নওবা বর্ষোমা তমারু স্বয়াগত ছে
আমার প্রায় যাযাবর জীবনের দেরাদুনে দ্বিতীয় দফায় তখন বছর পাঁচেক হয়ে গেছে। একসময় সেই শৈলশহর থেকে আবার ঠিকানা পাল্টাবার সময় এসে গেল।এবার গন্তব্য গুজরাটের বরোদা।তল্পিতল্পা গুটিয়ে সারমেয় পুত্র নিয়ে যাবার তোড়জোড় শুরু করে দিলাম। নতুন একটি জায়গার মানুষদের কৃষ্টি তাদের সংস্কৃতি,নিত্যনৈমিত্তিক আচার ব্যবহারের সাথে পরিচিত হবার আনন্দে এবং সাথে নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলির ওজোনও আরেকটু স্ফীত হবে ভেবে মনেমনে বেশ খুশী হলাম।ইতিপূর্বে জেনেছিলাম গুজরাতিরা নিরানব্বই শতাংশ কৃষ্ণ ভক্ত এবং নিরামিশাষী। সেই সূত্র ধরে রওনা দেবার ঠিক ব্রহ্ম মুহূর্তে বন্ধুরা ভয় দেখাল –এই যে নাচতে নাচতে চলেছ গিয়ে যখন মাছটি পাবে না তখন বুঝবে ঠ্যালা।এই কথায় আমার অতি খুশীর অবস্থা নিমেষে ভিজে কাগজ।রক্তমজ্জায় মাছে ভাতে বাঙালি।মুরগী পাঠা না হলেও চলবে কিন্তু দ্বৈপ্রহরিক ভোজনে মাছ ছাড়া নৈব নৈব চ।কিন্তু কী আর করা।ঐ যে রবীঠাকুর নামে সাদা চুলের দাড়ীওয়ালা বুড়ো কোনকালে লিখে গিয়েছিলেন –‘পতীর পুণ্যে সতীর পূণ্য নহিলে খরচ বাড়ে’।এই আপ্তবাক্য অমান্য করি কী করে।ফলে চলো বরোদা……
যথাসময়ে মে মাসের মাঝামাঝি দিল্লি হয়ে প্রায় রাত ন’টায় ছুলাম বরোদার মাটি।অভ্যাস বড় বিষম বস্তু।পাঁচবছরে ঠান্ডা পাহাড়ি জায়গার নরম হাওয়ায় শরীর যেন কোমললতা।ফুলের ঘায়ে মুর্ছা যায় দেহ তখন ঐ ভয়াবহ গরমে সারাদিনের যাত্রাপথের ক্লান্তিতে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাচি।ক্লান্ত অবসন্ন দেহে ওএনজিসি-র গেস্ট হাউসে পৌঁছে দেখি অনেকগুলো মাথা আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে।তাদের সাথে অফিসিয়াল, আনঅফিসিয়াল লৌকিকতা সেরে ঘড়ির দিকে যখন তাকালাম তখন সময় মধ্যরাত্রি ছুঁইছুঁই।কখন যে চোখের পাতায় ঘুম নেমে এসেছে টের পাইনি।হঠাত করে বিকট এক কর্কশ আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায়।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ভোর পাঁচটা।সাতসকালে কিসের আওয়াজ ভাবতে ভাবতে বিছানা ছেড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই।দেখি গেস্ট হাউস সংলগ্ন সবুজ চাদর বিছানো গলফ মাঠের প্রবেশ পথ জুড়ে রক্ষাকর্তা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক প্রাচীন বট গাছ।সেই বট গাছের নীচে এক ময়ূর তার পেখম বিস্তৃত করে মিলন পিয়াসী হয়ে ডেকে চলেছে প্রেমিকাকে।নিঃসন্দেহে দৃশ্যটি ভারী মনোরম কিন্তু এ কেমন ধারা তার কন্ঠস্বর !অচিরে মোহভঙ্গ।ভাবলাম জাতীয় পাখির এ কী আওয়াজ! এই নাকি কেকা !মজার কথা পরবর্তী সময়ে সারা দিনভর এই আওয়াজে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম যে কোনোসময় এদের ডাক না শুনতে পেলে অবাক হয়ে ভাবতাম ওদের হলটা কী ?এই প্রসঙ্গে বলি রাজস্থান ছাড়া ভারতের অন্য কোনো রাজ্যে মানুষ এবং ময়ূরের সহাবস্থান এমন প্রকটভাবে নজর বন্দী হয়নি।
ভোর চিরে সকাল হল ,শুরু হয়ে গেল আমার বরোদা বাসের জীবনপঞ্জি। দিন মাস পেরিয়ে একসময় এসে গেল কাঙ্ক্ষিত দুর্গা পুজো এবং তার হাত ধরে ‘নবরাত্রি’।এত শুধু চারটি দিন নয়,নয়টি দিনের সমারোহ।এই প্রথম ‘নবরাত্রি’ উৎসব চাক্ষুষ উপলব্ধি করার সাথে সাথে এর সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান আহরণ করলাম।যুগপৎ জানলাম এই নবরাত্রিকে কেন্দ্র করে সাধারণত পশ্চিম ভারতে সারা রাত ব্যাপী যে অসম্ভব জনপ্রিয় ‘গরবা’ ও ‘ডান্ডিয়া’ নাচের প্রচলন আছে তার অর্থ এবং পার্থক্য।দুটি একেবারেই ভিন্ন ঘরানার।এতদিন জানতাম জিলিপিরই আড়াই প্যাঁচ হয় । এবার জানলাম গরবা নাচও আড়াই প্যাঁচের নৃত্যভঙ্গীতে চলে।গুজরাতীদের নবরাত্রি উৎসবে এই নাচের একটি মুখ্য ভূমিকা রয়েছে এবং এই ‘গরবা’ ব্যাতীত তাদের নবরাত্রি উৎসব কল্পনাতীত।অপরদিকে‘ডান্ডিয়া’ মূলত মারাঠী সম্প্রদায়ের নাচ।এটিও নবরাত্রির সময় হয়ে থাকলেও বর্তমানে ‘ডান্ডিয়া’ বছরের যেকোনো সময় যেকোনোও অনুষ্ঠানে দেখা গেলেও ‘গরবা’ নবরাত্রি ছাড়া কখনই দেখা যায় না।কারণ গরবার জন্য বিশেষভাবে নবরাত্রির সাথে সাযুজ্য রেখে ভক্তিমূলক গান গাওয়া হয় এবং সেই গানকে কেন্দ্র করেই গরবা নাচের পরম্পরা।যা অন্য সময় সেই রেশ বয়ে আনতে সক্ষম হয় না।শুধু গরবার বাহার তো নয় গুজরাতীদের পোষাকে যে কত রঙের বাহার বা বৈচিত্র্যময়তায় ভরা তা এই গরবা্র সময় পরখ করা গেল। একে একে এই নবরাত্রি পার করে একসময় এল কালী পুজো বা দিওয়ালী।এই উৎসবের এক সপ্তাহ আগে আমার পরিচিত জনেরা ওয়াকিবহাল করে দিল দিওয়ালীর পর চারদিন দোকানপাট সব বন্ধ থাকবে।কাজেই ঘরে যেনো অন্ততঃ কান্দা,বাটাটা অর্থাৎ আলু পেঁয়াজ মজুত রাখি।অবাক হলাম এত শান্তিপ্রিয় জায়গা ততোধিক শান্তিপ্রিয় মানুষজন যেখানে মাঝরাতেও নির্ভয়ে মহিলারা একা চলাফেরা করতে পারে সেই জায়গায় কোন গন্ডগোলের আভাস বয়ে এল যে পাঁচদিন দোকানপাট সব বন্ধ থাকবে। কোনো রাজনৈতিক,সামাজিক-অসামাজিক দাংগাফ্যাসাদের খবরও কানে এসে পৌঁছায়নি।পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম না,সেইরকম কোনোও ঘটনা নয়।সম্মুখে আগত গুজরাতীদের ‘লা-পচম’ বা ‘লাভ-পচম’ বা ‘লখানি-পচম’ অর্থাৎ‘নববর্ষ’ !নভেম্বর মাসে নববর্ষ! শুনে বেশ নতুনত্ব লাগল।ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যের নানা ভাষাভাষীদের সাধারণত বৈশাখ মাসে নববর্ষের সূচনা হয়।শেখার আরেক পদক্ষেপ এগিয়ে জানলাম গুজরাতী ক্যালেন্ডারে নববর্ষ বৈশাখে নয় শুরু হয় কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের পঞ্চম দিনটি থেকে।এবং প্রথম দিনটি থেকে ক্রমাগত পাঁচটি দিন ধরে চলে তাদের ‘লা-পচম’ বা নববর্ষ উৎসব পালন। যা গুজরাতী সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় প্রধান উৎসব। কেমন এবং কিভাবেই বা উদযাপিত হয় এই পাঁচটা দিন...
লা-পচমের প্রথম দিনটিকে বলা হয় ‘বেস্তুবরস’
গুজরাতী সম্প্রদায় মূলত জীবিকায় ব্যবসায়ী ও আগেই উল্লেখ করেছি দ্বিজ ভক্তিতে তারা কৃষ্ণপ্রেমী।এইদিন তারা নিজেদের ব্যবসার শ্রীবৃদ্ধির মঙ্গল কামনায় গণেশ পুজো ছাড়াও অতি অবশ্যই শ্রীকৃষ্ণের গোবর্ধন রুপটিরও পুজো করে থেকে।সাথে “চোপড়া পূজন”(হালখাতা)-ও সম্পন্ন হয়।পুজোর পর চোপড়ার প্রথম পাতায় সিঁদুর দিয়ে আঁকা হয় একটি স্বস্তিক চিনহ। এই চোপড়া পূজনের পর ব্যবসায়ীরা অতি অবশ্যই চারদিন নিজেদের ব্যবসা বন্ধ রাখে ।কোনো লেনদেন অর্থাৎ ব্যবসায়িক আদানপ্রদান হয় না।
দ্বিতীয় দিন “ভাই দুজো”।আমাদের ভাতৃ দ্বিতীয়ার মতো।তফাৎ কোনো প্রতিপদ বা দ্বিতীয়ার বেড়া থাকে না।
তৃতীয় দিন চোপড়া পূজনের পরবর্তী অংশ।এই পূজাবিধি অনুযায়ী প্রথম ভাগে আদি ব্যবসার সূচনা যার মাধ্যমে বা বর্তমান সময়ে যিনি বাড়ির সর্বপেক্ষা বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষ তার পৌরহিত্যে সমাধা হয় নিজেদের বংশের আরাধ্য দেবতার পুজো।
চতুর্থ দিন চোপড়া পূজনের শেষ অংশ।এই দিনটি নির্দিষ্ট থাকে মূল গৃহকর্তার পরবর্তী বংশধরের জন্য।তার দায়িত্বে সম্পন্ন হয় গৃহে অবস্থিত লক্ষ্মী গনেশের পূজা।
লা-পচমের পঞ্চম দিনটি অর্থাৎ নববর্ষের দিনটিতে পরিবারের ছোটো থেকে বড়,মহিলা থেকে পুরুষ প্রতিটি সদস্য একত্রিত হয়ে ভজন ও আরতির মাধ্যমে গনেশ বন্দনা করে ‘চোপড়া’ বা হালখাতাটির প্রথম পাতায় স্বস্তিক চিনহের নীচটিতে সিঁদুর দিয়ে ‘ঋদ্ধি’ ও ‘সিদ্ধি’ এই দুটি শব্দ লিখে লা-পচম বা নববর্ষ উৎসবটির সমাপ্তি টানে। এখন গুজরাতী সম্প্রদায়ের মানুষেরা শুধু ব্যবসা নয় অনেকেই চাকুরীজীবী।তবে সেই সংখ্যাটি খুবই নগণ্য। সেইসব চাকুরীজীবি মানুষেরা শেষ দিনটি নিজেদের বাড়ির দেওয়ালে বিশেষত রান্নাঘরের দেওয়ালটিতে ‘ঋদ্ধি’ ও ‘সিদ্ধি’ শব্দ দুটি লিখে পাঁচটি দিনের পুজোর সমাপ্তি ঘোষনা করে।অপরদিকে শুরু হয় নতুন আশায় নতুন বছরে অতিথি অভ্যাগত পরিবার প্রিয়জনদের উদ্দেশ্যে বলা –‘নওবা বর্ষোমা তমারু স্বয়াগত ছে’অর্থাৎ নতুন বছরে তোমাকে স্বাগত জানাই।
ষষ্ঠ দিন থেকে আবার শুরু হয়ে যায় চলমান জীবনের ব্যস্ততা। চালু হয় দোকানপাট ,স্কুল কলেজ।সুখ দুওখ লাভ লোকসানের বছরভরের হিসাব নিয়ে এগিয়ে চলে জীবন।আর সাথে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা আরেকটি ‘লা-পচম’-এর জন্য।
সুচিন্তিত মতামত দিন