সুজন ভট্টাচার্য - মায়াজম

Breaking

১৪ জুন, ২০১৯

সুজন ভট্টাচার্য



আজকের পুরাণচর্চাঃ মৌলিক প্রশ্ন




দানিংকালে পুরাণ নিয়ে আলোচনার একটা প্রবল আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন পত্রিকায় পুরাণের কাহিনী নিয়ে এক বা একাধিক লেখার সন্ধান পাওয়া যায়। অনেকেই সেই বিষয়ে একটা পরিচিতিও তৈরি করে ফেলেছেন। অনেক আগ্রহী পাঠকও তৈরি হয়েছে। এমনকি ফেসবুকেও কেউ কেউ এই বিষয়ে ধারাবাহিকভাবেই চর্চা করে যাচ্ছেন। তাদের লেখাগুলোও বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে, পাঠকরা আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন। এবং প্রায় সকলের মধ্যেই ‘লুপ্ত, বিস্মৃত অতীতের গৌরবগাথা’ স্মরণ করে পুনর্গর্বিত হবার আনন্দও টের পাওয়া যাচ্ছে। তার মানে এই পুরাণচর্চা নিছক সময়ক্ষেপ নয়, বা সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো সৃজনশীলতার তাৎক্ষণিক বহিঃপ্রকাশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এখানে অতীতের ইতিবৃত্ত অনুসন্ধানের মাধ্যমে আত্মসন্ধানের একটা প্রক্রিয়া রয়েছে। অবশ্যই সকলেই যে এই বিষয়ে খুব সচেতন, এমনটা নিশ্চয়ই নয়।


গণ-পুরাণচর্চার যে ঐতিহ্য আমাদের দেশে রয়েছে, সেটা হলো কথকতার। কথকের পাঠ এবং নিজস্ব ব্যাখ্যার মাধ্যমেই সাধারণ মানুষের কাছে পৌরাণিক উপাখ্যান পৌঁছে যেত। নিজের মত করে সরাসরি পুরাণপাঠের প্রয়াস সমাজের উচ্চ অংশের খুব সামান্য একটা অংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। শহরাঞ্চলে এখন কথকতার আসর প্রায় উঠেই গেছে, আর বসলেও নেহাতই বৃদ্ধবৃদ্ধারাই তার শ্রোতা। সেই ফাঁকটা ভরাট করেছে সরাসরি পাঠের প্রবণতা। এবং শুধু পাঠ নয়, আরো অনেককে সরলভাষায় সেই উপাখ্যান জানানোর একটা তাগিদও বাড়ছে। প্রশ্ন হলো, কেন।
আসলে পরিপ্রেক্ষিতই একটা ভাবনাকে উশকে দেয়। একদা এই বাংলাতেই আর্যত্বের প্রচুর চর্চা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতেই পারে, সেটা ছিল পরাধীনতাদীর্ণ একটা জাতির আত্মগৌরবের অনুসন্ধান মাত্র। সেই বনেদি ভিতের উপরই গড়ে তুলতে চাওয়া হয়েছিল বর্তমান ও আগামীর জাতীয় আবহ। ঠিক আছে। কিন্তু একইসঙ্গে বাংলার জাতীয়তাবাদের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, শুরু থেকেই তার মধ্যে একটা হিন্দুত্বের ঝোঁক ছিল। এখন কেউ যদি দাবী করেন, হিন্দুত্বের উৎস লুকিয়ে ছিল সেই আর্যত্বের চর্চার মধ্যেই, তাহলে কিন্তু আলোচনাটা আর সরল থাকবে না। পুরাণচর্চার প্রেক্ষিত নিয়েও সেই একই প্রশ্ন তাই থেকেই যাচ্ছে।

কেউ পালটা বলতেই পারেন, এমন প্রশ্নেরই বা কারণ কি। সাহিত্য বা ইতিহাসচর্চার আবার কারণ লাগে নাকি? ইচ্ছে হয়েছে, সেটাই কি যথেষ্ট নয়? অবশ্যই যথেষ্ট, যদি সেটা একজন বিচ্ছিন্ন মানুষকে নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু বর্তমানের আলোচ্য পুরাণচর্চা যে এমন এক বা হাতগুনতি কয়েকজনের ব্যক্তিগত প্রয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, সেটাও অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। হঠাৎ এমন একটা জোয়ার তো কেউ একা একা আনতে পারেন না; নিঃসন্দেহে নানান বৃত্তের অনেক মানুষের উদ্যোগের ফলই হচ্ছে এটা। যে প্রয়াসের একটা সামাজিক উদ্যোগ আছে, তার পিছনে সামাজিক রসায়নও নিশ্চিতভাবেই থাকবে।
কিন্তু সেই যৌক্তিক উত্তর মানতে কতজন প্রস্তুত? আরেকটু এগোনো যাক। রামায়ণকে বলা হয় আদিকাব্য। তার মানে ঋকবেদ ও রামায়ণের মাঝখানে অন্য কোনও ধর্মীয় গ্রন্থ কিংবা মহাকাব্যের অস্তিত্ব থাকার কথা নয়। রামায়ণের বালকাণ্ড কিংবা বর্তমানের সর্বগ্রাসী বিশ্বাস অনুযায়ী রাম বিষ্ণূর অবতার। অথচ ঋকবেদে বিষ্ণূ নামক যে দেবতার উল্লেখ পাওয়া গেল, তিনি যে সূর্যদেবতারই একটি নাম, সেটাও বোঝা যায়। ঋকবেদের প্রধান দেবতাদের মধ্যে তিনি আসেন না। তাহলে বিষ্ণূ প্রধানতম দেবতা হয়ে উঠলেন কবে? নিঃসন্দেহে সেটা পৌরাণিক যুগের অবদান, যা বুদ্ধদেব ও মহাবীর জিনের সময়াময়িক। তাহলে হয় রামায়ণ এই সময়েরই সৃষ্টি, আর নয়তো বিষ্ণুর অবতার রাম এই ধারণা এই সময়েই রামায়ণে প্রক্ষিপ্ত হয়েছিল। আমরা আগেই বলেছি মূল পাঁচটি কাণ্ডের কোথাও রামকে অবতার বলে গণ্য করা হয়নি। তাহলে দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটাই সত্য।

আমরা এমন একটা সময়ে দাঁড়িয়ে আছি, যখন রামায়ণের কেন্দ্রীয় চরিত্র রামকে স্রেফ মহাকাব্যের চরিত্র না ভেবে ‘মর্যাদাপুরুষোত্তম’ বলে গণ্য করা হয়। মহাকাব্য থেকে ইতিহাসে উল্লম্ফনের এই যাত্রাপথ কিন্তু খুব সরল নয়। ধরুন রামায়ণের কথাই। সপ্তকাণ্ড রামায়ণের দ্বিতীয় কাণ্ড অর্থাৎ অযোধ্যাকাণ্ড থেকে ষষ্ঠ অর্থাৎ যুদ্ধকাণ্ড পর্যন্ত ঘটনাবলীর ক্রমবিকাশ একদম ছবির মতো। কোথাও রাম যে বিষ্ণুর অবতার তার প্রসঙ্গমাত্র নেই। উলটে যুদ্ধকাণ্ডের প্রায় শেষ পর্যায়ে রামকে দেখা গেল আত্মপরিচিতি দিতে, ‘আত্মানাম মনুষম মানয়ে, রাম দশরথাত্মজম’। অথচ প্রথম যে কাণ্ড মানে বালকাণ্ড, সেখানেই বলা হয়েছে রাবণ বধের জন্য বিষ্ণুই রাম হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন। তাহলে ব্যাখ্যা কি? একটাই যৌক্তিক উত্তর পড়ে থাকে, বালকাণ্ড পরবর্তীকালে রামায়ণে প্রক্ষিপ্ত হয়েছে।
রামায়ণ যত প্রাচীনই হোক না কেন, তার সবথেকে পুরনো লিখিত রূপ কবেকার? নেপালে প্রাপ্ত একাদশ শতাব্দীর একটি তালপাতার পুঁথিকেই এক্ষেত্রে প্রাচীনতম নিদর্শন বলে গণ্য করা হতো। যদিও সম্প্রতি কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিতে অগ্নিপুরাণের একটী পুঁথির মধ্যে সংযুক্ত আকারে পাওয়া গিয়েছে ষষ্ঠ শতাব্দীর রামায়ণভাষ্য – ‘দশগ্রীবা রাক্ষসচরিত্রম বধ’ মজার বিষয়, এই উপাখ্যানেও কিন্তু বালকাণ্ড এবং উত্তরকাণ্ড নেই। যাই হোক, যদি এটাকেও প্রাচীনতম নিদর্শন বলে মানি, তাহলেও মূল রচনাকালের নিরিখে খুব প্রাচীন নয়।
অথচ বৌদ্ধ জাতকের মধ্যেই দশরথজাতক নামে একটি ক্ষুদ্র কাহিনী রয়েছে, যা ৪৬১ নম্বর জাতক হিসাবে গণ্য। এটিও রামায়ণের কাহিনীরই অনুরূপ। তবে এখানে রাজা দশরথের (অযোধ্যার নয়, বেনারসের) জেষ্ঠ্য পুত্রর নাম রাম-পণ্ডিত। লক্ষণ তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই নয়, সহোদর। বিমাতার ষড়যন্ত্র থেকে তাঁদের রক্ষা করার জন্য রাজা দশরথই তাঁদের অজ্ঞাতবাসে পাঠিয়ে দেন। সীতাহরণ বা রাবণবধের কোনও কাহিনী এখানে নেই। যাই হোক, জাতক আদি বৌদ্ধগ্রন্থ সূত্তপিটকের অন্তর্গত ক্ষুদ্দক নিকয়ার অংশ। বুদ্ধের দেহাবসানের একশো বছরের মধ্যেই অর্থাৎ খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকেই আদি-পালিভাষাতে লিপিবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেই হিসাবে কলকাতার পুঁথির থেকেও তার প্রাচীনতা বেশি। এবং উৎস হিসাবে তার প্রামাণ্যতাও বেশি।



এই বিস্তারিত আলোচনায় একটা বিষয়ই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একদম শুরুতেই রামের উপর অবতারত্ব আরোপের যে পরবর্তী প্রয়াসের ধারণা দেওয়া হয়েছিল, বৌদ্ধ উৎসের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে সেটাই প্রমাণ হয়ে যায়। তার মানে মহাকাব্যের আদি কাঠামোর উপর নানান খড়মাটি পরবর্তীকালে চেপেছে, যুগের প্রয়োজনে।
প্রশ্ন হলো, কী সেই প্রয়োজন। একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, সনাতন বা বৈদিক ধর্ম নিঃসন্দেহে বৌদ্ধ বা জৈন ধর্মের তুলনায় প্রাচীন। কারণ বৈদিক ধর্ম ও প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেই বৌদ্ধ, জৈন ও আজীবক (বার্হস্পত্য বা চার্বাক) ধর্মের উৎপত্তি। কিন্তু অন্তত খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকেও বৈদিক ধর্মের পরম্পরায় এমন একজনও ঐতিহাসিক চরিত্রের নিদর্শণ নেই, যাকে আদর্শ রূপে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা যায়। বিপরীতে অন্তত বুদ্ধ বা মহাবীর আছেন। এই প্রয়োজন থেকেই সম্ভবত খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকেই ধীরে ধীরে রাম এবং কৃষ্ণের উপর অবতারত্বের আরোপ শুরু হলো, যাতে সামাজিক জীবনে বুদ্ধ এবং মহাবীরের বিপরীতে তাঁদের স্থাপন করা যায়।
আজকের হিন্দুধর্মের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যদি বৈদিক ধর্মকে বিচার করতে যাই তাহলে দুটোর মধ্যে মৌলিক মিলের বদলে পার্থক্যই খুঁজে পাব। বৈদিক ধর্মে বিগ্রহ পুজোর ব্যবস্থা নেই; অথচ আজকের হিন্দুধর্ম মূলগতভাবে পৌত্তলিক। সেই পৌত্তলিক আচরণের মন্ত্রাদি অবশ্য বেদ থেকেও সংগৃহীত। এই রূপান্তরের মিসিং লিঙ্ক হলো বিবিধ পুরাণ, যার মাধ্যমেই প্রধান দেবতা হিসাবে বিষ্ণুর উদ্ভব। রাম এবং কৃষ্ণ তাই হয়ে গেলেন তাঁরই অবতার। এই রূপান্তরের প্রক্রিয়া এবং তার পিছনের চাহিদাকে না বুঝতে পারলে, পুরাণ সংক্রান্ত যে কোনও আলোচনাই তাই খণ্ড। আর যা খণ্ড সত্য, তা হয় অসত্য অথবা অর্ধস্ত্য। আজকের পুরাণ চর্চার ক্ষেত্রে প্রায়শই এই বিষয়টিকে মাথায় রাখা হচ্ছে না। কী রকম?


ধরা যাক শকুন্তলা ও দুষ্মন্তের কাহিনী। আপনি দুভাবে এগোতে পারেন। হয় মহাভারতের আখ্যা অবলম্বন করে নিজের ভাষায় সেই কাহিনী লিখে ফেলতে পারেন, কোনও নিজস্ব ব্যাখ্যা ছাড়াই। অথবা, শকুন্তলার উপর দুর্বাসা মুনির দেওয়া অভিশাপের সূত্রে দুষ্মন্তের স্মৃতিলোপকে স্রেফ বাজে কথা বলে উড়িয়ে দিতে পারেন। কারণ অমনটা পার্থিব জগতে ঘটা সম্ভব নয়। আপনি বলতে পারেন, দুষ্মন্ত ইচ্ছে করেই শকুন্তলাকে চিনতে চাননি। পরে আশ্রমের যে প্রতিনিধিরা এসেছিলেন, তাদের কিংবা জনসাধারণের চাপে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এখানে আপনি চিরাচরিত কাহিনী থেকে সরে আসবেন যুক্তির নিয়ম মেনে। এবং সেই সরনের অনুসারী একটা সিদ্ধান্তও হয়তো উঠে আসবে। আপাতত সেই কথা থাক।
রামায়ণের মতো সুপরিচিত কাহিনীরই ভিন্ন রূপ আমরা এইমাত্র দেখলাম। সেই ভিন্নতার সূত্রে কয়েকটা সঙ্গত প্রশ্নেরও আলোচনা করলাম। তাহলে আপনি যে কাহিনীর অবতারণা কপরলেন, সেটির ভিন্নতর কোনও তূপ আছে কিনা সন্ধান করেছেন? পৌরাণিক সংস্কৃতি উত্তরবৈদিক সংস্কৃতির পরিবর্তিত রূপ, মূলত সুঙ্গ যুগ থেকে যার শুরু হয়েছিল। তার আগের মৌর্য যুগে জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের যে প্রবাহ ছিল, এই সময় থেকেই তা ধীরে ধীরে মুছে যেতে শুরু করল। গুপ্তযুগে এসে সনাতন ধর্ম জাঁকিয়ে বসল। পুরাণ সেই পরিবর্তনের আধার। আপনিও কি নিজেকে সেই সংস্কৃতিরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে বিবেচনা করেন?

পুরাণকে খাঁটি ইতিহাস বলে মানা হবে কিনা, সেই বিতর্ক অনেকদিনের। একদল যাই মনে করুন না কেন, মুখে বলেন, একদা সত্যি সত্যিই দেবতারা দলবল পাকিয়ে ঘুরে বেরাতেন। আরেকদল বলেন, বিষয়টা অমন সরল নয়। ইতিবৃত্তকে মহনীয় ও জনগণের সামনে ঐশ্বরিক বিধান হিসাবে তুলে ধরার প্রয়োজনেই গল্পের উপর এমন দেবত্ব আরোপের চেষ্টা করা হয়েছিল। আপনি কোন পক্ষে? যেমনটা আপনি ভাবেন, আপনার আখ্যানও সেইদিকেই গড়িয়ে যেতে বাধ্য। আর যদি বলেন, আমি তো স্রেফ পৌরাণিক কাহিনীর একটা সরল বর্ণনা দিচ্ছি মাত্র, তাহলে একটা প্রশ্ন উঠে আসতে বাধ্য।
ভারতবর্ষে শুধু আর্যরা ছিল না। ছিল অনার্য দ্রাবিড়রাও। আজ ভারতীয় উপমহাদেশের জনসত্বার মধ্যে দুটো প্রধান বংশগতিকে চিহ্নিত করা হয় – Ancestral North Indian এবং Ancestral South Indian। এছাড়াও রয়েছে Austro-Asiatic এবং Tibeto-Burman। আর সামান্য মাত্রায় রয়েছে Negrito। বাহ্য লক্ষণের ভিত্তিতে একজন তামিল আর বিহারীর মধ্যে যে পার্থক্য আপনি করতে পারেন, কিংবা একজন সাঁওতালের সঙ্গে একজন লেপচার, এগুলো তারই পারিভাষিক নাম। আপনার পুরাণের কথায় এরা কোথায়? ভারতবর্ষের ইতিহাস কি কেবল দীর্ঘাঙ্গ, গৌরবর্ণ আর্যদের কাহিনী? আর বাকিরা শুধুই বানর কিংবা রাক্ষস? পদানত অথবা পরাজিত হওয়াটাই যাদের একমাত্র পরিণতি?

পুরাণ নিয়ে আলোচনা করতে হলে আজকের জ্ঞানভাণ্ডারের সাপেক্ষেই তাকে বিচার করতে হবে। দেখুন কি মজার কাণ্ড। রাবণকে দশানন বলে, আমরা সবাই জানি। কেউই নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেন না যে সত্যি সত্যিই তার দশটা মাথা ছিল। জানেন কি, জৈন রামায়ণে একটা দারুণ গল্প আছে? রাবণের মা জন্মের পরে তার গলায় নয়টি মুক্তো দিয়ে গাথা একটা হার পরিয়ে দিয়েছিলেন। প্রতিটি মুক্তোয় তার মুখের প্রতিবিম্ব ফুটে উঠত, তাই তিনি দশানন। এই ছোটো ছোটো সিঁড়িভাঙ্গা না করলে সেটা কি আর আজকের উপযুক্ত হবে? অথচ দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রায়শই পুরাণচর্চার মানে হয়ে দাঁড়াচ্ছে বর্তমানকে সেই প্রাচীন কল্পমালার আলোকে বিচার করার অপচেষ্টা। সেই সাংস্কৃতিক লাঞ্ছন বহন করে উদার ও বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তার যে আপনিও একজন প্রাণহারী হয়ে দাঁড়াচ্ছেন, একবারও ভেবেছেন কি?

যে পরিমাণে ভারতে জাতবিদ্বেষ বাড়ছে, বাড়ছে ধর্মীয় উত্তাপ, সেই সময়ে এই বিষয়টা মাথায় রাখা খুব প্রয়োজন। আমরা কে কোথায় যে অজান্তেই ফাঁদে পড়ে যাচ্ছি, এবং হাততালির লোভে আরো অনেককে টেনে আনছি ফাঁদের মধ্যে, হয়তো নিজেরাই জানি না। একটা কথা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসের বিচার হয় সমকালীন দৃষ্টিভঙ্গীতে। উল্টোটা কখনই হয় না। তার মানে আপনি বাবরকে যখন বিচার করবেন, করবেন আপনার সময়ের জ্ঞান-চর্চা আর তথ্যভাণ্ডারের সাপেক্ষে। আওরঙ্গজেবকে বিচার করার সময় নিশ্চয়ই অষ্টম শতাব্দীর আরবের ভাবনার নিরিখে বিচার করবেন না। পুরাণের ক্ষেত্রেও সেই একই কথা সত্যি।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র