জয়তী অধিকারী

মায়াজম
2

একাকী তপস্বিনী




হাভক্তি পাঠশালার উঠোনে রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে বসেছিলেন মাতা তপস্বিনী। পেছনদিকেই পাশাপাশি ছোট্ট ঘরগুলোয় পড়ুয়াদের কলকলানি কানে আসছিল আর তিনি নিজেও পৌঁছে যাচ্ছিলেন নিজের ছেলেবেলায়।
সরদার নারায়ণ দেব তাঁর কন্যা সুনন্দাকে পড়াশোনায় যে উৎসাহ জোগাতেন, তার জন্যেই হোক বা সুনন্দার নিজের আগ্রহের কারণে ছোটবেলা থেকেই সংস্কৃত ব্যাকরণ ও সাহিত্যের সাথে সাথে বিভিন্ন শাস্ত্রেও যথেষ্ট জ্ঞান সঞ্চয় করেছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে চলত ঘোড়ায় চড়া আর রণকৌশল শিক্ষা। সম্পর্কে মাসী, ঝাঁসীর রানী লক্ষ্মীবাঈ আর সুনন্দা সমবয়সী ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের ছায়া ঘনিয়েছিল তাঁর জীবনে। অত্যন্ত অল্প বয়সে বিয়ে এবং তার পরেই বিধবা হয়ে বাবার কাছে ফিরে আসেন তিনি।
-“মাতাজী, আমাদের আজ গল্প শোনাবে না?”
বাস্তবে ফিরতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল তাঁর।
-“কতদূর পর্যন্ত বলেছিলাম যেন?”
-“ঐ তো, সুনন্দা মা চন্ডীর পুজো করত। সারাক্ষণ ধর্মের বই পড়ত আর কোন সাংসারিক টান ছিল না”।
-“আর, তারপর যখন তার বাবা মারা গেলেন, সুনন্দাই বাবার কেল্লা সারিয়ে, নতুন ফৌজ মোতায়েন করে নিজের রাজত্বের হাল ধরেছিলেন”।
মুচকি হেসে মাতাজী বলে উঠলেন, “বাহ্‌, এই তো তোমাদের সব মনে আছে”।
-“তারপর বলো না...”

চোখ বুঁজে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাতাজী আবার ফিরে গেলেন সেই সময়ে। তিনি মনে প্রাণে ঘৃণা করতেন ব্রিটিশদের।
-“একদিন ব্রিটিশ সরকার কোন কারণ ছাড়াই সুনন্দাকে জেলে পুরে দিল”।
-“কিন্তু সুনন্দা তো কিছুই করে নি মাতাজী!”
-“না, তা করেনি। কিন্তু ব্রিটিশরা তো সে’সব মানত না। নিজেদের খেয়াল-খুশী মত কাজ করত। কিন্তু সুনন্দার ধার্মিকতা দেখে তারা যখন বুঝল যে এই মেয়ের থেকে তাদের কোন বিপদের সম্ভাবনা নেই, তখন তাকে ছেড়ে দিল”।
-“সুনন্দা আবার তার বাবার রাজ্যে ফিরে গেল?”
-“না। সুনন্দা নৈমিষারণ্যে গিয়ে আশ্রমে তৈরী করে মা চন্ডীর পুজো করতে শুরু করল, সবাইকে ধর্মকথা শোনাত। তখন থেকেই সবাই সুনন্দাকে মাতা তপস্বিনী বলে ডাকতে লাগল। তার আশীর্বাদ নেওয়ার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসত সেই আশ্রমে। এমনকি ব্রিটিশ সেনাদলে থাকা সৈন্যরাও তার কাছে আসত। তাদের সুনন্দা ধর্মের সাথে সাথে দেশভক্তির কথাও শোনাত।”
-“সেনারা গিয়ে বলে দিত না?” পড়ুয়াদের মধ্যে কেউ কেউ ভয় পেয়ে জিজ্ঞাসা করলে মাতাজী হাসতে থাকেন।
-“কয়েকজন সাধু তাদের সাথে মিশে তাদের দুঃখের কথা শুনত, মাতাজীর পরামর্শে তারা সেনাদের বোঝাত যে ব্রিটিশরা ওদের ‘নিগার’ বলে কতটা অপমান করে! আমাদের দেশকে তারা লুট করছে, আবার ঠকাচ্ছেও”।
-“আচ্ছা মাতাজী, সায়েব সেনা আর আমাদের দেশের সেনারা সবকিছু একই পেত?”
-“না তো। সেটাই তো ওদের বোঝানো হত। ব্রিটিশ সেনাদের থেকেও অনেক বেশী সাহসী আর বীর হওয়া স্বত্তেও ব্রিটিশ সেনারা অনেক বেশী টাকাপয়সা পেত, সম্মান পেত। আর আমাদের দেশের সরল বোকা সেনারা ব্রিটিশের হয়ে যুদ্ধ করে নিজের দেশেরই ক্ষতি করে চলেছে”।
-“ওরা বুঝল?”
-“হ্যাঁ, ঠিকমত বোঝালে বুঝবে না কেন? ওদের যখন বোঝানো হল যে ব্রিটিশরা সবাইকে খ্রীস্টান করে দেবে ওরা তখন বিদ্রোহে যোগ দিতে রাজী হল”।  
-“আর এ’সব ওই তপস্বিনী মাতা শিখিয়ে দিয়েছিলেন? তাই না?” তপস্বিনী সামনে পেছনে মাথা নেড়ে মুচকি হাসলেন।
-“তারপর?”
-“তখন ১৮৫৭ সাল। নানাসাহেব, বালাসাহেব, তাঁতিয়া টোপী আর আজিমুল্লা খান গেলেন তপস্বিনীর কাছে, কিভাবে বিদ্রোহ শুরু করা যায় সেই নিয়ে আলোচনা করতে। সেই সময়ে সাধারণ মানুষকে বিদ্রোহ সূচনা দেওয়ার জন্য রুটি পাঠানো হত। আজিমুল্লা খান বললেন লাল পদ্ম দিয়ে বিদ্রোহ সূচিত করা হবে। তাই ব্রিটিশরাও কেউ আগে থেকে বুঝতেই পারে নি”।
-“তারপর?” শ্রোতাদের উত্তেজনা তখন তুঙ্গে।
কিন্তু মাতাজী তাদের বললেন, “বাকীটা আবার আগামীকাল। এখন তোমাদের পড়াশোনা করার সময়”।

সবাই চলে গেলে নিজের ঘরে এসে আহ্নিকে বসলেন তিনি। রাতে শুয়ে শুয়ে আবার ফিরে গেলেন সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে।  শুধুমাত্র তাঁর দ্বারাই প্রভাবিত হয়ে বিভিন্ন গ্রামের মানুষগুলো বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশদের কাছে যে শুধু আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ছিল তা তো নয়। আস্তিণের মধ্যেই যে সাপ লুকিয়ে আছে, সে খবর তো তাঁদের কাছে ছিল না। অসহায়ের মত পরাজয় স্বীকার করার পর তিনি বুঝলেন যে যতদিন ক্ষমতালোভী, খেতাবলোভী রাজারা ব্রিটিশের সাথে আছে, ততদিন বিদ্রোহ করে কোন লাভ হবে না। তবু তো তিনি চেষ্টা করেছিলেন। নেপালের রাজা জংবাহাদুর ব্রিটিশদের বন্ধুস্থানীয় জেনে, নানাসাহেবকে নিয়ে নেপালেও গিয়েছিলেন। সে’দিনটা আজও মনে পড়ে।

-“আসুন মাতাজী। আমার পরম সৌভাগ্য যে আজ আপনি আমার প্রাসাদে পায়ের ধুলো দিয়েছেন”।
-“কিন্তু আমি আপনার কাছে একটা সাহায্যের আশায় এসেছিলাম। আপনি তো বিচক্ষণ। বুঝতেই পারছেন ব্রিটিশরা এভাবে আমাদের দেশের উপর একাধিপত্য কায়েম করলে ভবিষ্যৎ কতটা অনিশ্চিত...”
-“কিন্তু এক্ষেত্রে আমি আপনার কোন কাজে আসতে পারব বলে মনে হয় না। আমি ওনাদের বন্ধুতা স্বীকার করেছি। এখন আমি কিভাবে তাদের বিরুদ্ধে...
আপনি বরং আমার এখানেই পাকাপাকিভাবে থেকে যান মাতাজী। আপনার যাতে কোন অসুবিধা না হয়, সেই সেবাটুকু করার অনুমতি আমাকে দিন”।
-“আপনাকে ধন্যবাদ রাজাবাহাদুর। কিন্তু আমি আপনার অসহায়তা আর বাড়াতে চাই না। আপনি ভাল থাকবেন। আমরা বরং আসি”।

তারপরেই তো দ্বারভাঙা হয়ে কলকাতায় চলে আসেন তিনি। তারপর এই ‘মহাভক্তি পাঠশালা’র জন্ম। আগামীকাল তিনি শোনাবেন কেন লোকমান্য তিলকের পায়ের ধুলো পড়েছিল এই আশ্রমে। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনি যে আজও আশাবাদী!

সেদিন লোকমান্য তিলকের পেছনে পেছনে এসে ঢুকলেন খাদিলকর, ‘কেশরী’ পত্রিকার সহ-সম্পাদক।
প্রণাম বিনিময়ের পর যে আর আসন গ্রহণ করলে খাদিলকর বলতে শুরু করলেন, “মাতাজী, আমরা বড় আশা নিয়ে এসেছি আপনার কাছে”।
তপস্বিনীর মনে পড়ে গেল গতকাল রাত্রেই তিনি ভাবছিলেন এই একই কথা তিনি বলেছিলেন নেপালের রাজাকে।
-“বলুন, আমি কি করতে পারি?”
-“আপনার সাথে নেপালের কমান্ডার সামশের জংয়ের তো খুব ভাল সম্পর্ক। আপনি যদি বলেন উনি নিশ্চয় আমাদের প্রস্তাব বিবেচনা করে দেখতে অরাজী হবেন না”।
-“কিন্তু প্রস্তাবটা কই? সেটা তো আগে জানতে হবে”
একটা ব্লু-প্রিন্ট মাতাজীর সামনে মেলে ধরলেন খাদিলকর।
-“সকলে জানবে এটা একটা টালি তৈরীর কারখানা। সামনে অবশ্য সেটাই প্রস্তুর হবে। কিন্তু আসলে এখানে গোপনে তৈরী হবে অস্ত্র”।
-“অস্ত্র!” অবাক হলেন তপস্বিনী।
-“হ্যাঁ মাতাজী। এখান থেকে খুব সহজেই এই অস্ত্র বাংলার কোণায় কোণায় পৌঁছে দেওয়া যাবে। শুধু আপনি যদি একটু সাহায্য করেন...”

কয়েক মাসের মধ্যে প্রস্তুত হল টালির কারখানা। কয়েকবার অস্ত্র সরবরাহ হওয়ার পর এক সকালে মাতাজীর কাছে খবর এল সবকিছু জানাজানি হয়ে গেছে।
-“মাতাজী, খারাপ খবর আছে” আশ্রমের এক নবীন সন্ন্যাসী মাথা নীচু করে এসে দাঁড়াল।
-“কি খবর শিবেন?”
-“অস্ত্র কারখানার খবর যথাস্থানে পৌঁছে গেছে”
-“সেকী! কি ভাবে এটা সম্ভব হল?” মাতাজী বসে পড়লেন। তার মানে তো আবারও কয়েক হাজার পা পিছিয়ে যাওয়া!
-“কারখানারই কেউ খবর দিয়েছে”
-“উফ্‌! এরা যে কবে নিজেদের ভাল বুঝবে! আর খাদিলকর?”
-“তিনিও ধরা পড়েছিলেন। কিন্তু খবর পাওয়া গেছে তিনি কোনক্রমে পালাতে পেরেছেন। সম্ভবত মহারাষ্ট্রেই চলে গেছেন”।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তপস্বিনী বললেন, “আচ্ছা, তুমি এসো শিবেন। আমাকে একটু ধ্যানে বসতে হবে”।
বয়সের ভারে সামান্য ন্যুব্জতা এলেও আজও তিনি মা চন্ডীর উপসনা থেকে নিজেকে একচুলও সরিয়ে নেন নি। সামনে এখনও অনেক কাজ আছে যে। বঙ্গভঙ্গের কথা কানে এসেছে তার। সর্বশক্তি দিয়ে তার মোকাবিলা যে করতেই হবে! জয় মা চন্ডী...শক্তি দাও মা। সাহস দাও।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন