অমিতাভ দাস

মায়াজম
2
মুখোমুখি দুই রানি 
.............................................





নৌকা এসে দাঁড়াল বংশবাটির খেয়াঘাটে । ক্লান্ত অপরাহ্ন । শীত শেষ হয়েছে । দু-চারটি কোকিলের ডাক । মৃদু-মন্দ বাতাস বইছে ।পতপত করে উড়ছে নৌকার পতাকাগুলি ।

যে নৌকাটি এসে প্রথমে দাঁড়াল সেইটি অধিক সজ্জিত । তার পিছু পিছু আরো গোটা দশেক নৌকা  । 

অদূরে ঘাটে দাঁড়িয়ে আছেন এক প্রবীন মানুষ । তিনি বংশবাটি  এস্টেটের দেওয়ান । হাত জোর করে আছেন । 

সজ্জিত নৌকা থেকে বেরিয়ে এলেন রানীমা । সঙ্গে খাস দাসী পদ্মা ও যমুনা । 
রানীমাকে দেখেই লালমোহন এগিয়ে গেল । বললে ,আস্তে আস্তে নেমে আসুন মা । রানীমা এগিয়ে এলেন । লালমোহন রানীমার বিশ্বস্ত কর্মচারী । 

ইতিমধ্যে দেওয়ানজীও এগিয়ে এসেছেন । 
রানীমা বললেন , লালমোহন খবর পাঠিয়েছিলে তো ?

--জি ।পাঠিয়েছি । ওঁনারা এসেছেন আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ।
রানীমা অর্থাত্ জানবাজারের বিখ্যাত ব্যবসায়ী ও জমিদার প্রীতিরাম দাসের পুত্রবধূ , রাজা রাজচন্দ্রের স্ত্রী রানী রাসমণি  । যাঁর দান ও সেবার কথা লোকমুখে চারিদিকে প্রচারিত । রানী না হলেও তাঁর প্রজারা তাঁকে রানীমা বলেই ডাকে । যাঁর জীবনের নানান অলৌকিক কথা লোকমুখে দেওয়ানজীর কানে এসেছিল । তিনিও এই প্রথম দেখলেন রানী রাসমণিকে ।

রানীমাকে দেখে তিনি বিস্মিত ও মুগ্ধ ।যেন দেবী জগদম্বা । কী প্রবল ব্যক্তিত্ব ! দর্শনেই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যায় । সাদা থান পরা । গলায় পদ্মবীজের মালা । মধ্য বয়সেও অসামান্য রূপের দ্যুতি যেন ঠিকরে পড়ছে পড়ন্ত দুপুর  বেলার খেয়াঘাটে । 
দেওয়ানজী কাছে এসে প্রণাম জানালেন করজোড়ো । বললে ,আসুন মা --আসুন--পালকি প্রস্তুত ।
--পালকির কী প্রয়োজন ছিল ।হেঁটেই তো যেতে পারতুম ।বললেন রানী রাসমণি  । সহজ সরল কথা আন্তরিকতায় পূর্ণ । পদ্মা আর যমুনার দিকে তাকিয়ে বললেন , সকলকে নিয়ে তোরাও দ্রুত মন্দিরে চলে যায় । আর হ্যাঁ ,পুজোর ডালা ও অন্যান্য পুজোর সামগ্রী কেলোর মায়ের হাতে পাঠিয়ে দিস । সে বেচারি উপোস করে আছে ।পুজো দিয়ে তবে প্রসাদ খেয়ে উপোস ভাঙবে । 
--তুমিও তো উপোস করে আছো মা ।কত বেলা হল ,বললে যমুনা ।
--সে তো আমার অভ্যেস আছে । নে আর কতা বলিস নে । তাড়াতাড়ি আয় দিকিনি । বলে পালকিতে উঠলেন ।

রানী রাসমণির মন বড়ো অশান্ত । নৌকাযোগে তিনি জগন্নাথ দর্শন করে এলেন গত বছর১৮৫০ সাল । সেও এক ঘটনাবহুল যাত্রা ।  গঙ্গার মোহনায় তাঁর নৌকাটি অন্য নৌকাগুলি থেকে বিচ্ছিন হয়ে যায় । অচেনা জায়গা । তবে রঘুবীর যাঁর সহায় বিপদ তাঁকে কী স্পর্শ করতে পারে ! এক দরিদ্র ব্রাহ্মণের কুটিরে আশ্রয় পান ।প্রাণ রক্ষা হয় । তিনি ব্রাহ্মণকে দান করেন একশোটি টাকা । তারপর আবার তাঁর চলা । তিনি নিজের টাকায় সুবর্ণ রেখা থেকে পথ তৈরী করতে করতে পৌঁছলেন জগন্নাথ ধাম । পড়িয়ে দিলেন তিনটি হীরক খচিত মুকুট প্রিয় দেবতা জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার মাথায় ।

এ বছর আবার এসেছেন স্নান করতে সাগর সঙ্গমে । এ যাত্রাও কম ঘটনাবহুল নয় ।পড়েছিলেন ডাকাতের খপ্পরে । সর্বদাই অবিচলিত রানী রাসমণি । ভাবলেন ,দেখি এ যাত্রায় রঘুবীর বাঁচান কী না ! ডাকত দাবি করলে মুক্তিপণ । রানী স্মিত হাসলেন ।বললেন , যে টাকা তুমি চাইছ তা আমার কাছে এ মুহুর্তে নেই । তবে তুমি পাবে ।রানী রাসমণি মিথ্যে বলে না । ডাকাত রানীকে বিশ্বাস কবলে ।পরে অবিশ্যি রানী কথা রেখেছিলেন ,মুক্তিপনের বারো হাজার টাকা তিনি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ।

পালকি এসে দাঁড়াল হংসেশ্বরী মন্দিরের সামনে । রানী রাসমণি নেমে এলেন । সামনে তাকিয়ে দেখলেন কী অপূর্ব মন্দির মা হংসেশ্বরীর । খুব কাছেই দাঁড়িয়ে প্রাচীন অনন্ত বাসুদেবের মন্দির ।অসামান্য  টেরাকোটার কাজ । রানী  মুগ্ধ । 
সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলেন । মন্দিরের ঠিক সামনেই এক অশীতিপর বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে ।গায়ে সাদা একটি চাদর । রানী রাসমণিকে দেখেই এগিয়ে এলেন এক পা ,দু পা করে । চোখে ভালো দেখেন না । বললেন  , এসেছো তুমি রাসমণি ,তুমি এসেছো...কী যে ভালো লাগছে আমার...

রাসমণি বুঝলেন এই সেই রাণী শঙ্করী । যিনি এই মন্দিরের প্রকৃত নির্মাতা । স্বামীর ইচ্ছায় তাঁর  অসমাপ্ত কাজকে যিনি পূর্ণতা দিয়েছেন । যিনি এখনো বংশবাটির সকলের ছোটমা ।আজো তাঁর কী অপার্থিব রূপ--সত্যিই এককালে অসামান্যা রূপবতী ছিলেন রাণী শঙ্করী । 

এগিয়ে এসে রানী রাসমণি রানী শংকরীর হাত দুটি স্পর্শ করে বললেন , দিদি--আমি তোমায় চিনেছি দিদি--
--আজকাল চোখে ভালো দেখতে পাই না । তবে ভালো শুনতে পাই ।তুমি আমায় দিদি বললে রাসমণি । প্রাণ জুড়িয়ে গেল ভাই--
তোমার গুণের কথা শুনি । তোমার দানের কথা ।কত স্বাদ ছিল তোমাকে দেখার । মা আমার সে স্বাদ  পূর্ণ করেছে ।

পুজো শেষে সকলে এসে দাঁড়ালে মন্দির চাতালে । যেখানে হাড়াকাঠ ,তার আশেপাশে অনেক নারী-পুরুষ জানবাজারের রানীমাকে দেখতে এসেছে । কত কথা তাঁরা শুনেছে । এই রানীমা নাকি এক বিরাট মন্দির তৈরী করছেন । তিনি নাকি কাশী যাবার পথে স্বপ্নে দৃষ্ট হন ।আর তারপরেই জামাইকে নির্দেশ দেন কালী মন্দির নির্মাণের । 
সকলের চোখে অসীম কৌতুহল । এক বৃদ্ধ চুঁচুরা নিবাসী এসেছিল হংসেশ্বরী মন্দিরে পুজো দিতে ।সে বললে , রানীমা ইংরেজদের জব্বর সায়েস্তা করেছেন । তাঁকে খুব মান্যি করে ইংরেজ সরকার । একবার হল কী... 
কথা শেষের আগেই খোল-কত্তাল বেজে উঠল । সবাই তাকাল অনন্ত বাসুদেব মন্দিরের দিকে । রানী রাসমণি এখন সেখানে পুজো দিচ্ছেন । 
রানী রাসমণির চোখে জল ।পাশে বসে আছেন রানী শংকরী । ফুল-মালা আর ধূপের গন্ধে মুখরিত মন্দির প্রাঙ্গন ।
রানী রাসমণি বলছেন , প্রভু কত সাধ ছিল তোমাকে দেখার । রঘুবীর এও তোমার এক রূপ...
রানীর চোখে ভক্তিঘন আনন্দাশ্রু । রানী শংকরী আলতো করে হাত রাখলেন রাসমণির পিঠে ।

বিকেল হয়ে এল ।সন্ধ্যায় আরতি ।তারপর ভাগবত্ পাঠ অন্তে কীর্তন ।তার আগে পথ শ্রমে ক্লান্ত রানী গেলেন শংকরী ভবনে । কারণ তিনি আজ বংশবাটি রাজবাড়ির অতিথি ।
.
রুপোর গ্লাসে দুধ । রুপোর থালায় নানা রকমের ফল ও মিস্টি । বড়ো যত্ন করে রানী শংকরী খাওয়ালেন রাসমণিকে । নাম মাত্র খেলেন তিনি । তবু আন্তরিকতা আর যত্নে তাঁর মন ভরে গেল । বললেন , দিদি তোমার পাশে এই ছোট্ট মেয়েটি কে ? ভারী মিষ্টি দেখতে ।
--ও তো ছুটকি । মানে ওই তো এখন রানী । ভালো নাম মৃন্ময়ী । ও হল আমাদের রাজা দেবেন্দ্রর বৌ... রাসমণি মুগ্ধ হয়ে দেখলেন সেই  নতুন রানীকে  । 
.
রাসমণি শুনছিলেন হংসেশ্বরী মন্দির তৈরীর উপাখ্যান । রানী শংকরীর আত্মত্যাগ । এই মন্দিরের জন্য লড়াই--যা আদালতে গিয়ে থেমেছিল । জয়ী  হয়েছিলেন রানী শংকরী । শেষ করেছিলেন স্বামীর শেষ ইচ্ছা --মা হংসেশ্বরীর মন্দির ।
.
রাজ হলেও অন্তরে সন্ন্যাসী নৃসিংহ দেব রায় । শোনা যায় তিনি শ্যামামায়ের দর্শন পেয়েছিলেন ।নিজের জননীর নামানুসারে এই মন্দিরের নাম । তিনি মন্দিরের কাজ শেষ করে যেতে পারেন নি ।কাজ শেষ করেন ছোটরানী শংকরী । ১৮১৪  সালে রথযাত্রার প্রাক্কালে স্নানযাত্রার দিন হংসেশ্বরী  বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হয় ।

মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন রাসমণি । বাইরে কে যেন ডাকলে ।মৃন্ময়ী বললে , ঠাকমা চলো , সন্ধ্যা আরতির  সময় হল । 
রানী রাসমণির দিকে তাকিয়ে বললেন , চলুন রানীমা...

রাসমণি প্রদীপের আলোয় দেখলেন অশীতিপর বৃদ্ধার দুচোখ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে অশ্রুধারা । স্মৃতি কত যে বিষাদের  আর কত যে আনন্দের তা রাসমণি জানেন । এই সে সেদিন যে ঘাটে তাঁর পিতা স্নান করতেন সেটি বাঁধিয়ে দিয়ে এলেন । চোখে জল এসেছিল বারবার । বাবার কথা মনে পড়েছিল তাঁর । কত ভালোবাসতেন । দরিদ্র অথচ সত্ একজন মানুষ ছিলেন তাঁর বাবা । কী সুন্দর কন্ঠ ছিল বাবার ! কে বলবে ,এই লোকটি সকালে ঘরামির কাজ করতেন  আর সন্ধ্যার পর মেতে উঠতেন খোল-কত্তাল নিয়ে কীর্তন গাইতে । 
রাসমণির মনে পড়ে বাবার থেকেই তো  পেয়েছি যা কিছু আমার সংস্কার --গান--ভক্তিপ্রেমরাশি...
.
সন্ধ্যারতি শেষ হয়েছে । শুরু হয়েছে ভাগবত্পাঠ । রাসমণি শুনছেন ।শুনতে শুনতে তাঁর বালিকা বয়সের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে । ছোটবেলা কেমন চমত্কার গাইতেন তিনি । কত বছর হয়ে গেছে ,তিনি আর গান করেন না । ইচ্ছেও করে না ।তাছাড়া জমিদারী আর ব্যবসা সামলে সময় কোথায় !

ভোর হয়েছে । স্নান সেরে মন্দিরে পুজো দিলেন রাসমণি । অনেকক্ষণ বসে থাকলেন হংসেশ্বরীর মূর্তির সামনে । তন্ময় হয়ে দেখছেন মাতৃরূপ । শিবের নাভি থেকে প্রকাশিত  প্রস্ফুটিত পদ্মের ওপর আসীন দেবী । বাঁ পা মুড়ে ডান পা ঝুলিয়ে রেখেছেন । চতুর্ভুজা । দুই ডান হাতে অভয় ও বরাভয় মুদ্রা ।দুই বাঁ হাতে অসি ও মুন্ডমালা ।নীল বর্ণের বিগ্রহ নিমকাঠে নির্মিত । করজোড়ে প্রণাম করলেন রাসমণি ।
.
এবাবে যাবার ক্ষণ উপস্থিত । রাণী শংকরী বললেন ,আর দুটো দিন থেকে যাও বোন ।
রানী বললে ,তা হয় না দিদি । বিস্তর কাজ পড়ে আছে আমার ।ঐ দিকে মন্দিরের কাজ দেখছে মথুর । সে একা কত দিক দেখবে । আমাকে যে যেতে হবে দিদি...
রানী শঙ্করী বললেন , যাবে যখন, বাধা দিই কীভাবে ।  তাহলে  কথা দাও আবার আসবে--
সম্মতি জানিয়ে রানী বললেন  ,আমার একটা ইচ্ছা ছিল দিদি...
--কী ইচ্ছা--
--আমি বংশবাটির ব্রাহ্মণদের কিছু দক্ষিণা দিতে চাই ।

রানী শংকরী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন ।তারপর বললেন , তা হয় না বোন । তুমি আজ আমার অতিথি । তাছাড়া এখানে তুমি যদি আজ দান করো ,আমি যা দান করি সে দানের আর মর্যাদা থাকবে না  ভাই ।তাই ওইটে কোরো না--

রানি রাসমণি বুঝলেন রানি শংকরীর মনের  কথা ।বললেন ,তাই হবে দিদি । তোমার কথাই থাক । বলে সৌজন্য হেসে শংকরীর হাত দুটো স্পর্শ করে বললেন ,আসি দিদি...

ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন রানি রাসমণি । পেছনে মন্দির চাতালে দাঁড়িয়ে রানি শঙ্করী । একটু একটু করে সকালের প্রথম রোদ্দুর এসে  ছুঁয়ে যাচ্ছে  হংসেশ্বরী মন্দিরের চূড়া ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন