জয়ন্তী অধিকারী - মায়াজম

Breaking

১৪ জুন, ২০১৯

জয়ন্তী অধিকারী








একটি মুক্তা,পাটিগণিত ও লীলাবতী
                             



র্য, আপনারা আমাকে অপমান করছেন ! ”
জ্যা মুক্ত শরের মত তীব্রবেগে উঠে দাঁড়ালেন ভাষ্করাচার্য ,আহত ক্রোধে তাঁর ললাটের উর্দ্ধপুন্ড্র জ্বলে উঠল।
“শান্ত হোন আচার্যদেব,আপনি উজ্জয়িনী মানমন্দিরের প্রধান জ্যোতির্বিদ,সসাগরা ধরণীর সর্বশ্রে্ষ্ঠ  গণিতজ্ঞদের অন্যতম। আমাদের স্পর্ধা কী, যে আপনার অবমাননা করি ! আপনার কন্যা লীলাবতীর নিশ্চিত বৈধব্যযোগ তো আপনারই গণনার ফল,দেবতা। অকপটে আপনি তা আমাদের গোচরীভূত করেছেন,এ আপনার অসীম মহত্ব। কিন্তু চিন্তা করুন,আমার একমাত্র পুত্রটির পরমায়ুর প্রশ্নও গভীরভাবে  জড়িত রয়েছে এই বিবাহের সঙ্গে। এ যদি আপনার পুত্র হত,আপনিও কি একই ভাবে দ্বিধাদীর্ণ হতেন না?”

ভাষ্করাচার্য  আত্মসংবরণ করলেন- তিনি প্রবাদপ্রতিম পন্ডিত দৈবজ্ঞ চূড়ামণি মহেশ্বরাচার্যের পুত্র,পারিবারিক ঐতিহ্য ও জ্ঞানচর্চার ধারক, ,কোন অবস্থাতেই তাঁর ধৈর্যচ্যুতি অভিপ্রেত নয়,  সম্ভাব্য বৈবাহিকদের সকাশে তো নয়ই। তিনি নিম্নকণ্ঠে বললেন,
“আমাকে ক্ষমা করবেন ,কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার আচরণ সর্বদা যথাযথ হয় না। আপনার পুত্রটি তো আমারও সন্তানসম,তার মঙ্গলামঙ্গলের চিন্তা আমার চিত্তে সর্বদাই জাগ্রত আছে। আমি বহু পরিশ্রম করে একটি অতিবিশিষ্ট লগ্ন গণনা করেছি,সেই লগ্নে বিবাহ সুসম্পন্ন  করলে কন্যার বিবাহিত জীবন সুদীর্ঘ ও পরমকল্যাণময় হবে। আপনারা সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত থাকুন, মহাবালেশ্বরের কৃপায় সমস্ত মঙ্গল হবে।”

“আপনার গণনায় বিশ্বাস রাখলাম আচার্যদেব।আগামী শুভলগ্নে বিবাহের আয়োজন করুন।”

দাক্ষিণাত্যের  বিজ্জলবিড় নামে এক নগরের অধিবাসী ভাস্করাচার্য। গণিত এবং জ্যোতিষ- দুই বিদ্যাতেই   তাঁর অতুলনীয় পাণ্ডিত্যের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল নগরের সীমানা অতিক্রম করে দূরদূরান্তে,এমন কী  বিদেশে। তাঁর ঊর্ধ্বতন পুরুষদের নাম যথাক্রমে ত্রিবিক্রম,ভাস্করভট্ট,গোবিন্দসর্বজ্ঞ ,,প্রভাকর,‌মনোরথ ও মহেশ্বরাচার্য,অধস্তন দুই পুরুষ  লক্ষ্মীধর ও চঙ্গদেব। এঁরা সকলেই শাস্ত্রজ্ঞানী ,পাণ্ডিত্যের জন্য এই পরিবার সর্বজনমান্য।
নিজের জন্মবৎসরের সূত্র হিসাবে  ভাস্করাচার্য লিখছেন,
“রসগুণপূর্ণমহীসমশকনৃপসময়ে ভবন্মমোৎপত্তিঃ”
অর্থাৎ তাঁর জন্ম ৬(রস) ৩ (গুণ) ০(পূর্ণ ) ১ (মহী) কে বিপরীত দিক থেকে দেখলে ১০৩৬ শকাব্দে,অর্থাৎ ১১১৪ খ্রিস্টাব্দে।

শান্ডিল্য গোত্রীয় কর্ণাটকী ব্রাহ্মণ ভাষ্করাচার্য শিক্ষালাভ করেন পিতার কাছে। পিতৃদেব  ছিলেন জ্যোতির্বিদতিলক,চতুর্বেদে পারদর্শী, বিখ্যাত অধ্যাপক ও বৃত্তশতক গ্রন্থের রচয়িতা। ভাষ্করাচার্য হয়ে ওঠেন অসাধারণ পান্ডিত্যের অধিকারী-অমূল্য গ্রন্থরচনা, শিক্ষকতা ও চালিশগাঁওতে বিবিধ গণিতচর্চার ফলস্বরূপ তাঁর খ্যাতি বহুদূর পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত হয়। তাঁর পূর্বসূরী বরাহমিহির ও ব্রহ্মগুপ্ত প্রতিষ্ঠিত  উজ্জয়িনী মানমন্দিরে  তিনি পেলেন অধ্যক্ষের পদ। বরাহমিহির  ও ব্রহ্মগুপ্তের গণিতধারাকে তিনি বহূদূর অগ্রসর করে দ্বাদশ শতকের গণিত ও মহাকাশ বিজ্ঞানের শীর্ষবিন্দুস্বরূপ হয়ে ওঠেন।
তাঁর সম্বন্ধে বলা হয়েছিল, “ তিনি ভট্টে পারদর্শী,সাংখ্যে মাননীয়,তন্ত্রে অদ্বিতীয়,বেদে গভীর জ্ঞানসম্পন্ন,ত্রিবিদ্যায় মহান,ছন্দে স্বাধীন,বৈশেষিক শাস্ত্রে ঘনিষ্ঠ,প্রভাকর পদ্ধতিতে প্রভাকর তুল্য,কাব্যে কবি,গণিতাদি তিন সূক্ষ্মবিদ্যায় ত্রিনয়নতুল্য,জ্ঞানীজন যাঁর চরনে প্রণত,সেই ভাষ্করাচার্যের জয়।”(চালিশগাঁওতে প্রাপ্ত শিলালিপি )

এই প্রবাদপ্রতিম পন্ডিত ভাষ্করাচার্যের কন্যা ছিলেন লীলাবতী। পরমা সুন্দরী কন্যাটি ছিলেন অতুলনীয় ধীময়ী,বিশেষত গণিত শাস্ত্রে তাঁর অসাধারণ মেধা কখনও স্বয়ং ভাষ্করাচার্যেরও বিস্ময় উৎপাদন করত। মৌখিক ও লিখিত রূপে তিনি কন্যাকে পাটিগণিত,বীজগণিত ইত্যাদি শিক্ষা দিতেন , লীলাবতী মহা আগ্রহ ও উৎসাহে সেই বিদ্যা অঞ্জলি পূর্ণ করে গ্রহণ করতেন। অন্য বালিকারা যখন পুত্তলিকার বিবাহ দেয়,জননীর নিকট বিবিধ রন্ধনপ্রণালী আয়ত্ত্ব করে,বা সখীদলে  মিলে নূতন প্রসাধনকৌশল অভ্যাস করে,লীলাবতী তখন পিতার সঙ্গে যোগ,বিয়োগ বা গুণনপ্রক্রিয়ার নানাবিধ পদ্ধতি অনুশীলন করেন। রাত্রিকালে শয্যায় শয়ন করে রূপকথার পরিবর্ত্তে পিতা নিম্নস্বরে প্রশ্ন করেন, “মৃগনয়নী লীলাবতী ,বল দেখি পার যদি ১৩৫ গুণন ১২ কত হয় যদি তোমার জানা রয় গুণন প্রক্রিয়া, পৃথক অংশে আর পৃথক অংকে? ”, কন্যা অস্ফুটে বলেন,১৬২০  । পিতা আবার প্রশ্ন করেন,  “একদল মৌমাছির এক পঞ্চমাংপদ্মফুলের মধু আনতে গেল, এক তৃতীয়াংশ গেল  কলাগাছে, তারপর কী হল জানো আমার মৃগনয়নী মেয়ে, তাদের সংখ্যাদের বিয়োগফলের তিনগুণ সংখ্যক মৌমাছি উড়ে গেল তিক্ত  কোড়াগা গাছের ফুলের দিকে,পড়ে রইল একটা মৌমাছি। সে একবার চাঁপাফুল আর একবার পান্দানুসের ফুলের দিকে ঊড়ে উড়ে যায়।বল দেখি লীলাবতী মোট কয়টি মৌমাছি ছিল?  লীলাবতী নিদ্রার ঘোর কাটিয়ে  মনে মনে গণনা করে উত্তর দিলেন পনেরটি।

প্রকৃতির নিয়মে বালিকা হয়ে উঠলেন অনিন্দ্যসুন্দরী কিশোরী ,সামাজিক প্রথা মেনে
পিতামাতা তাঁর বিবাহের জন্য উদ্যোগ শুরু করলেন। কিন্তু এক ভয়ংকর দুশ্চিন্তায় পিতার হৃদয় বিদীর্ণ হতে থাকে,অসংখ্য রাত্রি কাটে নিদ্রাহীন। কন্যার জন্মের অব্যবহিত পরেই তার কোষ্ঠী  অধ্যয়ন করে করে তিনি পেয়েছেন অতি নিষ্ঠুর এক গণনাফল,কন্যাটির বিবাহ হলে অবিলম্বেই সে বিধবা হবে।

পন্ডিতশ্রেষ্ঠ পিতা ভারতবর্ষের  বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগ্রহ করলেন বহু দুষ্প্রাপ্য পুঁথি,নিবিষ্টচিত্তে অধ্যয়ন করলেন, অহোরাত্র উপবাসী থেকে অমানুষিক পরিশ্রমে সুদীর্ঘ গণনা করে অবশেষে একটি উপায়ের সন্ধান পেলেন। বৎসরে একবার আসবে সেই মহাদুর্লভ লগ্ন, মহাকাশে নক্ষত্রপুঞ্জ একটি অলৌকিক অবস্থানে স্থিত হবেন,সেই লগ্নে বিবাহ সম্পন্ন হলে অবধারিত ভাবে খন্ডিত হবে কন্যার বৈধব্যযোগ। লগ্নগণনার জন্য একটি বিশেষ যন্ত্র নির্মাণের প্রয়োজন, সে কৌশল তাঁর জ্ঞাত আছে।

শুভকর্মে   বিলম্ব হওয়া বিধেয় নয়,তদুপরি সেই মহালগ্নটি খুব দূরেও নয়। পার্শ্ববর্ত্তী নগরের ভীষকাচার্যের পুত্র কল্যাণসুন্দর অল্প বয়সেই চিকিৎসাবিদ্যায় প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেছেন,যুবকটি সৌম্যকান্তি,সুভদ্র,পরিশীলিত,দায়িত্ববান, ধনী পরিবার। ভাষ্করাচার্যের সঙ্গে সম্পর্কস্থাপনে তাঁরাও  গভীর আগ্রহী। এতকাল ভাষ্করাচার্য কন্যার বৈধব্যযোগের কথা কারো কাছেই প্রকাশ করেন নি,নিজ পত্নীকেও জানান নি,দুঃসহ আশঙ্কা ও ভীতির পর্বতভার একাই বহন করেছেন। কিন্তু এখন তিনি বিবেচনা করলেন পাত্রপক্ষকে পূর্বাপর সমস্ত অবগত করানোই ধর্ম। সত্যগোপন ভাষ্করাচার্যকে শোভা দেয় না। সমস্ত বিষয়টি তিনি পাত্রপক্ষের অভিভাবকদের সম্মুখে পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষ নিবেদন করলেন,তিলমাত্র গোপন করলেন না।

প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় এই বিবাহে নিবৃত্ত হতে চাইলেও পরে আচার্যদেবের গণনায় সম্পূর্ণ আস্থা রেখে পাত্রপক্ষ  সানন্দ সম্মতি প্রদান করলেন। তাম্বুল ও গুবাক বিনিময় করে “নিশ্চয় তমূলম” ও বিশাল তাম্রকলস পবিত্র নদীজলে পূর্ণ করে দম্পতির স্বাস্থ্য,সমৃদ্ধি ,জ্ঞান ও দীর্ঘজীবন কামনা করে “নন্দী” অনুষ্ঠান সম্পন্ন হল।

শুভপরিণয়ের মঙ্গলদিবস। আদরিণী কন্যা লীলাবতী আজ বধূবেশে অপরূপা,
নবরী শাড়ি,হীরামুক্তাখচিত মা‌ঙ্গটিকা,স্বর্ণহার, কর্ণাভরণ, রত্নময় কোমরবন্ধ  তাঁকে স্বর্গের রূপসী করে তুলেছে। কিন্তু কন্যার বিচ্ছেদবেদনায় বিহ্ব্ল হওয়ার অবকাশ আচার্যের নেই। তিনি শ্বাসরোধ করে অপেক্ষা করে আছেন কখন মন্ডপ পূজা সমাপ্ত হবে।
কল্যাণবর পাত্র এল মহাসমারোহে ,সুমঙ্গলীরা তাকে আরতি ও বরণাদি করে পরম সমাদরে মন্ডপে বসালেন,মন্ডপ পূজার শুভারম্ভ হল।

কন্যার পিতা সেই মুহূর্ত্তে পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা উত্তেজিত মানুষ। বিবাহের বিশিষ্ট ক্ষণটি সম্পূর্ণ ত্রুটিহীনভাবে নির্ণয় করার জন্য তিনি নির্মাণ করেছেন একটি জলঘড়ি,যাতে একটি জলপূর্ণ বড় পাত্রে ভাসমান রয়েছে একটি ছিদ্রযুক্ত  ক্ষুদ্র পাত্র। ক্ষুদ্র পাত্রটির আকার এবং ছিদ্রটির মাপ এমনভাবে নিরূপিত যাতে একটি নির্দিষ্ট সময় পর সেটি জলমগ্ন হয়ে যায়। রুদ্ধদ্বার কক্ষে প্রায় একশত বার পরীক্ষ করে তিনি এই সময়টি সুনিশ্চিত রূপে গণনা করেছেন। গ্রহনক্ষত্ররা যে মুহূর্তে সঠিক সন্নিবেশে আসবেন, তার ঐ সময়টুকু আগে তিনি  ভাসিয়ে দেবেন পাত্রটি। পাত্র যে মুহূর্তে নিমজ্জিত হবে, সেই মুহূর্তে কন্যা সম্প্রদান করলেই সব বিপদের অবসান।

পুরোহিত মন্ডপ পূজা করুন, পত্নী প্রজ্ঞাবতীকে নিয়ে আচার্য প্রায় দৌড়িয়ে এলেন নিজের পাঠকক্ষে,  বিশেষ কুঞ্চিকা দিয়ে দ্বার খুললেন,জলঘড়িটি
নিয়ে চললেন লীলাবতীর কক্ষে।

“শোন তোমরা,”আচার্য অনুভব করলেন,তাঁর হস্তদ্বয় ও কন্ঠ কম্পিত হচ্ছে,”আমার এই অনুজ্ঞা পালনের উপর নির্ভর করছে কন্যার জীবন। এই ক্ষুদ্র পাত্রটি জলমগ্ন হওয়া মাত্র আমি লীলাবতীকে নিয়ে বিবাহসভায় যাব। তুমি এইখানে থেকে স্থির লক্ষ্য রাখো,যেন এর নিকটে কেউ না যায়,স্পর্শ দূরস্থান। আর সুকন্যা লীলাবতী, বিশেষত তুমি এই পাত্রের নিকটে আসবে না , কোন অবস্থাতেই দৃষ্টিপাত বা স্পর্শ করবে না । এর অন্যথা ঘটলে জানবে ভয়ংকর সঙ্কট। আমি দেখি, রাজবাড়ি থেকে অতিথিরা এলেন বোধ হচ্ছে।”

স্বামীর কথায় প্রজ্ঞাদেবী বিশেষ গুরুত্ব দিলেন না। পিতা ও কন্যার অহোরাত্র গণিত চর্চাকে তিনি বিশেষ প্রীতির চক্ষে দেখতেন না। তাঁর ধারণা হল,এটিও তেমনই কোন উদ্ভট খেয়াল হবে। তিনি একবার ওষ্ঠ বক্র করে , সমাগত অতিথিদের অভ্যর্থনা করতে চলে গেলেন।

বিবাহ বিষয়টি লীলাবতীর নিকট তেমন স্পষ্ট হয় নি,তদুপরি সেখানে পাটিগণিত চর্চা হয় কিনা তাও জানা যায় নি। বর আসা মাত্র সখীরা নুপূরনিক্কণ তুলে কলহাস্যে সেইদিকে ধাবিত হয়েছে,কিন্তু লীলাবতী গবাক্ষপথে বা অন্যভাবে ভবিষ্যৎ স্বামীরত্নকে দেখার কোন ইচ্ছাই অনুভব করলেন না,তার চেয়ে  জলপাত্রটি নিমজ্জিত হওয়ার সময়টি নির্ণয় করা সহস্র গুণে কৌতূহলোদ্দীপক। তিনি অতি মনোযোগে ঝুঁকে পড়ে পাত্রদুটি নিরীক্ষণ করতে লাগলেন, কিছুটা অনুমাননির্ভর গণনা করে স্থির করলেন,পাত্রটি নিমজ্জিত হতে আর দেড় দন্ড ,চার পল লাগবে।

তিনি লক্ষ্য করলেন না,সেই মুহূর্ত্তে তাঁর মাঙ্গটিকা থেকে একটি ক্ষুদ্র নীলমুক্তা জলপাত্রের মধ্যে পড়ে তাঁর ভাগ্য নির্ধারিত করে দিল।

গণনা অভ্রান্ত ছিল,ঠিক অর্ধ দন্ড পরেই পিতা এসে জলপাত্রটির প্রতি ঘন ঘন দৃষ্টিপাত করতে লাগলেন,কিন্তু ধীরে ধীরে দেড় দন্ড চলে গেল,পাত্রটির অর্ধাংশও পূর্ণ হল না। বিস্মিত ,উৎকন্ঠিত আচার্য নত হয়ে দেখামাত্র তাঁর অভিজ্ঞ চোখে মুক্তাটি ধরা দিল।

স্থিতধী  পন্ডিতশিরোমণি জীবনে প্রথমবার সংজ্ঞা হারালেন।

সব রাত্রির মতই সেই দুঃখময় রাত্রিও একসময় শেষ হল। প্রজ্ঞাদেবী ও অন্য আত্মীয়দের উপদেশে আচার্য কর্ণপাত করেন নি,করজোড়ে পাত্রপক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছেন,কেবলমাত্র তাঁরই অসাবধানতায় লগ্ন অতিক্রান্ত হয়ে গেছে,পুত্রসম কল্যাণের জীবন নিয়ে তিনি ছলনা করতে পারবেন না,কন্যা লগ্নভ্রষ্টা হয়েই থাকুক,মহেশ্বরের যা ইচ্ছা।
তবে,প্রাণাধিকা কন্যার অশ্রুপাত তাঁর সহ্য হল না,এক অভূতপূর্ব সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি বললেন,”মা,তোমার নামে আমি একটি গ্রন্থ রচনা করব,যা শেষ সময় পর্যন্ত টিকে থাকবে,কারণ সুনাম হল দ্বিতীয় জীবন,এবং মহান সৃষ্টির স্থায়িত্বকাল অনন্ত”।

শুরু হল গণেশাদি দেবতার স্তুতি সহযোগে“সিদ্ধান্ত শিরোমনি” গ্রন্থচতুষ্টয়ের  প্রথম গ্রন্থ “লীলাবতী”,কাব্যময় গণিতপুস্তক রচনার বিশাল শ্রমসাধ্য কর্মযজ্ঞ।
শ্রীগণেশায় নমঃ
লীলাবতী
প্রীতিং  ভবংজনস্য যা জনয়তে বিঘ্নং  বিনিঘ্রন স্মৃ্ত
স্তং বৃন্দারক  বৃন্দবন্দিতপদং  নত্বাা মতঙ্গাননম্।
আত্মজার কষ্ট দূর করতে পিতা  তাকে সন্ধান দিলেন এক মহান সৌন্দর্যের ও লোকাতীত অনুভূতির, বাস্তব নিষ্ঠুর জগতকে অতিক্রম করে প্রজ্ঞাময়, সুশৃঙ্খল এক গণিতজগতের।  তেরটি অধ্যায় ,২৬৬ টি শ্লোকের মাধ্যমে রচিত পাটিগণিতের এই বইটিতে আলোচনা করা হল আটটি মৌলিক গাণিতিক প্রক্রিয়া (পরিকর্মষ্টক)- সংখ্যাগণনা,যোগ, বিয়োগ, গুণ (ছয়টি প্রক্রিয়া,সবক পদ্ধতি), ভাগ, বর্গ, ঘন, বর্গমূল এবং ঘনমূল। তারপর রচিত হল
১। শূন্যপরিকর্মণঃ শূন্যের ব্যবহার,
২। ব্যস্তবিধিঃ ব্যস্ততার নিয়ম,
৩। ইষ্টকর্মঃ ঐকিক নিয়ম,ত্রৈরাশিকা,

৪। সংক্রমণ, বর্গসংক্রমণ,বর্গকর্ম,
৫। মূলগুণকঃ বর্গমূল ও দ্বিঘাত সমীকরণ সংক্রান্ত সমস্যা ,
৬। বন্দপ্রতিবন্দকঃ বিনিময় ব্যবস্থা,‌সুদকষা,লাভক্ষতি,

৭। মিশ্রব্যবহারঃ মিশ্রণের নিয়ম ,
৮। শ্রেণীব্যবহারঃ ধারার ব্যবহার ,
৯। অঙ্কপাশা বিন্যাস ও সমাবেশ ,
১০। কুত্তক বা কট্টকঃ অনির্ণেয় সমীকরণের সমাধান ,
১১। ক্ষেত্রগণিতঃ  -ত্রিভুজ/চতুর্ভুজ,আয়তক্ষেত্র,বর্গক্ষেত্র,ট্রাপিজিয়ম ইত্যাদির ধর্ম,গর্ত,কূপ খনন,সুর্যঘড়ির কাঁটা ,ছায়ার পরিমাপ ,
১২।সমান্তর,গুণোত্তর প্রগতি ইত্যাদি ।

বইটির অধিকাংশ অঙ্ক সরস ছন্দে, কবিতার শ্লোকের মত হৃদয়গ্রাহী রচনাশৈলীর মাধ্যমে বর্ণনা করা হল , সাজানো হল মুক্তা,ভ্রমর, হাতি, পদ্মফুলের মত পরিচিত জিনিস দিয়ে যাতে শিক্ষার্থীদের বুঝতে সুবিধা হয়,যেমন -

“সারস আর হংসপূর্ণ সরোবরে,
জলতলের অর্ধহস্ত উপরে এক পদ্মকলি  ঋজু দাঁড়িয়ে।

অপরাহ্নের সমীরণ,
দেহে জাগায় কম্পন
আদি অবস্থানের দুই হস্ত দূরে,‌পরশে পদ্মকলি জলকে যায় নাড়িয়ে।

শুনলে এই বর্ণনা
করো এবার গণনা
জলের গভীরতা আর পদ্মের উচ্চতা।”(অনুবাদ- ম্যাভেরিক ব্লগ)




আচার্য যথার্থ বলেছিলেন,বিশ্বের ইতিহাসে এটি পাটিগণিতের চিরকালীন প্রামাণ্য গ্রন্থ।




অতিক্রান্ত হয়েছে দশ বৎসর,সিদ্ধান্তশিরোমণির আরও তিনটি খন্ড (বীজগণিত,গ্রহগণিত,গোল অধ্যায়)রচনার পর ভাষ্করাচা্র্য পরিকল্পনা করছেন করণ কুতুহলা নামে একটি গ্রন্থরচনার ।

আজ লীলাবতী তার জননীকে নিয়ে এসেছেন তুঙ্গভদ্রার (পম্পা) তীরে,সুপ্ৰসিদ্ধ বিটঠল রাওয়ের মন্দিরে। প্রত্যুষকাল,জবাকুসুমসঙ্কাশ আদিত্যদেব প্রকাশিত হচ্ছেন, নদীর অপর তটে ঋষ্যমুখ পর্বত  হরিৎলতা পল্লবসমাচ্ছন্ন, নানাজাতীয় তরুরাজি পরিশোভিত গিরিশ্ৰেণী আশ্চর্য মনোরম। সহসা মাতা প্রজ্ঞাবতী তাঁর বাহু  আকর্ষণ করে দেখালেন এক দীর্ঘকান্তি পুরুষ তাঁর সুদীর্ঘ অবগুন্ঠনবতী পত্নীকে নিয়ে চলেছেন,”কল্যাণসুন্দর” নিম্নস্বরে তিনি বলে ওঠেন।

না,লীলাবতীর বিন্দুমাত্রও  বিচলন হল না,অবগুন্ঠিত জীবন তাঁর জন্য নয়।

পূর্ণদৃষ্টিতে তিনি দেখলেন সূর্যালোকপ্লাবিত এই বসুন্ধরাকে।

আজ তিনি সেই মুক্তাটি নিয়ে এসেছেন,থলিকা থেকে সেটি বের করে তিনি নিক্ষেপ করলেন নদীতে। মাতা পম্পার বিশাল জলরাশি প্রসন্নভাবে সেটি গ্রহণ করলেন।

লীলাবতী নিরুচ্চার প্রার্থনা করলেন-”সকল প্রাণী সুখী হোক,সকল বাতাস মধু বহন করুক, নদ ও নদীতে মধু ক্ষরিত হোক, আমাদের ওষধি সকল মধুময় হোক । রজনী ও ঊষা মধুময় হোক, মধুময় হোক ধরণীর ধূলিকণা আর মধুময় হোক আমাদের পালয়িতা ঐ দ্যুলোক । মধুময় হোক আমাদের বনস্পতি, মধুময় হোক সূর্য আর মধুর হোক আমাদের ধেনুগণ ।”

আর  নিজের জন্য আছে লীলাবতী গ্রন্থের শেষ অংশ,যা তাঁর জীবনপাত্র পূর্ণ করে দিয়েছে-
“  আনন্দ এবং সুখে প্রকৃতই উদ্ভাসিত হচ্ছে জগত, তাদের জন্য যাদের গলা জড়িয়ে আছে লীলাবতী  (গ্রন্থ)–ভগ্নাংশ, গুণন এবং সূচকের সুশৃঙ্খল সরলীকরণে সুসজ্জিত, সমাধানের মত বিশুদ্ধ ও সঠিক, আর বচনামৃতের মতই মনোহর।”

---------------------------------------------------------------------------------------------------------------

লেখিকার নিবেদন -১।লীলাবতী সম্বন্ধে যা তথ্য পাওয়া যায়,তার ওপর ভিত্তি করে এটি একটি কাল্পনিক কাহিনী,প্রামাণ্য প্রবন্ধ নয়।লীলাবতী সম্বন্ধে নানা মত আছে - কেউ বলেন বাল্যবিধবা কন্যাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য ভাস্করাচার্য  পাটীগণিত অধ্যায়ের নাম রাখেন ‘লীলাবতী’। অন্য আর-এক মতে মেয়েকে পাটীগণিত শেখানোর জন্যই নাকি ভাস্করাচার্য পাটীগণিত অধ্যায়টি রচনা করেছিলেন এবং মেয়ের নামে নাম রেখেছিলেন ‘লীলাবতী’। অনেকে বলেন ভাস্করাচার্যের স্ত্রীর নাম ছিল লীলাবতী, এঁদের কোনো সন্তান ছিল না। সেই শোক ভোলার জন্য এবং স্ত্রীর নাম চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য তিনি পাটীগণিত গ্রন্থের  নাম রাখেন ‘লীলাবতী’।কোথাও বলা হয়েছে ‘অয়ি বালে লীলাবতী’, কোথাও সখে, কান্তে, বৎসে বলে সম্বোধন করেছেন। ‘লীলাবতী’ শব্দের অর্থ ‘গুণসম্পন্না’। তাই অনেকে মনে করেন ভাস্করাচার্য নিজের বই সিদ্ধান্ত শিরোমণিকে গুণসম্পন্না বোঝাতে লীলাবতী নামটি ব্যবহার করেছেন। প্রাচীন ভারতে স্বীকৃত গ্রন্থ সম্বন্ধে এই ধরণের বিশেষণ ব্যবহারের প্রচলন ছিল।লীলাবতী নাম নিয়ে আরও একটি মত - সরস্বতীর আরেক নাম লীলাবতী। গ্রন্থটি রচনার সময় সরস্বতী বন্দনার উদ্দেশ্যেই ভাস্করাচার্য লীলাবতী নামটি গ্রহণ করেছিলেন।
২।২০০৮ সালে ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স থেকে রোহিণী গোড়বলে ও রামা রামস্বামী সম্পাদিত ভারতীয় মহিলা বিজ্ঞনীদের জীবনীর কটি সকলন প্রকাশিত হয়,তার নাম  “লীলাবতীস ডটারস।

তথ্যসূত্র
১। ভাস্করাচার্য ও লীলাবতী,নিবোধত,রজত জয়ন্তী বর্ষ, ২য় সংখ্যা,২০১১,পৃষ্ঠা ১৪৫।
২। আন্তরজাল সূত্র- ম্যাভেরিক ব্লগ,এবং আলাপ,জয়ঢাক,বিডিকম,শিক্ষাবার্তা ইত্যাদি।
৩।হিন্দুগণিত ও ভাস্করাচার্য,শৈলেশ দাশগুপ্ত,বেস্ট বুকস,২০০২।

















































কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র