উত্তম বিশ্বাস

মায়াজম
3

                     আদি প্রত্ন কথা 



সেনাপতি অনঙ্গ হাওদা থেকেই হাঁক ছাড়লেন, ‘বিরজু, ঘরমে হ্যাঁয়?’  মাটির প্রদীপ হাতে বিজলী বেরিয়ে এল। বিজলী বিরজুর শৈলী সঙ্গিনী। জরির ঘোমটাখানি নাক অবধি নামিয়ে দিয়ে অনঙ্গদেবকে রাজন্য রীতিতে আহ্বান জানাল বিজলী। আলোর স্তম্ভ অনুসরণ করে হেঁটে চললেন নবজলধরশ্যামকান্তি মদনবিগ্রহস্বরূপ স্বয়ং সেনাপতি 
-‘মূর্তির কাজ আর কতটা বাকি শিল্পী?’ গুমটী ঘরের অন্ধকার ঠেলে বেরিয়ে এল সম্মোহন মিশ্রিত শুষ্ক স্বর, ‘হুজুর, দেবতার গতিক ভালো না। তাছাড়া বিজলিও আজকাল বায়না ধরছে। বলে কিনা, শতমুখীর পলল কাটিয়ে না দিলে সে তার আড়াল সরাবে না।’ 
-‘সে কী হঠাৎ শতমুখী সংস্কারের সংকল্প কেন?’ 
বিরজু অবজ্ঞার সাথে বলল, ‘হুজুর, ও বলে ওই নদীপথেই নাকি ওর পালিত হরিণগুলি রোজ দলবেঁধে পার হয়ে অন্য রাজ্যে পালিয়ে যাচ্ছে!
অনঙ্গদেব বিজলীর অঙ্গসৌষ্ঠব লক্ষ্য করে অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন। হঠাৎ বিজিলীর বুকঠ্যালা কম্পিত বাষ্পে মাটির প্রদীপখানি দপকরে নিভে গেল। এরপর সেনাপতি হাওদাতে ওঠার আগে ঝম করে একটি মোহরভরা পুঁটলি ছুড়ে মারলেন। সেটি বিজলির বুকের ওপর আছাড় খেয়ে পড়তেই ওর ঘোমটাখানি খসে গেল।

ইদানীং গুমটীঘরে বিজলী আর আসে না। একদিন গভীর রাতে পাথর ঠোকাই করতে করতে বিরজু লক্ষ্য করল, মজেআসা নদীটার ওপর দিয়ে ছুটন্ত হরিণের মতো দলবেঁধে কারা যেন পার হয়ে যাচ্ছে। আর বিজলী লেবুর পাতায় একটা একটা করে মোহরদানা ভাসিয়ে দিচ্ছে। আর ওগুলো কিছুদূর আবদি গিয়েই ডুবে যাচ্ছে। বিরজু বিজলীকে ঝাঁকিয়ে দিয়ে চিৎকার করে উঠল “এ কী পাগলামি করছ তুমি?”
-“আমার হরিণগুলি সব পালিয়ে গেল গো!”
-“মাথা খারাপ হয়েছে তোমার! তোপধ্বনি শুনছ না? ধারেকাছে নিশচই যুদ্ধ লেগেছে। ঘরে চলো নইলে এখুনি মারা পড়বে!” বাকি মোহর পুঁটলি করে নিয়ে বিজলী আবারো তার বক্ষবন্ধনীর গিঁটে গুঁজে রাখল। বিরজু হাত বাড়াতেই বিজলী বাঁধা দিয়ে বলে উঠল, “উঁহু একদম ছোঁবে না বলছি। এটা পাথর না, তাই ইচ্ছে হলেই ছেনি ঠুকবে। বড্ড আনাড়ি ভাস্কর তুমি বুঝলে!”
শিল্পী হিসাবে বিরজুর সুখ্যাতি সাতসাম্রাজ্যজুড়ে। তারও চেয়ে অধিক কদর মোহিনী ষোড়শবিভঙ্গের অধিকারিণী বিজিলী বাঈয়ের। বিরজুর চোখে বিজলী সাকারা সম্পদ। কিন্তু ইদানীং কী যেন একটা অতৃপ্তি, একটা অদৃশ্য তাড়না বিরজুর ঐশীসত্ত্বাকে দিনকে দিন দিকভ্রান্ত করে দিচ্ছে। মাত্র তিন পক্ষকালের মধ্যে তিনকুড়িরও অধিক মূর্তি নষ্ট হয়েছে ওঁর হাতে। যেটা কিনা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের থেকেও অধিক অঘটনের বলে মনে হয় শিল্পী মহলে কিন্তু এসব খবর একদম বাইরে চাউর হতে দেয় নি বিরজু। প্রতিটি মূর্তিই বক্ষদেশে এসে ক্ষতগ্রস্ত হতে লাগল। কর্তিত স্তন ক্ষত বিক্ষত বক্ষদেশ মেরামত করতে করতে বিরজু একসময় মরিয়া হয়ে উঠল বারবার সেই একই ভুল, ধ্যানভঙ্গ সাধকের মতো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ছিটকে যেতে লাগল তার আরাধ্য মাধুরী। পাহাড় থেকে পাথর বহন করতে করতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ল বিরজু। হাতুড়ির আঘাতে সঞ্চিত সময়টুকুও ধুলো হয়ে ঝরে পড়তে লাগল। কিন্তু মহারাজ তাঁর অভিষেক তিথিতে সকলের সমক্ষে সংকল্প করেছেন নন্দনমহল সাজাবেন বিজলীর প্রতিরূপ পাষাণের উর্বশী বসিয়ে। এমন মগ্নমন্দ শিল্প নিদর্শন দেখামাত্রই শিরোচ্ছেদ যে অবধারিত একথা শিল্পী মোক্ষমরকম জানে। তাই গভীর রাতে সবার অলক্ষ্যে বিরজু সেগুলি শতমুখীর চরে একটা একটা করে পুঁতে ফেলতে লাগল। শতমুখীর চর যেন এখন এক অলিখিত সমাধিক্ষেত্র! একদিন বিজিলী ঝড়লাগা মাস্তুলের মতো আড় হয়ে দাঁড়াল বিরজু যেখানে গর্ত খনন করছিল, সেই বালির উপরে, “হাহাহা! সত্যকে এভাবে কবর দিতে হয় বুঝি শিল্পী? কতো কতো রাজদরবার ধুলো হয়ে গেল ইতিহাস সাক্ষী। তোমার সুখ্যাতির ইমারত থেকে একটুও সুরকী খসাতে দেবে না এই পণ করে আছ বুঝি?”
-“আর একটিবারের জন্যে তুমি সঙ্গ দাও বিজলী। সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে নিজেকে প্রকাশ করো!”
মোহরভরা পুঁটলিটি ঝাঁকিয়ে বিজলী বলতে লাগল, “এর বিনিময়ে কী দিতে পারবে আমার? রাজ্যপাট? সোনার পালঙ্ক? রাজকীয় বীর্যবত্তা? অমরত্ব?-- কিচ্ছু নেই তোমার? মরুভূমির উটের কুজেও সামান্য তরল থাকে, তোমাতে তাও নেই! দাও ছেনি দাও, হাতুড়ি দাও, বাটালি দাও—যাও যাও কিছু দিনের জন্যে বিশ্রাম নাও শিল্পী। নগ্ন যদি হতেই হয়, সেই রাজসন্দর্শনেই হব। কেউ তোমার শিরোচ্ছেদ করবে না, তুমি নিশ্চিন্ত হতে পার!”

গাড়োয়ান সম্ভবত পথ হারিয়েছে। এখন গভীর রাত। তবে প্রহর মাপার উপায় নেই। চান্দ্রজোয়ারের ভেসে যাচ্ছে দশদিক। বিজলী চলেছে সেই লালমাটির প্রাসাদ আবিস্কারের আশায়। যেখানে তার মতো নারীশরীরকে পাষাণে প্রতিষ্ঠা করতে চান স্বয়ং রাজা। ছইয়ের তলায় তন্দ্রাতুর বিজলী মোহিনীস্বরে গাইছে-- 
“গ্যায়ে দিনো কা সুরাগ লেকর।
কিধার সে আয়া কিধার গ্যায়া ও।
আজিব মানুষ আজনবি থা
মুঝে তো হয়রান করগ্যায়া ও।
গ্যায়ে দিনোকা---। 
ব্যাস এক মোতিসি ছব দেখাকর
ব্যাস এক মিঠিসি ধুম শুনাকর 
সিতারা এ শ্যাম বনকে আয়া---
বরং গে খব সাহার গ্যায়া ও।
আজিব মানুষ আজনবি থা---!  
ও হিজরি কি রাত কা সিতারা
ও হাম নাফাস হাম সুখাম হামারা।
সদা রহে উসকা নাম পেয়ারা। 
শুনাহে কাল রাত মর গ্যায়া ও।”

ষাঁড়ের পিঠে চাবুক চালাতে চালাতে গাড়োয়ানও মাঝে মাঝে দোহার দিচ্ছে--  
“ও রাত কা বে নভা মুসাফির
ও তেরা শায়ের ও তেরা নাসির।
তেরি গলেতক তো হামনে দেখা থা
ফিরনা জো আনে কিধার গ্যায়া ও” একসময় গান থামিয়ে বিজলী জিজ্ঞাসা করল, “এটা কোন রাজ্যের ওপর দিয়ে চলেছি গাড়োয়ান?”
-“জানিনা তবে এটি বিসনাগার করদ রাজ্য। তবে এই নামটিও হয়ত আর কিছুদিনের মধ্যেই মুছে যাবে!”
-“মানে?”
গাড়োয়ান একটু এদিক ওদিক চোখঘুরিয়ে ষাঁড়ের পিঠে জোর চাবুক লাগাতে শুরু করল। বিজলী আবার কুতূহলী হয়ে উঠল, “ওই যে উঁচু উঁচু শীষগুলো দেখা যাচ্ছে ওগুলো কি সব সোনার গাড়োয়ান?”
-“না এগুলো গম যব আর জনারের ক্ষেত। তবে এই মাটিতে তাল তাল সোনা জমা আছে কিনা, তাই ক্ষেতির সব শীষগুলো সোনার মতো দ্যাখাচ্ছে।” মোহরের পুঁটলিখানি বার করে বিজলী টিপে টিপে মিলিয়ে দেখতে লাগল, কাঁচা ফসলের রঙ উজ্জ্বল, নাকি তার কাছে সঞ্চিত সোনার দানা? কিচ্ছুক্ষণের জন্যে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল বিজলী। হঠাৎ অচেনা এক শব্দে ছৈএর মধ্যে ঠেলে উঠল, “শুনতে পাচ্ছ গাড়োয়ান, কাদের পায়ের শব্দ?”
-“মুসলমান হানাদারদের যুদ্ধের ঘোড়া!”
-“মূর্খ! মুসলমান হলে, যুদ্ধের ঘোড়ার পায়ে নূপুর বেঁধে দিল কে? তুমি নিশ্চই?” গাড়োয়ান সদুত্তোর দিতে না পেরে খুব লজা পেল। কিন্তু ওই যে যুদ্ধজয়ের মতো শতকিন্নরদলের শোভাযাত্রার মতো ধ্বনি জোসনার চন্দন মেখে মেখে বিজলীর চেতনালোর সকলদুয়ার গুলি যখন উল্টে পালটে দিতে শুরু করল বিজলী গরুর গাড়ি থেকে ঝাঁপ দিয়ে জনারের ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে উন্মাদিনীর মতো দৌড়াতে লাগল। গাড়োয়ান অসহায়ভাবে হাঁক দিল, “ফিরে এসো। নতুবা রাতের শুকোর সন্ধানীরা বাগে পেলে তোমাকে কাবাব বানাবে!” 

সারেঙ্গীর শুশ্রূষায় অনেকটা সুস্থ্য হয়ে উঠেছে বিজলী। গমের আলকুশি আর শুকরসন্ধানীদের ছোড়া পাথরে সোনার অঙ্গ নিয়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে ভূমে লুটিয়ে পড়েছিল সে। সারেঙ্গী ও তার সহযাত্রীরা টমটমিতে তুলে নেয়। সারেঙ্গী রাজ নর্তকী। এককালে ধুলাধোয়ী পাহাড়ের কোলে চেল রাজ্যে ছিল ওদের আদি বাস। ভালো বাদ্যযন্ত্র বানাতো এদের পূর্বপুরুষেরা। বছরের পর বছর বহিঃশত্রুদের অত্যাচারে সর্বস্বান্ত হয়ে ওদের মধ্যে কেউ কেউ প্রবল প্রতাপশালী বিসনাগা সাম্রাজ্যের অধীনে কেউ রাজদাসী, কেউ নর্তকী, এসব পেশা বেছে নিয়েছে। এখন বিসনাগা সাম্রাজের অন্তঃপুরের একমাত্র অলংকার সারেঙ্গী। একটু একটু করে বিজলী সম্পর্কে সব জেনে নিতে চায় সারেঙ্গী। কিন্তু বিজলী পাষাণের চেয়েও অটল। বিজলী যখন বুঝল সারেঙ্গীও কিছু সারছে, অমনি সে বক্ষবন্ধনীর নিচ থেকে মোহরভরা পুঁটলিটা ছুড়ে দিয়ে বলল, “আমার আর কিচ্ছু মনে নেই। শুধু এটুকু মনে আছে আমি এই সাম্রাজ্যের রমণীমোহন সম্রাটের সন্ধানে একদিন সংসার পরিজন সবকিছু ছেড়ে পথে নেমেছিলাম! এগুলো সব তুমি নাও। এর বিনিময়ে দয়াকরে আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে চলো।”
সারেঙ্গী কনকগুলি কুড়িয়ে নিয়ে একটা একটা করে খুঁটিয়ে দেখল, সবই সম্রাটের নামাঙ্কিত। এরপর ওগুলি ওকে ফেরত দিয়ে আলত আদর করে বলল, “কাল তাঁর দর্শন পাবি।”
-“সত্যি? কোথায়?”
-“বিরাট সাগরে।” 
বিজলী ব্যস্ত হয়ে উঠল, “কোথায় সে বিরাট সাগর?”
-“কাল উষা প্রকাশে আয়, দেখবি পদ্মপাতায় কতশত শুকুন্তলা কটিবাস খুলে ভেসে আছে!” 

পদ্মশোভিত বিশাল জলকর। চুতুরপার্শে প্রস্তর প্রাসারিত সিঁড়ি। স্তম্ভের পাশে রাখা আছে বীণা। কৃত্রিম ফোয়ারার সাথে বাঁধা আছে সিতারা। আজ বিরাট এক দুগ্ধকলস উপুড় করে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছে বিজলী। রাজা আসবেন। গাত্রস্খালন করতে করতে বিজলীকে দেখবেন। কিন্তু এল না। দিনশেষে একদল ঘোড়সওয়ারী ধুলোঝর আর বিরাট আতঙ্কের হল্লা জাগিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে। বিজলী অনুভব করল জলের ওপটা যেন মহাপ্রলয়কালে সমুদ্র যেমন টলতে থাকে, তেমনই টলছে! চারিদিক হয়ে একের পর এক হল্লা ভেসে এল, “যুদ্ধ লেগেছে। বর্গী এসেছে। যবন হানাবাহিনীর হাতে সবার মুণ্ডু নিপাত যাবে পালাও!” ধোপানী নাপিত সহিস মাহুত যে যেদিকে পারল প্রাণ হাতে করে দৌড়াতে লাগল। কেউ কেউ পরিখার খোলে আত্ম বিসর্জন দিল। বিজলী বুঝল এমন দিনে রাজার স্নান বিলাসিতায় আসা অসম্ভব। এবার সে নিজেকে জল থেকে টেনে তুলবার চেষ্টা করল। আবারো একবার আতঙ্কে গলা ফেড়ে ডাকল, “সারেঙ্গীইইইইইই!” কিন্তু কোথায় সারেঙ্গী? কোত্থাও নিক্কনধ্বনি শুনতে পেল না। চারিমহলা থেকে মুহুর্মুহু হর্মপতন আর হ্রেষাধ্বনি ভেসে আসতে লাগল।

নগরের প্রতিটি তোরণ দিয়ে জলস্রোতের মতো ঢুকতে লাগল বহিরাগত শত্রুসৈন্য। একের পর এক ধূলিসাৎ হতে লাগল অপূর্ব সব শিল্পরীতি। রাতের আঁধারে নগ্ন পায়ে প্রেতাত্মার মতো হেঁটে বেড়াতে লাগল বিজলী। গ্রীক গান্ধার চোল পল্লব সমস্ত প্রস্তর প্রতিমা বিজলীর পায়ের কাছে এসে লুটিয়ে পড়তে লাগল। এদের কর্তিত মুণ্ডু, ভঙ্গুর ভগ্নাবশেষ আর নাটমহলের ধুলো দুহাতে উড়িয়ে এক এক সময় বিজয়ের উল্লাসে ফেটে পড়ল বিজলী। অচেনা আতঙ্কে উদ্যান থেকে ঝাঁক বেঁধে উড়ে গেল পাখি। বিদ্যুৎ চমকের মতো সরে গেল সোনালী সব হরিণ। আগুন ছড়াতে ছড়াতে মরুবালুর দিকে ধেয়ে গেল শতশত অশ্বারোহী। প্রলয়ের চেয়েও অশুভ নাদ তুলে দুলকিচালে বেরিয়ে যেতে লাগল অগণিত গজ। হঠাৎ একদিন অন্তঃপুরবাসিনী নারীদের কলরোলের মধ্যে বিজলী শুনতে পেল সেই বার্তা, “রাজা বন্দী হয়েছে। রাজা বন্দী হয়েছে। আগামীকাল ঊষা প্রকাশের আগে এই বেদীর ওপর বসিয়ে ওঁর শেষ ইচ্ছা শোনা হবে। তারপর--!”
--“তারপর কী?” সবাই যেন সেই একটি কথা অস্ফুটে এড়িয়ে যেতে লাগল। বিজলী মরিয়া হয়ে কান পাতল দেওয়ালে, “তারপর কী হবে তাড়াতাড়ি বলো!” মনে হল যেন পুরু দেওয়ালের ভাঁজে মাছির মতো আটকা পড়েছে অনেকে। বিজলী কপাল ঠুকে বলল, “আমার মাথা খাও -- বলো-- বলো! শেষ কথাটা বলো!” এইবার ওখান থেকে অসুখী আত্মার থেকে পলেস্ত্রা ফুড়ে ভেসে সেই সর্বনেশে কথা, “শেষ ইচ্ছা পূরণের পর সম্রাটের শিরোচ্ছেদ করা হবে!”
বিজলী বুঝল তার হাতে সময় খুব কম। সেদিন খুব ভোর ভোর সাত কলস মহিষের দুধ দিয়ে নিজেকে ধৌত করে নিল। তারপর রাজদরবারের ঠিক সামনের সারিতে সবচেয়ে উঁচু মণিখচিত স্তম্ভের উপর উঠে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ পরেরই আবার হাহাকারের মতো হল্লা ভেসে এল, “রাজাকে আনা হচ্ছে! রাজাকে আনা হচ্ছে!”
এইবার বিজলী কটিবাস খুলে হাওয়ায় উড়িয়ে দিল। সম্পূর্ণ উলঙ্গ। অথচ মোহর রাখা চামড়ার পুঁটলিটি উঁচিয়ে ধরে খাজুরাহ রীতিতে খিলানের ওপর দাঁড়াতে চেষ্টা করল। অমনি কোথা থেকে এক বিষমাখা তির বিজলীর বক্ষদেশ বরাবর এসে বিঁধে গেল। কনক কাঙ্ক্ষিত শরীর নিয়ে বিজলী ভূমিতে লুটিয়ে পড়ল। ভিড়ের মধ্যে থেকে বুনো শিকারী বেগ নিয়ে এক উন্মাদ বিজলীর নিথর দেহটি কোলে নিল। তিরটা তুলে নিয়ে খাপে রাখল। বন্যার বেগে সৈন্য বেরিয়ে গেল। পিঁপড়ের সারির মতো কৃতদাস। অথচ এ অচিন্ত্য মহলায় অদ্ভুত এক নৈশব্দ! একসময় লোকটি আকাশ কাঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ঠিক তখন বন্দী অনঙ্গদেব চিনতে পারলেন, “বিরজু তুমি? এটা তোমার বিজলী বাঈ না?” 
বিরজু কোনও জবাব দিল না। সে বিজলীর আলুলায়িত মুঠো থেকে মোহরকুচিগুলি কুড়িয়ে নিয়ে অনঙ্গদেবের পায়ের কাছে রেখে মৃত হরিণীর মতো বিজলীকে কাঁধে তুলে নিল। অনঙ্গদেব আবারো জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার শৈলীকে কোথায় নিয়ে চললে শিল্পী?” 
বিরজুর শ্রান্ত সমাহিত শেষ জবাব, “শতমুখীর চরে!”



                                  




তথ্য ঋণ- 
মধ্যযুগের দক্ষিণ ভারতীয় সাম্রাজ্য বিকাশ (গুগুল)
মধ্যযুগের দক্ষিণ ভারতীয় শিল্পকলার ইতিহাস(গুগুল) 
কল্পনায়- বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সম্ভব্য পরিনিতি।
গান- গজল(গুলাম আলী আশা ভোঁসলে)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন