মীরাবাঈ
শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে দুই নারী অঙ্গাঙ্গি জড়িয়ে । একজন রাধা। অন্যজন রাজস্থানের মীরাবাঈ (১৪৯৮/১৫৪৭)। রাধা অবশ্যি কবি জয়দেব ( ১১৭০- ১২৪৫) এর কল্পনাপ্রসূত কাল্পনিক সত্ত্বা । কিন্তু মীরাবাঈ ঐতিহাসিক নারী। তাঁর জন্ম ভারতবর্ষের রাজস্থানের এক প্রভাবশালী গোত্রে। মীরাবাঈয়ের অন্যতম পরিচয় একজন মরমী কবি হিসেবে; কিংবা একজন কৃষ্ণভক্ত হিসেবে ।
ইতিহাস বিমুখ আমাদের এই ভারতবর্ষে এমনকি মাত্র ৫০০ বছর আগে জন্মান মীরাবাঈয়ের জীবন নিয়েও ধোঁয়াশার শেষ নেই। যা হোক মনে করা হয় ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে মীরাবাঈয়ের জন্ম রাজস্থানের মেরতায়, পিতা মেরতার শাসক রতন সিং, রাঠোড় বংশের মেরতা-শাসক রাও দুদার ছোট ছেলে রতন সিং। রাও দুদা আবার রাও যোধার ছেলে – যিনি ছিলেন যোধপুর শহরের প্রতিষ্ঠাতা। সুতরাং মীরার বংশকৌলীন্যের জৌলুস ছিল !
সম্ভবত অতি অল্প বয়সেই মাকে হারান তিনি, মীরা প্রতিপালিত হন দাদা রাও দুদার আশ্রয়ে। বর্ণিত আছে, বাবা রতন সিং মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা যান। রাও দুদা ছিলেন বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী। তিনি মীরাকে ধর্ম, রাজনীতির ব্যাপারে পাঠদান করেন। পাশাপাশি গান এবং শিল্পকলায় ও পারদর্শী হয়ে ওঠেন মীরা। সম্ভবত দাদুর কাছ থেকেই মীরার কৃষ্ণভক্তির প্রথম পাঠ ! অবশ্য ছোটবেলায় এক সাধু এসে মীরাকে এক কৃষ্ণমূর্তি দিয়ে যান, কারণ মীরা ছিলেন কৃষ্ণের চিহ্নিত সেবিকা , এরকমও প্রচলিত আছে, কিন্তু আমি মীরাকে ঐতিহাসিক এবং সামাজিক ভাবেই বর্ণনা করতে চাই!
মীরার মায়ের মৃত্যু খুব ছোটবেলাতে হলেও বাবা রতন সিংহ বেঁচে ছিলেন, কিন্তু তখনকার রাজপুত আর মোগলদের সংঘর্ষময় সময়ে তিনি বেশিরভাগ সময়েই যুদ্ধক্ষেত্রে কাটাতে লাগলে , মীরার দাদু রাও দুদা তার লালন পালন করেন, কিন্তু ১৫১৬ সালে তার মৃত্যু হয় ! তারপরে মীরা মূলত তার কাকা বিক্রমের তত্ত্বাবধানেই থাকেন , বিক্রমের পুত্র ছিলেন জয়মল্ল , যিনি পরবর্তীকালে বিখ্যাত রানা জয়মল্ল হিসেবে খ্যাত হন !
ওদিকে ১৫০৮ সালে শিসোদিয় বংশের বিখ্যাত রানা সংগ্রাম সিংহ যিনি রানা সঙ্গ হিসেবেই বেশি পরিচিত মেবার এবং চিতোরের শাসনভার গ্রহণ করেন ! চিতোরের কেল্লা ছিল মীরার বাড়ি মেরাতের থেকে মাত্র ১৫০ মাইল দূরে ! উত্তর ভারতে বাবর তখন মোগল বংশের পত্তন করছিলেন , রানা সঙ্গ সমগ্র রাজপুতদের একত্রিত করবার চেষ্টা করছিলেন ! তার একটা উপায় বিবাহবন্ধন ! ১৫১৬ সালে তিনি যোধপুর বংশের রাজকুমারী কে বিয়ে করেন , এর ফলে তার রাজ্যের উত্তর পূর্ব অংশ নিরাপদ হলো ! পরে তিনি বিবাহ করেন বুন্দির রানার বোন কর্মাবতি দেবী কে , এই বিবাহ পরে মীরার জীবন বিষময় করে তোলে, কারণ এই রানীর পুত্র ছিল মীরার পরবর্তীকালের দেবর বিক্রমজিৎ ! এই বিবাহের ফলে রানা সঙ্গের রাজত্বের উত্তর পশ্চিম সীমানা নিরাপদ হয় ! এই একই নীতি অনুসারে তিনি তার উত্তরাধিকারী যুবরাজ ভোজরাজের সঙ্গে মীরার বিয়ের প্রস্তাব দেন ! এর উদ্দেশ্য ছিল তার রাজ্যের উত্তর সীমানা নিরাপদ করা !
বিয়ের আগে থেকেই মীরা কৃষ্ণ ভক্ত ছিলেন, কিন্তু এরকম ধারণা করা যায় যে সেটা তার বিয়ের জন্যে কোনো সমস্যার সৃষ্টি করেনি ,আঠারো বছর বয়সে মীরার বিয়ে হয়। স্বামী চিতরের রাজা ভোজরাজ । বংশগৌরবের দিক থেকে দেখতে গেলে এই বিবাহ ছিল বিশাল ব্যাপার !কিন্তু স্বামী ছিলেন কালীভক্ত। কাজেই মতাদর্শগত বিরোধ অনিবার্য হয়ে উঠতে থাকে। শুরুতে তিনি মীরাকে পার্থিব জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি মীরার এই গভীর কৃষ্ণ প্রণয় মেনে নেন এবং ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব এবং পারস্পারিক শ্রদ্ধার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে তাদের সম্পর্ক। কারণ তিনিই মীরাকে উৎসাহিত করেন কবিতা লিখতে এবং তার উপাসনার জন্য মন্দিরও বানিয়ে দিয়েছিলেন। প্রাসাদেও ভক্তিগীতির আসর বসতে শুরু করে ! মীরা এবং ভোজরাজের বৈবাহিক জীবন কেমন ছিল তা হয়তো তার ৫১ এবং ৭৭ নম্বর কবিতা থেকে আন্দাজ করা যেতে পারে, যেখানে তিনি নিজেকে কুমারী হিসেবে বর্ণনা করেছেন !
মীরার খ্যাতির পাশাপাশি তার রচনা করা ভজনগীতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তার খ্যাতি এবং আধ্যাত্মিকতা লোকমুখে প্রচারিত হতে হতে মোঘল সম্রাট আকবরের কানে পৌঁছায়। বিভিন্ন ধর্মীয় পথ নিয়ে আগ্রহী সম্রাট আকবর মীরাবাঈ এর সাথে সাক্ষাতের জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। আকবর এবং মীরার পরিবার একে অপরের প্রতিপক্ষ ছিল , তাই ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে তানসেনকে সাথে নিয়ে হাজির হন মীরার কাছে। আকবর তার প্রাণবন্ত সঙ্গীত এবং ভক্তিমূলক গানে এতটাই আসক্ত হয়েছিলেন যে, ফিরে যাওয়ার সময় মীরার চরণে তার পরিহিত মূল্যবান গলার মালা উৎসর্গ করে যান। একসময় ভোজরাজের কানে আকবর এবং মীরার সাক্ষাতের ঘটনা পৌঁছালে তিনি এতটাই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন যে, মীরাকে ডুবে আত্মাহুতি দেওয়ার নির্দেশ দেন। মীরা স্বামীর আদেশ পালন করতে যখন জলে ঝাঁপ দিতে যাবেন তখনই শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটে এবং তিনি মীরাকে নির্দেশ দেন বৃন্দাবনে পালিয়ে যেতে। মীরা তখন তার কয়েকজন অনুগামী্দের নিয়ে বৃন্দাবনে গিয়ে কৃষ্ণের উপাসনায় মগ্ন হলেন। শীঘ্রই ভোজরাজ ভুল বুঝতে পারেন এবং অনুতপ্ত হয়ে ওঠেন এবং তাকে ফিরিয়ে আনতে বৃন্দাবন যান এবং মীরাকে ফিরে আসতে অনুরোধ করেন। মীরাবাই সম্মত হন !
আকবরের সঙ্গে সাক্ষাৎকার এবং ভোজরাজের বেঁচে থাকা অবস্থাতেই মীরার বৃন্দাবন গমন নিয়ে বিভিন্ন ইতিহাসবিদের মাঝে মতানৈক্য রয়েছে। সম্ভবত পরবর্তীকালে মীরার গুরুত্ব বাড়ানোর জন্যে এইরকম প্রচার হয় !
মোগল দের সাথে যুদ্ধে রাজা ভোজরাজ আহত হন এবং অপুত্রক অবস্থাতেই ভোজরাজ মারা গেলেন ১৫২১ সালে, রানা সঙ্গ বেঁচে থাকতেই । শ্বশুর রানা সঙ্গ মীরাকে আদেশ দেন স্বামীর সঙ্গে সতী হবার জন্যে । কিন্তু মীরা অস্বীকার করেন , তার যুক্তি তিনি কেবল কৃষ্ণকেই তার দয়িত বলে মানেন এবং সে হিসেবে তার বিধবা হওয়া সম্ভব না ( Sati na hosyan girdhar gansyam mhara man moho ghanasami)! যে কোনো কারণেই হোক মীরার শ্বশুরবাড়ি তাঁকে জোর করতে পারে নি !
১৫২৭ সালে রানা সঙ্গের নেতৃত্বে রাজপুতরা মোগলদের সঙ্গে বিরাট পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হলো ! এই যুদ্ধে মারা গেলেন মীরার বাবা রতন সিং ও , আহত হলেন রানা সঙ্গ ! কিন্তু রানা সঙ্গ আবার যুদ্ধের আয়োজন করতে থাকলে মন্ত্রীরা ষড়যন্ত্র করে এই বীরকে ১৫২৮ সালে বিষ প্রয়োগে হত্যা করে !রানা সঙ্গের মৃত্যুর পাঁচ বছর আগে করা ব্যবস্থা হিসেবে সিংহাসনে বসেন রানা সঙ্গের প্রথম পত্নীর পুত্র রত্ন সিং ! হতে পারে মীরার কোনো পুত্র সন্তান থাকলে রানা সঙ্গ তাকেই সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করতেন ! রত্ন সিং রাজা হন বিক্রমাদিত্য নাম নিয়ে, মজার ব্যাপার হলো রানা রত্ন সিং মাতৃকুল এবং মীরার বংশ , দুইই প্রাচীন রাজপুত রাঠোর বংশ থেকে উৎপন্ন , অর্থাৎ ওই দুই বংশই যোধপুরী ঘরানার অন্তর্গত ! কিন্তু আত্মীয়দের মধ্যেই বৈরিতা বেশি হয় ! শাসনভার গ্রহণ করবার পরেই মীরার কাকা বিক্রমদেবের বিরুদ্ধে আক্রমণ করা হয় ! এবং বেশ বোঝা যায় এখান থেকেই মীরার প্রতি বৈরিতার শুরু হয় ! রানী কর্মাবতীর প্রভাবও রাজসভায় বাড়তে থাকে , ১৫৩১ সালে রানা রত্ন সিংয়ের মৃত্যু হলে রানী কর্মাবতীর পুত্র বিক্রমজিৎ সিংহাসনে বসেন, তার বয়স তখন চোদ্দো বছর !
রানা রত্ন সিংয়ের আমলে মীরার কি অবস্থা ছিল তা পরিষ্কার করে জানা যায় না, তবে তখনও তিনি কৃষ্ণ সাধনা নিয়েই ছিলেন এমন ধারণা করা যেতে পারে।
কিন্তু বিক্রমজিতের আমলে মীরার ওপরে রীতিমতো অত্যাচার শুরু হয় ,কালীভক্ত শ্বশুরবাড়ি ধীরে ধীরে মীরার ওপরে খড়গহস্ত হয়ে উঠতে থাকে ! মীরার ওপর নির্যাতন শুরু হয়। এই নিয়েও অনেক অসম্ভব কাহিনী প্রচলিত আছে, তাঁকে বিষ দেওয়া হয়, ফুলের ঝুড়ির মধ্যে বিষাক্ত সাপ পাঠানো হয়, লৌহ শলাকায় ফেলে দেওয়া হয় , কিন্তু না মীরা মরেনি। যা মনে হয় প্রাসাদে তার শুভাকাঙ্খী কেউ কেউ নিশ্চয়ই ছিল অথবা ঐসব ঘটনা ঘটেই নি !তবে বিক্রমজিৎ তাকে প্রাসাদের বাইরে দুজন মাত্র দাসীকে নিয়ে থাকতে বাধ্য করেন, যদিও তা মীরার পক্ষে তেমন খারাপ হয়নি, সাধু সন্ত থেকে সাধারণ ভক্তদের ভিড় বাড়তেই থাকে তাকে ঘিরে !
তখনকার রাজপুতানার বিখ্যাত সাধন রাইদাস , যিনি ছিলেন নিম্নশ্রেনীভুক্ত মীরা তার কবিতায় অনেক সময় তাকে গুরু হিসেবে বর্ণনা করেছেন , এবং এটাকেও অনেকে তার ওপরে রাজবাড়ীর ক্রোধের কারণ হিসেবে মনে করেন, তবে সম্ভবত তিনি মীরার সরাসরি গুরু ছিলেন না ! মনে রাখতে হবে রানা সঙ্গের পিতামহ বিখ্যাত রানা কুম্ভ ছিলেন বৈষ্ণব , এবং রাইদাস বর্তমান ছিলেন মীরার জন্মেরও আগে ! রানা সঙ্গের মা ছিলেন রাইদাসের অনুগামী, এবং তিনি প্রাসাদে সৎসঙ্গ ইত্যাদির আয়োজন করতেন , এটা খুবই সম্ভব মীরা বিয়ে হয়ে আসার পরে তিনিও এই ধারার শরিক হন , সে হিসেবে বলা যায় কৃষ্ণসাধনা মীরার শ্বশুরবাড়িতে অজানা কিছু ছিল না এবং তা দুরাচরণীয়ও ছিল না , তাহলে কৃষ্ণভক্তির জন্যে মীরাকে কেন এত অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল ? মীরার ওপরে শ্বশুরবাড়ির নির্যাতনের কারণ হিসেবে সাধারণত তার কৃষ্ণভক্তি এবং রাজঘরানার সাথে খাপ না খাওয়া আচার আচরণকেই মূল হিসেবে দেখানো হয়, কিন্তু এর পেছনে অন্য রাজনৈতিক কারণ থাকার সম্ভাবনাও খুব বেশি , তার শ্বশুরবাড়ি তার বাপের বাড়িকে আক্রমণ করেছিল, রাজপ্রাসাদের রাজনীতিতেও একাকী বিধবা মীরা নিশ্চয় কোনঠাসা হয়ে গেছিলেন , হতে পারে এই জন্যেই তিনি আরো বেশি করে কৃষ্ণ ভজন আঁকড়ে ধরেছিলেন ! মীরা রাজনীতিতে কতটা জড়িত ছিলেন তা বলা কঠিন, সম্ভবত ছিলেন না , কারণ তার মন অনেক আগেই রাজকীয় ঐশ্বর্যে নিস্পৃহ হয়ে গেছিলো , কিন্তু মীরার ভাবসাব ঠিক তখনকার উচ্চবংশের বিধবাদের মতন ছিল না, বৈধব্যের কোনো কিছুই তিনি পালন করেননি , পুজোপাঠে অংশ নেওয়া, কৃষ্ণের প্রেমে মাতোয়ারা নৃত্য গীতি তার শ্বশুরকুলের সামাজিক সম্মান কে পদে পদে আহত করছিলো !
রানার বৈরিতা ক্রমশঃ বাড়তে থাকলে আর শাশুড়ি আর দেবরের নির্যাতন সইতে না পেরে মীরা প্রাসাদ ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। এই শাশুড়ি তার স্বামীর মা ধনদেবী নাকি রানার মা কর্মাবতী ছিলেন তা বলা শক্ত , হতে পারে দুই জন্যেই অখুশি ছিলেন ! মীরা শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নেন তার কাকা বিক্রম দেবের কাছে ! কিন্তু ১৫৩৮ সালে মীরার আদি বংশ স্বয়ং যোধপুরের রানা বিক্রমদেবকে রাজ্যহারা করেন ! সম্ভবত তখন মীরার কাছে এই সব রাজনীতি থেকে দূর বৃন্দাবনে চলে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না !
প্রাসাদ ছেড়ে যাবার আগে তিনি নাকি তখনকার বিখ্যাত ভক্তিসাধক তুলসীদাস কে চিঠি লিখে পরামর্শ চান, তুলসীদাস পরামর্শ দেন যারা তাকে বিশ্বাস করে না তাদের কাছ থেকে দূরে চলে যাওয়ায় ভালো ! এখানে মনে রাখতে হবে তুলসীদাসের জন্ম ১৫১১ সালে উত্তরপ্রদেশে এবং তিনি যার জন্যে বিখ্যাত অর্থাৎ রামচরিতমানস তার রচনা কাল ১৫৭২ ! মীরাবাঈ প্রাসাদ ছাড়েন ১৫৩৮ সাল নাগাদ, সে সময়ে তিনি হঠাৎ করে এক অজানা সাধককে চিঠি কেন লিখবেন ! এসবই পরবর্তীকালের ভক্তদের আরোপিত বলে মনে হয় !
ষোড়শ শতকের ভারতবর্ষের পথে পথে দেখা গেল এক পাগলিনী সন্ন্যাসীনি কে। যে করে গান । যে গানের নাম কৃষ্ণসংগীত। তার গন্ত্যব্য ছিল বৃন্দাবন, তৎকালীন বৈষ্ণবদের কেন্দ্রস্থল , সাথে সাথে হিন্দু বিধবাদের অন্যতম গন্ত্যব্যও বটে। এখানে এসে মীরার সব বন্ধন যেন কেটে যায়, মীরা ছিলেন স্বভাব কবি , তার কবিতা আর ভজনের স্রোত বৃন্দাবনে পুরো প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে ,কবিতা রচনা, ভক্ত সাধকদের সান্নিধ্য সবমিলিয়ে সম্ভবত এই সময়টিই ছিল তার জীবনের সেরা সময় !
মীরা কি ধরণের ধরণের গান লিখেছেন ? তার নামে প্রায় হাজার পাঁচেক গান চলে, তার মধ্যে ঐতিহাসিকদের মতে দুশো থেকে চারশোটি তার নিজের রচনা হবে !আজও ভারতবর্ষের পথেপ্রান্তরে কৃষ্ণভক্তের কন্ঠে শোনা যায় সে সব আশ্চর্য গান । জয়দেবের ঘরানায় প্রচুর ভক্তিগীতি বা ভজন রচনা করলেও তার গানে কিন্তু নারীর সামাজিক অবস্থানের প্রতিবাদও প্রচুর পাওয়া যায় ! যেমন
Thara desa mein Rana saadh nahin chhe, log base sab kudo
(in your kingdom Rana, the people are all garbage)
Gehna gaanthi Rana hum sab tyaga, tyaga karro chuudo
(I have renounced all jewellery and finery, even my wedding bangles)
Kajal teeki hum sab tyagya, tyagya hai bandhan judo
(I have renounced all makeup and stopped tying my hair too)
এরসঙ্গে তার আদিরসাত্মক রাধাকৃষ্ণের রাসলীলার গানও রয়েছে , এবং এটাও বলা যেতে পারে তার গানে যৌনতাকেও অস্বীকার করা হয় নি ! এটা রাধাকৃষ্ণের ভক্তিগীতিতে কোনো নতুন ব্যাপার না, এবং মীরা সবসময়েই কৃষ্ণকে তার দয়িত হিসেবে বর্ণনা করেছেন , সুতরাং তার প্রার্থনায় আকুতি থাকা আশ্চর্যের কোনো ব্যাপার না ! যেমন ধরুন নিচের গান টি
चितनन्दन आगे नाचूँगी ।
नाचि नाचि पिय रसिक रिझाऊँ, प्रेमी जन को जाचूँगी ।
प्रेम प्रीत का बाँध घूँघरा, सूरत की कछनी काछूँगी ।
लोक लाज कुल की मरजादा, या मैं एक न राखूँगी ।
पिया के पलंगा जा पौढ़ूँगी, मीराँ हरि रंग राचूँगी ॥
I will dance before the Consciousness-Charmer.
Having danced and danced, I will please my enjoyer. I will feel my lover.
I will tie on the ankle bells of love and affection. I will wear the dancing-garment of his face.
Worldly modesty, family honor—I will not care for either of these.
I will go and lie in the bed of my beloved. I, Mira, will dye myself in Hari's color.
(Translation by Johanna-Hypatia Cybeleia)
এই ধরণের গানের সামাজিক অভিঘাত সেই সময়ে হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি ছিল, মনে রাখতে হবে জয়দেবের রাধার সৃষ্টি তখনো ভারতীয়দের কাছে সদ্যনতুন ! মহাভারতের কৃষ্ণের ভক্তিবাদী সাধকদের দ্বারা প্রেমিক কৃষ্ণে পরিবর্তনের পালা চলছিল ! কিন্তু অন্য পুরুষ ভক্তিসাধকদের পক্ষে মীরার মতন আর্তি গানে আনা সম্ভবই ছিল না !
এইদিক থেকে ভাবনা চিন্তা করলে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার মাথায় আসে , মীরার জীবনকাল ভারতবর্ষের ভক্তি আন্দোলনের তুঙ্গ সময় ! ভক্তি আন্দোলন আট শতকে দক্ষিন ভারতের তামিলনাড়ু ও কেরালাতে শুরু হলেও পনেরো থেকে আঠেরো শতকে উত্তরভারতে ছড়িয়ে পড়ে ! ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম শাখা ছিল বৈষ্ণব সাধনা ! ভক্তি আন্দোলন ছিল কবি , লেখক এবং সংগীতকারদের সময় ! মীরাবাইকে ভক্তিআন্দোলনের অন্যতম একজন হিসেবেই ধরা যায় ! খেয়াল করা দরকার যে ভক্তিবাদী সাধকদের বাকি সবাই পুরুষ ছিলেন ! তাদের সঙ্গে মীরাবাঈয়ের কি দেখা হয়েছিল ? অথবা তাঁরা তাকে কেমন ভাবে দেখতেন ? এই ব্যাপারে কোনো প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায় না ! মীরাবাঈয়ের সমসাময়িক কিন্তু মহাপ্রভুও ( ১৪৮৬- ১৫৩৪), তবে তাঁদের মধ্যে দেখা হওয়া সম্ভব হয়নি !
যা জানা যায় সম্ভবত ১৫৩৮ সালে মীরাবাঈ বৃন্দাবনে পৌঁছান এবং তার বাকি জীবনের বেশিভাগটাই তিনি সেখানে কাটান , মৃত্যুর মাত্র কিছুদিন আগে দ্বারকায় চলে যাবার আগে ! তখন বৃন্দাবনে বসবাস করছেন বিখ্যাত ছয় বৈষ্ণব আচার্য্য , রূপ -সনাতন গোস্বামী , রঘুনাথ ভট্ট গোস্বামী , গোপাল ভট্ট গোস্বামী , জীব গোস্বামী, রঘুনাথ দাস ! এঁদের সঙ্গে মীরাবাঈয়ের দেখা হয়েছিল কিনা তা এঁরা কেউই কোথাও সম্ভবত উল্লেখ করে যান নি , কিন্তু তখনকার সমাজে মীরাবাঈয়ের মতন একজন ব্যক্তিত্বের নাম এঁরা নিশ্চয় না শুনে থাকবেন না , তবে কি রমণী হিসেবে মীরাবাইকেও এরা ধর্তব্যের মধ্যে আনেন নি ?
কোথাও কোথাও বলা হয়ে থাকে কবীর সম্ভবতঃ বৃন্দাবনে এসেছিলেন এবং মীরা তাঁর সাক্ষাৎ প্রার্থনা করেন , কিন্তু কবীর তার সঙ্গে দেখা করতে সম্মত হননি ! আরো একটি প্রচলিত কাহিনীতে বলা হয় মীরা জীব গোস্বামীর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে , তিনি অস্বীকার করেন , তখন মীরা শ্রীচৈতন্যের উক্তি মনে করিয়ে দেন যে, বৃন্দাবনে একমাত্র পুরুষ হলেন শ্রীকৃষ্ণ ! তবে জীব গোস্বামী ছিলেন মীরার থেকে তেরো বছরের ছোট, মীরা কেন অত নবীন সন্যাসীকে গুরুত্ব দেবেন তা বলা কঠিন, এর কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণও পাওয়া যায় না।
আচার্য্য, গুরুরা তাকে কতটা গ্রহণ করেছিলেন সে ব্যাপারে ঠিকঠাক জানা না গেলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে মীরা চিরকালীন হয়ে গেছেন !
মৃত্যুর আগে মীরা বৃন্দাবন ত্যাগ করে দ্বারকা গমন করেন , এর পেছনে তখনকার বৈষ্ণব আচার্যদের তাচ্ছিল্য নাকি নিজের তার প্রাণবল্লভ কৃষ্ণের শেষ লীলাভূমি দ্বারকাতে যাওয়ার ইচ্ছে ,কোনটা কাজ করেছে তা বলা যায় না ! হয়তো তার শ্বশুরবাড়ির হাত ও থাকতে পারে ! তার কারণ হচ্ছে ওই সময়েই শিশোদিয় রাজপুতদের বিশাল সামরিক পরাজয় হয় এবং অসংখ্য নারী জহরব্রত পালন করেন, এরকম ধারণার সৃষ্টি হয় যে মীরার ওপরে অবিচারের ফল হিসেবেই এইসব হয়েছিল, এবং তার শ্বশুরবাড়ি তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা শুরু করে। এবং এই জন্যেই হয়তো তিনি বৃন্দাবন ত্যাগ করেন !
দ্বারকাতে তিনি রণছোড়জীর মন্দিরের আশেপাশে বসবাস করছিলেন ! কিন্তু শ্বশুরবাড়ি থেকে থেকে লোকজন এখানেও পৌঁছে যান ! রাজপুরুষ এবং ব্রাহ্মনদের দেখে তিনি ফিরতে অস্বীকার করেন ! বলা হয়ে থাকে একদিন তিনি মন্দিরে প্রবেশ করেন এবং রণছোড়জীর সাথে লীন হয়ে যান ! আমাদের শ্রীচৈত্যনদেবের লীন হওয়ার রহস্য মাথায় রাখলে মীরার কি পরিণতি হয়েছিল তা আন্দাজ করা শক্ত না ! এছাড়া মীরাবাঈয়ের শারীরিক মৃত্যুর ব্যাপারে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না ! সেদিক থেকেই তিনি চির রহস্যময়ী থেকে গেছেন !
তথ্যসূত্র:
উইলিস ব্রানসটন এবং টনি ব্রানসটন সম্পাদিত “লিটারেচারর্স অভ এশিয়া, আফ্রিকা অ্যান্ড লাতিন আমেরিকা” (ফ্রম অ্যান্টিকুইটি টু দ্য প্রেজেন্ট)
The Devotional Poems Of Mirabai - by A J Alston
A monograph on Mirabai; the saint of Mewad :by Mehta, S.S
সুচিন্তিত মতামত দিন