পৃথা দাস - মায়াজম

Breaking

১৪ জুন, ২০১৯

পৃথা দাস


           অন্নদামঙ্গল বা নূতন মঙ্গলকাব্য





শুভ নববর্ষ । এবারে  মায়াজম  ওয়েবজিনের  আলোচ্য বিষয়ের  বিস্তৃতি অনেকটা পর্যটকের  ভূ-পরিক্রমার মতো। আলোচনায় যেমন থাকছে   ইতিহাস  বা  ঐতিহাসিক  চরিত্র  বা ঘটনাবলি, পুরাণ  বা  পৌরাণিক  চরিত্র ,  ক্রম  পরিবর্তমান  সমাজের  দৃশ্যাবলি   এবং  মঙ্গল কাব্য ।  প্রকৃতপক্ষে   মঙ্গলকাব্য  গুলি  এক অর্থে   বৃহত্তর   সমাজের  লৌকিক  ও  সামাজিক   চালচিত্র ।  সুতরাং  মঙ্গল কাব্য  সম্বন্ধে কিছু  আলোচনা করার  অর্থই  কিন্তু  একটি সুন্দর চিত্রকাব্যের  মাধ্যমে   তৎকালীন  সাহিত্য  ও  সমাজের  একটি   সমসাময়িক  চিত্রাঙ্কন । 
    
রামায়ণ  মহাভারত-- ভাগবতের   অনুবাদের  মাধ্যমে   বাঙলা  ও  বাঙালির   চিন্তাভাবনা  ও  আবেগ  ব্রাক্ষ্মণ্য  সংস্কৃতির  নিবিড়  সংস্পর্শে   আসে  এবং  তার  ফলে বাঙলা  সাহিত্যের  যে  বিচিত্র  বিকাশ  হয়  তা  আমরা  অনূদিত  সাহিত্য   সম্ভারে দেখেছি।  এই  পর্বে   সপ্তদশ  শতকে  মহাভারতের  অনুবাদক  কাশীরাম  দাস  একাই  সমগ্র   শতাব্দীর   মানদণ্ড   হিসেবে  বিরাজ  করেছেন।   সাহিত্যের   গুণগত  মানের  উৎকর্ষ  খুব  একটা  চিত্তাকর্ষক   হতে  পারেনি । এই  শতকের  শেষ  পর্বে   যদি  লৌকিক   সাহিত্য   জনজীবনে   বিশেষ  সাড়া  ফেলে  থাকে,  তাহলে  বলা  যায়  সেই  স্থানে  বিরাজ  করছে    মধ্যযুগীয়   বাঙলা  সাহিত্যের   নতুন ধারা   ---  মঙ্গলকাব্য । প্রকৃতপক্ষে  খ্রিঃ  পঞ্চদশ  শতক  থেকে  অষ্টাদশ   শতকের  শেষ  ভাগ  পর্যন্ত   মঙ্গলকাব্য  গুলি রচিত  হয়েছে। গোটা  বাংলাদেশেই   এই  মঙ্গলকাব্য    সমূহের   অসাধারণ   প্রভাব   দেখা  যায় । 
          বর্তমান  কালেও  পল্লী   অঞ্চলে বছরের  বিভিন্ন   সময়ে  মঙ্গলকাব্যের  কোনো   কোনো   দেব  বা দেবীর  ঘটা  করে  পুজো  ও  তাঁদের  নানাবিধ  মহিমাবিষয়ক  গান  করা  হয়--- এই  পুজো  ও  প্রচার  সম্বন্ধীয় কার্য কলাপ  সম্বন্ধীয় একপ্রকার  আখ্যানকাব্যকে  মঙ্গলকাব্য   বলা  হয়ে  থাকে।

আশ্চর্যজনক ভাবে  এই  আরাধ্য   দেবদেবীরা অনেকেই  আর্য   পরিমন্ডলের নন,   বাঙলার  গ্রাম্য  পরিবেশে  ও  সমাজে  এঁদের  আবির্ভাব   ও  প্রতিষ্ঠা । এই দেশে  আর্য   সংস্কৃতি   তত্ত্ব   দৃঢ়মূল  হওয়ার   আগে  অস্ট্রিক  গোত্রসম্ভূত  আর্যেতর  জাতি বাস করত।  বহু  শতক পরস্পরের  সহাবস্থানের ফলে আর্য  ও অনার্য   দেব-- দেবী রাঢ়  ও  বঙ্গভূমে   একই রকম   ভাবে  মান্যতা  পেতে  শুরু  করেন।  এই  পর্বটিকে    আর্যায়ন   বা কৌলিক   পরিবর্তনের   সময়   বলে  ধরা  হয়।  তা  সত্বেও  আর্যেতর--- কৌলিক মূর্তি,   টোটেম  ইত্যাদি   কিন্তু   গ্রাম  ভিত্তিক   সভ্যতায়  তখনও   তার  পুরাতনী  -- সনাতন  ধারা  অক্ষুণ্ণ   রাখতে  সমর্থ   হয়েছিল।  বিশেষত  সমাজের  নিম্নস্তরে এবং  নিরক্ষর  পল্লী অঞ্চলে---  এবং  পল্লী রমণীদের  মধ্যে আর্য  কি প্রভাব   একেবারেই পৌঁছাতে পারে নি । আজ  পর্যন্ত   বাঙলার  পল্লীতে  আটচালা  বা স্থানীয় গাছতলাস্থিত ছোটো মন্দির গুলিতে যে সমস্ত   দেবদেবী  পূজিত  হন, তাঁদের মধ্যে   কেউ-ই  সংস্কৃত   মন্ত্রের   দ্বারা  পরিশুদ্ধ   নন।   পৌরাণিক  দেবত্ব  তাঁদের নেই।  তাঁরা  নেহাতই   লৌকিক--সামাজিক   দেব দেবী।  চন্ডী,  মনসা,  বাশুলী,  ধর্ম ঠাকুর,  পঞ্চানন  ঠাকুর--- প্রভৃতি   গ্রামের  দেবদেবী  বাঙালির  আর্যেতর সংস্কারের  বাহক।   সেই  হিসেবে  বলা  যায়   তাঁরা  সামাজিক   দেবতা  হিসেবে  মানুষের  অনেক  কাছের   এবং  এই  ভাবেই পুজো ও  শ্রদ্ধা   পেয়ে   আসছেন।

      বিপদে  আপদে  পড়লে  মানুষ   ভয়ে--ভক্তিতে দেব  দেবীর  শরণ  নেয়। বাঙলার  মঙ্গলকাব্যের   দেব-দেবীদের উৎপত্তির  মূলে  এইরকম   নানা  ধরনের  আধিভৌতিক আপদ  বিপদের  প্রভাব  আছে।  যেমন  বলা  হয় -- হিংস্র   শ্বাপদের থেকে  ত্রাণকর্ত্রী   দেবী চন্ডী, সর্পের  অধিষ্ঠাত্রী  দেবী  মনসা,  বসন্ত  রোগের  ত্রাণকর্ত্রী  দেবী শীতলার উৎপত্তি । এমনকি   নিম্নবঙ্গের  সুন্দরবনাণ্চলে  বাঘের অত্যাচার   থেকে  রক্ষা  পাওয়ার জন্য   দক্ষিণ রায়ের  মূর্তি  পূজা করা হয়।  মঙ্গলকাব্যের দেবদেবী  কিন্তু বহু আগে থেকেই  গ্রামীণ ছড়া, পাঁচালি,  মহিলাদের   ব্রতকথায় নিজ  নিজ  অস্তিত্ব  রক্ষা  করে  চলছিলেন। পঞ্চদশ  শতকে  সাহিত্য   ও  সমাজে   নতুন   করে  তাঁদের  প্রভাব  দেখা  গেল।  ষোড়শ  ও  সপ্তদশ  শতকে রাষ্ট্রীয়  ও  সামাজিক  নানাবিধ    বিপর্যয়ের ফলে সাধারণ   জনমানসে শান্তি ছিল না । স্বাভাবিক ভাবেই  এই চূড়ান্ত  উপদ্রবের   হাত  থেকে  রক্ষা  পাওয়ার   জন্যে   অলৌকিকতার আশ্রয়ের  প্রয়োজন   হয়ে পড়ল।  লৌকিক--সাধারণ  মানুষের  হৃদয়ের  খুব  কাছের --অতি  নিকট  আত্মীয়ের  মতো কৌলিক   সমাজ কল্যাণকারী  এই  দেবদেবীদের কাছে  নিদান প্রার্থনা করতে  শুরু  করল --যাঁদের স্বল্পতম   কৃপাকটাক্ষ   লাভ  করতে  সর্ব  সিদ্ধি লাভ  হতে  পারে।

      সেইজন্যই   মঙ্গলকাব্যের  দেবতা , বিশেষত  দেবীরা ভক্তের কাছে  বরাভয়রূপিনী--বরদাত্রী  মূর্তিতে  হাজির  হয়েছেন। ভক্তবাঞ্ছা কল্পতরু  রূপে  তাঁরা  বিরাজমানা । তাই তাঁদের  রুষ্টি  ও  তুষ্টি  দুইই  অতি তীব্র । এই সমস্ত  দেবদেবীর পরিকল্পনার মূলে কিঞ্চিত  রূঢ়-রুক্ষ আর্যতর প্রভাব  আছে , তা অস্বীকার  করা যায়  না । অবশ্য  পঞ্চদশ--ষোড়শ   শতাব্দীর সমাজে  পৌরাণিক  প্রভাব   গভীর  ভাবে  অনুপ্রবেশ   করলে , মঙ্গলকাব্যের  দেবদেবীরা   ধীরে ধীরে  আর্য  পূজনরীতিতে   সামিল হতে শুরু করলেন।  ব্রাক্ষ্মণ কবিরা  পূর্বতন   সংস্কার  বিস্মৃত   হয়ে  চন্ডী,  মনসা , বাশুলী, ধর্ম ঠাকুরের আরাধনা ও তাঁদের  মহিমা --প্রচারক  কাব্য --  রচনায়   মহানন্দে  আত্মনিয়োগ  করলেন। 


সাধারণত  অধিকাংশ  মঙগলকাব্যে  পূজা  প্রচার কার্য  সমাধা হয়  দেবীর  কোনো বিশেষ  ভক্তের  দ্বারা ----যিনি  আগে  ছিলেন  স্বর্গের   অধিবাসী,  কিন্তু  তাঁর  দ্বারা  মর্ত্যধামে  পূজা বিধি  প্রণয়নের  নিমিত্ত  দেবীর  তাঁকে   অতি  সামান্য   অপরাধের  শাস্তিস্বরূপ শাপগ্রস্ত   করে  মর্ত্যে  মনুষ্যজন্ম   গ্রহণ  করতে  বাধ্য   করেন। মর্ত্যে  দেবীর পূজা   প্রচারের ও  প্রচলনের  পর  শাপভ্রষ্ট   দেবকুমার   বা  দেবলোক   বাসিনী  অভিশপ্তা   নর্তকী  মর্ত্যদেহ  ত্যাগ  করে  পুনরায়   স্বর্গে   ফিরে যাওয়ার   অনুমতি   পান। তাই  প্রচলিত  মঙ্গল   কাব্যে  কিছুটা দেবকাহিনী  ও  কিছুটা  মর্ত্যলোক   কাহিনী  বর্ণিত   হতো ।  যদিও   সামাজিক   আচার  আচরণে  মঙ্গল কাব্যগুলি লৌকিক  নিয়মাদির   জন্য   বিশেষ  ভাবে  আদৃত  হতো কিন্তু   সাহিত্য   রসসৃস্টিতে  সেই  কাব্য   বা পাঁচালির  বিশেষ  কোনো অবদান  ছিল  বলে  সমালোচকরা মনে করে থাকেন । এই  হিসেবে  কবিকঙ্কণ   মুকুন্দরাম  চক্রবর্তীকে  বাদ  দিলে  রায়  গুণের  ভারতচন্দ্রের    সমকক্ষ   আর  কোনো  কবি  মধ্যযুগে  আবির্ভূত   হন  নি । 
      
ভারতচন্দ্র  ও  অন্নদামঙ্গল কাব্য 
--------------------------------------------'---
অষ্টাদশ   শতকের   সর্বশ্রেষ্ঠ কবি  রায়  গুণাকর  সমগ্র  বাঙলা  সাহিত্যের   একজন  প্রথম  শ্রেনীর  মার্জিত  রুচির  বিদগ্ধ   সারস্বত   সাধক। তাঁর  রচনার  কিছু  অংশ  আধুনিক  রুচির  কাছে  আপত্তিকর  লাগলেও তাঁর  অসাধারণ  শব্দচিত্রে   ও  তির্যক  বাচনভঙ্গিমায়,  সরস  হাস্যপরিহাসে  এবং  অম্লাক্ত  ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে  যে  বিচিত্র  নাগরিকতার  পরিচয়  দিয়েছেন,  তা সমকালীন   বাঙলা  সাহিত্যে  প্রায়   দুর্লভ   বললেও  অত্যুক্তি   হয় না । তাঁর  রচনা  মধ্যযুগীয়   ধারানুসারী   হলেও  গ্রামীণ স্থূলতার   পরিবর্তে   নাগরিক  সূক্ষ্মতার   পরিচয়  অধিক  মেলে।    অজান্তেই    হয়ত   তিনি   আধুনিক  বাঙলা  সাহিত্যের   নব্যযুগের   প্রবর্তন    করেন।  রায়গুণাকর    ভারতচন্দ্র   বাঙলা  সাহিত্যের   ইতিহাসে  কৃষ্ণনগরাধীশ   মহারাজ   কৃষ্ণচন্দ্রের   সভা কবি  হিসেবেই   সমধিক  পরিচিত।
  প্রথম  জীবনে---নিতান্তই   কৈশোরে  সত্যপীরের  মাহাত্ম্য -- বিষয়ক  দুটি অতি  ক্ষুদ্র   পাঁচালি   রচনা  করেন । এছাড়া   আরও   কয়েকটি  পুঁথি  রচনা   করেন , তবে  সেগুলির  মধ্যে   বিষয়বস্তুর   নতুনত্ব   ভিন্ন   অন্য   কোনো  দিশানির্দেশিকা  দেখা  যায়  না । বাস্তব   জীবন  বোধ  ও   পরীক্ষা-নিরীক্ষার কিছু   নিদর্শন   পাওয়া   যায়   ভারতচন্দ্রের   হিন্দি   ও  ফার্সি   শব্দ   মিশ্রিত  ভাষায়   রচিত  কয়েকটি   কবিতায় । 
ভারতচন্দ্র   অমর  হয়ে  আছেন , তাঁর  "অন্নদামঙ্গল কাব্যে "র গুণে। "ভারত  ভারত  খ্যাত আপনার  গুণে"---  সে গুণ  হলো   অন্নদামঙ্গলের অন্তর্ভুক্ত   পরস্পর   সম্পর্কযুক্ত   অথচ  রূপকার্থে   ভিন্নধর্মী   তিনখানি  কাব্য---অন্নদামঙ্গল  বা  নুতন  মঙ্গল,  অন্নপূর্ণ মঙ্গল  বা  মানসিংহ  এবং   কালিকা মঙ্গল   বা বিদ্যাসুন্দর   কাব্য ।  ইতিহাস  ও  পৌরানিক  ঘটনাবলির  সাবলীলতায়   গ্রথিত  হয়েছে পূর্ণাঙ্গ   একটি  কাব্য ও  ছন্দময়

কাব্যগ্রন্থ--- অন্নদামঙ্গল কাব্য 
 অন্নদামঙ্গল   কাব্য   সম্বন্ধে  আলোচনা  করার   পূর্বে  খুব সংক্ষেপে   দ্বিতীয়   পর্ব   কালিকামঙ্গল  বা  বিদ্যাসুন্দর এবং মানসিংহ  বা অন্নপূর্ণামঙ্গল  বিষয়ে    দুই-  এক  লাইনের  মধ্য দিয়ে   কিঞ্চিৎ উল্লেখ  করা প্রয়োজন ।  বিদ্যাসুন্দর ও  দেবীকালিকার  মাহাত্ম্য   নিয়ে  ভারতচন্দ্রের  আগেও  কিছু  কাব্য   রচিত  হয়েছিল, সুতরাং   ভারতচন্দ্র   মৌলিক   রচয়িতা  নন।  কিন্তু  তীব্র   আদিরস  ও  অখণ্ড  বাস্তব   চিত্রায়নের   জন্য   পূর্বসূরিদের   তুলনায়  ভারতচন্দ্র   কিছুটা  এগিয়ে   আছেন।  এই  খন্ডটি    মূলতঃ   "বিদ্যাসুন্দর " নামেই  পরিচিত --- কালিকামঙ্গল   এখানে  আড়ালেই  থেকে  গিয়েছে । রায়গুণাকরের এই  খন্ডের   রচনাটি  প্রধানত  "বিদ্যাসুন্দর " পালা বা পাঁচালি  হিসেবে এখনও  জনমানসে  পরিচিত । তৃতীয়  পর্বটি   মানসিংহ  বা  অন্নপূর্ণা মঙ্গল কাব্য ।
 আশ্চর্য জনক ভাবে   এই  খণ্ডের কেন্দ্রীয়   চরিত্র   দেবী  অন্নপূর্ণা   কোনো  বিশেষ  কারণ  ছাড়াই   ধর্মীয় ও সামাজিক বিবাদ  বিসংবাদের   সূত্রে  তাঁর  দেবীত্বে   উপনীত   না  হয়ে কোথায়   যেন   শুধুমাত্র    রাজ  পরিবারের ও  কৃষ্ণ নগরের     রক্ষাকর্ত্রী  রূপেই    অধিক   পরিচিতি  লাভ   করেছেন। অবশ্য  রাজকবি   হিসেবে  মহারাজ   কৃষ্ণচন্দ্রের  গুণগান  করা  ভারতচন্দ্রের  অবশ্য পালনীয়  কর্তব্য  -- সে   বিষয়ে   সন্দেহ   নেই।   তবে  অনৈতিহাসিক  ঘটনা  ও  অতিরঞ্জনের  প্রভাবে   লেখনীর  কাব্যগুণে   ঘাটতি   থেকে   গিয়েছে ।
        অন্তিমে  আমরা অন্নদামঙ্গল  বা নূতন মঙ্গল কাব্য  নিয়ে  কিছু   আলোচনার  পরিসর   খুঁজে   নিতেই  পারি , যেহেতু  আমাদের   মূল  লক্ষ্য  কবির  ভাষায়   নূতনমঙ্গল কাব্যগাথার কিছু  পরিমাণ  চর্চা । এই  পর্বে   ভারতচন্দ্র  ইতিহাসের  ধারাকে   অনুসরণ  ও  অনুসন্ধান  করার  সাথে   সাথে  মহারাজ  কৃষ্ণচন্দ্রের ও  দেবী   অন্নদার  যশোকীর্তন  করেছেন। অন্নদামঙ্গলের  এই  অংশে   বাঙলার  নবাব  আলিবর্দি খান কর্তৃক  ভারতচন্দ্রের  পৃষ্ঠপোষক  মহারাজ   কৃষ্ণচন্দ্রকে  জগৎ শেঠের  সাথে  জটিল  রাজনৈতিক  ষড়যন্ত্রে   জড়িত  সন্দেহে রাজ্যচ্যুত  করে  কারাগারে  বন্দী  করা  এবং   কৃষ্ণচন্দ্র কর্তৃক   অন্নপূর্ণার  আরাধনায়  বাধা  বিপত্তি ও  বন্দীদশা   থেকে মুক্তি 
 এবং  পরবর্তীতে  কৃষ্ণচন্দ্রের  মহাসমারোহে দেবী  অন্নপূর্ণার পূজার  প্রচলন--- প্রধান   প্রতিপাদ্য । 
       পরের  অংশে  ভারতচন্দ্র  মূল  "কাশীখন্ড"  ও  তৎসহ সংস্কৃত  ভাষায়   রচিত  বিভিন্ন  "শিবপুরাণে"র  কাহিনী   অবলম্বনে  দক্ষযজ্ঞে  সতীর   দেহত্যাগ  ও  " কন্যা  উমা রূপে পর্বতরাজ  হিমালয়ের গৃহে  জন্মলাভ  , কিশোরী  উমার  তাপসিনী  রূপ এবং অবশেষে  শঙ্কর--উমার  বিবাহ এবং কাশী নামে   "অন্নপূর্ণা-- শিবাণী " রূপে পূজিত  হওয়ার  ঘটনার  বিস্তারিত   বিবরণ   করেছেন।  বৃদ্ধ  ব্যাসদেব  কাশীকে ব্যাসকাশীতে  পরিণত  করার  অপরিণত  প্রয়াসে শিবাণীর অলৌকিক   মহিমার  কাছে   কেমন   ভাবে  নাজেহাল হয়েছিলেন  ---অত্যন্ত  সরস  ভঙ্গিমায়    কবি   "ব্যাসকাশী" প্রসঙ্গে  বিবৃত  করেছেন। 
         কাশীধামে   দেবীর  মহিমা  প্রচারের  পর  দেবী অন্নপূর্ণা মর্ত্যলোকের  বিভিন্ন   অঞ্চলে শিবপূজা   প্রচারের জন্য   সচেষ্ট   হলেন  এবং  কুবেরের   অনুচরকে   শাপগ্রস্ত   করে এক  হতদরিদ্রের  গৃহে   হরিহোড়  রূপে  জন্মগ্রহণ   করতে  বাধ্য   করলেন ।  হরিহোড়  মর্ত্যধামে   দৈবী   কৃপায়  দারিদ্র্য  মুক্ত হয়ে বিশেষ  আড়ম্বর   করে   অন্নপূর্ণা   পূজার  প্রচার  করলেন।  কিন্তু   প্রৌঢ়বয়সে এক  রূপবতী   তরুণীকে  বিবাহ  করে  ভোগলিপ্সায়   নিমজ্জিত   হয়ে  দেবীর  আরাধনা  থেকে  বিচ্যুত   হলেন। ফলে  ক্রুদ্ধ  দেবী  পুনরায়    তাঁকে   ত্যাগ   করে কুবেরের  পুত্র   নলকুবেরের   প্রতি   দৃষ্টি   দিলেন। ইতিপূর্বেই  নলকুবের কে  লঘুপাপে  গুরুদন্ড  দিয়েছেন। তিনি   ভবানন্দ   মজুমদার   রূপে পৃথিবীতে  জন্মগ্রহণ    করেছেন । করুণার অবতার  দেবী অন্নপূর্ণা---- এইখানেই  দেবীকে "অন্নদা " আখ্যা  দিয়েছেন  রায়গুণাকর ।   প্রসঙ্গত   বলা  যায়   যে  ভবানন্দ  মজুমদারই   মহারাজ  কৃষ্ণচন্দ্রের  কৃষ্ণচন্দ্রের    পূর্ব   পুরুষ । ভবানন্দের গৃহে দেবী অন্নপূর্ণা  "অন্নদা লক্ষী"  রূপে অচলা  হলেন।  ভবানন্দ   সাধুপ্রকৃতির  মানুষ  ছিলেন ।  তাই  তিনি দেবীর  আশীর্বাদ   ধন্য। 
            মোটামুটি  ভাবে  এই  চালচিত্রেই  বাঁধা আছে অন্নদা মঙ্গলের কাহিনীর  কাঠামো ।  কাহিনী  খুব যে  চিত্তাকর্ষক তা বলা যাবে না , মৌলিক  তো নয়ই । তবে চরিত্র   চিত্রায়ন ও দৃষ্টিভঙ্গির   দিক  থেকে   এটিকে   একটি  বিচিত্র   কাব্য   বলা যায় । দেবীমাহাত্ম্য  প্রচারে  অন্নদামঙ্গলের  এক অভূতপূর্ব   দিক  উঠে   আসে   সাধারন   মানুষের  জীবনযাত্রায় ।  দেবীর সাধারণ   মানবী   রূপ  ও  ঈশ্বর পাটনীর  সঙ্গে  তাঁর  লৌকিক কথোপকথন  যেন চিরকালীন।  "আমার সন্তান   যেন  থাকে দুধে ভাতে "------- ।  খেয়া  নৌকার মাঝি -- ঈশ্বর, সাধারন  নিম্নবর্গের  বাঙালির  প্রতীক।  প্রতিদিনের  নৌকা  পারাপারে তার  দিনাতিপাত।  কূলবধূর   ছদ্মবেশে  দেবী  অন্নদা অনুরোধ   করেন  নাওয়ে   করে  তাঁকে নদীর অপর  পাড়ে   নিয়ে   যেতে।
ঈশ্বর  অপরিচিতা  নারীকে   নৌকায়  উঠতে  দিতে  পারে না । একাকিনী  বধূটি  স্ব -পরিচয়  দিতে রাজী নন। স্ব- মুখে  স্বামীর  নাম  উচচারণে  সামাজিক বাধা । অনিচ্ছুক   পাটনীর  সেই  নৌকার সেঁউতি তে বধূ  রাখেন  তাঁর কমল  চরণ--- মুহূর্তে   কাঠের ধরে সোনার বরন।   এই  মেটাফর ঈশ্বরের  বোধোদয় । সে  বোঝে  ইনি  সাধারনী   নন, দেবী । তাই  দেবী  স্বরূপে আবির্ভূতা  হয়ে  আশীর্বাদ   সহ  বর  দিতে চান।  ঈশ্বর   অতি সাধারণ  তুচ্ছ  ভক্ত ---- সে  কিছুই  চাইতে  পারে না ---- শ্রদ্ধা 
ও  ভালোবাসায়  আপ্লুত   ঈশ্বর  পাটনী দেবীর  কাছে তার পরিবারের   সামগ্রিক  কল্যাণ  কামনা করে ---- তার সন্তান  যেন থাকে  দুধে ভাতে ।  দেবী "তথাস্তু "বলে বরদান করে অদৃশ্য   হয়ে যান । 
আজ   প্রায়    তিনশো  বছরেরও  পুরনো  কাহিনী , কিন্তু  এখনও   সাধারন পিতার আন্তরিক  হৃদয় নিঙড়োনো  প্রার্থনা  ---তার সন্তান   যেন  ভালো থাকে , সুস্থ  থাকে , দুধে - ভাতে থাকে।  অধ্যাপক  অসিতকুমার  বন্দোপাধ্যায়ের মতে --"অন্নদা  মঙ্গল কাব্য--অষ্টাদশ  শতাব্দীর  সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্য , সমগ্র   বাঙলা সাহিত্যের  উল্লেখযোগ্য   গ্রন্থের  অন্যতম।" মধ্যযুগের   সব  কবিই  তাঁদের  নায়িকাকে দেবীত্ব  দিয়েছেন  কিন্তু  রূপের বর্ণনায়   তাঁরা  যেন  প্রেয়সী, অথচ  ভারতচন্দ্রের  লেখনীতে 
---"কে বলে শারদ শশী , সে  মুখের তুলা 
    পদনখে  পড়ে আছে তার কতগুলা "।।
মধ্যযুগের কবিদের মধ্যে  আজকের দিনেও সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক তাঁর লিখিত  কিছু  কথা প্রবাদ বাক্যের মত মনের মধ্যে  মনি মানিকের  মূল্য নিয়ে  থেকে গিয়েছে--- " নগর পুড়িলে দেবালয়  কি এড়ায়" ? "মন্ত্রের  সাধন কিংবা শরীর পাতন "---- এ  হেন  কবির  কাব্যগ্রন্থ   মাত্র   একটি --- "অন্নদামঙ্গল "যা কবির নিজের ভাষায়  "নূতন  মঙ্গল  কাব্য " । 




তথ্যসূত্র----- বাঙলা সাহিত্যের  ইতিবৃত্ত---ডঃ অসিত
 কুমার বন্দোপাধ্যায় ।
বাঙলা সাহিত্যের  মধ্যযুগীয়  ইতিহাস--- উইকিপিডিয়া।।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র