বীরাঙ্গনা তুলু রানি
……………………………
রাজা লক্ষ্মাপ্পাকে দ্রুতপদে অন্তপুরে আসতে দেখে রানির পরিচারিকা মাল্লো পথ থেকে সরে দাঁড়াল। সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে লক্ষ্মাপ্পা জিজ্ঞাসা করলেন, মহারানি কোথায় ? নতমুখে মাল্লো জবাব দিল, মহারানি নিজের ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছেন।
~ তাঁকে একবার ডেকে দাও। বলো আমার বিশেষ প্রয়োজন। কথাটা বলেই লক্ষ্মাপ্পা আলাপকক্ষে প্রবেশ করলেন। তাঁর চোখেমুখে চিন্তার লেশমাত্র নেই। বরং দেখে মনে হচ্ছে কোনো কারণে তিনি রেগে আছেন। এমন কিছু নিশ্চয়ই ঘটেছে যাতে তিনি ক্রুদ্ধ। মাল্লো পরিচারিকা। তার এইসব বিষয়ে কৌতূহল থাকা উচিত নয়। তাই সে নীরবে রানির বিশ্রামকক্ষের দিকে চলে গেল।
রানি আবাক্কা ব্যক্তিত্বময়ী। দিবালোকে তিনি যখন বিশ্রামকক্ষে থাকেন, তখন রাজা সেখানে প্রবেশ করেন না। আবাক্কা পছন্দ করেন না যখনতখন রাজার প্রবেশ। এমনকি মাল্লো বা মিন্তি ছাড়া তাঁর বিশ্রামকক্ষে কেউ সচরাচর প্রবেশ করে না। প্রবেশের পূর্বেও অনুমতি নিতে হয় পরিচারিকাদেরও।
এই প্রাসাদে একটি ভিন্ন আলাপকক্ষ আছে। সেখানে আছে দুটি সাদামাটা সিংহাসন ও কয়েকজনের বসার জন্য বেদি। রানির সঙ্গে শলাপরামর্শ করতে হলে রাজা এই কক্ষে আসেন। দিবাভাগেই সাধারণত আলোচনা করেন। রানির বুদ্ধিমত্তা এবং রাজত্ব পরিচালনার অভিজ্ঞতা আছে। বহুবার রাজা আবাক্কার সঙ্গে পরামর্শ করে তাঁর বুদ্ধিকৌশলে বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়েছেন লক্ষ্মাপ্পা। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই ভরসাও করেন আবাক্কাকে। রানি এলেই এই সিংহাসনদুটি ব্যবহৃত হয়। অন্য কারও সঙ্গে আলোচনার সময় তাঁরা বেদিতে বসেন। রাজা ও রানি ব্যতিরেকে আর কারও সিংহাসনে বসার অধিকার নেই।
মাল্লো তাড়াতাড়ি রানি আবাক্কাকে রাজার তলব-সংবাদ জানাল। আবাক্কা খানিকটা অবাক হলেন। এইসময় তো ডাকার কথা নয়। রাজ্য ও রাজত্ব সম্পর্কে আবাক্কা যথেষ্ট খোঁজখবর রাখেন। বহুদিন হল রাজ্যে কোনো সংকটের উদয় হয়নি। সামান্য যা ঝঞ্ঝাট দেখা দেয় তা লক্ষ্মাপ্পা তাঁর মন্ত্রীমণ্ডলীর সাহায্যে সমাধা করে নেন। এমন কিছু তো ঘটেনি যে তাঁকে তলব করলেন রাজা ! তাহলে কি পোর্তুগিজরা কোনো সমস্যা সৃষ্টি করল? চিন্তিত মুখে আবাক্কা আলাপকক্ষে এলেন।
তখনও রানি সিংহাসনে বসেননি। তার আগেই লক্ষ্মাপ্পার প্রশ্ন ভেসে এল।
~ তুমি নাকি আমার রাজ্যে পোর্তুগিজদের মশলা ব্যবসা করায় আপত্তি জানিয়েছ?
নিজের আসনে বসে আবাক্কা তাকালেন লক্ষ্মাপ্পার দিকে। তাহলে পোর্তুগিজরাই মূল কেন্দ্রে ! রাজার 'আমার রাজ্য' কথাটাও তিনি খেয়াল করেছেন। তাঁর চোয়াল কঠিন হয়ে উঠল। তিনি জবাব দিলেন, আপনি ঠিকই শুনেছেন রাজা। মহামন্ত্রীকে আমি বলেছি পোর্তুগিজরা যেন আমাদের রাজ্যে ব্যবসা করার অধিকার না-পায় সেটা দেখতে।
আবাক্কা মাঝেমাঝেই এভাবে রাজ্য পরিচালনার ব্যাপারে পরামর্শ দেন। মহামন্ত্রীকে ডেকে পাঠিয়ে তাঁর বক্তব্য জানান। লক্ষ্মাপ্পা কোনো কারণে ব্যস্ত থাকলে তখন রানি প্রয়োজনে রাজ্য পরিচালনায় মতামত দেন। লক্ষ্মাপ্পা এ নিয়ে কখনও আপত্তি জানাননি। বরং আবাক্কার বুদ্ধিমত্তায় খুশিই হন। আজ রানির এই নির্দেশনায় তিনি ভীষণ বিব্রত ও অখুশি হয়েছেন।
~ কিন্তু কেন? লক্ষ্মাপ্পার কণ্ঠে স্পষ্টতই বিরক্তি। রানি সেসবে আমল না-দিয়ে বলে গেলেন, ওরা তো শুধু মশলার ব্যবসাই করবে না, ওদের দাবি সেই ব্যবসায় ভর্তুকিও দিতে হবে। এ কেমন কথা ! আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা কেন বঞ্চিত হবে? ঐ বিদেশিরা উলালেও এইরকম সুবিধা চেয়েছিল। আমার মা তা হতে দেননি। আমিও তা হতে দিতে পারি না। একটানা কথাগুলো বললেন আবাক্কা।
~ তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছ এটা তোমাদের উলাল রাজ্য নয়। এটা আমার রাজ্য। আমি এই রাজ্যের রাজা। এখানে পোর্তুগিজদের ব্যবসায় বাধা দেওয়া হবে না।
রানি বুঝলেন লক্ষ্মাপ্পা অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছেন। অধিকারের প্রশ্ন তুলছেন প্রচ্ছন্নভাবে। তাঁর কাছে রাজার এই আচরণ বিসদৃশ্য লাগছে। তবু সেসব সরিয়ে বলে গেলেন, আপনি কি পোর্তুগিজদের ভয় পাচ্ছেন মহারাজ? না-হলে দেশীয় ব্যবসায়ীদের স্বার্থ না-দেখে বিদেশিদের স্বার্থ দেখছেন কেন?
রানি আবাক্কা জানেন লক্ষ্মাপ্পা দুর্বলচিত্ত ও ভীতু। তাঁর আশংকা যুদ্ধকুশলী পোর্তুগিজরা আক্রমণ করলে রাজত্ব হারাতে হতে পারে। এমনকি প্রাণসংশয় হওয়াটাও অসম্ভব নয়। কেননা তাঁর রাজ্য ম্যাঙ্গালোরের সেনাপতি ও রণসম্ভার তেমন জোরালো নয়। এই কারণেই সম্ভবত রাজা পোর্তুগিজদের সঙ্গে সংঘাতে যেতে চান না।
আবাক্কা আসলে ভয় পাওয়ার কথা বলে রাজার পৌরুষে ধাক্কা দিতে চাইলেন। কিন্তু লক্ষ্মাপ্পা রানির এই ধাক্কায় বেসামাল হলেন না। বরং স্বীকারই করে নিলেন।
~ হ্যাঁ, আমি যুদ্ধের ভয় পাচ্ছি। ওরা যোদ্ধার জাত। ওদের অস্ত্রসম্ভারও আমাদের থেকে উন্নত।
~ তেমন বুঝলে উলালকেও সঙ্গে পাবেন রাজা। আপনি অযথা বিচলিত হবেন না।
~ আমি যা ভালো বুঝেছি সেটাই করতে চাই। ওরা ব্যবসা করুক। আমাদের তেমন একটা ক্ষতি তো নেই।
~ ক্ষতি নেই বলছেন? আমাদের দেশীয় ব্যবসায়ীরা বঞ্চিত হবেন। তাঁরা ব্যবসায় ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। তাছাড়া বিদেশিদের এভাবে আস্কারা দিলে ওরা রাজ্যের নানা বিষয়ে নানাভাবে নাক গলাবে। সেটা তো কাম্য নয় !
লক্ষ্মাপ্পা কঠিন চোখে তাকালেন রানির দিকে। তাঁর মুখে কোনো ভাষা নেই। কিন্তু চোখে আগুন জ্বলে উঠল। রানি আবাক্কা এবারও রাজার অভিব্যক্তিকে গুরুত্ব না-দিয়ে বরং আবারও মানসিক আঘাত হানতে চাইলেন। তাঁর ইচ্ছে যেভাবেই হোক রাজার এই দুর্বলতাকে নিবৃত্ত করা আর পোর্তুগিজদের ব্যবসায়িক সুবিধা দেওয়া থেকে বিরত করা।
~ আমার মা আর মাসি বিদেশিদের দৌরাত্ম্যকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেননি। ওদের আধিপত্য মেনে নেননি। বরং প্রয়োজনে যুদ্ধ করে পরাস্ত করেছেন। আমিও বিদেশিদের ভয় পাই না। আমাদের উলালে বাণিজ্যের অধিকার পেতে ব্রিটিশ আর ওলন্দাজরা চেষ্টা করেছিল। আমরা তা প্রতিহত করেছি। আসলে আপনি যুদ্ধ করতে ভয় পান। তার চেয়ে বিলাশে জীবন কাটানোই আপনার শ্রেয় মনে হয়।
~ রানি আবাক্কা, মনে রাখলে ভালো হয় এটা উলাল নয়। ম্যাঙ্গালোরের বঙ্গ বংশীয় দ্বিতীয় নরসিংহ লক্ষ্মাপ্পা আরসা এই রাজ্যের রাজা। এখানে আমার কথাই শেষ কথা। আমি ওদের একচেটিয়া ব্যবসার অনুমতি দেবো। আর ভর্তুকিও মঞ্জুর করব।
~ এটা যে আপনার রাজ্য তা আমি বিলক্ষণ অবগত আছি। কিন্তু আমিও এই রাজ্যের রানি। এর আগেও নানাভাবে আমি আপনাকে পরামর্শ দিয়েছি এবং তাতে আপনার ক্ষতি হয়নি। সেটাও আশাকরি বিস্মিত হননি আপনি।
রানির কথা শেষ হওয়ার আগেই রাজা চলে গেলেন আলাপকক্ষ ছেড়ে। রানির শেষ বাক্যগুলো হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
কয়েকদিন এই নিয়ে তীব্র বাদানুবাদ হল দুজনের মধ্যে। আবাক্কা কিছুতেই রাজার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছেন না। ইতিমধ্যে তাঁর কাছে খবর আসে রাজা সত্যিই পোর্তুগিজদের বাণিজ্যিক অধিকার ও ভর্তুকির অনুমতিপত্রে স্বাক্ষর করে পাঠিয়ে দিয়েছেন। খবরের সত্যতা সম্পর্কে নিঃসংশয় হওয়ার পর আবাক্কা সিদ্ধান্ত নিলেন, আর এখানে থাকা যাবে না। চিরশত্রু পোর্তুগিজদের দাবির কাছে তাঁর স্বামী বা রাজার এই নতজানু হওয়া চূড়ান্ত অবমাননাকর। এখান থেকে তিনি ফিরে যাবেন নিজ অধিকারের রাজপাটে।
আবাক্কা চৌথা তৃতীয় তিরুমলরায়ের ভগ্নীকন্যা। তাঁর মা প্রথম আবাক্কা। চৌথাদের রাজত্বে আলিয়াসন্তানা কাত্তু প্রথা প্রচলিত। যা আসলে ভাগিনেয় ধারা। পুত্রের সন্তানের পরিবর্তে কন্যার সন্তান পাবে রাজত্ব। প্রথম আবাক্কার কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। তাই তাঁর কন্যা দ্বিতীয় আবাক্কাই ভাবীকালের রানি হবেন এমনই নির্ধারিত আছে। আবাক্কা খালি পায়ে থাকেন তাঁর মা ও মাসির মতোই। এমনকি তিনি সাদা রাজছত্রও ব্যবহার করেন না অন্য রানিদের মতো। তালপত্র বা সুপারিপত্রের রাজছত্র তাঁর শিরের উপর শোভা পায়। এই রাজ্যের রীতি হল, উলালের রানি প্রতিবেশী কোনো রাজাকে বিবাহ করে সংসার করবেন। সেই রাজার ঔরষজাত সন্তান পাবে উলালের রাজত্বের অধিকার। এই রীতি চলে আসছে যুগান্ত ধরে।
উলালের প্রতিবেশী রাজ্য ম্যাঙ্গালোরের রাজা লক্ষ্মাপ্পার সঙ্গে আবাক্কার বিবাহ দেন তাঁর মামা তিরুমলরায়। আবাক্কার মামা ভাবীরানির কথা চিন্তা করে কৈশোরেই আবাক্কালে অসিচালনা, যুদ্ধকৌশল, কূটনীতি, অশ্বারোহণ, সেনাপরিচালনা ইত্যাদি রাজপাট সামলাতে যা-যা বিষয়ে দক্ষতা আবশ্যক সেই সমস্ত শিক্ষা দিয়েছেন। আবাক্কাও এইসব বিষয়ে নৈপুণ্য অর্জন করেছেন। দেশীয় রীতি অনুসারে আবাক্কা যদি এখন ফিরে যান উলালে, তাহলে তাঁর হাতে চলে আসবে সেখানকার রাজপাট। তারপরই পোর্তুগিজদের স্পর্ধা তিনি বুঝে নিতে চান। সেইসঙ্গে লক্ষ্মাপ্পাকেও বুঝিয়ে দিতে চান যে আবাক্কা ভীরু নন।
(২)
দিনের আলো নিবে গেছে খানিক আগে। সন্ধ্যায় রাজপ্রাসাদে একে একে জ্বলে উঠছে দীপালোক। রাজা লক্ষ্মাপ্পা রাজ্য সংক্রান্ত গুরুতর আলোচনার জন্য দরবারে বসে আছেন সভাসদদের সঙ্গে। ঠিক সেইসময় রানি আবাক্কা দুই শিশুকন্যা আর নিজের সমস্ত অলংকার সামগ্রী নিয়ে গোপনে ভেসে পড়লেন নেত্রবতী নদীতে। শুধুমাত্র মাল্লো তাঁর চিরবিদায়ের কথাটি জানে। তাঁদের বেরিয়ে যাওয়ার সময় অন্য কয়েকজন পরিচারিকা দেখে ফেলেছিল। কিন্তু এইরকমভাবে রানি মাঝে মাঝে বিহারে যান। তাই এই নিয়ে সম্ভবত কারও মনে কোনো সংশয় দেখা দেয়নি।
রানি আবাক্কার পালতোলা নৌকো এগিয়ে চলেছে উলালের দিকে। নেত্রবতী নদীর তীরে থাকা দু-একজন রানির এই যাত্রা সম্পর্কে অবহিত হল। তাদেরই কেউ সম্ভবত রাজার কানে রানির অন্তর্হিতের খবর পৌঁছে দিয়েছে। কিংবা অন্তপুরের কেউ হয়তো রানির গোপন অভিসন্ধি জেনে গেছে। তার থেকেও রাজা খবরটা পেতে পারেন। এমন একটা সম্ভাবনার কথা রাজাও ভেবে রেখেছিলেন। তাই রানির উপর নজর ছিল। রানির চলে যাওয়ার খবর পেয়ে লক্ষ্মাপ্পা দ্রুত লোকলস্কর পাঠালেন। রানিকে ধরে আনা হল রাজার কাছে। কিন্তু আত্মসম্মান বজায় রেখে এই রাজপ্রাসাদে যে আর থাকা সম্ভব নয়, রানি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন লক্ষ্মাপ্পাকে। অনেক বাকবিতণ্ডার পর দিন কয়েক পরে আবাক্কা তাঁর দুই কন্যাসহ ফিরে গেলেন উলালে, তাঁর নিজের জায়গায়। রীতি অনুসারে উলালের উত্তরাধিকার গ্রহণ করে তিনি হলেন সেখানকার রানি। তাঁদের মাতৃভাষা তুলু। তাই অনেকেই তাঁকে তুলু রানি বলেও ডাকে।
আবাক্কা প্রথমেই দূত পাঠালেন বেদনুরের রাজা ভেঙ্কটপতি নায়েকের কাছে। মৈত্রী গড়তে চান তিনি। ভেঙ্কটপতিও তুলু রানির মৈত্রীপ্রস্তাব হৃষ্টচিত্তে গ্রহণ করেছেন। তিনি জানেন আবাক্কা বুদ্ধিমতী, বন্ধু্বৎসল। তাই ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে তাঁর সহায়তা পাবেন। এদিকে আবাক্কার ভাবনাতেও ভেঙ্কটপতির প্রয়োজনীয়তা প্রকট। আসলে চিরশত্রু পোর্তুগিজদের কাছে লক্ষ্মাপ্পার আত্মসমর্পণ কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না তিনি। লক্ষ্মাপ্পার সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কও চুকেবুকে গেছে। ভেঙ্কটপতির সঙ্গে লক্ষ্মাপ্পার সম্পর্ক সম্প্রতি ভালো নয়। একইসঙ্গে তিনি পোর্তুগিজদের আধিপত্যও খর্ব করতে চান। তাই ভেঙ্কটপতির সঙ্গে মৈত্রী গড়ে লক্ষ্মাপ্পাকে শায়েস্তা করার সংকল্প নিলেন আবাক্কা। চরম প্রতিহিংসা নিয়ে বেদনুরের সেনাদের সাহায্যে লক্ষ্মাপ্পার রাজ্য আক্রমণ করলেন রানি। ভেঙ্কটপতি নিজে এই যুদ্ধে তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালেন। আবাক্কার সেনারা লক্ষ্মাপ্পার দুর্গ আগুনে ভস্মীভূত করে দিল। আবাক্কার ইচ্ছে করছিল যুদ্ধে পর্যুদস্ত লক্ষ্মাপ্পার মাথাটা ধড় থেকে আলাদা করে দিতে। কিন্তু চৌথাদের রণনীতি হল পরাজিত রাজাকে হত্যা করা যাবে না। যুদ্ধে যদি প্রাণ যায় তাহলে আলাদা কথা।
লক্ষ্মাপ্পা প্রাণে বাঁচলেন বটে, কিন্তু প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলে উঠলেন। পোর্তুগিজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করলেন রানির বিরুদ্ধে। আবাক্কাকে চরম শাস্তি দিতে হবে। পোর্তুগিজরাও সুযোগ খুঁজছিল। লক্ষ্মাপ্পার ডাকে সাড়া দিল তারাও। এদিকে আবাক্কা বুঝলেন এবার শুধু ভেঙ্কটপতিকে দিয়ে হবে না। এই কঠিন লড়াই লড়তে গেলে অন্য কারও সাহায্য দরকার। তাছাড়া ভেঙ্কটপতির আচরণও সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। তলে তলে লক্ষ্মাপ্পার সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলছেন বলেও খবর কানে আসছে আবাক্কার। সত্যিমিথ্যে জানেন না তিনি। এখন এতকিছু ভাবারও সময় নেই তাঁর। মালাবারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন অতি সন্তর্পণে। এখানকার মোপালারা যুদ্ধনিপুণ। বিয়ারি আর মোগাবির সম্প্রদায় ভয়ংকর জেদি যোদ্ধাজাত। এদের সাহায্য পেলে পোর্তুগিজদের সঙ্গে লড়াই করা অনেক সহজ হবে। সেইসঙ্গে কালিকটের রাজা জামেরিনের সঙ্গেও সখ্য গড়ে তুললেন।
ইতিমধ্যে পোর্তুগিজরা উলালের সঙ্গে কালিকটের মৈত্রী অবৈধ ঘোষণা করেছে। পারস্যের সঙ্গেও বাণিজ্য নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। আবাক্কা ভীষণ ক্রুদ্ধ হলেন। জামেরিনও প্রবল বিক্রমে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন আবাক্কার দিকে। যুদ্ধের জন্য মনে মনে প্রস্তুত হলেন আবাক্কা। এমন সময় পোর্তুগিজরা তাদের প্রতিনিধি পাঠিয়ে কর দাবি করল উলালের কাছে।
~ এত বড় স্পর্ধা আপনাদের ! বিদেশি হয়েও দেশীয় রাজ্যের থেকে কর চান? কোন অধিকারে কর চাইছেন? আমরা কি আপনাদের করদ রাজ্য?
পোর্তুগিজ প্রতিনিধি দোম আলভারো দ্য সিলভিয়েরার চোখে আগুন। আবাক্কা সেই আগুন উপেক্ষা করে অ্যাডমিরাল আলভারোকে জানিয়ে দিলেন, ফিরে যান আপনি। জানিয়ে দিন আমি কর তো দেবোই না, বরং যুদ্ধ করে আপনাদের এদেশ থেকে তাড়িয়ে ছাড়ব।
এরপর স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হল। যুদ্ধ শুরুও হয়ে গেল। ভয়ংকর সেই যুদ্ধ। রানি জয়ী হতে পারলেন না। তবে পোর্তুগিজরাও আর এগোতে সাহস পেল না। যে বিক্রমে রানির সেনাবাহিনী, জামেরিনের সেনাবাহিনী আর মোপালারা যুদ্ধ করেছে, তাতে আপাতত পিছু হঠাই শ্রেয় মনে করেছে পোর্তুগিজরা। তবে যে লক্ষ্মাপ্পার সঙ্গে তাদের সখ্য গড়ে উঠেছিল, সেই লক্ষ্মাপ্পার ম্যাঙ্গালোর লুঠ করল পোর্তুগিজরা। কেননা তাদের রসদ চাই। অস্ত্রশস্ত্র চাই। এ সংবাদে প্রথমে খানিকটা খুশিই হয়েছিলেন আবাক্কা। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝলেন পোর্তুগিজদের বাড়বাড়ন্ত প্রতিহত করা দরকার। ম্যাঙ্গালোর তাঁর শত্রুরাজ্য হলেও দেশীয় রাজ্য। সেখানে বিদেশিরা লুঠ করবে ! একসময় তাঁর রাজ্য বা অন্য রাজ্যও লুঠ করতে পারে ! আবাক্কা সেনা পাঠিয়ে অতর্কিতে আক্রমণ করলেন পোর্তুগিজ শিবিরে। বিধ্বস্ত পোর্তুগিজরা এই আক্রমণে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল।
আসরে নামলেন তাদের গর্ভনর আন্তোনিও দ্য নোরোনহা। অ্যাডমিরাল দোমের কাছে খবর পাঠালেন তীব্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে। রণকৌশলও বুঝিয়ে দেন তিনি। আন্তোনিওর নির্দেশে গোপনে আবাক্কার কুশলী কয়েকজন সেনাপতিকে অজস্র রুপোর উপঢৌকন দিয়ে কিনে নিল পোর্তুগিজরা। পোর্তুগিজদের আক্রমণে রানি আবাক্কা পিছু হটতে বাধ্য হলেন।
বিশ্বাসঘাতক সেনাদের জন্য পরাস্ত আবাক্কা দিশেহারা। সেইসময় ধর্মপ্রাণ মসজিদপ্রধান জৈন রানিকে সপার্ষদ আশ্রয় দিয়েছেন। এদেশের রানি তিনি। ভিন্ন ধর্মের হলেও মুসলমান ধর্মের প্রতি তাঁর বিরাগ নেই। বরং অনুরাগই দেখান। এমন একজন রানির বিপদে তাঁর পাশে দাঁড়ানো কর্তব্য মনে করেছেন তিনি।
রানির অনুরোধে মসজিদের বেশিরভাগ বাতি নিভিয়ে দেওয়া হল। চারিদিক নিস্তব্ধ। যে বাতিগুলো জ্বলছে সেগুলোও স্তিমিত করে রাখা আছে। স্বল্পালোকে রানি আবাক্কা বিশ্বস্ত সেনাপতি ও আমাত্যদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করলেন।
~ আজ রাতেই আমাদের আঘাত হানতে হবে। স্পষ্ট জানালেন রানি।
~ কিন্তু রানিমা, ওরা যে রাজপ্রাসাদও দখল করে নিয়েছে। তার উদ্ধার…
~ জানি। কিন্তু ভয় পাবেন না। ঐ রাজপ্রাসাদ আবার আমি ফিরে পাবো। পেতেই হবে। লড়াইয়ের জন্য আপনারা প্রস্তুত তো?
~ হ্যাঁ রানিমা, আমরা প্রস্তুত। সমস্বরে জানালেন দু-তিনজন মন্ত্রী ও সেনাপতি। কেউ কেউ এমনও জানালেন যে প্রয়োজনে জীবন বাজি রেখেও লড়াই চালাবেন তাঁরা।
রাতের অন্ধকারে আবাক্কা চললেন পোর্তুগিজদের আক্রমণ করতে। তাঁর সঙ্গী তখন দুশোর কাছাকাছি সেনা। রানির প্রখর বুদ্ধি আর রণকৌশল সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল সকলে। উলালের রাজপ্রাসাদ জয়ের উল্লাসে তখন মেতে আছে পোর্তুগিজরা। আবাক্কার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল তাদের ওপর। নিজের তরবারিতে রানি হত্যা করলেন জেনারেল পিসাতোকে। বাকিদের কেউ প্রাণ হারাল। কেউ আহত হল। বন্দি হল অনেক।
~ বন্দিদের নিয়ে কী করব রানিমা? জিজ্ঞাসা করলেন সেনাপতি।
~ কতজন?
~ ষাট-সত্তর জন হবে।
~ সবাইকে নিয়ে চলো আমাদের সঙ্গে।
ক্রুর হাসি ঝুলিয়ে চলে গেলেন সেনাপতি। অবশেষে রাজপ্রাসাদ পোর্তুগিজদের দখলমুক্ত হল। রানি ফিরে পেলেন তাঁর নিজস্ব আস্তানা।
দিন দুয়েক পরে ম্যাঙ্গালোর আক্রমণ করলেন আবাক্কা। সেখানে শিবির তৈরি করে আছে পোর্তুগিজরা। এবারও পর্যুদস্ত হল তারা। অ্যাডমিরাল মাসকারেনহাসের রক্তে রঞ্জিত হল রানির তরবারি। তিনি নিহত হলেন। পোর্তুগিজরা বুঝে গেল এই রানি অন্য ভারতীয় রাজন্যের মতো নন। যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিনী তিনি। অসম্ভব সাহসিনী। কিন্তু তারাও কুশলী বণিক। যুদ্ধবাজ জাতি। এত সহজে তারা হাল ছাড়তে রাজি নয়। তাই বারবার হানা দিল উলালের সাম্রাজ্যে।
আবাক্কার উলালের সঙ্গে এরপরেও পোর্তুগিজদের বার কয়েক যুদ্ধ হয়েছে। কখনও আবাক্কা জিতেছেন। কখনও পোর্তুগিজরা জয় হাসিল করেছে। শেষবার পরাজিত আবাক্কাকে বন্দি করতে সক্ষম হয় পোর্তুগিজরা। কয়েদখানায় বিষণ্ন রানিকে দেখে উলালের অন্য বন্দিরাও যন্ত্রণা অনুভব করে। ক্ষোভে দুঃখে উলালবাসী অশ্রুমোচন করতে থাকে অসহায়ভাবে। বাতাসের ডানায় ভেসে বেড়ায় তাদের হাহাকার। কিন্তু শেষপর্যন্ত আবাক্কার কী হল কেউ জানতে পারল না।
হাওয়ায় হাওয়ায় তুলোবীজের মতো নানা কল্পকাহিনী উড়ে বেড়ায়। আবাক্কা নাকি কারাগারে বিদ্রোহ করেছেন আর কারারক্ষীদের সঙ্গে লড়াইয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। রানি আবাক্কা কৌশলে কারাগার থেকে পালিয়ে পশ্চিমঘাট পর্বত অতিক্রম করে বহুদূরে চলে গেছেন, এমন সংবাদও বাতাস বহন করে আনে উলালের ঘরে ঘরে। কেউ আবার দুঃসংবাদ বয়ে আনে, রানি চরম মানসিক বিপর্যয়ে আত্মহত্যা করেছেন।
রানির জন্য হাহাকার ছড়িয়ে পড়ে উলালের সর্বত্র। যন্ত্রণার রেণু ভেসে বেড়ায় এদিকে-সেদিকে। ইতিহাস বুকে আগলে রাখে বীরঙ্গনা রানি আবাক্কাকে।তাঁর শেষ পরিণতি অজানার অন্ধকারে ঢাকা পড়ে থাকে।
…………………………………………….……………
তথ্যসূত্র ~ দক্ষিণ ভারতের ইতিহাস এবং অন্তর্জাল।
[ রানি আবাক্কা সম্ভবত ভারতের প্রথম বীরাঙ্গনা নারী, যিনি প্রবল বিক্রমে ঔপনিবেশিক পোর্তুগিজদের বিরুদ্ধে আমৃত্যু যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু ভারতীয় ইতিহাস তাঁকে সেভাবে মনে রাখেনি। আমাদের ইতিহাসবিদরা, দক্ষিণ ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে ঔদাসিন্যের কারণেই হোক বা অন্য কারণে, রানি আবাক্কার কাহিনী সেভাবে তুলে আনেননি। যে কতিপয় দক্ষিণের ঐতিহাসিক আবাক্কার সংগ্রামকে মর্যাদা দিয়েছেন, তাও তেমন সমুজ্জ্বল নয়। মালাবার অঞ্চলের এই রাজ্যের রানি প্রথম আবাক্কা ইংরেজ ও ওলোন্দাজদের তাঁর সাম্রাজ্যে ব্যবসা করার অধিকার দেননি। তার আগে তাঁর দিদি ছিলেন রাজ্যের রানি। দিদির অকালমৃত্যুর পরে প্রথম আবাক্কা রানি হন। তাঁর সাহসিকতা ও বীরত্ব ছিল অসামান্য। কিন্তু বিদেশিদের সঙ্গে সেই অর্থে যুদ্ধ করতে হয়নি সেভাবে। কিন্তু তাঁদের কন্যা দ্বিতীয় আবাক্কা ছিলেন অসম্ভব বুদ্ধিমতী, বীরাঙ্গনা, যুদ্ধকুশলী। তিনি পোর্তুগিজদের অন্যায় আবদার বরদাস্ত করেননি। আমরণ তিনি বিদেশিদের প্রতিহত করার চেষ্টা করে গেছেন। তাঁর আত্মত্যাগের কাহিনী তুলু সাম্রাজ্য ছাড়িয়ে সমগ্র দক্ষিণ ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল। দীর্ঘকাল এই সাম্রাজ্য স্থায়ী হয়েছিল। ষোড়শ শতাব্দীর রানি আবাক্কার সেই সাম্রাজ্যের পতন হয় ১৮২২ সালে ব্রিটিশদের হাতে। তিনি, দ্বিতীয় আবাক্কা, তুলু রানি নামেও পরিচিত ছিলেন। তুলু হল মালাবার অঞ্চলের একটি ভাষা। আজও সে ভাষা প্রচলিত। বীরাঙ্গনা তুলু রানি ভারতের ইতিহাসের এক বরেণ্য চরিত্র। এটি সেই অর্থে কোনও ঐতিহাসিক গল্প নয়। গল্পের আঙ্গিকে ইতিহাসকে তুলে আনার প্রচেষ্টা মাত্র। ]
সুচিন্তিত মতামত দিন