ প্রান্তে পৌঁছে থমকে দাঁড়ালো। দপ করে জ্বলে উঠলো। তার দূরাগত আলোকে মুহুর্তক্ষণের জন্য একটি নারীমূর্তি অবয়ব দেখা গেল।তারপর আলোর শিখাটি হঠাৎই নিভে গেল আর নারীমূর্তিটিও আর দেখা গেল না।

    সূর্য উঠলো জবাকুুমের রঙ মেখে।

নিত্যানন্দ আর অপেক্ষা করলেন না। রাত্রিজাগরণের ক্লান্তি, অনাহাদের দৌর্বল্য, -সব ছাপিয়ে গেছে পরমদয়িতের সাথে অাগামী মিলনের আনন্দ।

  উপলবন্ধুর পথ বেয়ে তিনি এগিয়ে চললেন পূর্বে। ওইদিকেই সূর্য ওঠে রোজ। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

  1. মুগ্ধ হলাম ভাই। কি অসাধারণ লেখা তবে হ্যাঁ একবারে হয়নি, বারদুয়েক চোখ বোলাতে হয়েছে, মনকে বশে রেখে তবেই এ মর্মার্থ ধরা দিয়েছে। এগিয়ে চলো। দুরের ঔজ্জ্বল্য তোমার অপেক্ষায় সাজাচ্ছে সভা।

    উত্তরমুছুন
  2. এমন লেখা পড়বার আশায়ই তো দিন গুনি।

    উত্তরমুছুন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন