বল্বল
আমাদের মণিমতী নগরীতে আজ অটবীপূজা। বন আমাদের ঘিরে রেখেছে মায়ের আদরের মতো। মাকে অবশ্য দেখিনি আমি। ধাইমা সিংহিকা বলেন, মায়েরা নাকি সন্তানকে দুহাতে ঘিরে রাখেন। এই মহাবনের গাছেরা আশ্রয় দিয়েছে আমার পূর্বপুরুষদের। মারা যাওয়ার পর তাঁরা গাছে মিশে যান। তাঁদের ডাকেই আকাশ চিরে বৃষ্টি নামে। বন থেকে আমরা খাদ্য পাই, ওষধি পাই। তাই, আমরা বনকে পূজা করি। আজ আমাদের মেয়েরা, বনের মধ্যে বিশেষ পূজাস্থানে যাবে। গান শোনাবে গাছদের, দুই হাতে জড়িয়ে ধরবে গাছের কাণ্ড, আদর করে বলবে, শান্ত হও, তৃপ্ত হও, সুখী থাকো, ঘিরে রাখো। প্রধান পুরোহিত সকলকে বনের গল্প শোনাবেন। বলবেন, মাটির কথা। জানাবেন, কেমনভাবে আমাদের পূর্বপুরুষরা মিশে আছেন বন আর মাটির সঙ্গে। পূজা আরম্ভ হতে আর বেশি দেরী নেই। আর, এই সময়ই সে বনের মধ্যে গিয়ে বসে রইলো? কবিরা পাগল হয় শুনেছিলাম, এখন দেখছি। ওকে খুঁজে আনার দায়িত্ব আমারই। কারণ, প্রথমত, প্রায় আমার সমবয়সী এই ব্রাহ্মণ কিশোরের সন্ধানে আমি সহায়ক হবো বলে কথা দিয়েছি, দ্বিতীয়ত, এই পূজাতে ওকে একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে,গোধূলি লগ্নে। বনের মধ্যে অনেক বিপদ। কথা হলো, গেল কোথায়? ওই যে, গলা শোনা যাচ্ছে। ওকি! আটবিক গোষ্ঠীর ইধ্ম না? হাতে পাথরের মুদ্গর, বুকে হেঁটে চলেছে সেই ঝোপটার দিকে, যার আড়াল থেকে গান ভেসে আসছে।
- জয় বনানী, জয় বনানী
কোথায় উধাও হও না জানি!
বসতি নেই, নেই মানবও
হে অটবী, ভয় করে না?
ভয় করে না?
ঝিল্লি মুখর সন্ধ্যাকালে
পতঙ্গরা ধরলে আখর
সুর ছুটে যায় হাওয়ায় সওয়ার
বনানী হয় বীণাপাণি
জয় দেবী বাক্।
গাছের গায়ে হেলান দিয়ে গান গাইছে। চোখ বোজা। মুখে অপার শান্তির আলো। কবিরা কি সম্পূর্ণ নিজস্ব এক পৃথিবীতে বাস করে? ইধ্ম পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে, হিংসাবিকৃত মুখ। সাবধানে উঠে দাঁড়িয়ে হাত ওপরে তুলল। তারপরেই বিকট চিৎকার। আমার অয়োমুখ বাণ বিঁধে গেছে বাহুমূলে। সে চোখ খুলেছে। বিস্ময়বিমূঢ় চোখে চেয়ে আছে ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়নপর ইধ্মর দিকে। সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
- এখানে কী করছিস?
হাসল সে।
- অটবীপূজার জন্য গান রচনা করছিলাম বল্বল। আমি দরিদ্র ব্রাহ্মণ। আর তো দেওয়ার কিছু নেই।
- তোর দেবভাষায় রচনা করা গান আমার প্রজারা গাইতে পারবে না ভাই! আর, বাইরের কারও, বিশেষত আর্যদের, এ পূজায় কোনও অধিকার থাকে না।
যন্ত্রণাভরা অসহায় মুখ। নিঃশ্বাস ফেললাম।
- গানটা আমায় শিখিয়ে দিস। অনুবাদ করে পরের বছর পূজায় কাজে লাগাবো।
তার মুখে মেঘকাটা আকাশের মতো হাসি। কিছুক্ষণের নীরবতা। আমরা পাশাপাশি হাঁটছি।
- বল্বল।
- বল
- ওই মানুষটি আমাকে মারতে চাইছিল কেন রে? আমি তো ওর কোনও ক্ষতি করিনি।
এর কী উত্তর দেব? পশ্চিম দিকে সরস্বতী-দৃষদ্বতী নদী-সংলগ্ন বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগে আর্যরা বসতি স্থাপন করেছে। বহিরাগত ওরা। আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছে বারংবার। আমার প্রপিতামহ হিরণ্যকশিপু, পিতামহ হ্লাদ এবং আমার পিতা ক্রমাগত বিরোধিতা করে গেছেন ওদের। তবে, সন্ধি করেছিলেন পিতামহের অগ্রজ প্রহ্লাদ। তাই তিনি ওদের নয়নমণি। আর আমরা? দানব, দস্যু, দাস! আমাদেরকে অপবিত্র, অশুচি প্রমাণে ব্রাহ্মণদের উৎসাহ সবচেয়ে বেশি। ফলে, মুনি, ঋষি আর বামুনদের ওপরই আমাদের জাতক্রোধ। পিতা তো…
- আমরা দানব দৃঢ়সু। আমার অরণ্যবাসী প্রজারা, তোদের ভাষায় পিশাচ। পৈশাচিক আচরণই করবে, এটাই প্রত্যাশিত নয় কি? আমার পিতা ব্রাহ্মণদের খুব ভক্তি করতেন। সে ভক্তি এতদূর গিয়েছিল যে, তিনি এক মহাতেজা ব্রাহ্মণের ঔরসে, আমার মায়ের গর্ভে, তোদের ইন্দ্রের সমান তেজস্বী এক পুত্র উৎপাদন করতে চেয়েছিলেন। সেই ব্রাহ্মণ কী বলেছিলেন জানিস? বলেছিলেন, অশুচি দানবী গর্ভ নরকতুল্য। যে কোনও বীর্যনিষেকে সেই নরক থেকে যমদূতই উঠে আসবে। এ কথা শুনে পিতা সঙ্গে সঙ্গে সেই ব্রাহ্মণকে বধ করেন। তারপর থেকে ব্রাহ্মণবধ তাঁর ব্যসন হয়ে ওঠে।
- কিন্তু, তুই তো অন্যরকম। আমি তোর কাছে যেদিন এলাম, মাসাধিক কাল পূর্বে, আমার পরিচয় জানার পরও, তুই আমাকে মিত্র বলে গ্রহণ করলি। আমার সন্ধানে আমাকে সহায়তা করবি বলে কথা দিলি। বললি, অটবীপূজার পরই…
- আমি তো অন্যরকমই। সেই ব্রাহ্মণদেবতা বলেছিলেন না, নরককুণ্ড থেকে ভিন্ন জাতীয় জীব উঠে আসে? তাই তো, আমার জন্মের সঙ্গে সঙ্গে আমার মা মারা যান। এক মাস পর পিতাও। আমার কথা থাক। তুই এই সন্ধানে বেরোলি কেন তা বুঝিয়ে বল। তোর পিতার সন্ধান পেয়ে কী লাভ? এটা আমি এই ক’দিন জানতে চাইনি।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে বলল,
- নিজেকে এত যন্ত্রণা দিস না বল্বল। যাই হোক, আমি কেন বেরোলাম? দ্যাখ, আমার মা লোপামুদ্রা বিদর্ভ দেশের রাজকন্যা। আমার পিতা ব্রাহ্মণ হলেও দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। অগ্নির স্বরূপ তিনি। আর্যাবর্ত জুড়ে বারবার তিনি দানব দলন করেছেন। তাঁর খ্যাতি এতটাই প্রচণ্ড ছিল যে, পুত্র উৎপাদনের জন্য যখন তিনি মাকে বৃদ্ধ বয়সে বিবাহ করতে চাইলেন, আমার পিতামহ এতটুকু আপত্তি করলেন না। এরপর প্রবল পরাক্রমে তিনি আমাকে পৃথিবীতে আনার চেষ্টা করতে লাগলেন। তাঁর ইন্দ্রিয়প্রহারে ক্লান্ত মাতা একদিন তাঁকে বললেন,রাজনন্দিনীর শরীর সুখে লালিত হয়েছে। সেই দেহ থেকে যদি পুত্র উৎপাদন করতেই হয়, তবে তার যথোপযুক্ত পরিচর্যার ব্যবস্থাও পিতাকেই করতে হবে। অন্যথায়, দারিদ্র্যক্লিষ্ট দেহ তাঁর পৌরুষের তেজ বেশিদিন সইতে পারবে না। তিনি পুত্রসুখ লাভের পূর্বেই মা লোকান্তরিতা হবেন। এককথায় অর্থ চাই। তাই…
- তাই, রাজা শ্রুতর্বা, ব্রধ্নশ্ব এবং ত্রসদস্যুর সঙ্গে মিলিত ভাবে তিনি আমাদের রাজ্য আক্রমণ করলেন। পিতাকে বধ করলেন। রাজ্য লুন্ঠিত হলো। সৈন্যদের যথেচ্ছ নারীধর্ষণে অনেক অবাঞ্ছিত শিশু জন্ম নিলো। তাদের বনের মধ্যে ফেলে দিলো তাদের মায়েরা। আটবিকরা মানুষ করলো তাদের। তোকে যে মারতে চেয়েছিলো, ওই ইধ্ম,সে ওরকমই এক শিশু ছিলো। এবার বোধহয়, তোর প্রশ্নের উত্তর পেয়েছিস? ওর চোখে তুই, এক প্রতিকারহীন অবিচারের প্রতীক।
- তোর কাছেও তো?
- কী?
- বলছি, তোর কাছেও তো আমি তাই?
চুপ করে রইলাম। সে নীচু গলায় হাসলো।
- বোধহয় এসে গেছি পূজাস্থানে। তোর রক্ষীরা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে। বাঁধতে হবে না বল্বল। আমি পালাবো না।
- কী বলছিস?
- বল্বল, বল্বল! আমাকে এতটা নির্বোধ ভাবলি কী করে ভাই? তোর রাজ্যে মাসাধিক কাল রয়েছি, অটবীপূজায় নরবলি প্রয়োজন এই সংবাদ পাব না? রক্তে ভূমি ধুইয়ে পিতৃপুরুষকে অর্চনা করতে হয় আমি জানি।
- হ্যাঁ তাই!
চিৎকার করে উঠেছি আমি।
- তাই, যেদিন প্রথম এলি, সেদিনই আমি বুঝেছিলাম তোকে বনদেবী এনেছেন এখানে। নাহলে, মণিমতীর পরম শত্রুর পুত্র অটবীপূজার ঠিক আগে এখানে আসবে কেন? আমার কাছে প্রাণভিক্ষা করে কোনও লাভ নেই। আমি নরক থেকে উঠে আসা যমদূত। আমি...
- বল্বল! শান্ত হ ভাই! আর অত্যাচার করিস না নিজের ওপর। তোকে যেদিন প্রথম দেখি, সেদিনই বুঝি তুই ভীষণ একা। কোনও বন্ধু নেই তোর। একা থাকার প্রবল যন্ত্রণায় ছটফট করছিস। কে সেই ব্রাহ্মণ যে মানুষকে এতবড় অপমান করে? সে ব্রাহ্মণ হতেই পারে না। ঋষি তো নয়ই। ঋষি সকল প্রাণীকে এক আনন্দের সুতোয় বাঁধা দেখেন। আলোর গান করেন। যারা তোকে, তোদের অপমান করেছে, আঘাত করেছে, তাদের সকলের হয়ে প্রায়শ্চিত্ত করবো বলেই আমি ঘর ছেড়েছি। পিতার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করবো বলে, রাজ্যে রাজ্যে গিয়ে ক্ষমা চাইছি : প্রাণ যেতে পারে জেনেই। তোর কাছে এসেছিলাম একই উদ্দেশ্যে। কিন্তু, তোর ক্ষত এতই গভীর, কেবল ক্ষমা প্রার্থনায় কিছু হবে না। তাই, বলি হবো বলে অপেক্ষা করছিলাম। আমার জন্মের পরই পিতা ঘর ছাড়েন। এখন শুনছি, তিনি দক্ষিণ দিকে যাচ্ছেন। যদি দেখা পেতাম, তবে বলতাম, তিনি ভুল পথ বেছেছেন। হিংসা থেকে হিংসাই জন্মায়। যাক সে কথা। আমার রক্তে যদি তোর শান্তি আসে, তবে তাই হোক। আমি তোর বন্ধু বল্বল।
হাসলো সে। ভোরের আলোর মতো হাসি।
- তোকে গানটা শেখানো হলো না।
পুরোহিতরা এগিয়ে আসছেন। মেয়েরা গাছ জড়িয়ে গান করছে। ছেত্তা খড়্গে শাণ দিচ্ছে। আমি অবিশ্বাসভরা চোখে তাকিয়ে আছি। মরতে ভয় করে না, এ কে? পুরোহিতরা তার দুইবাহু ধরেছেন।
- থামুন!
চারিদিক নিঃস্তব্ধ।
- আমি, হিরণ্যকশিপুর বংশধর, দনুজপতি বল্বল, এই মুহূর্ত থেকে, অটবীপূজায় নরবলি নিষিদ্ধ ঘোষণা করছি। অকারণে অনেক রক্ত ঝরেছে, আর নয়।
আমরা যাত্রা শুরু করেছি। দক্ষিণদিকে। সব মিলিয়ে বর্ষার্ধ অতিবাহিত হয়েছে, এর মধ্যে। বলি বন্ধের পর, পুরোহিতদের প্ররোচনায় রাজ্যে প্রজাবিদ্রোহের উপক্রম হয়েছিল। ঘন ঘন আলোচনা করতে হয়েছে। বোঝাতে হয়েছে, প্রতিবারই বহিরাগত কাউকে বলি দেওয়া সম্ভব নয়।সেক্ষেত্রে, বনদেবীর সন্তানদেরই বলি দিতে হবে, পরবর্তীকালে। এবং রাজা যদি পুরোহিত বংশ থেকেই বলি নির্বাচন করেন, পুরোহিতরা বাধা দিতে পারেন না। কেননা, রাজা সর্বশক্তিমান। পবিত্রতম রক্তে বনদেবীর আরাধনাই বিধেয় নিশ্চয়ই? কেন জানি না, এরপর থেকে সব পুরোহিতই বলির বিপক্ষে মত দিতে থাকেন।
আমরা এগিয়ে চলেছি দণ্ডকারণ্যের দিকে। পাঁচশত সৈন্য সঙ্গে আছে। আমি সারথির হাত থেকে রথের রশি নিয়ে দ্রুত এগোলাম সামনে। সামনে একটা রসাল গাছ। ওপরের দিকে মুখ তুলে, অজিন পরিহিত এক ব্রাহ্মণ কুমার দাঁড়ানো। নিতান্তই শিশু। বোঝাই যাচ্ছে, গাছে চড়তে জানে না। রথ থেকে নেমে কাছে গেলাম।
- ব্রাহ্মণ দেবতা, প্রণাম।
দেবতা গম্ভীরভাবে বললেন,
- জয় হোক।
- অধীন কিছু ফল পেড়ে দিয়ে পুণ্য অর্জন করতে চায়। অনুমতি পাবে কি?
- নিশ্চয়ই বৎস।
বৎস! অর্বাচীনের সাহস দেখ! কিন্তু, আমিই বা এমন চপলতা করছি কেন? শিশুটিকে দেখার আগে পর্যন্ত ভাবিনি, এমন বানরের মতো গাছে চড়ে বসবো! গাছ থেকে ফল নীচে ফেলছি, দেবতা কুড়িয়ে নিচ্ছেন। গাছ থেকে নেমে এলাম। এইবার আত্মপরিচয় দেব। অনেক খেলা হয়েছে। এখনই এই কমলানন ভয়ে শুকিয়ে যাবে।
- ব্রাহ্মণ তুষ্ট। তোমার পরিচয় কী বৎস?
আবার! আবার বলছে! দাঁড়া তো!
- আমি এক দানব ব্রাহ্মণশিশু। নাম বল্বল।
- ধ্যাৎ!
- মানে?
- স্পষ্ট দেখছি মানুষ, বলে দানব! পশুর মতো নখ, দাঁত কিছু নেই, আকাশ ছোঁয়া উচ্চতা নেই, দানব না আরও কিছু!
চূড়ান্ত অবজ্ঞায় আমাকে নস্যাৎ করে, অজিনপূর্ণ রসাল নিয়ে, নগ্ন দেবতা হেঁটে চলেছেন। আমি ব্যদিত মুখে তাঁর প্রস্থানপথের দিকে চেয়ে আছি। পেছন থেকে দৃঢ়সুর হাসি শোনা গেল।
- দানব, রাক্ষস সম্পর্কে যা গল্প ও শুনেছে, কিছুর সঙ্গেই তোর মিল নেই বল্বল। যে আচরণ তারা করে বলে ও জানে, তেমন আচরণও তুই করিসনি। ও ভয় পাবে কেন? রাক্ষস-দানব গাছে চড়ে ফল পেড়ে দিয়েছে বলে আমরা এর আগে শুনিনি।
রথ থেকে নেমে আমার কাঁধে হাত রাখলো।
- তোর সৈন্য নিয়ে আমার সঙ্গী হওয়াটা এখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। এতটা সাহায্য প্রত্যাশা করিনি, সত্যি বলছি।
- নিজের স্বার্থে তোর সঙ্গে যাচ্ছি। তোর পিতাকে আমারও কিছু বলার আছে।
আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম। কিন্তু, পুনরায় থামতে হলো। এবার, দৃঢ়সু থামতে ইশারা করছে।
-ওওওওঁ।
সমবেত কন্ঠে মন্ত্রোচ্চারণের ধ্বনি ভেসে আসছে অল্প দূর থেকে। মনে হচ্ছে কারও আশ্রম। হ্যাঁ, তাই। যজ্ঞ হচ্ছে। অনেকগুলি ধেনু বাঁধা সামনে।
- শতক্রতো, স্তোত্রধেনু যে ক্ষেত্রে যায় মিলন আশে।
তোমার উজল দীপ্তি দিয়ে সে স্থানটিকে পুণ্য করো।।
স্তবসমূহের পূজ্যা প্রাচীন মাতা সেথায় বিরাজ করে।
এবং আছেন সপ্ত কুমার স্বয়ম্প্রভ তাঁহার পাশে।।
ঋক মন্ত্রের একটা মহিমা আছে স্বীকার করতেই হয়। আর্যরা আসার পর তাদের এই শ্রুতির ভাগ যক্ষ-রক্ষ-দানবরাও মাঝে মধ্যে পেয়েছে। তাই, চতুর্বেদ একেবারে অপরিচিত নয় আমার।
- হাম্বাআআআ!
একি! এ কাজ কে করলো? পেছনের বন থেকে একটা বাণ এসে একটি গাভীর গলায় বিঁধেছে। মাটিতে পড়ে ছটফট করছে। আহা! বড় যন্ত্রণা পাচ্ছে। অন্যায়! ঘোরতর অন্যায় এ কাজ। আমি জানি, এই ঋষিরা আমাদের কলঙ্কিত করে। জানি এদের যজ্ঞ, এদের জীবনযাত্রার সঙ্গে যুক্ত বলে, যজ্ঞ নষ্ট করলে এদের শাসকদের কাছে একটা বার্তা পৌঁছয় – অনার্যরা মানছে না তোমাদের আধিপত্য। কিন্তু, এ কার্য অনুচিত। নিরস্ত্র মানুষ আর অবলা প্রাণী বধে কোনও বীরত্ব নেই। থাকতে পারে না। অতএব, বনের আড়াল থেকে গুপ্তঘাতকের মতো সায়ক নিক্ষেপকারী, তোমরা যেই হও, বল্বল ও তার সৈন্যদের না মেরে মুনিদের স্পর্শ করতে পারবে
না।
মুহুর্মুহু ধনুষ্টঙ্কার, বনের ভেতর থেকে হুংকার দিয়ে বেরিয়ে আসা সৈন্যরা একে একে মাটি নিচ্ছে। এবার পিছু হঠছে তারা। আমি ইশারা করলাম। আমার সৈন্যরা ধাওয়া করলো তাদের। সেনানী বীরভদ্র কাকে যেন ধরে আনছে। আমাদেরই বয়সী কে একজন।
-মহারাজ, এই কিশোরই এদের নায়ক মনে হচ্ছে।
-কে তুমি?
-আমি রক্ষশ্রেষ্ঠ সুবাহুর পুত্র প্রহস্ত। এই বনভূমি আমার পিতৃপুরুষের। তোমরা কে?
-আমি দনুজ বংশীয় বল্বল। ইনি আমার সখা ব্রাহ্মণতনয় দৃঢ়সু।
-সখা? দানব-মানবে সখ্য?
প্রশ্নটা এল দুই দিক থেকে। প্রহস্ত ও একজন মুনি একই সঙ্গে একই কথা বলেছেন। আমি প্রহস্তের দিকে তাকালাম।
-পিতৃপুরুষের বনভূমি উদ্ধারের জন্য ক্ষত্রিয়দের সঙ্গে যুদ্ধ করছো না কেন? নিরীহ মুনিদের মারা কবে থেকে বীরপুরুষের কাজ হলো?
সে চুপ করে রইলো। আমি হাসলাম।
-অর্থাৎ, তুমি মেনেই নিচ্ছ, আর্যদের অস্ত্রবিদ্যা উন্নতমানের। অন্তত তোমার, তাদের বিরূদ্ধে জয়লাভের কোনও আশা নেই। তাই, নির্দোষ প্রাণীহত্যা। চমৎকার! একবার শান্ত ভাবে ভেবে দেখ, রক্তপাত থেকে আরও রক্তপাত; হিংসা থেকে আরও হিংসা; এই বিষচক্র ভেদ করার সময় এসেছে কিনা। পারস্পরিক মৈত্রী, আলাপ-আলোচনা, আদান-প্রদানের দ্বারা আমরা উভয় পক্ষই লাভবান হতে পারি কিনা।
মুনির দিকে ফিরলাম। কিন্তু, আমি কিছু বলার আগেই আমার বন্ধু এগিয়ে এলো।
-আমি দৃঢ়সু। মিত্রাবরুণ ও উর্বশীর সন্তান আমার পিতা; বিদর্ভরাজকন্যা আমার মাতা। মুনিবর, দেবরক্ত, রাজরক্ত বইছে এই ধমনীতে। আমি জানতে চাই মানব-দানব সখ্যে আপনার আপত্তি কী?
-ওরা বেদ বিরোধী, কদাচারী, বর্বর, অসভ্য।
-ওদের সভ্যতা সম্বন্ধে কিছুমাত্র না জেনে এ মন্তব্য যিনি করেন, তিনি বিচারমূঢ়। তাছাড়া, বেদবিরোধী তো আপনিও।
-কী?
দৃঢ়সুর এরকম মূর্তি আগে দেখিনি। মুনির চোখে চোখে রেখে স্পষ্ট কন্ঠে সে উচ্চারণ করলো,
-নানান ভাষা, ধর্ম নানান, মানুষ নানান ধারা
বাস্তুভিটা এই পৃথিবী পালেন মাতার পারা।
আমাকে দিন ঝরিয়ে দ্রবিণ হাজারঝোরা ঢল।
স্থির দাঁড়িয়ে লক্ষ্মী গাভীর মতোন অচঞ্চল।।
ঋষি অথর্বার ভূমিসুক্ত মুনিবর। যে ভূমিতে আমরা দাঁড়িয়ে তা আমার, আপনার, আমার বন্ধুর, সবার। বুঝেছেন?
মুনিবর মৌন রইলেন। আমার হাত ধরে রথের দিকে চলল আমার সখা।
দক্ষিণদিকে যত এগোচ্ছি, তত এক অস্ত্রধারী ঋষির কথা কানে আসছে। তিনি অলৌকিক ভাবে শরক্ষেপণ করতে পারেন। তিনি বৃদ্ধবয়সেও তরুণের মতো ক্ষিপ্র। তাঁর নামে থরহরি কম্পমান দানব-যক্ষ-রক্ষ। এই মুহূর্তে তিনি বিন্ধ্যপর্বতের পাদদেশে ক্লান্তি দূর করছেন। শীঘ্রই পর্বত অতিক্রম করে পাড়ি দেবেন সুদূর দক্ষিণে, যেখানে আজও আর্যশক্তি পদার্পণ করেনি। আমরা যেখানে আছি, সেখান বিন্ধ্যপর্বত দশদিনের পথ। এগিয়ে যাওয়া ছাড়া কিছু করার নেই। দৃঢ়সুকে
বললাম,
- বিন্ধ্যপর্বত অতিক্রম করা প্রায় অসম্ভব। বিন্ধ্যাচল গোষ্ঠীর প্রহরীরা রক্ষা করে গিরিবর্ত্ম। তবে, আমি যখন আছি, একটা শেষ চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।
পর্বতের পাদদেশে পৌঁছনোর আগেই কানে এল ধনুকের টংকার, আর ঘোর শঙ্খরব। আর তারপরই সিংহনাদ এবং আর্তনাদ। সামনের লতাজালের আবরণ সরিয়ে উন্মুক্ত ভূমিতে আসা মাত্র এক বিচিত্র দৃশ্য চোখে পড়লো। পর্বতাকায় এক যোদ্ধা ভূমিতে শয়ান এক ঋষির গলায় ভল্ল ঠেকিয়েছেন। ঋষির জানু রক্তে ভেজা। যতদূর চোখ যায় শবদেহ। যোদ্ধাটি বলছেন।
-যতই বাণ মারার কৌশল জানুন না কেন ঠাকুর, এই পাহাড় আপনাকে ডিঙোতে দেওয়া যাবে না। পুরুষের পর পুরুষ আমরা এই পাহাড় পাহারা দিয়ে আসছি। আপনারা এদেশে ঢোকার পর তো পাহারা আরও কড়া হয়েছে। ধরে নিন, এই বিন্ধ্যপাহাড় এত উঁচু যে,সুয্যি ঠাকুরেরও ওপারে যাওয়ার অনুমতি নেই। আপনি তো মানুষ।
ঋষি বলছেন,
-বিন্ধ্যাচল, আমি চাই পাহাড়ের ওদিকে সভ্যতার আলো নিয়ে যেতে। তোমরা অনর্থক বাধা দিলে। এবং তোমার স্বপক্ষীয়দের মরণের কারণ হলে। তোমর ছুঁড়ে আমার জানুদেশ আহত না করলে
তুমিও এতক্ষণ জীবিত থাকতে না।
বিন্ধ্যাচল অট্টহাস করে উঠলেন।
-সভ্যতা? তার মানে আমরা অসভ্য? একটা কথা কেন বুঝছেন না ঠাকুর? যে সভ্যতা অপরকে বোঝার চেষ্টা মাত্র করে না, সামান্য বাধার সামনে পড়লেই নির্বিচারে মানুষ মারে সে সভ্যতা আমরা চাইনে। আর, আমি এতক্ষণ জীবিত আছি বলেই, আপনি আর জীবিত থাকছেন না।
ভল্ল শূন্যে তুললেন তিনি।
-দাঁড়ান!
- কে?
- আমি দনুজ বংশীয় বল্বল। হিরণ্যকশিপুর প্রপৌত্র।
ভল্ল হাত থেকে পড়ে গেল। হাত জোড় করলেন।
-রাজকুমার, আমরা, এই পাহাড়ের রক্ষীরা, মহারাজ হিরণ্যকশিপুকেই রাজা বলে মেনে এসেছি বংশ পরম্পরায়। তাঁর বংশধরও আমাদের রাজা। আজ্ঞা করুন।
- এই ঋষিকে পর্বত পেরিয়ে যেতে দিন।
-সর্বনাশ হয়ে যাবে কুমার! এই ঋষি যমের অবতার! কত নিরীহ মানুষ মারবে তার ঠিক নেই।
- না। মারবেন না।
দৃঢ়সু এগিয়ে এসেছে।
-প্রণাম পিতা। আমি আপনার পুত্র, দৃঢ়সু। বলতে পারেন আপনার হননযজ্ঞের প্রায়শ্চিত্ত করতে বেরিয়েছি। ভেবেছিলাম, সময়ের সঙ্গে আপনার ঘাতক প্রবৃত্তি কিছুটা কমেছে। কিন্তু, এখানে এসে যা দেখছি, তাতে আর কিছু বলার থাকতে পারে না। নায়ক বিন্ধ্যাচল, এই ব্যক্তির সমস্ত অস্ত্র কেড়ে নিয়ে, এই আহত অবস্থাতেই ওঁকে পর্বতের ওদিকে যেতে দিন দয়া করে। তারপর, উনি জীবিত থাকেন কি মৃত, সেটা তাঁর অদৃষ্ট।
আমি বিস্ফারিত চোখে চেয়ে। দৃঢ়সু পুনর্বার অচেনা হয়ে উঠেছে। শ্বাস ফেলে বললাম,
- ওঁর ক্ষতর সুশ্রুষা না করে যেতে দেবেন না।
ঋষির সামনে এসে দাঁড়ালাম।
- প্রণাম। আমি বল্বল। আপনি আমাদের রাজ্য আক্রমণ করে আমার পিতা ইল্বল এবং পিতৃব্য বাতাপিকে হত্যা করেন।
ঋষির চোখভরা ভয়। হাসলাম।
- প্রতিশোধ নিতে আসিনি। আপনি আমার বন্ধুর পিতা। আমি বলতে এসেছি, আপনাকে মার্জনা করলাম। পারলে, আপনিও নিজেকে ক্ষমা করবেন।
ক্ষতস্থানে অনুলেপন দেওয়া শেষ। সমস্ত অস্ত্র রেখে দেওয়া হয়েছে। পা টেনে টেনে গিরিবর্ত্মের দিকে এগচ্ছেন দৃঢ়সুর পিতা।
ঋষি অগস্ত্য।
(ঋণ – গৌরী ধর্মপাল)
প্রণাম জানাই চয়ন বাবু। আপনার লেখার সাথে পরিচয় খুব একটা ছিলনা। কিন্তু তবুও পেতাম বন্ধু, ভাই কর্ণের দেওয়ালে, হেতা হোতা। আজ আমার মুগ্ধ হওয়ার দিন। মন জুড়িয়ে যায় এমন লেখা পড়লে। বহুক্ষণ স্থায়ী হয় এই নেশা। ভালো থাকুন।
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ।
মুছুনএই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনভীষণ ভালো লিখেছ চয়ন। তুমি আমার প্রিয় মানুষ ও লেখক। কেন প্রিয় বারবার লেখা দিয়ে বুঝিয়ে দাও। মুগ্ধতা জানিয়ে গেলাম।
উত্তরমুছুনভালোবাসা নিও যুগান্তরদা!
মুছুন