দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়

মায়াজম
0

রাধে তুই থমকে গেলি কেন?—



না জানি কত হাজার বছর আগের কথা, দ্বাপর কালের একসময় হবে হয়তো। বিদর্ভরাজ ভীষ্মকের প্রাসাদ সংলগ্ন বাগানে খেলা করছিল তার ফুটফুটে মেয়ে রুক্মিণী। দেখভাল করার দায়িত্ব থাকা দাসী নিশ্চিন্তে বাগানের প্রহরীর সাথে নিভৃতে গল্পে মত্ত। এই সুযোগটা সে আগেও নিয়েছে। দাসীর বয়স বেশি নয়, অতীব সুন্দরী। এর সঙ্গলাভের জন্য অনেক ধরাধরি করে রাজার ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী সুকেশ উদ্যানের দায়িত্ব নিয়েছিল।

বেলা বেশি হয়নি। রাজকন্যা একদমই ছোট, বছর দেড়েকের হবে। তবে ভালো হাঁটতে শিখে গেছে। এক ফুলগাছ থেকে আরেকটাতে দৌড়ে বেড়াচ্ছে প্রজাপতিদের সাথে সাথে। আপনমনে কথা বলছে নিজের সাথে, প্রজাপতিদের সাথে কখনো বা ফুলেদের সাথে। এই সুযোগটা দাসী ও সুকেশ প্রায় রোজই নিত। সেদিনও ব্যতিক্রম ছিল না। হটাৎ চারদিক কালো হয়ে গেল, বিষাক্ত এক হাওয়ার ঝাপ্টায় জ্ঞান হারালো দুজনেই, প্রায় রাজবাড়ির সকলেই। কয়েক মুহুর্তের ব্যাপার, সব মিলিয়ে গেল, রোদে ঝলমল করতে লাগল চারদিক শুধু একটাই পরিবর্তন চোখে পরল দাসী এবং সুকেশের। রাজকন্যা রুক্মিনী উধাও। কোত্থাও নেই ফুটফুটে শিশুটি।

মেঘের ঘনকালো পরতের ওপরে, বুকের মধ্যে ছটপট করতে থাকা রুক্মিনীকে নিয়ে হাওয়ার বেগে উড়ছে পুতনা। এই ভয়ালদর্শনা রাক্ষসীর পছন্দের আহার কচি শিশুরা, শুধু আহারের প্রয়োজনেই নয়, এক তীব্র আক্রোশ পূতনার মনে গরলের ঢেউ তোলে যখন তখন। নিজের পিতামাতাকে অভিশাপ দেয় পুতনা বারবার। নিজের রাক্ষসকূলে জন্মের জন্য, নিজের ভয়ানক রূপের জন্য। তাই ফুলের মতো সুন্দর শিশুদের দেখলেই ওর মনে জেগে ওঠে আক্রোশের দাবানলকিন্তু আজ একি হচ্ছে? এতক্ষণ তো ঠিকমতোই উড়ে চলেছিল পুতনা। হটাৎ এমন ভাবে হাঁফ ধরে গেল কেন, বুকের মধ্যে একটা চাপ চাপ ব্যথা, চোখের সামনে আঁধার ঘনিয়ে আসতে শুরু করেছে।

পুতনা টের পেল বয়ে নিয়ে যাওয়া শিশুর ওজন প্রতি মুহুর্তে বেড়ে চলেছে, যেন একটা পাহাড় বইছে ও। এটা কেমন করে সম্ভব। এতটুকু শিশুর ওজন এতো হয় কি করে। কিন্তু শরীর যে আর সাথ দিচ্ছেনা, এখন নিকষ কালো অন্ধকারে হারিয়ে ফেলছে দৃষ্টিশক্তি। প্রত্যেকটা শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। এই শিশু কি মানবশিশু নাকি ছদ্মবেশে কোন দেবশিশু? ভাবতে ভাবতেই আর পারল না পুতনা। আকাশের অনেক ওপর থেকে ভারী পাথরের মতো আছড়ে পড়তে শুরু করলো ওর অচেতন দেহ। সশব্দে, চারদিকে আলোড়ন তুলে বিশাল শরীর আছড়ে পড়ল মাটিতে। পতনের কারণেই ওর অবশ হাত থেকে ছিটকে বেড়িয়ে গেল ওর শিকার

বৃন্দাবন থেকে খানিক দূরে, যমুনা নদীর ধারে গোকুল নামে ছোট্ট গ্রামটি ছিল গোপালকদের আবাসভূমিসাধারণ জীবন ধারন করে সুখে শান্তিতে কাটালেও মাঝে মধ্যে পুতনার মতো রাক্ষসী, স্বল্পদুরে থাকা মথুরার রাজা কংসের অত্যাচারের ঢেউ নামিয়ে আনত শোক, দুঃখ। কিন্তু আবারো সব ভুলে নিজেদের সরল জীবনে ফিরে যেত তারা। এই শোকের ছায়া তখনো ছেড়ে যায়নি সেখানকার জমিদার, একজন গোপালক বৃষভানু ও তার স্ত্রী কৃতিকে। মাত্র মাস তিনেক আগেই ওরা খুইয়েছে নিজেদের একমাত্র সন্তান রাধাকে। এমনই এক মেঘঢাকা সকালে, আকাশ থেকে নেমে এসেছিল ভয়াল রাক্ষসী পুতনা, মায়ের চোখের সামনে থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেছিল ফুটফুটে মেয়ে রাধাকে। এখনো চোখ বুঁজলে মেয়ের কান্না কানে ফিরে আসে কৃতির।
আকাশে আবারো সেই মেঘ ঘনিয়ে আসা অন্ধকার, জোরে জোরে শ্বাস নেওয়ার আওয়াজ শুনে, মাথায় খুন চেপে গেছিল আপাত শান্ত বৃষভানুর মাথায়। হাতের কাছে থাকা ভাঙ্গা অথচ তীক্ষ্ণ লাঙ্গলের ফলা তুলে ছুটে গিয়েছিল যমুনার দিকে, পিছনে পিছনে কৃতিও। যমুনার তীরে একটা জায়গায় মাটি বিরাট গর্ত হয়ে বসে গেছে, একটা বিশাল দেহের আকারে। কিন্তু যারই দেহ হোক না কেন সে পালিয়েছে ওদের আসার অবসরে।

ফিরেই আসছিল দুজনে, ঠিক সেই সময়ে খিলখিল করে বাচ্চার হাসিতে চমকে উঠেছিল ওরা। পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে দেখেছিল, যমুনার ধারে ঘন পদ্মবনে এক অপরূপ শিশু, প্রজাপতিদের স্পর্শে হাসছে। কেউ নেই আশেপাশে। এগিয়ে গিয়ে চমকে উঠেছিল দুজনেই, এযে ওদের রাধা। এখানে কি ভাবে এলো? কোথায় ছিল এতদিন? পাগলের মতো ছুটে গিয়ে কোলে তুলে নিয়েছিল কৃতিযেন মাকে ফিরে পেয়েছে এমন ভাবে কৃতির গলা জড়িয়ে ধরেছিল শিশুটি। আর মা মেয়েকে বৃষভানু। দুচোখে আনন্দের অশ্রু নিয়ে ফিরেছিল গ্রামে। গ্রাম তখন জেগে উঠছে ধীরে ধীরে। সবাই আশ্চর্য হয়েছিল, খুশীও, এভাবে রাধাকে ফিরে পাওয়া গেছে দেখে। উৎসবের সূচনা হয়েছিল বৃন্দাবনে। একটাই দুঃখ রয়ে গেছিল বৃষভানুর আর কৃতির, মেয়ে কিছুতেই যে তার চোখ খুলছিল না। কিন্তু সে দুঃখ মেনে নিয়েছিলেন তারা শুধু মেয়েকে খুঁজে পেয়েই।

আরেকটা উৎসবের সূচনা হল বৃন্দাবনে, এর কিছুদিন বাদেই। নন্দ আর যশোদার ঘর আলো করে বিরাজমান হল, কৃষ্ণ। নন্দলালা, গোপাল এমন কত নামে সবাই ডাকতে শুরু করল, ঘোর নীলাভ কৃষ্ণবর্ণ দুষ্টু, মিষ্টি বালককে। যার চোখের ভাষা পড়ার ক্ষমতা ছিলনা কারুরই কিন্তু ওইটুকু শিশুর মধ্যে যে অদ্ভুত কিছু আছে তা বুঝতে অসুবিধে হয় নি পাড়াপড়শিদের। একদিন নন্দ ওই ছোট্ট শিশুকে নিয়ে গেলেন গোকুলে, বন্ধু বৃষভানুর বাড়িতে। দুই শিশুকে এক জায়গায় রেখে বাইরে বসে কথা বলছিলেন ওরা, কৃতি ব্যস্ত হয়ে পরেছিলেন অতিথি সৎকারের ব্যবস্থাপনায়। হটাৎই দুই বাচ্চার মিলিত হাসি শুনে, কি ঘটল দেখার জন্য গিয়ে অবাক সবাই। রাধা চোখ খুলে কৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে হাসছে। কৃষ্ণও যোগ দিচ্ছে তাতে।

বাবা মায়ের মন বলে দিল, রাধার এই দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়া কৃষ্ণের জন্যই সম্ভব হয়েছিল। এই বালক যে সাধারণ কেউ না এই বিশ্বাস জন্মে গেল সবার মনে। এরপরের গল্প সবারই জানা। একের পর এক অসাধ্যসাধন করে বালক কৃষ্ণ এই বিশ্বাস গেঁথে দিল সবার মনে যে সে কোন সাধারণ বালক নয়, সে নররূপী কোন ভগবান। তাকে হত্যা করার জন্য বারবার চেষ্টা চালিয়েছে কংস সম্পর্কে যে কৃষ্ণেরই মামা। প্রতিবার ব্যর্থ হতে হয়েছে সকলকে। রাধাকে অপহরণ করে আনা পুতনাও শেষ হয়েছে এই চেষ্টা চালাতে গিয়ে।

ধীরে ধীরে বালক কৃষ্ণ প্রিয় থেকে প্রিয়তম হয়ে উঠল সবার মনে। তার দুষ্টুমীকে মেনে নিতে নিতে এমন অবস্থা হল কোনদিন কৃষ্ণ ভালো হয়ে থাকলে সবার মন খারাপ হয়ে যেত। বন্ধুদের সাথে গোচারণ ভূমিতে যাওয়ার পর প্রিয় স্থানটিতে, গাছের নীচে ঠেস দিয়ে বসে কোমর থেকে বের করে তার প্রিয় বাঁশীটা ঠোঁটে তোলার সাথে সাথেই, সারা বৃন্দাবনে এক অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা যেত।

ঘরের কাজ ভুলে, সকলের মন একছুটে চলে যেত যমুনার তীরে। গোপিনীরা, নানা ছুতোয়, নানা অছিলায় দল বেঁধে বেড়িয়ে পড়ত। সবারই মনে একটাই বাসনা, একবার কৃষ্ণের প্রিয়পাত্র হওয়া। অতোটা দূরে থাকলেও রাধার কানেও সে ডাক পৌঁছে যেত এক মুহুর্তে। প্রথম প্রথম বয়সে খানিকটা বড় হওয়ার জন্য, বাড়ি থেকে কৃষ্ণেরই এক দুরসম্পর্কের মামার সাথে বিয়ের কথা হয়ে থাকায়, সামান্য সংকোচ, ইতস্ততবোধ ছিল রাধার মধ্যে কিন্তু লক্ষ্মীর অংশ হিসেবে যার আগমন পৃথিবীতে, সে কিভাবে বিষ্ণুর অবতারের থেকে দূরে সরে থাকে?

কৃষ্ণ তাঁর বাঁশীতে যে রাধাকেই ডাকতো, এটাও একদিন আর লুকিয়ে রইল না অন্য গোপিনীদের কাছে। তারাও যূথবদ্ধ চেষ্টা চালাল, রাধার থেকে কৃষ্ণের মনোযোগ তাদের দিকে করবার। ললিতা, বিশাখা, বিরজা, মালিনী, মঞ্জীরা, চিত্রলেখা, ইন্দুলেখা, ইত্যাদিরা সে কাজে যে একদম ব্যর্থ হয়েছিল, তাও নয়। কিন্তু কৃষ্ণের ছলাক্লার সামনে বেচারি রাধা আর কি করে। একই সময়ে একই মুর্তি ধরে সকল সখিদের সাথে বিনোদনে মত্ত এই সাংঘাতিক প্রেমিককে কে সামলায়।

ভগবান বিষ্ণু তারই অবতারের এইসব খবর পাচ্ছিলেন, একদিন কৃষ্ণের সমস্ত সাথীকে অপহরণ করালেন, শুধু কৃষ্ণ কি করে দেখার জন্য। কৃষ্ণ নিজের ক্ষমতাবলে সমস্ত সাথীকে তৈরি করে যার যার বাড়িতে পাঠিয়ে দিল। নিন্দুকেরা বলে সেই সাথীদের মধ্যে আচমকা এসে পরা আয়ানও ছিল, যার সাথে রাধার বিয়ের কথা ছিল। এই সুযোগের অসদ্ব্যবহার করার মানুষ তো কৃষ্ণ ছিলেন না। তিনি নিজেই আয়ানরূপে বিয়ে করে ফেললেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় সখি, তাঁর শরীর মনের অংশ, শ্রীরাধাকে।

এমনি ভাবে চলছিল দিনযাপন। ভালোবাসার, প্রেমের জোয়ারে গোটা বৃন্দাবনকে ডুবিয়ে একদিন কৃষ্ণ ঠিক করলেন, অনেক হয়েছে, অত্যাচারি কংসকে এবার উচিৎ শিক্ষা দেওয়া দরকার। দাদা বলরামের সাথে রওনা দিলেন মথুরার উদ্দেশ্যে। পিছনে পরে রইল কৃষ্ণের অগুনিত ভক্ত, প্রিয়পাত্রেরা। চোখের জলের বাঁধ ভাঙল গোপিনীদের। কৃষ্ণকে কিছুতেই যেতে দেবেনা তারা। শুধু একাকী রাধা একপাশে, যেন খানিকটা অবহেলিত হয়েই দাঁড়িয়ে রইল। কৃষ্ণ এগিয়ে গেল, রাধার চিবুক ধরে মুখটা উঠিয়ে বলল, তুমি বিষাদে ভেঙে পরবে এটা আমি ভাবতেও পারছিনা। আমি আর তুমি কি আলাদা নাকি? তুমি তো আমার সাথেই থাকবে, সবসময়।

সে আশ্বাসে ভরসা ছিল কিনা নাকি শুধুই বিদায়বেলার সান্তনা, তা না বুঝেই রাধা হেসেছিল। বড় রহস্যময় সেই হাসি। হয়তো কৃষ্ণ নিজেও জানত না এই হাসির কি অর্থ। কিন্তু একটা অদ্ভুত শিহরণে কেঁপে উঠেছিল কৃষ্ণের শরীর।

মথুরা পৌঁছে দ্বন্দযুদ্ধে কংসকে আহ্বান জানিয়ে, তাকে বধ করতে কিছুই অসুবিধে হয়নি কৃষ্ণের। কংসের মৃত্যু পরোয়ানাতে এটাই যে লেখা ছিল। মথুরা ও বৃন্দাবনবাসীদের কংসের অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা করার পর রাজপাট সামলাতে গেল বেশ কিছুদিন। কংসের মৃত্যুতে রাজ্যবাসী আনন্দিত হলেও, বিরূপ হয়েছিল তাঁর কিছু বন্ধু, তাদের আক্রমণ বার বার আছড়ে পড়তে লাগল, কিন্তু কৃষ্ণ ও বলরাম অপরাজিতই রইলেন। কিন্তু ক্রমশ আক্রমণ বাড়তে থাকায় কপালে ভাঁজ পরা শুরু হল তাদের। সাধারণ প্রজাদের মৃত্যু এভাবে কামনা করেননি তারা। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, যাদবদের সাথে নিয়ে সুদূর পশ্চিমে, দ্বারকায় নতুন রাজত্ব গড়ে তুলবেন।

এই যাত্রায় রওনা হওয়ার আগে কৃষ্ণ ফিরে এলেন বৃন্দাবনে তাঁর বন্ধু, বান্ধবীদের সাথে দেখা করতে। দেখা করতে পালিতা মাতা যশোদা ও পিতা নন্দের সাথেও। কৃষ্ণের আগমনের খবর ছড়িয়ে পড়তে, সবাই এসে হাজির হল, কৃষ্ণের চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছিল একজনের জন্য কিন্তু না, রাধা আসে নি। হয়তো অভিমান, বিরহ বেদনায় আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে ঘরের এক কোণেতেই। সবার কাছে বিদায় নেওয়ার পর ফেরার পালা যখন তখন ভিড় থেকে অনেক দূরে, একটা গাছের নীচে দেখা গেল রাধাকে। ম্লান, বিষণ্ণ মুখ, বিষাদে ভরা চাউনি। একবার শেষবারের জন্য প্রেমাষ্পদকে দেখবে বলে ছুটে এসেছে এতোটা পথ। আসবো না বললেই কি চলে, কিভাবে থাকা যায় না এসে?

কৃষ্ণ ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন, রাধার নিচু হয়ে থাকা মুখ, চিবুক ধরে তুললেন। তাকালেন গভীর দৃষ্টিতে রাধার দুচোখে। সেখানে ঘন কালো বাষ্পভরা মেঘ জমেছে, বারি ধারায় ধুয়ে যাচ্ছে গাল, টপ টপ করে সেই অশ্রু ঝরে পরছে সখার পাদপ্রান্তে। কৃষ্ণ বুকে জড়িয়ে ধরলেন রাধাকে। শীতল কপালে এঁকে দিলেন স্নেহচুম্বন, শুধু কি স্নেহ? সেই চুম্বনে হয়তো ছিল আরো কিছু গভীর, গোপন অভিসন্ধির আভাস। হাসি ফুটল রাধার মুখে। সামান্যই সেই হাসি।

কৃষ্ণ বললেন, তুমি ভাবলে কি করে আমি তোমায় ছেড়ে কোথাও যাবো। আমি যেখানেই যাই, তুমি আমার সাথে, আমার কাছেই রইবে রাধে। আমার সাধনা, আমার শক্তি, আমার পরিপূরক তুমি, তোমাকে ছাড়া আমার কোন অস্তিত্বই নেই, শুধু এই কালে নয়, আগামীতেও আমার নামের আগে তোমার নাম উচ্চারণ করবে সবাইসেভাবেই সবার হৃদয়ে জায়গা করে নেবে তুমি। এখন আমাকে অনুমতি দাও। আমি এগোই।

আরো কিছুক্ষণ কৃষ্ণের বুকের সাথে মিশে রইলেন রাধা, যেন কৃষ্ণের হৃদয়ের প্রতিটি শব্দ বসিয়ে নিলেন নিজের হৃদয়ে তারপর সরে দাঁড়িয়ে বললেন, যাও শ্যাম, গোটা জগতের তোমাকে প্রয়োজন। যদি কখনো আমার কথা মনে পরে, একবার ডেকো আমাকে আমি যেখানেই থাকিনা কেন চলে আসব তোমার কাছে। কৃষ্ণের মুখে খেলে যাওয়া স্মিত হাসির মর্ম সেমুহুর্তে বোঝেন নি রাধাওশুধু জলভরা চোখ একসময় ঝাপসা করে দিল অপসৃয়মান প্রেমাস্পদকে।

শক্তিশালী মগধ সাম্রাজ্যের অধীনস্ত ছিল মথুরারাজ কংস, তেমনি চেদিরাজ শিশুপাল ছিলেন আরেকজন, তাকে ছেলের মতো ভালবাসতেন মগধ সম্রাট, জরাসন্ধ। কংসের মৃত্যু এদের কৃষ্ণের ওপরে ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল। খানিকটা সেই সব কারণেই মথুরা ছাড়ার পরিকল্পনা করেছিলেন কৃষ্ণ ও বলরাম। এরই মধ্যে কৃষ্ণের অদ্ভুত ক্ষমতার কথা ছড়িয়ে পরেছিল চারদিকে, কংসের বোন পুতনাকে হত্যা করার সময় পাওয়া খবর একসময় কানে পৌঁছেছিল বিদর্ভরাজ ভীষ্মকের কানেও। জানতে পেরেছিলেন তার প্রিয়, হারিয়ে যাওয়া মেয়ে রুক্মিণী বড় হচ্ছে বৃন্দাবনে এক জমিদার গৃহে।

জানার পর আর দেরী করেননি রাজা ভীষ্মক, সাথে সাথে চলে গিয়েছিলেন বৃন্দাবনে, ফিরিয়ে এনেছিলেন কন্যা রুক্মিণীকে নিজের কাছে। খুশি হয়েছিল ভাই রাজপুত্র রুক্মিওমনে মনে ঠিক করে নিয়েছিল, বোনের সাথে বিয়ে দেবে বন্ধু শিশুপালের। এইভাবে মগধের সাথেও আত্মীয়তার একটা সম্পর্ক গড়ে উঠবে। কিন্তু বোনের মনে যে সারাক্ষণ কৃষ্ণই ঘুরছে। বাবাকেও জানিয়েছে যে ছোটবেলা থেকেই মনে মনে সে কৃষ্ণকেই পতি রূপে চেয়ে এসেছে। ভীষ্মকও রাজি হন নি মেয়ের কথায়। তিনি মেয়ের জন্য স্বয়ংবর সভার ব্যবস্থা করবেন ঠিক করলেন। দিনক্ষণও ঠিক হয়ে গেল। সেদিন রুক্মিণী সখীদের সাথে নিয়ে গেছিলেন মন্দিরে পুজো দিতে, খানিকটা পরিকল্পনা করেই।

মন্দির থেকে বেরোনো মাত্র কৃষ্ণ রুক্মিণীকে তুলে নিলেন তার রথে, প্রশিক্ষিত অশ্বেরা দ্রুতবেগে ছুটল দূর থেকে দূরান্তরে। খবর পেয়ে বিরাট সৈন্যদল নিয়ে বাধা দিতে এল রুক্মি, বিদর্ভরাজের ছেলে। কিন্তু মুখোমুখি হতে হল কৃষ্ণের দাদা বলরামের। সে পাহাড় ডিঙোবার সাধ্য ছিলনা কারুরই। তারা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখল কৃষ্ণের রথ ছুটে চলে যাচ্ছে দৃষ্টিসীমার বাইরে।
এতক্ষণ ঘটনার আকস্মিকতায় ভীত হয়ে কোনরকমে কৃষ্ণকে আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিল রুক্মিণী। বিপদসীমার বাইরে পৌঁছে গতি শ্লথ করে, রুক্মিণীকে একহাতের বেষ্ঠনীর মধ্যে টেনে নিল কৃষ্ণ। মুখ তুলে তাকিয়ে রাধা বললেন, এই জন্যই সেদিন অমনভাবে হেসেছিলে তুমি শ্যাম? সেই সেদিন যেদিন আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসেছিলে? আমি জানতাম একটা না একটা উপায় তুমি করবেই। আমি ভাবতেও পারছিনা, আমি এখন থেকে সারাজীবনের জন্য তোমার কাছেই থাকব। আনন্দে, আবেগে, আবেশে কৃষ্ণকে জড়িয়ে ধরল রাধারাণী মানে রুক্মিণী।

কৃষ্ণ একটা বড় সরোবরের পাশে তখন দাঁড় করিয়েছেন রথ। এতক্ষণ ছুটে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া ঘোড়াদুটিকে একটু খাওয়ার, জল পান করার সুযোগ করে দেবার জন্য। মাথার ওপরে ঝলসাচ্ছে প্রবল সুর্যের তাপ। সামান্য আচ্ছাদনের নীচে দাঁড়িয়ে রাধার অর্থাৎ রুক্মিনির চিবুক ধরে মুখটা তুলে কৃষ্ণ চোখ রাখলেন চোখে। বললেন, আজ থেকে ভুলে যাও রাধা বলে কেউ ছিল, আমাদের পরে যখন আমাদের কাহিনী লেখা হবে, মানুষ রাধাকে খুঁজে পাবে না কোথাও। বৃন্দাবনের গোপালিকা রাধা হারিয়ে গেছে বিস্মৃতির অরণ্যে। শুধু বেঁচে থাকবে কৃষ্ণের রাজমহিষী রুক্মিণী। বিদর্ভরাজ ভীষ্মকের কন্যা রুক্মিণী। মহাভারতের পাতায় তাঁকেই খুঁজে পাবে সবাই। রাধাকে নয়। মনে রেখো এটা।

রুক্মিণী প্রতিবাদ করলেন না। মেনে নিলেন তার প্রিয়তমের কথা। বৃন্দাবনের রাধা বিদর্ভরাজ্যের সীমায় থমকে দাঁড়ালো শেষবারের মতো, তারপর রুক্মিণী হয়ে এগিয়ে চলল তার প্রেমাস্পদের রাজত্ব দ্বারকার দিকে।

--শেষ--
DEBASIS MUKHOPADHYAY
VILL-SOUTH CHECHAKHATA
POST-ALIPURDUAR JUNCTION
DIST-ALIPURDUAR, 736123
M/NO-9932384283, 9836651834

সম্পাদিকা চেয়েছেন তথ্যসূত্র। তাই দিতেই হবেঃ- প্রথমত এই পৌরাণিক ঘটনা অবলম্বনে একটি মনগড়া গল্পমাত্র, যা আমি নিজে খানিকটা বিশ্বাসও করি, (যদি এর মধ্যে বিশ্বাসযোগ্য কিছু থাকে তবেই)। তবুও এই মনগড়া লেখাটা লেখার জন্য আমাকে সাহায্য নিতে হয়েছে অন্তর্জালের, উন্মুক্ত বিশ্বকোষের। তারপর একসময় খানিকটা উৎসাহী হয়েই পড়ে ফেললাম ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, জয়দেবের গীতগোবিন্দ, বাংলা সাহিত্যের কিছু অধ্যায়, মহাভারত আবারো। এমনকি বৈষ্ণব সাহিত্যের কিছু অংশও। বলতে বাধা নেই, খারাপ লাগেনি খুব একটা। রাধা কৃষ্ণের এই সম্পর্কের, কৃষ্ণের পরাক্রম, নানান অলৌকিক কান্ড কারখানা ঘটানোর ব্যাপারটা ছোট থেকেই মন কাড়তো, এখন বড়বেলায় আবারো তা পড়ার সুযোগ পেলাম, সৌজন্য অবশ্যই শ্রীযুক্তা সোনালী মিত্র। উনি এমন কোন একটা লেখা দিতে বলেছিলেন বলেই বেশ কয়েকটা বিষয় নিয়ে কদিন ফেলে আসা, ছেড়ে আসা বইপত্রের সাথে আবারো সখ্যতা বাড়ল, এটাই আমার প্রাপ্য। ভবিষ্যতে অশ্বথামা, পরশুরাম, হিড়িম্বা ইত্যাদিদের নিয়েও কিছু লেখার বাসনা রয়ে গেল মনে। তাদের নিয়ে পড়াশুনো এখনো জারি রেখেছি।  

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)