চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য - মায়াজম

Breaking

১৪ জুন, ২০১৯

চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য

ইতিহাসের বিস্মৃতি-বিকৃতি ও রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপ



ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে অনেকেরই অভিযোগ আছে এবং তাঁর কিছুটা হয়তো ন্যায়সঙ্গতও। বিশেষ করে স্কুলস্তরে, যে সময় একজন ভবিষ্যতের নাগরিকের প্রাথমিক জ্ঞানভাণ্ডার তৈরি হয়, সেই স্তরে পাঠ্য ইতিহাস অনেকটাই একপেশে। এমন কিছু কারণেই কৃষ্ণবর্মা, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, চম্পকরমন পিল্লাই,  মৌলানা বরকতুল্লাহ ভুপালি, দাদাচানজি কেরসাস্প, বীরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত, জীতেন্দ্রনাথ লাহিড়ি, প্রমথনাথ দত্ত, অবিনাশ ভট্টাচার্য, ওবেইদুল্লা সিন্ধি, সোহন সিং ভাখনা, ভাই জ্বালা সিং, কেশব সিং, হরনাম সিং, সত্যেন সেন, কর্তার সিং সারাবা, কাঁসিরাম, বিষ্ণু গণেশ পিংলে, পৃত্থ্বী সিং আজাদ, রহমত আলি, নিধিন সিং চুঘ, হরনাম সিং তুণ্ডিলাট-দের নাম অধিকাংশ ভারতীয়েরই অজানা। অথচ, এদের একেক জনকে নিয়েই উপন্যাস লেখা যায়। নাবালক শহিদ হিসাবে ক্ষুদিরামের নাম যতজন জানি, তাঁর ১০ ভাগের একভাগ মানুষও শহিদ বসন্ত বিশ্বাসের না জানেন না। অথচ, তিনিও নাবালক শহিদ। বস্তুত এরা সবাই ছিলেন সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পক্ষে।
এদের পথ ভুল ছিল, এমন দাবি করা যাবে না। এডমন্ড হিলারি-তেনজিং নোরগে এভারেস্টের দক্ষিণ পথ দিয়ে উঠেছিলেন। পরে উত্তরে চিনের দিকের পথ আবিস্কার হয়েছে। তাঁর অর্থ এই নয় যে হিলারিদের আবস্কৃত পথ ভুল ছিল। উপরে যাদের কথা বলা হল, তাঁদের সঙ্গে রাসবিহারী বসুর নাম জুড়লে পাওয়া যাবে, ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বিশ্বজুড়ে ভারতীয় বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ড ও পথ তৈরির প্রচেষ্টা। তারা সেদিন আংশিক সাফল্য পেয়েছিলেন, পূর্ণ নয়। অথচ, সেই আংশিক সাফল্যই পরবর্তীকালে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে যোদ্ধা বানিয়েছিল। উপরে যাদের নাম বলা হল, তাঁরা তৈরি করেছিলেন ইন্ডিয়া ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ, যার সভাপতি ছিলেন সভাপতি ছিলেন সত্যজিত রায়ের গুপি গাইন বাঘা বাইন-এর যাদুকর হারীণ চট্টোপাধ্যায়ের দাদা বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, যার আরেক বোন ছিলেন সরোজিনী নাইডু। বার্লিনে বসে এই কমিটি তৈরি হয়েছিল বলে এর আরেক নাম ছিল 'বার্লিন কমিটি'।
হয়তো স্মরণে থাকবে, প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি লালকেল্লায় প্রথম স্বাধীন ভারত সরকারের (আজাদ হিন্দ) ৭৫ বছর উদযাপন করেছে। রাজনৈতিক দল ও নেতাদের নানা রকম এজেন্ডা থাকতেই পারে, ইতিহাসের এজেন্ডা একটাই -- সত্য নিরূপন। এটাই ইতিহাসের কাছে দায়বদ্ধতা। সেদিক থেকে দেখতে গেলে, প্রথম স্বাধীন ভারত সরকারের বা আজাদ হিন্দ সরকারের শতবর্ষ চলে গিয়েছে চার বছর আগে। দ্বিতীয় সরকার তৈরি হয়েছিল প্রথম সরকারের ২৯ বছর পর, আন্দামানে। প্রথম সরকারের রাষ্ট্রপতি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন না, তিনি ছিলেন দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি। নেতাজীর সময় প্রধানমন্ত্রী, বিদেশমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষা বা যুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীরা কারা ছিলেন, কেউ জানেন? ছিলেন তো নিশ্চয়ই, কারা তাঁরা?
তাঁদের নাম যেমন আমাদের বলা হয় না, তেমনই প্রথম সরকারের কথাটাও ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা আছে। যেমন, সাধারণ ভারতীয়কে জিজ্ঞাসা করলে শোনা যায়, আজাদ হিন্দ ফৌজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। কিন্তু একথা সত্য নয়। বেসরকারি কোনও বক্তি কোনও ফৌজের জন্ম দিতে পারে না। আজাদ হিন্দ ফৌজের ইতিহাস - সরকারি এবং বেসরকারি সবেতেই লেখা আছে- প্রতিষ্ঠাতার নাম কর্নেল মোহন সিং। পরে সুভাষচন্দ্র এই ফৌজের সর্বাধিনায়ক হয়েছিলেন। ঠিক তেমনই ভারতের স্বাধীন সরকার প্রথম তৈরি হয়েছিল ১৯১৫ সালের পয়লা ডিসেম্বর, আফগানিস্তানের কাবুলে। তাঁর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বরকতুল্লাহ ভুপালি আর প্রেসিডেন্ট বা রাষ্ট্রপতি ছিলেন রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপ। আর, ১৯৪৩ সালে জাপানে নেতাজীর হাতে পরবর্তী প্রেসিডেন্টের ব্যাটন তুলে দিয়েছিলেন রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপই। আজাদ হিন্দ ফৌজের আগেও বিপ্লবীরা ফৌজ গঠন করেছিলেন মহেন্দ্রপ্রতাপের সরকারের অধীনে। বালুচিস্তানে একটি বাহিনী গড়েছিলেন এই সরকারের অধীনে দুজন বাঙালি বিপ্লবী আর কাবুলে তৈরি হয়েছিল 'জুনেইদ-এ রব্বানী' বা ঈশ্বরের সেনাবাহিনী'। সেই বাহিনীকে সাহায্য করেছিল জার্মানী, আফগানিস্তানের আমির এবং তরস্কের আনোয়ার পাশা। বস্তুত মহেন্দ্রপ্রতাপের সরকারকে এই তিন দেশ 'স্বাধীন' দেশ হিসাবে স্বীকৃতিও দিয়েছিল।
ইতিহাসের এই সত্যতা কি ভারত সরকার স্বীকার করে? হ্যাঁ, অবশ্যই করে। ভারতের সরকারি মহাফেজখানাতে এখনও তার সব তথ্য আছে। সেই তথ্যের ভিত্তিতেই ১৯৭৯ সালের ২৯ এপ্রিল তাঁর প্রয়াণের পর রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপের স্মৃতিতে ভারত সরকার একটি বিশেষ ডাক্টিকিট প্রকাশ করে। ডাকটিকিটের পরিচিতিতে সরকার লেখে, "in Kabul, along with other Indian revolutionaries he established Provisional Government of Free India. He was the President and Maulana Barkatullah was the Prime Minister."

রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপ ওরফে পীর পিটার প্রতাপ
বিতর্কের অবকাশ পরেও পাওয়া যাবে, আগে বরং মহেন্দ্রপ্রতাপের জীবন ও কাজের কথা একটু জানা যাক। কাবুলে তাঁর ঘরেই তাঁরই জন্মদিন পয়লা ডিসেম্বরে জন্ম নেয় ভারতের প্রথম স্বাধীন সরকার। তাঁকেই করা হয় রাষ্ট্রপতি। হ্যাঁ, পরাধীন ভারতের অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি। সরকারের নাম 'হুকুমত-এ-আজাদ হিন্দ'। আজাদ অর্থ স্বাধীন, হিন্দ অর্থে ভারত আর হুকুমত অর্থে সরকার। মহেন্দ্রপ্রতাপ ছিলেন উত্তর প্রদেশের মুরসানের রাজা ঘনশ্যাম সিংয়ের সন্তান। কিন্তু প্রতিপালিত হয়েছেন বৃন্দাবন-নিবাসী হাতরাসের অপুত্রক রাজা হরনারায়ণ সিং-য়ের পরিবারে। মাত্র তিন বছর বয়সেই মহেন্দ্রপ্রতাপকে দত্তক নিয়েছিলেন হরনারায়ণ। মহেন্দ্রপ্রতাপ এম.এ পাশ করেন আলিগড়ের এম.এ.ও কলেজ (এখন নাম আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি) থেকে। বিয়ে করেছিলেন মহেন্দ্র পাঞ্জাবের সাংরুর (জিন্দ)-এর মহারাজা রণবীর সিং-এর ছোট বোনকে, শিখ ধর্মমতে। জন্মসূত্রে হিন্দু, শিক্ষা মুসলিম কলেজে আর বিয়ে করেছেন শিখ মেয়েকে -- তাই তিনি ছদ্মনাম নিয়েছিলেন ‘পিটার পীর প্রতাপ’। রাজনৈতিক জীবনে কাজ করেছেন লালা হরদয়াল, উধম সিং, মানবেন্দ্রনাথ রায়, সুভাষচন্দ্র বসু এবং বিশ্বব্যাপী গদর নেতাদের সঙ্গে। শেষদিকে মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ মেনে জীবন বাহিত করেছেন।
এই সরকারের মন্ত্রীদের পরিচয় দেওয়া যাক। সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মৌলানা বরকতুল্লাহ ভুপালি, বিদেশমন্ত্রী ডঃ চম্পকরমন পিল্লাই, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন মুসলমান ধর্মশিক্ষক মৌলানা ওবেইদুল্লা সিন্ধি, যুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন মৌলবী বশির আর যোগাযোগ মন্ত্রী ছিলেন আলি জাকারিয়া। এই সরকারের মন্ত্রী ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায় এবং শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ও। বার্লিন থেকে জার্মান দূত অস্কার ভন নিডেরমেয়ারের সঙ্গে মহেন্দ্রপ্রতাপ, চম্পকরমন, বরকতুল্লাহ প্রমুখ জার্মান কাইজার, তুরস্কের আনোয়ার পাশা, মিশরের ক্ষমতাচ্যূত খাদিভ আব্বাস হালিমের অনুরোধ-জ্ঞাপক চিঠি আফগান আমীর হবিবুল্লাহকে দেন। ভিতু হবিবুল্লাহকে ইতস্তত করছেন দেখে বিপ্লবীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন আমীরের ভাই নসরুল্লাহ খান এবং দুই ছেলে ইনায়েতুল্লা আর আমানুল্লা খান।
মহেন্দ্রপ্রতাপ রাশিয়ার জার, চিন ও জাপানের সমর্থন চেয়েছিলেন। তুরস্ক স্বীকৃতি দিয়েছিল, বিপ্লবে সার্বিক সহায়তাও দিয়েছে। মহেন্দ্রপ্রতাপের পারিবারিক সূত্রে প্রকাশিত নথি বলছে, ভীরু হবিবুল্লাহ নিজের ভাই, ছেলে ও ভারতীয় নেতাদের চাপে মহেন্দ্রপ্রতাপের সঙ্গে একটি গোপন চুক্তিও করেছিলেন। চুক্তিতে ছিল, “সিন্ধু নদ হবে আফগানিস্তান ও ভারতের সীমানা। ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যুদ্ধে আফগান আমীর ৫০,০০০ সৈন্য দেবেন। যুদ্ধে নিহত প্রত্যেক সৈন্যর জন্য মহেন্দ্রপ্রতাপের সরকার আফগান আমীরকে দেবে ১০,০০০ টাকা। জার্মানী থেকে ২৫,০০০ সৈন্য আসার পর আফগান আমীর ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন।” এর পর ওবেইদুল্লা দূত ও চিঠির মাধ্যমে সিন্ধ, পাঞ্জাব, বিহারে সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ ঘটানোর চেষ্টা করেন। অন্যদিকে মহেন্দ্রপ্রতাপের চিঠি নিয়ে বৃন্দাবন, এলাহাবাদ ও বারাণসী গিয়ে কংগ্রেস নেতা নারায়ণ দাস, পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য এবং শিবপ্রসাদ গুপ্তাকে দিয়েছিলেন আচার্য কৃপালনী। রাশিয়ার জার সরকার খানিকটা মদত দেওয়ার  ইঙ্গিত দেওয়ায় আফগান প্রধানমন্ত্রী নিজের খরচে ভারতের জন্য ১২,০০০ আফ্রিদির বাহিনী গঠন করেন।
কিন্তু, ইংরেজ ইতিমধ্যে কিছু দালাল তৈরি করেছে। তাদের একের পর এক বিশ্বাসঘাতকতায় বিপ্লবীরা ধরা পড়তে থাকেন। তাঁদের হত্যা করা হয়। তিরমিজে ধরা পড়ে ফাঁসি হয় সমশের সিং-এর। কাদির বক্স, খুদা বক্স গ্রফতার হন। ইরাণে ব্রিটিশরা গুলি করা মারে ধৃত কেদারনাথজী, দাদাচানজি কেরসাস্প, সর্দার বসন্ত সিংকে। ফাঁসি হয় বৃদ্ধ সুফি বিপ্লবী অম্বাপ্রসাদের। মহেন্দ্রপ্রতাপের চিঠি নিয়ে নেপালের পথে ধরা পড়ে খুন হন কালা সিং।
অন্যদিকে পাণ্ডুরং খানখোজে আর প্রমথনাথ দত্ত তুর্কীদের কারাগারে বন্দি ভারতীয় ও গদরদের নিয়ে গড়লেন নতুন বাহিনী। উপজাতীয়দের সহযোগিতায় তারা বালুচিস্তানে বিরাট এলাকা ব্রিটিশমুক্ত করে কয়েক মাস সরকার চালালেন। এই উপজাতীয়রা বরাবর ভারতীয় বিপ্লবীদের বন্ধু, কখনও বিশ্বাঘাতকতা করেন নি। এখানকারই মানুষ লাল কুর্তা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক সীমান্ত গান্ধী খান আব্দুল গফফর খান।
স্বীকৃতি চেয়ে চিন, জাপান ও আমেরিকায় গেল প্রবাসী ভারত সরকারের দূতেরা, কিন্তু সাফল্য এল না। ইতিমধ্যে রাশিয়ায় নভেম্বর বিপ্লবের পর ফের স্বীকৃতির চেষ্টা করেছিলেন মহেন্দ্রপ্রতাপ। ১৯১৮-র মার্চে ট্রটস্কির সাহায্যে তাশখন্দ থেকে মৌলানা বরকতুল্লাহকে বিশেষ ট্রেনে বিজয়ীর মতো সম্বর্ধনা দিতে দিতে পেট্রোগ্রাড (পরে নাম লেনিনগ্রাড) হয়ে মস্কোয় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ২৫,০০০ মানুষের সমাবেশে তিনি ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে বলেন। সেখান থেকে বার্লিনে গিয়ে তিনি ও রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপ বাহিনীর জন্য সেনা পাঠানোর আর্জি নিয়ে জার্মান কাইজারের সঙ্গে দেখা করলেন।
কিন্তু, এই দুজনের অবর্তমানে ব্রিটিশের চাপের কাছে নতিস্বীকার করে আফগান আমীর মহেন্দ্রপ্রতাপের সরকারকে দেওয়া সুযোগসুবিধা প্রত্যাহার করলেন। ফলে তাঁর পরিবারে বিদ্রোহ ঘটল, খুন হলেন আমির হাবিবুল্লা। নতুন আমীর হলেন হাবিবুল্লার ভাই নসরুল্লা। কিছুদিনের মধ্যেই হাবিবুল্লাহর ছেলে আমানুল্লা আমির হলেন। আমানুল্লার পরামর্শে আর মৌলানা বরকতুল্লার কূটনীতির ভরসায় রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপ গেলেন মস্কো। ক্রেমলিনে তাঁকে স্বাগত জানালেন স্বয়ং লেনিন। ১৯২১-র ১২ ডিসেম্বর আমানুল্লা ও ওবেইদুল্লার পরামর্শ মেনে রাশিয়ার সঙ্গে মৈত্রীচুক্তি করলেন মহেন্দ্রপ্রতাপ।
ইতিমধ্যে, এই সরকারের 'অফিসার' মৌলানা আব্দুর রব এবং আচার্য কৃপালনীকে দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজের কারণে প্রথমে আফগানিস্তান সরকার, পরে রাশিয়া বহিস্কার করে। ধাক্কা খেল সরকারের মর্যাদা। এরপর আমানুল্লার পরামর্শে মহেন্দ্রপ্রতাপ চিন, জাপান, তুরস্ক, তিব্বত, শ্যাম, আমেরিকা ও জার্মানীতে দূত পাঠালেন। মহেন্দ্রপ্রতাপ গেলেন তাশখন্দে। সেখানে থাকার মধ্যেই জানতে পারেন, চাপের মুখে ব্রিটিশের সঙ্গে নতুন চুক্তি করেছে আমানুল্লা। হতাশ মহেন্দ্রপ্রতাপ আমীরের দেওয়া সব চিঠি ও নথি ফেরৎ দিয়ে মৌলানা বরকতুল্লাকে নিয়ে গেলেন মস্কো। সেখান থেকে বরকতুল্লা গেলেন বার্লিন। উদেশ্য, ফের একবার অর্থ ও অস্ত্র সহায়তার আশ্বাস জোগাড়।
আফগানিস্তানের মধ্যে দিয়ে ভারতে সেনা নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হলে (রেশমি রুমাল ষড়যন্ত্র) মহেন্দ্রপ্রতাপ চাইছিলেন, চিন-তিব্বত-নেপালের মধ্যে দিয়ে ভারতে বাহিনী পৌছানোর পথ খুলতে। গদর বিপ্লবীদের অকুণ্ঠ সহায়তায় ১৯২৫-এ তিনি সেই চেষ্টা শুরু করেন। তাঁর ধারণা ছিল, “পশ্চিমের রাশিয়া-আফগান-মুজাহিদিন রুট খুলে গেছে। এবার চিনের সাহায্যে উত্তরের পথ খুলতে হবে।” বার্লিন থেকে জাপানে এসে মার্শাল ফেং ইয়ু শিয়াংইয়ের সমর্থন আদায় করে চিনের মধ্যে দিয়ে তিব্বতেও পৌছেছিলেন। কিন্তু অপেক্ষা করেও নেপালের দিক থেকে সাড়া না পাওয়ায় তাঁর সেই প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়। এই সময়ে অসম্ভব কষ্ট স্বীকার করে তুষারাবৃত পথে ঠাণ্ডায় গাধার পিঠে প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও ভারতে বিপ্লবী বাহিনীর পৌছানোর পথ খোলার চেষ্টা চালিয়েছেন। ভেঙে যাওয়া কাবুলের সরকারের অনেকেই তখন মৃত। জাপানে টোকিওতে তিনি পুনর্গঠন করেন ভারতের কার্যনির্বাহী পরিষদ। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা হল রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপকেই। ভাইস-প্রেসিডেন্ট হলেন রাসবিহারী বসু আর মহাসচিব বা প্রধানমন্ত্রী হলে আনন্দমোহন সহায়। নতুন পথ পেতে মহেন্দ্রপ্রতাপ ফের জার্মান ও ইতালি সরকারের সঙ্গে কথা বললেন।
মহেন্দ্রপ্রতাপের নিরলস প্রচেষ্টার স্বীকৃতস্বরূপ ১৯৩২ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য তাঁর নাম বিবেচিতও হয়েছিল। এরপরই শুরু হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ২০ নভেম্বর ১৯৪১, মহেন্দ্রপ্রতাপ জাপানের সঙ্গে আলোচনা করলেন, কিন্তু জাপানী পরিকল্পনা তাঁর মনঃপুত হল না। জাপান চেয়েছিল, তাদের ফৌজ ভারতে ঢুকে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়ববে। কিন্তু, দেশের মাটিতে মহেন্দ্রপ্রতাপ আরেক বিদেশী শক্তির সামরিক বুটের ছাপ দেখতে চাননি। মহেন্দ্রপ্রতাপের সঙ্গে একমত ছিলেন না রাসবিহারী বসু এবং আনন্দমোহন সহায়। রাসবিহারী বসুর পরামর্শে সুভাষচন্দ্র বসু ভারত থেকে পালিয়ে রাশিয়া, জার্মানি হয়ে এলেন জাপান। সুভাষচন্দ্র বসু মত দিলেন জার্মান-ইতালি-জাপানের সয়াহতা নিয়ে ভারতের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ শুরুর পক্ষে। রাসবিহারী বসু তাঁর হাতে তুলে দিলেন নিজের তত্ত্ববধানে কর্নেল মোহন সিং-এর গড়া আজাদ হিন্দ ফৌজ। নতুন করে গড়ে উঠলো প্রবাসী অস্থায়ী ভারত সরকার বা হুমুকত--আজাদ হিন্দ। প্রেসিডেন্ট-এর দায়িত্ব সুভাষচন্দ্রর হাতে তুলে দিলেন মহেন্দ্রপ্রতাপ।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই, দীর্ঘ ৩২ বছর বিদেশে থেকে ৯ আগস্ট ’সিটি অফ প্যারিস’ জাহাজে তিনি টোকিও থেকে ভারতে ফেরেন। সোজা যান ওয়ার্ধায়, গান্ধীজির কাছে। গান্ধীজিকে নেতা মানলেও তিনি কংগ্রেসে যোগ দেননি। ১৯৫৭ সালে মথুরা থেকে জনসংঘের তরুণ তুর্কী অটলবিহারী বাজপেয়ীকে চতুর্থ স্থানে পাঠিয়ে, জামানত জব্দ করিয়ে, জিতেছিলেন নির্দল প্রার্থী মহেন্দ্রপ্রতাপ। মহেন্দ্রপ্রতাপ পরবর্তীকালে পঞ্চায়েতরাজ ও স্বচ্ছ প্রশাসনের জন্য সাধ্যমত কাজ করেছেন। মহেন্দ্রপ্রতাপ প্রয়াত হয়েছেন ১৯৭৯-র ২৯ এপ্রিল।


তথ্যসুত্রঃ

১) রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপের পারিবারিক ইতিহাস (ইন্টারনেট)
২) গদর আন্দোলনের ইতিহাস ৩) হুকুমত-এ আজাদ হিন্দ শতবার্ষিকী দস্তাবেজ ৪) ভারতের নির্বাচন কমিশনের নথি ৫) কোমাগাতা মারু, সোহন সিং যোশ, পিপলস পাব্লিকেশন, নয়া দিল্লি। ৬) ইন্টারনেটে বহু গবেষণামূলক প্রবন্ধ।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র